| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সিনেমা

ঋতুপর্ণর একার লড়াই যে লড়াইয়ের পরে আলো আসে

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ওর ওপর তুমি রাগ কোরো না মা, সবাই তো তোমার মতো হয় না। হয়তো আমরা ওকে ঠিকমতো তৈরি করতে পারিনি।— রোমিতা সম্পর্কে ঝিনুককে বলছিলেন রোমিতার বাবা, ঝিনুক তখন বিধ্বস্ত, আদালতে তার সাক্ষ্য বিফলে গিয়েছে, টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে রোমিতার ওপর শারীরিক আক্রমণকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, এ ব্যাপারে রোমিতা একেবারেই মুখ খোলেনি। আদালত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ঝিনুককে এই কথাগুলি বলবেন বলেই অপেক্ষা করছিলেন রোমিতার বাবা। তাঁর কথায় ক্রমাগতই উঠে আসছিল…রোমিতার এমন আচরণের কারণ হিসেবে তার শ্বশুরবাড়ির নিষেধাজ্ঞা বা বিয়ে বজায় রাখার প্রসঙ্গগুলি। মেয়ের ভবিষ্যতের নিরাপত্তাজনিত একটা ভয় সক্রিয় ছিল তাঁর গলার স্বরে।

‘দহন’-এর এই মেয়েটি, রোমিতা, যে প্রায় ট্রমা-য় আচ্ছন্ন ছিল সারা ছবিতে, শুধু তার গোপন অনুভূতিগুলি প্রকাশ করত চিঠিতে, (তেমনই কয়েকটি চিঠিতে গাঁথা গোটা ছবিটা), শেষ চিঠিতে সে এই ভয়টার কথাই উল্লেখ করেছিল, লিখেছিল ‘কত ভয় আমাদের!’ প্রায় একই রকম কথা বলেছিল ঝিনুক, ‘আমার খুব ভয় করছে ঠাম্মি।’ ছবির শেষে এসে। অথচ সারা ছবিতে একা-একা কী লড়াইটা না সে করেছিল! তার ভয় তার প্রেমিকের অসঙ্গত আচরণ নিয়ে, তার আসন্ন বিয়ে বা সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে।

ঠাম্মি, ঝিনুকের বিধবা ঠাম্মি, যিনি রীতিমতো সুস্থ এবং সক্ষম, কিন্তু একা থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে, কারওর সাহায্য না নিয়েই, যিনি ঝিনুকের লড়াইয়ে উচ্ছ্বসিত না হয়ে বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে কম কী আর করত, ওর যা করার ও তাই তো করেছে, এতে বাহাদুরির কী আছে? চোখের সামনে অন্যায় দেখে মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক, মেরুদণ্ড না থাকাটাই স্বাভাবিক, না কি অন্যায় হওয়াটাই স্বাভাবিক?’ তিনিই বোঝাতে থাকেন তখন ঝিনুককে: তুই কাউকে দেখেছিস যে ঠিক তোর মনের মতন? তোর ঠাকুর্দা চাননি আমি বিএ পাশ করি, যদি আমি ওঁর সমান সমান হয়ে যাই!…জোর করে ক্ষমা করতে হয়নি তাঁকে, নাইতে খেতে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেল, প্রথমটায় রাগ হয়েছিল, পরে আর রাগটা থাকেনি, তার জন্য জোর করতেও হয়নি।…অমনিবাসের মতো আমাদের জীবন, রাগ দুঃখ ভালবাসা সুখ হাসি কান্না আনন্দ প্রবঞ্চনা শঠতা— কোনও কিছুই আলাদা করা যায় না। আলাদা করে মুহূর্ত বলে কিছু নেই।

সেই একাকী প্রবীণার মুখ থেকে সধবা জীবনে একা-র অস্তিত্ব যে কতখানি অসম্ভব তা শুনতে-শুনতে বলেই ফেলে ঝিনুক, ‘একা চলাফেরার অভ্যেসটা একটু থাক না ঠাম্মি, মোটরবাইকও তো মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে যেতে পারে।’ অফিস-ফেরত মোটরবাইকে ঝিনুককে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার প্রেমিকের। অপেক্ষা না করে ঝিনুক একাই বেরিয়ে পড়ে।

রোমিতাও ছবির শেষে বিদেশে একা-একা পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়, চিঠিতে লেখে ‘আমরা সবাই বড় একা। একা চলার আনন্দটুকু পেতে চাই এবার, একা চলার ভয়টাই এতদিন শুধু পেয়েছি।’ সে সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিল তার বড় জা-কে, রাজি হননি তিনি, নিজের একাকিত্বকে লুকিয়ে রেখে বলেছিলেন, ‘দু’দিনের স্বাধীনতায় লাভ কী, আবার তো এসে এই হেঁশেলে, তার চেয়ে মানিয়ে যখন নিয়েছি…’

আসলে দু’দশক আগে, নব্বইয়ের দশকের মধ্যপর্বে নিজের এই তৃতীয় ছবিটিতে, একা হয়ে যাওয়ার বিপন্নতার সঙ্গে সঙ্গে তা পেরিয়ে একা বেঁচে থাকার কথাও বলেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। বরাবর ছবিটিকে মেয়েদের সামাজিক বিপর্যয়ের ছবি হিসেবেই দেখা হয়, সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তার তলায় বাঁচার আরও কোনও অভিপ্রায় বা আকাঙ্ক্ষাও হয়তো কবুল করতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। আজ তাঁর মৃত্যুদিনে সে কথাটাই বেশি করে মনে হচ্ছে।

সমাজ-সভ্যতা নিরপেক্ষ ভাবেই ব্যক্তির একটা দায় থাকে ব্যক্তি হয়ে-ওঠার, সে নিজেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে-দায় কাঁধে তুলে নেয়। বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও আত্মপ্রতিরোধের ভিতর দিয়ে তার অভিপ্রায়ের দিকে সে এগিয়ে চলে। ভুল হোক, ঠিক হোক, যত তুচ্ছ বা সামান্যই হোক, ব্যক্তি তার লড়াইটা জারি রাখে। মুশকিল হল, আমাদের সত্তর-পেরনো স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই তো সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত পরিচয়টাকে একমাত্র আত্মপরিচয় ঠাউরেছি আমরা। দীর্ঘ পরাধীনতা আমাদের আত্মপরিচয় অর্জনের প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে ফেলেছে, স্বাধীনতার জন্য সমষ্টির জাগরণ এতটাই বড় হয়ে উঠেছিল যে, ব্যক্তি হয়ে-ওঠার চেষ্টা সে ভাবে করিনি আমরা। নাগরিক বলে দাবি করি বটে নিজেকে, ব্যক্তি হয়ে-ওঠার মতো, ব্যক্তি-কে বোঝার মতো নাগরিক-মনটাই নেই আমাদের।

তামাম মূলস্রোতের ভারতীয় ছবিতে তারই প্রতিফলন। ব্যক্তির ভিতর যে রহস্যময় মানুষটা বাস করে, তার মনের মধ্যে যে খাড়াই-উতরাই লড়াই, তা প্রায় কখনওই ধরা পড়ে না আমাদের ছবিতে। যে ব্যক্তিকে নিয়ত দেখি ফিল্মে, একটা গড় চেহারা ফুটে ওঠে তার মধ্যে। সিনেমার সেই গড় চেহারার মানুষটির জীবনে কোনও ব্যক্তিগত সংকটই তাকে ব্যক্তিগত ভাবে তত বিপন্ন করে না, যাতে বেদনায়-বিষাদে সে এক জন স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে ওঠে।

নির্বোধ অসংবেদনশীল সমাজ নিশ্চয়ই, আমাদের ওপর সেই প্রথাগত সমাজ ভায়োলেন্স নামিয়ে আনছে তা-ও ঠিক, কিন্তু প্রান্তিক মানুষটিও যদি এটা ভেবে বসে থাকে যে, কেউ তাকে হাত ধরে পার করে দেবে, বা অপরের সহানুভূতির প্রত্যাশায় সে যদি বসে থাকে, তা হলে সেই জীবনের অধিকারীই সে নয়। কেউই আহা-বেচারি নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলার কিছু নেই, নিজের পথ-চলার পথ নিজেকেই ঠিক করতে হবে।…এ সব কথা একাধিক টেলিভিশন-সাক্ষাত্কারে বলতেন তখন ঋতুপর্ণ, অকালে চলে যাওয়ার আগে, সালটা সম্ভবত ২০১২।

বলেছিলেন: রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসময়ে প্রান্তিক ছিলেন। তাঁর পেলবতা বা লালিত্য তাঁকে ব্রাত্য করে দিয়েছিল, লম্বা চুল আর মোলায়েম গলা বিচ্ছিন্ন করেছিল সমবয়সিদের থেকে, শুধু বদ্ধ ঘরই নয়, স্কুলের কিংবা কলেজের সহপাঠীদের কুরুচিকর অশোভন ব্যবহারেও আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরত যাননি তিনি। ‘‘কিন্তু নিজের ‘মার্জিনালাইজেশন’টাকে তুচ্ছ করার শক্তি ছিল তাঁর অপরিসীম। তা থেকে আমরা যদি একটু একটু করেও নিয়ে নিই, আমি তো বারবার করে নিয়েছি, বারবার করে তাঁর প্রেরণা পেয়েছি। আমার সৌভাগ্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেই স্পেসটা তৈরি করে নিতে পেরেছি।’’

বিভিন্ন সঙ্গে-অনুষঙ্গে নিঃসঙ্গ হতে-হতে, অপমান পেতে-পেতে, সর্বোপরি সামাজিক প্রবঞ্চনার পর প্রতিটি মানুষের কাছেই তাই রবীন্দ্রনাথ থেকে যান, মনে করতেন ঋতুপর্ণ, বলেছেন, এখান থেকেই হয়তো একটা লড়াই শুরু করা যায়, সেই লড়াইয়ের পর কোথাও একটা আলো আসে…

‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে/আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে।’…গানটা অত্যন্ত প্রিয় ছিল ঋতুপর্ণের।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত