| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী(পর্ব-৩০)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ৩০পর্ব।


কণ্ব তো ফিরে এলেন আশ্রমে। জানতে পারলেন সব কিছুই। কিন্তু একটুও রাগলেন না। বরং খুশিই হলেন। এমন সুযোগ্য পাত্র বলে কথা!” 
এবার শুনুন, তিন বছর হয়ে গেল। শকুন্তলা মা হলেন আশ্রমেই। কণ্বমুনি স্বয়ং সেই শিশুর জাতকর্ম পালন করলেন। শিশুর দাঁত দেখা দিল, কান্তিমান বালকে পরিণত হল, ছয় বছর বয়স হল। এই বয়সেই যেমন গায়ে জোর, তেমন ভয়ডর বলে কিছু নেই। বাঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়য়, সিংহের সঙ্গে খেলা করে। আশ্রমবাসীরা তার বিক্রম দেখে আদর করে নাম দিলেন সর্বদমন, অস্ত্বয়ং সর্ব্বদমনঃ সর্বং হি দময়ত্যম্, যে সকল পশুকেই দমন করে( ৮৮তম অধ্যায়, খণ্ড দুই, শ্লোক ৮ পৃঃ১০১৪) । সেই শক্তিশালী বালকের ব্যাপার স্যাপার দেখে কণ্বমুনি বুঝলেন এবার একে যুবরাজ করার সময় এগিয়ে আসছে। এবার একে বাবার কাছে পাঠানো দরকার। সব শিক্ষা তো আর এই আশ্রমে হবে না! তখন কয়েকজন শিষ্যের সঙ্গে সপুত্র শকুন্তলাকে পাঠিয়ে দিলেন রাজা দুষ্মন্তের কাছে।
রাজার প্রহরীরা সব শুনে শকুন্তলাকে ঢুকতে দিলেন। কণ্বমুনির শিষ্যরা ওখান থেকেই ফিরে গেলেন আশ্রমে। খারাপ কিছু হতে পারে, তা তো ওঁরা ভাবতেই পারেন নি! 
তাহলে অবস্থাটা কী! শকুন্তলা, সাত আট বছর পর স্বামীর মুখোমুখি, একেবারে রাজসভায়, যে বিয়ের কতনো সাক্ষী নেই, যে শকুন্তলা এই প্রথম কোনো নগরে এলেন, সঙ্গে সঙ্গী শুধু বালকপুত্রটি! 
আর নিজের কথাটি বলামাত্র সবার সামনে সেই পুরুষটি কি বললেন! “
আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না! কস্য ত্বং দুষ্টতাপসি! তুমি কে হে, দুষ্ট  তাপসি!! (১৯, প্রাগুক্ত)
তোমার সঙ্গে কখনো কিছুই তো ঘটে নি আমার! কী আজেবাজে বলছ! তুমি এবার যা খুশি কর, তোমার ব্যাপার! আমাকে বলার কী আছে”!!
প্রথমে তো লজ্জায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শকুন্তলা। লোকটা বলে কী!!! তারপরে রাগে, ক্ষোভে তাঁর ঠোঁট কাঁপতে লাগল, চোখ লালচে আভা দেখা দিল। একেবারে যোগ্য উত্তর দিলেন সেই মেয়ে! ভাবলে রোমাঞ্চিত হতে হয়! “জানন্নপি মহারাজ! কস্মাদেবং প্রভাষসে।ন জানামীতি নিঃশঙ্কং যথান্যঃ প্রাকৃতো জনঃ।।(২৫, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০১৮) সব জেনেও না জানার ভান করছেন কেন, ছোটলোকের মতো”! হ্যাঁ, প্রাকৃত জন মানে তাই। ভরা সভায় রাজাকে বলছেন এক মেয়ে, এইমাত্র যার সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন রাজা! আরো বললেন, “মানুষ জনহীন স্থানে পাপ করে ভাবে, কেউ দেখল না! কিন্তু দেবতারা দেখেন, সবচেয়ে বড় কথা সে নিজে তো দেখে! তার মানে আপনি তো নিজে নিজেকেই অস্বীকার করছেন! এতে আপনার মঙ্গল হবে না কিন্তু! আমি নিজে এসেছি বলে আমাকে, নিজের স্ত্রীকে অবজ্ঞা করছেন! সভার মাঝখানে এই ভাবে অপমান করছেন”!!! 
