| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী(পর্ব-৩২)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ৩২পর্ব।


নল-দময়ন্তীর প্রেম-কাহিনীর মধ্যে একটু টুক করে অর্জুনের গল্পটা সেরে নি? যদিও এই গল্পের সঙ্গে লেজুড় আরো একটা দুর্ধর্ষ প্রেমের গল্প আছে। আগে সেইটে শুনতে হবে। দেখুন, মহাভারত এমনি এমনি মহাকাব্য হয় নি। এ একেবারে পেঁয়াজ বা লাচ্চা পরোটা বা অমৃতি। পাকের পরে পাক, প্যাঁচের পরে প্যাঁচ। রাবড়ি বানানো জানেন? দুধ ফুটিয়ে ফুটিয়ে সরের পরতগুলি কড়ার গায়ে  সাজিয়ে সাজিয়ে বিপুল পরিশ্রম আর মনোনিবেশ করে তবে রাবড়ি বানানো হয়। যখন সেটি আপনার মুখে পড়বে আর আপনি মিলিয়ে যাবে আর এই দুনিয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন আপনি, তখন কি তার পেছনের শ্রমটা খেয়াল থাকে? মহাভারতের রচনাকার সেইরকম দক্ষ, মহাভারতের ঘন টাটকা কাহিনীগুলিকে পাক দিয়ে দিয়ে  রাবড়ি বানিয়ে দিয়েছেন একেবারে।
 চলুন। নল যেমন বোকার মত রাজি হল, দেবতাদের কু প্রস্তাবে, বেশ একটু টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করুন। আমরা খানিক পেছনপানে হাঁটি। ফ্ল্যাশব্যাক যাকে বলে।
 আক্ষরিক অর্থেই Miss Universe উর্বশী, তাঁর জন্ম কথা রহস্যময়। একাধিক গল্প আছে এই নিয়ে। যেমন নারায়ণের উরুভেদ করে জন্মেছিলেন বলে উর্বশী, উরু অর্থাৎ মহাপুরুষকে যিনি বশ করতে পারেন, তিনি উর্বশী। বিষ্ণুপুরাণে সমুদ্র মন্থন করে যে অপ্সরাদের পাওয়া গেছিল, তার মধ্যে উর্বশীও ছিলেন। এছাড়াও আরো। ঋক্ ও অথর্ব বেদ থেকে শুরু করে শতপথ ব্রাহ্মণ, হরি বংশ, বিষ্ণু পুরাণ, পদ্মপুরাণ, ভাগবত, মহাভারতে তো বটেই; ঐতিহ্য সব মহা মহা গ্রন্থে উর্বশীর কথা আছে (পৌরাণিক অভিধান, অমল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃঃ ১৮০)।
 মর্ত্যের এক রাজা এসেছেন ইন্দ্রের সভায়। তখন অমন রাজারা ডাক পেতেন। এমনকী যুদ্ধের জন্যেও ডাক দেওয়া হত। কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলমেও দুষ্মন্তকে ইন্দ্র এমন যুদ্ধের জন্য ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন।
 তো সেই সভায় তখন উর্বশী নাচছেন। তাঁর রূপ দেখে তো পুরুরবা হাঁ। এবার নাচের সময় অমন ড্যাবড্যাব করে কেউ যদি তাকিয়ে থাকে, একটু অন্যমনস্ক হয়ে যেতেই পারে নর্তকী। উর্বশীরও তাল কাটল। কথা নেই, বার্তা নেই, ইন্দ্র অভিশাপ দিয়ে বসলেন যে উর্বশীকে পৃথিবীতে যেতে হবে। কারুর সর্বনাশ তো কারুর পৌষমাস; প্রবাদটা তো এমনি এমনি গড়ে ওঠে নি! উর্বশীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল আর পুরুরবা দেখলেন, এ তো স্বপ্ন সত্যি হল। তিনি উর্বশীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। উর্বশী রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু তিনটি শর্তসাপেক্ষে ।
