Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

হৃদয় রহস্যের খোঁজে পার্পল জলফড়িং

Reading Time: 3 minutes

ছোটগল্প মূলত গদ্যধর্মী হলেও কখনো কখনো কবিতাও ছোটগল্প হয়ে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি কে গুণে মানে একটি সার্থক ছোটগল্প বলা যায়। আবার একরাত্রি,পোষ্টমাষ্টারের মত অসংখ্য গল্প আছে গদ্য কবিতার মতো সমৃদ্ধ। বলা যেতেই পারে রোমান্টিক কবিতার সাথে ছোটগল্পের আত্মিক মিল অত্যন্ত নিবিড়। স্মৃতি ভদ্রের গল্প কবিতা সত্তাকে ছুঁয়ে থাকে বললে অতুক্তি হবে না স্মৃতির ঘটনা বর্ণনা অনেকাংশে জীবনানন্দ প্রভাবিত।

২০২০ একুশে গ্রন্থ মেলায় পেন্সিল পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত স্মৃতি ভদ্রের গল্পগ্রন্থ পার্পল জলফড়িং নামটাই কাব্যিক, ভূমিকা পড়তে শুরু করলে মনে হবে উপরের কথাগুলো অযৌক্তিক নয়। বইটিতে মোট গল্প আছে নয়টি।

আধুনিক ছোটগল্প বলতে আমরা যা বুঝি তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ডিকেন্স,গোগল,পো থেকে শুরু করে মোপাসা,চেখভ কিংবা রবীন্দ্রনাথ পযর্ন্ত কিন্তু প্রশ্ন হলো আধুনিক ছোট গল্প আসলে কী? মনে পড়ছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যে ছোটগল্প বইটির কথা সেখানে এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে লিখছেন(যদি স্মরণশক্তি প্রতারণা না করে) ছোটগল্প হচ্ছে প্রতীতিজাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যকাহিনী যার একটি বক্তব্য কোন ঘটনা বা পরিবেশ বা কোন মানসিকতাকে অবলম্বন করে মিলিত সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে। স্মৃতি ভদ্রের গল্পে এই কথার প্রতিধ্বনি দেখা যায়। যেমন-

“সেবারই পোদ্দার বাড়িতে প্রথম দূর্গাপুজা ছিল তাঁর। আগের বছরগুলোর মতোই জমজমাট সে পুজো। ধুপ,ধুনো আর আতপের গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে চলেছিলো সে পরব।আর পরব শেষে দক্ষিণা হিসেবে অনেকগুলো তামার মুদ্রার সাথে এই একটি রুপার মুদ্রাও দেওয়া হয়েছিলো দীনেশ ভাদুরিকে।”(পদ্মপুকুরে রাণী ভিক্টোরিয়া)

পরি ও একজন মালতি দি গল্পের প্রবীণ মমিন সাহেবের অতীত, চন্দনের গন্ধমাখা এক পরির মতো কিশোরীর পরি হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই পাঠকের সামনে এসে হাজির হয় মুক্তিযুদ্ধের আগুন দিনগুলো।মমিন সাহেবের অপরাধবোধ আর জাদুবাস্তবতা এক হয়ে অতীত আর বর্তমানের ঘুর্ণি মিলেমিশে পাঠককে ভাবনার অশেষ খোরাক যোগায় এই গল্প।

কিংবা গোঁসাইবাড়ির বীথিলতা গল্পের পরাগ বা অন্যান্য চরিত্রগুলো পড়তে পড়তে যখন দৃশ্যমান তখন মনে হয় ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রের উদ্ভাস। দেশ,সমাজের প্রেক্ষিতে,ক্ষমতাবানের অনুশাসন থামাতে মানুষ কখনো একা কখনো অনেকে মিলে উঠে দাঁড়াবে। অনন্য এক সংঘাতে। বীথিলতার গচ্ছিত জং ধরা টিনের বাক্সের ভেতর পাওয়া একটি ছোট্ট চিঠি, আর কিছু অমূল্য সম্পদ পাঠককে নিয়ে যায় এক অনবদ্য মানবিক গল্পের ভেতর। দাঙ্গা, দেশভাগের রাজনীতির ভেতরেও বুকের ভেতরের পবিত্র অনুভবের পুরো রেশ মেলে।এই সংঘাতের কারণেই গল্পগুলো এতো জীবন্ত। তাছাড়া গল্পের ভেতর গল্প গুঁজে দেবার কাজটি অত্যন্ত শিল্পনিপুণভাবে নাটকীয় পরিবেশে করেছেন লেখক।

সাম্প্রতিক ছোটগল্পে সমাজ সচেতনতা, রাজনীতি, নিরীক্ষাধর্মিতা লক্ষ করা যায়। এ ছাড়াও ইমপ্রেশনারিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, কাঠামোবাদ, উত্তরকাঠামোবাদও দেখা যায়।নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেট, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন সভ্যতায় প্রবেশ করেছে। তারা ব্লগে লেখে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অংশগ্রহণ করে, মোবাইল সংযোগে সম্পর্কের বিস্তার ঘটায়। তাদের হাতে গল্প হয়ে উঠতে পারে নতুন বৈশ্বিক সামাজিক বিন্যাসের বাস্তবতায়। নতুন বৈশ্বিক-সামাজিক সম্পর্কের পরিসরে তারা উপলব্ধি করছে সমাজ ও রাজনীতির প্রবাহ। স্মৃতি ভদ্রের লেখায় রাজনীতির একটি ফল্গুধারা খুব সচেতনভাবে বয়ে চলেছে।

‘আজ তিনদিন ধরে ফেসবুক অ‌্যাকাউন্ট ডিজ্যাবল হয়ে আছে। ওই জগতটা থেকে দূরে থাকলে অস্থিরতা বাড়ে তিয়াষার। দূর্দশার এই সময়ে ওই একটাই মাধ্যম পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখার। কীইবা করেছিল সে? নিজের মনের কথা, বিশ্বাসের কথা অকপটে লিখেছিলো শুধু।

তবুও মানুষগুলো এভাবে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করছে তাকে। খুব বেশিদিন এভাবে বন্দী থাকতে হবে না তিয়াষাকে। ছেড়ে চলে যাবে এই শহর।’

শেষমেষ তিয়াষা কি এ শহর ছেড়ে বেরোতে পারবে? নীরুই বা কতখানি আগলে রাখতে পারবে তাকে? একের পর এক জিজ্ঞাসা নিয়ে পরিণতির দিকে এগিয়েছে এই অস্থির সময়ের গল্প ‘ডিজ্যাবল লাইফ’।

বিশ্বায়ন ব্যবস্থা ও উত্তরাধুনিক কালের প্রবাহে এসে পরিপার্শ্ব ও মানবসম্পর্কের নতুন রূপ ও প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করা যাচ্ছে। ছোটগল্পের মৃত্যু অত্যাসন্ন কি না তা নিয়েও পাঠকমনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। ইলেকট্রনিক সাহিত্য পরিসরে প্রবেশের ফলে কাগুজে সাহিত্য আর বইয়ের আকারে প্রকাশিত সাহিত্যের আবেদন কতটা টেকসই হবে তা নিয়েও জিজ্ঞাসার শেষ নেই। মানুষ, মানবজীবন, মানবসম্পর্ক যতদিন থাকবে সাহিত্য পরিসর এবং পাঠকদের আগ্রহের বহুমাত্রিক রূপও ততদিন থাকবে এটুকু বলা যায়। পরাজিত গল্পের বনানী কিংবা বিহাস ইসলাম বা জামিল,রানু চৌধুরীদের যাপন ও টানাপোড়েন একটি সিডি কিংবা একটি নাম মিথিলা চৌধুরীতে যখন জেগে ওঠে তখন মনে হয় আশা বেঁধে রাখি আগামীর হাতে ও কলমে।

গল্পের আঙ্গিক, ধরন, কাঠামোগত রূপ ও বিষয়বস্তু পাল্টে যাচ্ছে। ইরাক, আফগানিস্থান, ইসরাইল আর পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসপ্রবণতার দিকে তাকালে গল্পকারদের গল্পও ম্লান হয়ে যায়।‘এবং অপেক্ষা’ ও ‘রাতুলের জুতা’ এই দুটি গল্পেও বর্তমান সময়ের অস্থিরতাকেই সাজিয়েছেন লেখক। হিংস্র থাবার ক্রমবিস্তারের দুঃসহ লজ্জা কিভাবে আমাদের বিবেককে গ্রাস করেছে সে চিত্রও আলোকিত হয়েছে এইসব গল্পে। শ্রেণি-চৈতন্য আর সাম্য চিন্তার প্রতীকী উপস্থাপন করেছেন গল্পকার। গল্প বুননের পদ্ধতি একেবারে নতুন না হলেও বর্ণনারীতি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।তাছাড়া গল্পের শুরুতেই নাটকীয়তা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় গল্পের গভীরে।অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবনের জলছবি হৃদয় রহস্যের খোঁজে পার্পল জলফড়িং এর গল্পকার মানবিক গভীরতায় বুনন করেছেন আশাবাদের একটা আশ্রয়। এভাবেই গল্পকার এবং গল্প পূর্ণ হয়ে উঠেছে পাঠকের বিবেচনায়।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>