এরপরে যা কথাটা , তা আবার পুরোটা তুলে দিতে ইচ্ছে করছে। বললেন, 
“অর্ধ্বং ভার্য্যা মনুষ্যস্য ভার্য্যা শ্রেষ্ঠতমা সখা। ভার্য্যাং মূলং ত্রিবর্গস্য ভার্য্যা মূলং তরিষ্যতঃ।। (৪১শ্লোক, প্রাগুক্ত,  পৃঃ ১০২২) অর্থাৎ স্ত্রী পুরুষের অর্ধেক, সবচেয়ে ভালো বন্ধু, ধর্ম অর্থ কামের প্রধান কারণ এবং উদ্ধার পাওয়ারও প্রধান মাধ্যম” ।
 স্পষ্ট জানালেন, “মনে রাখবেন, যাঁর স্ত্রী আছে, তিনিই যজ্ঞ করার অধিকারী (মনে করুন, সীতা না থাকায় রামকে সোনার সীতা তৈরি করাতে হয়েছিল, যজ্ঞ করার আগে), তাঁরাই গৃহস্থ, তাঁরাই সব জায়গায় শোভা পান। মনে রাখবেন মধুরভাষিণী স্ত্রী বন্ধুর মত, ধর্মের কাজে পিতার মত আর রোগে-ভোগে মায়ের মত। রতি প্রীতি ও ধর্ম এ সবকিছুই পত্নীর অধীন। আর এসব ছাড়াও সন্তান যখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে, তার চেয়ে বেশি সুখ কি আছে সংসারে? পিঁপড়ে পর্যন্ত নিজের ডিমকে রক্ষা করে, পালন করে, আর আপনি তাতে অসম্মত হচ্ছেন”? 
এইভাবে কত কী যে বললেন শকুন্তলা! কী দৃপ্ত বচন! কী দার্ঢ্য ভঙ্গিমা! কী তেজ! কী জ্ঞানের মহিমা! তর্ক করছেন, কথা শোনাচ্ছে, কিন্তু যুক্তিতে থেকে। কিন্তু দুষ্মন্ত তো জেগে ঘুমিয়ে থাকা লোক। সুতরাং তিনি মানলেন না, বরং আক্রমণ আরো তীব্র করলেন! বললেন, “তোমার মা বেশ্যা, তুমিও তেমন কথাই বলছ! এই ছেলে এত তাড়াতাড়ি এত বড় হলোই বা কি করে! সবটাই তোমার বেশ্যাসুলভ কথাবার্তা! তুমি যাও এখান থেকে”!
সভার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই কথা শুনতে হল শকুন্তলাকে। আজন্ম তপোবনে লালিতা পারে তা শকুন্তলাকে! যে মিথ্যাচার কী, তাই জানে না! বস্ত্রহরণের চেয়ে কম কী! এমন অপমান! এতেও দমলেন না সেই আগুনপানা মেয়ে! নিজের হক বুঝে নিতে হবে, বুঝেছেন! বুঝেছেন ওই কয়েক বছর আগের প্রেমপূর্ণ বুলি ছিল নেহাতই ফাঁকা আওয়াজ, কামের নিবৃত্ত ঘটানোই ছিল উদ্দেশ্য। তিনি বললেন, “সর্ষপমাত্রাণি পরচ্ছিদ্রাণি পশ্যসি! আত্মনো বিল্বমাত্রাণি পশ্যন্ ন অপি ন পশ্যসি!! (৮২শ্লোক, প্রাগুক্ত,  পৃঃ  ১০৩১) কী দারুণ কথা! আমার সর্ষের মত দোষ আপনার চোখে ধরা পড়ছে আর নিজের নিজের বেলের মত বড় দোষটাকে দেখেও দেখছেন না! চালুনি বলে ছুঁচকে ফুটো!! বিতান্ত সেই! তাও শকুন্তলার সর্ষে প্রমাণ দোষ কিছু থাকলেও, তা তার বাবা মায়ের। মা না হয় ছেড়ে গেলেন, বাবাও তো রাখলেন না! শকুন্তলা কি করবেন সেক্ষেত্রে!!
খুব বিনীত ভাবেই জানালেন, “কুরূপ কেউ নিজেকে ততক্ষণই সুন্দর ভাবে, যতক্ষণ না নিজেকে আয়নায় দেখে! অর্থাৎ আপনার তো সব তোষামুদে লোকেজনে ঘেরা, আপনি যে অন্যায়টি করছেন, তা কেউ বলবে না। আমি আপনার সেই আয়না! দেখুন তাতে, আপনার মনের চেহারাটি কী বিশ্রী! সবচেয়ে মজা কি জানেন, খারাপ লোক যখন ভালো মানুষের নিন্দা করে! আপনি যখন বিশ্বাস করছেন না, আমি চললাম”। এই বলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বললেন, “এ আমারও পুত্র দুষ্মন্ত! এ তোমার একার নয়! তোমার সঙ্গে থাকা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। আমার ছেলেকে আমি এমন করে বড় করে তুলব যে একদিন এই ছেলে পৃথিবী শাসন করবে”! 
দেবীসূক্ত মনে পড়ে গেল পড়তে পড়তে । এই অহম্,  যে আমিই পারব, একাই পারব, আর এমনভাবে পারব যে সবাই মেনে নেবে আমার ক্ষমতা! 
শকুন্তলা চলে যাওয়ার পর আকাশবাণী হল, “এ তোমারই ছেলে। শকুন্তলাকে অবজ্ঞা কোরো না। ছেলের নাম ভরত রাখো। তোমার মঙ্গল হবে”।
দুষ্মন্ত যখন সব দিক থেকে কোনঠাসা হয়ে পড়ল, তখন হেঁ হেঁ করে বলল, “আসলে শকুন্তলা এসে বললেই যদি আমি মেনে নিতাম, লোকে যদি খারাপ ভাবত বা ভুল ভাবত”!
তারপর শকুন্তলাকে “দেবি” “প্রিয়তমে” “বিশালনয়নে” “কল্যাণি” এইসব সম্বোধন করে তাঁকে মানালেন আর ফিরিয়ে আনলেন।
 এই তেজোদীপ্ত মেয়েটিকে কালিদাস বানিয়ে দিলেন অশ্রুভরা অসহায় একটি মেয়ে! যে তার দয়িতকে ভাবতে ভাবতে কর্তব্য ভুলে যায়, অভিশপ্ত হয়; জানতেও পারে না। সখীরা চুপি চুপি তার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় আদায় করে। আর দুষ্মন্ত! এক বিদূষকের তীক্ষ্ম বচনগুলির তীর ছাড়া কবি তাকে মহিমান্বিত করে তোলেন! কী করবেন বেচারা রাজা! দুর্বাসার অভিশাপ না হলে ভুলতেন নাকি! 
তবে আবার এও হতে পারে, দুষ্মন্তের অসভ্যতা এমন, যে তার দোষস্খালনের জন্য অভিশাপের আড়ালটি না রাখলে এই কাব্যটি হয়ত সমাদরই পেত না! ঝুঁকি নিতে চাননি। আর এমন মধুর কাব্যটি রচনা করেছেন, যে মানুষ মূল কাহিনীটিই ভুলে গেছে! আর নায়িকারা ঝাঁঝালো হলে তো তথাকথিত আধুনিক যুবারাও পছন্দ করেন কই! নতমুখী, যখন তখন চোখের জল আনা, কোমলাঙ্গী মেয়েই তো চায় সব দেখি! গর্জে ওঠা জেদী তেজী মেয়ে কঠিনাঙ্গী  তো এখনকার বাজারেও অচল! 
মহাভারতের শকুন্তলাকে যে বহু যুগ ধরেই আর বিশেষ দেখতে পাই না!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত