Rezauddin stalin

পাঠ প্রতিক্রিয়া: না ফেরা অবাধ্য কবির ক্রুশের দিনগুলি

Reading Time: 3 minutes

বাংলাদেশের কবিতা তখনো শ্লোগানধর্মী স্বর থেকে বের হয়নি যখন বাংলাদেশের কবিতাকাশে বাংলা কবিতার নতুন স্বর নিয়ে এলেন রেজাউদ্দিন স্টালিন। স্টালিনের কবিতার চমক তাঁর কবিতার গদ্য ও নাটকীয়তা এবং অতি অবশ্যই অতিবাস্তবতা, সম্প্রসারিত বাস্তবতা, অনুপস্থিত বাস্তবতার সুচারু ব্যবহার। ক্রুশের দিনগুলো কবিতার বইটি পড়তে পড়তে কবিকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বাংলা কবিতায় প্রতিপার্শ্ব আর সময় কে এমন করে জ্যামিতিক মাত্রায় কেউ ব্যবচ্ছেদ করেনি। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় হাইপার রিয়েলিটি এবং এ্যাবসেন্ট রিয়েলিটির উপস্থিতি দেখে ভাবি, কবি সত্যিই উত্তরাধুনিক চিন্তাকে অনেক দূর নিয়ে গেছে। মানব পরিচয়ের যে সারাৎসার সেখানে প্রবেশ করতে চেয়েছে। তথাকথিত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে মানুষের মৌলিকত্ব বিকাশের বাঁধা কোথায় স্টালিন জানে। একজন মানুষের প্রকৃত যাপন জানে এই জন্যে রেজাউদ্দিন স্টালিন বলতে পারে-

শহরগুলো ঝিমায় স্মরণীয়তায় ঠেঁস দিয়ে

প্রথম দিন মরে যায় ঘটনা

দ্বিতীয় দিন নিয়ম

তৃতীয় দিন কান্না

চতুর্থ দিন বিস্ময়

কবি শ্রমশীল ও আশাবাদী, সে দুঃখকে স্বীকার করে, কিন্তু হতাশ হয় না। এই দৃঢ়তা নান্দনিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার রচনাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। কবিতায় এতো বেশি মিথের ব্যবহার কবি করেছে এক-একটা মিথের পেছনে রয়েছে বড় বড় সব লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি, গল্পগাথা, কল্পকাহিনী, অন্ধবিশ্বাস, ইতিহাস ও রাজরাজরার বিস্ময়কর সত্য-মিথ্যা।

নারীর বুকের মধ্যে বুনে দেয়া হচ্ছে বিজ্ঞাপন

শয়তানের লেজ ধরে ঘুরছে ক্যামেরা

ঘামের সাথে মেশানো হয়েছে আবেহায়াত

পশ্চাৎদেশে দাগানো হচ্ছে নিরাপত্তার মোহর

রেজাউদ্দিন স্টালিন কখনো কখনো যন্ত্রণামুখর ও সুতীব্র –নিঃসঙ্গ স্রষ্টা। এটা তার লেখাকে আত্মবিশ্লেষণে মুড়ে দেয়। একাকিত্ব সুনিশ্চিতভাবে আধুনিক কবির জন্মদাগ। ব্যক্তির বিবেক ও কল্পনায় যে সাম্যচিন্তার পুনর্জন্ম তাকে খাটো করে দেখা চলে না। মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা সমাজতন্ত্রী কবিদের সন্দিগ্ধ করেছে প্রায়শ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহ প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন মানবিক মূল্যবোধে জারিত কবিদের রাজনৈতিক করে তুলেছে বারবার। শহরবাসী শিক্ষিত  কবি-গোষ্ঠীদের একাংশ উত্তরাধুনিকতার নামে লোকজীবনকে উপজীব্য করার যে প্রচেষ্টা নববইয়ের দশক থেকে দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত জারি রেখেছে সেখানেও অস্পৃষ্টতা এবং ক্লান্তিকর অনুবর্তনের ছোঁয়া। রেজাউদ্দিন স্টালিন এই ক্লান্তিকর অবয়ববাদীদের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের জগৎ গড়তে তৎপর। তাঁর পুরাণচিন্তা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাংলা কাব্যভূমিকে উর্বরতা দিয়েছে।

সময়কে ধারণ করেছে অনেক কবিতায়। কোনো কোনো কবিতায় সময়ের খণ্ড চিত্র, আবার কোনো কোনো কবিতায় সময়ের পূর্ণচিত্র ফুটে উঠেছে শৈল্পিক সৌন্দর্যে, পরোক্ষে, ইঙ্গিতে সংকেতে। ফলে সে সব কবিতা সময়ের চালচিত্র হয়েও, সময়োত্তীর্ণ শিল্পীত বয়ান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। কবি তার সময়কে এভাবে ভাষারূপ দিয়েছে :

জাতিগত দাঙ্গায নিহতদের স্মরণসভা

মাত্রা ছাড়ানো বেগে গিটারের কান্না

ভারতবর্ষে শূন্য আবিষ্কারের হাজার বছরপূর্তি

উদ্বোধক আলেকজান্ডার

যিশু উদ্বোধন করছেন অন্ধত্বের লক্ষ বছর

কবি চলমান সময়ের আসল রংকেই ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে তার কবিতার ক্যানভাসে। রোমাণ্টিকতা, দ্রোহ, কল্পনাবিলাস কিংবা স্রোতের উল্টোদিকে যাত্রা না করে কবি বিজ্ঞানমনস্কভাবে তার কাব্যাদর্শের পথে যাত্রা করলে চলমান সময়ের সোসিও-ইকোনমিক কনটেক্সটে। তাই কবিতা লিখতে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলো এমন এক ত্রিমাত্রিক বাস্তবতায়- যার একদিকে নিরন্ন অসহায় মানুষ, অন্যদিকে করপোরেট পুঁজিবাদী বৈশ্বিক শিল্পায়ন। তাইতো কবি স্বীয়সত্তা ও সময়কে আবিষ্কার করে বলতে বাধ্য হল এমন করে বলতে।

আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির ওপর অঘাতে, দেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন যখন এক নিদারুণ ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পতিত তখন স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ্যা হতে বাধ্য আমাদের মেধা ও মনন।সমকালীন তথাকথিত রাজনৈতিক সচেতন কবিরা যখন শ্লোগান সর্বস্ব কবিতা লিখে পাঠকদের মন কেড়ে নেয়ায় ব্যস্ত, তখন রেজাউদ্দিন স্টালিন আমাদের নতুনদের জেগে ওঠাকে চিহ্নিত করে একজন দার্শনিকের প্রজ্ঞায়-

নাগরিক পঞ্জির নারীদের গর্ভে প্রতিবাদ

কোনো নিবন্ধন নষ্ট করতে পারেনি মাতৃত্ব

কোনো পরিচয়পত্র বলতে পারেনি জন্মদাগ

প্রযুক্তি মানুষের ভর মাপতে ভুল করছে বার বার

 

ক্রুশের দিনগুলো দীর্ঘ কবিতাটির ইংরেজি ভাষান্তর করেছে কুশল ভৌমিক। কুশল নিজে কবি তাই ইংরেজি ভাষান্তর আরো কাব্যিক হতেই পারতো। ভাষান্তর পড়তে গিয়ে কাব্যিকতা খুঁজে পাইনি। বাংলা প্রকাশনা জগতে সম্পাদনা পর্ষদ গড়ে ওঠেনি এটা আমাদের ব্যর্থতা। তারই ফলে এই বইটির শব্দ বিন্যাস ও মেকআপ ও গেটআপ আমার ভালো লাগেনি। অনেক বেশি হিজিবিজি মনে হয়েছে। কাগজ ও ছাপার মান আরো ভালো হতে পারতো। মোস্তাফিজ কারিগরের প্রচ্ছদটি কবির শ্রমশীল ও আশাবাদী,  দুঃখকে স্বীকার করে, কিন্তু হতাশ না হবার  স্বর ও ভাবনাকে সমর্থন করেনি । পাতায় পাতায় ব্যবহৃত স্কেচগুলো ব্রাশের না হয়ে লাইনের হলে ভালো লাগতো মনে হয়।   

 

 

 

কাব্যগ্রন্থ

ক্রুশের দিনগুলো

রেজাউদ্দিন স্টালিন

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ: মোস্তাফিজ কারিগর

শিকড় প্রকাশনী

মূল্য: ২০০ টাকা

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>