প্রথম শর্তটা বেশ অদ্ভুত। পুরুরবা দিনে তিনবারের বেশি উর্বশীকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন না। Pretty Woman  দেখেছেন? জুলিয়া রবার্টস একজন গণিকা যাকে রিচার্ড গ্যেরে, বিশাল ধনী এক শিল্পপতি, নিঃসঙ্গ, ভাড়া করে। সেখানে সেই গণিকা বলে, সে সব করতে রাজি আছে, কিন্তু ঠোঁটে চুম্বন করবে না! পরে যখন সে ভদ্রলোককে সত্যি ভালো বেসে ফেলে, তখন এক রাতে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটির ঠোঁটে চুম্বন করে। আসলে অধরে অধর এসে মেলে যখন, হয়ত একটা বিশেষ emotional attachment তৈরি হয়ে যায়, যা হলে গণিকা পেশায় সমস্যা হতে পারে। আলিঙ্গনও কিন্তু এমনি একটা দৈহিক মুদ্রা, যা শুধু কাম জাগায় না সব সময়। একটা স্নেহমাখা, ভরসামাখা অন্যরকম আদর এই জড়িয়ে ধরা। হয়ত তাই স্বর্গের এই অপ্সরা চাননি পৃথিবীর এক রাজার সঙ্গে তেমন চূড়ান্ত আবেগের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে।
তাই প্রথমেই এমন একটা শর্ত রাখলেন। দ্বিতীয় শর্ত, উর্বশীর ইচ্ছে না হলে পুরুরবা সঙ্গম করতে পারবেন না। এটা না হয় বোঝা গেল। তৃতীয় শর্তটাও একটু অদ্ভুত। সঙ্গমের সময় ছাড়া অন্য কোনো সময় রাজাকে নগ্ন দেখলে সেই মুহূর্তে উর্বশী রাজাকে ছেড়ে চলে যাবেন। সেই গঙ্গা-শান্তনুর শর্ত মনে করুন। 
এবার পুরুরবা তো সবেতেই রাজি। এমন সব আশ্চর্য শর্ত মেনে বেশ কয়েক বছর ধরে সুখে কাটালেন। এদিকে স্বর্গ তো উর্বশী বিহনে ঝিমিয়ে পড়েছে। তখন ছেলে অপ্সরারা এগিয়ে এল। ছেলে অপ্সরা আবার কি জিজ্ঞাসা করছেন তো? গন্ধর্বদের বলছি আসলে। তাঁরাও তো গান বাজনা নাচ অভিনয়, এসব নিয়েই থাকতেন। তাঁদের বিশেষ রকম সুন্দর দেখতেও হত। পুরুষালির পরিবর্তে কমনীয়। তাহলে ছেলে অপ্সরা বলে কি ভুল করেছি? ইন্দ্রের সভায় অপ্সরা নাচতেন, সঙ্গে কোনো গন্ধর্ব বাজনা বাজাতেন বা গাইতেন। বলা হয় অপ্সরারা গন্ধর্বদের স্ত্রী বা সঙ্গিনীরূপে থাকতেন। এবং এঁদের মধ্যে মেয়েদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশাই স্বাভাবিক ছিল। এবং যাঁকে পছন্দ হতো, তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। এখান থেকেই পৃথিবীতে পারস্পরিক  পছন্দের বিয়ে গান্ধর্ব বিয়ে বলে খ্যাত হয়।
 উর্বশীর খাটে দুটি মেষশাবক বাঁধা থাকত। সেই দুটিকে নিয়েই গন্ধর্বরা উর্বশীর সঙ্গে পরিকল্পনা করল। পুরুরবা বেচারা কিছুই জানেন না। রমণক্লান্ত রাজা নগ্ন হয়েই ঘুমিয়ে কাদা! এমন সময় পূর্ব পরিকল্পনা মত একটি মেষশাবককে গন্ধর্বরা চুরি করে নিয়ে গেল। উর্বশী যেন হঠাৎ তা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি করে রাজাকে বলে উঠল, “ওরা আমার মেষশাবক চুরি করে পালাচ্ছে! রাজা, শিগগিরই ওদের ধরো”!
একে প্রেয়সীর কাতর গলা, তায় দুচোখে তখনও ঘুম, বেচারা রাজা ভুলেই গেলেন তাঁর গায়ে এক টুকরো কাপড়ও নেই! তিনি চোর ধরতে বিছানা ছাড়তেই, গন্ধর্বরা তৈরি ছিলেন, তাঁরা বজ্রপাতের ব্যবস্থা করলেন। বিদ্যুতের চমকে রাজা দেখলেন তিনি নগ্ন। দেখলেন যে উর্বশীও তাঁর দিকেই তাকিয়ে। পর মুহূর্তেই উর্বশী অদৃশ্য হয়ে গেলেন!
পুরুরবা কিন্তু সত্যি ভালোবেসে ছিলেন উর্বশীকে। তিনি পাগলের মত খুঁজে বেড়াতে লাগলেন তাঁকে, দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে। রোগা হয়ে গেলেন। দুর্বল হয়ে পড়লেন। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে এক দীঘিতে উর্বশীকে স্নানরত অবস্থায় দেখতে পেলেন। কিন্তু পুরুরবার কাতর অনুনয়েও উর্বশীর মন গলল না। তিনি তো পুরুরবাকে ভালোই বাসেন নি! বহু অনুরোধের পর এইটুকু শুধু বললেন, বছরের শেষ রাত আমি তোমার সঙ্গে থাকব। শুধু ওই রাতটুকু। তাইই সই। তিনশ চৌষট্টি দিন অপেক্ষা করার পর একদিন পাওয়া। বিপুল বিরহের পর প্রিয়মিলনের সুখ। এইভাবে উর্বশী পাঁচটি (মতান্তরে সাতটি)  সন্তানের মা হলেন। এত দিনে বোধহয় তাঁর মন নরম হল। কারণ বুঝলেন এই পৃথিবীর মানুষটি তাঁকে যেভাবে ভালো বেসেছেন, তা স্বর্গেও দুর্লভ! তিনি রাজাকে বললেন, গন্ধর্বরা তোমাকে বর দিতে চায়। যা তোমার খুশি, চেয়ে নাও । উর্বশী ছাড়া আর কী বা চাইবার ছিল রাজার! তিনি তাই চাইলেন। সেই থেকে উর্বশী পুরুরবা গন্ধর্বলোকে ঠাঁই পেলেন। তাঁদের প্রেম অক্ষয় হয়ে রইল। শতপথ ব্রাহ্মণ ও পুরাণগুলিতে এই গল্পই আছে। 
মহাকবি কালিদাস আবার বিক্রমোর্বশীয়ম্ বলে একটি প্রেমকাহিনী রচনা করেন।
কালিদাস বোধহয় কিছুতেই উর্বশীর কাঠিন্য, পুরুরবার এক তরফা প্রেম মেনে নিতে পারেন নি। তাঁর পৌরুষে লেগেছিল! যেমন শকুন্তলার অতখানি সাহস আর তেজকে আর দুষ্মন্তের অসভ্যতাকে কেমন ঢেকে দিয়েছিলেন! ঠিক তেমনি এখানেও কাতর কাঁদোকাঁদো পুরুরবাকে তিনি বীর পরাক্রমশালী রাজা রূপেই দেখিয়েছেন। তাঁর লেখা একেবারেই চিরন্তন বীর পুরুষ আর আর্ত নারীর কাব্য। এই কাব্যে দেখি সূর্য্য বন্দনা করে ফেরার পথে পুরুরবা জানতে পারলেন উর্বশী আর চিত্রলেখাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে কেশী দানব। তাঁদের উদ্ধার করলেন রাজা। উর্বশী মনে মনে বললেন, “ভাগ্যিস! কেশী না হরণ করলে এমন তো হত না! উপকৃতং খলু দানবৈঃ( বিক্রমোর্বশীয়, অনুঃ জ্যোতিভূষণ চাকী, সংস্কৃত সাহিত্য সম্ভার, খণ্ড ১২, পৃঃ ১৯৩)!
এবং রাজার মতোই উর্বশীও প্রেমে পড়লেন। ইন্দ্রের সভায় অভিনয় করার সময় পুরুষোত্তম বলতে গিয়ে পুরুরবা বলে ফেলে শাপগ্রস্ত হলেন। তারপর নাটকের আরোও স্তর আছে। ভিতরে আর ঢুকছি না। কিন্তু এই বৈসাদৃশ্যগুলিই মানুষের চিন্তাভাবনার বদলটাকে স্পষ্ট করে দেয়। পুরুষ মানেই বিক্রমপূর্ণ হতে  হবে;  কোমল হৃদয়, কেঁদে ফেলা, একটি মেয়েকে একতরফা ভালো বাসা ইত্যাদি পুরুষত্ব থেকে সরিয়ে নিতে হবে!
যাই হোক, এখন এই পুরুরবা উর্বশীর প্রেম কাহিনীর সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক কি? উর্বশীকে প্রত্যাখ্যানের ধান ভানতে পুরুরবার গীত কেন গাইলাম? বলছি বলছি।
এই পুরুরবা আর উর্বশীর এক পুত্র আয়ু।
আয়ুর ছেলে যযাতি। সেই যযাতি দেবযানী শর্মিষ্ঠা। যযাতি আর শর্মিষ্ঠার ছোট ছেলে পুরু। পুরুর বংশধরদের পৌরব বলা হয় আর এই পৌরব থেকেই কৌরব ও পাণ্ডব বংশের সৃষ্টি (পৌরাণিক অভিধান, সুধীরচন্দ্র সরকার, পৃঃ ৩০১)।
 এবার অর্জুন উর্বশীকে পেলেন কোথায়? তাঁকে না বললেনই বা কখন? এবার সেই গল্পে আসি। আর জেনে নিন, যুধিষ্ঠিরের বহু আগে, অর্জুন কিন্তু সশরীরে স্বর্গে ঘুরে এসেছেন।
[চলবে]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত