Irabotee.com,irabotee,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

রোহণ কুদ্দুসের গল্প: করালীর আত্মজন

Reading Time: 12 minutes

আজ ২৫ অক্টোবর প্রকাশক,কথাসাহিত্যিক রোহণ কুদ্দুসের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

করালীর আত্মা স্টোররুমে রেখে এসে তনুকে ফোন করলাম। তনুর ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’ কলারটিউন প্রথম লাইনেই ধাক্কা খেল। প্রাণের পর পশার আগেই একগাদা গাড়ির হর্ন আর ভারী চাকার আওয়াজে তনুর চিৎকার কানে এলো – “হ্যালো।” এই মূহুর্তে সে রাস্তায় আছে বুঝলাম, তাই আসল খবরটা না দিয়ে ছোট করে বললাম – “বিকাশ বলছি। বাড়ি ফিরেই ফোন করো। জরুরি কথা আছে।” তনুর চারদিকে কলকাতা ট্রাফিকের হট্টগোল। তাই একই কথা ৩-৪ বার চেঁচিয়ে বলতে হল। জানি না সে বুঝল কিনা। তার আগেই লাইন কেটে গেল। তাই একটা এস এম এস-ও করে দিলাম একই কথা লিখে। ড্রয়িংরুমের সোফাতে গা এলিয়েছি, মোবাইল বেজে উঠল। তনু।

বারকয়েক মহড়া দিয়েছি। তবু ঠিকঠাক হল না। কোনওরকমে বললাম – “তনু, করালী মারা গেছে।” তনু নিঃস্পৃহ গলায় জিজ্ঞাসা করল – “কবে?” গতরাতে। দাহ করে এইমাত্র ফিরেছি করালীর বাসায়, যেখানে করালী আর তার খান পঞ্চাশেক বেড়াল বাস করত। বেড়ালগুলোকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো সে। কিন্তু সেই ভালোবাসাই যে তার প্রাণ নেবে, তা করালী ভেবেছিল কি? ডাক্তারের মতে করালীর ডিপথেরিয়া হয়েছিল। তনু সব শুনে হালকা একটা শ্বাস ফেলে বলল – “এখন রাখি। লাঞ্চ হয়নি এখনও।” আমি জানি তনু এখন মোটেই লাঞ্চ করবে না। গতবছর তার স্বামী বিজন আর এখন করালী। কাছের দুজন পুরুষ একের পর এক চলে গেলে মেয়েরা ঠিক কী করে তা জানি না। তনু হয়ত তার বারান্দার এককোণে আরামকেদারায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবে সারা দুপুর। মোবাইল বন্ধ করে রাখবে। ডোরবেল বাজলেও উত্তর দেবে না। কিন্তু আর যা-ই করুক, ভুলেও পরে কথা বলার সময় করালীর প্রসঙ্গ উঠলে ভিজে চোখে তাকাবে না।

করালীর প্রতি তনুর এই আপাতশীতলতা করালীই তৈরি করে গেছে। করালী আর তনু কলেজ জীবনের প্রেমিক-প্রেমিকা। একসাথে সিনেমা-থিয়েটার-বইমেলা-লাইব্রেরি… আমরা যারা কখনও প্রেমিকা জুটিয়ে উঠতে পারিনি, তাদের জন্যে করালী ছিল ঈর্ষার পাত্র। কিন্তু করালী বোধহয় কখনও ভাবেনি আর একজন মানুষের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। এমন নিবিড় সম্পর্ক যাতে এক ছাদের তলায় থাকা যায়। তাই চাকরি পাওয়ার পর করালী একদিন তনুর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল। খবরটা প্রথমে আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি। করালী আর তনু একে অপরের জন্যে, আর তাই তারা বিয়ে করবে। এমনটা কেউ আমাদের কখনও বলে দেয়নি। কিন্তু আমরা জানতাম। কিন্তু তেমন আর হল কই? পরের ক’মাসের মধ্যেই তনু বিয়ে করল বিজনকে। বিজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। বিজন সুদর্শন। বিজন তনুর স্বামী। বিজনও আমাদের ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠল।

তনুকে বিয়ে করেনি মানে এই নয় যে করালী একজন হৃদয়হীন রাক্ষস। করালী বরং আমাদের জন্যে ছিল দরদী বন্ধু। আমরা অনেকেই যারা তখনও চাকরি পাইনি বা কখনও চাকরি পাইনি, তাদের জন্যে করালী ছিল শেষ আশ্রয়। মেসভাড়া বা বোনের কলেজের ফিজ বা যা খুশি হোক। যখন ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা আমরা করালীর কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়েছি। কেউ পরে শোধ দিতাম, কেউ দিতাম না। করালী কখনও তাগাদা দেয়নি। বরং বড়দিন বা নববর্ষে ছিমছাম গ্রিটিংস কার্ড পাঠাত সে অনেককেই। করালীর একটা সবুজ মলাটের খাতায় তার বন্ধুদের নাম-ঠিকানা লেখা থাকত। ভারতীয় ডাকের হলদে পোস্টকার্ডে করালী আমাদের কখনও কখনও বেগুনি কালিতে চিঠিও লিখত। ২-৪ লাইনের ছোট চিরকুট। তাতে জানা যেত করালী ভালো আছে এবং সামনের সপ্তায় কোনও এক সন্ধ্যায় তার বাসায় গেলে বার্গম্যান বা কুরোশয়া দেখাবে।

করালীর সিনেমা সংগ্রহের নেশা ছিল। এখনকার মত তখন ইন্টারনেট বা সহজলভ্য সিডি-ডিভিডির ব্যাপার ছিল না। করালীকে বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে বিদেশী চিত্রনির্মাতাদের ছবি জোগাড় করতে হত। আমন্ত্রণ মত তার বাসায় হাজির হলে, মহার্ঘ্য সেই কালো মোটা ক্যাসেট দেখিয়ে করালী বলত – “তোর জন্যে এখনও দেখিনি বইটা।” জানতাম সে মিথ্যে বলছে, হয়তো করালী আমার আগে আসা আরও দশজনকে একই কথা বলেছে। তবু করালীর সাথে সময় কাটানো তখনও উপভোগ্য ছিল। যে কোনও ব্যাপারে তার রসিকতা ছিল এক্কেবারে তীক্ষ্ণ। পরিচিত মহলে আমার মত আর যারা লেখালিখি করে, আমরা সবাই জানতাম সাহিত্যিক হলে করালী রম্যরচনা-লিখিয়ে হিসাবে দারুণ নাম করত। বা সিনেমা সমালোচক হিসাবে অনায়াসে তার প্রবন্ধ ছাপা হতে পারত বিদেশী ফিল্ম ম্যাগাজ়িনে। কিন্তু করালী তার কোনওটাই করত না। সে আমাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করত আর অলসভাবে মাঝে মধ্যে ২-১ লাইন ছুঁড়ে দিত গম্ভীর স্বরে। বিশেষতঃ যারা করালীকে তখন পাশ কাটিয়ে যেতে আরম্ভ করেছিল, তাদের সে সুযোগ পেলেই অপদস্থ করত।

করালীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রথম কারণ হল বেড়াল। করালীর বাড়িতে তখন প্রায় ১০টা বেড়াল ঘোরাঘুরি করত। করালীর মা মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলায়। বাবা ছিলেন নামকরা উকিল, করালী কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনোর পর তিনিও গত হয়েছিলেন। আর কোনও আত্মীয় স্বজনও ছিল না তার কোনওকালে। তাই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে করালীর বেড়ালের সংখ্যাও বেড়েছে বিনা বাধায়। ঘরে ঢুকলেই মিউ মিউ স্বরে পায়ের সাথে লেজ বুলিয়ে যেত কেউ-না-কেউ। তাদের নামও ছিল বিচিত্র। অকালসৎসঙ্গ, মার্জারী, গামু, কেলো, লালকুমার, বেহেড জনসন, খন্ডত্য – এমন একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ স্কেলে করালীর বেড়ালরা ঘোরাফেরা করত। মনিবের আদর আর আশকারা পেয়ে এমন একটা সময় এলো যখন তারা অতিথিদের কোলে বা ঘাড়ে-মাথায় উঠতে চাইত। তার ওপর অবিবাহিত একলা পুরুষ হলে যা হয়। ঘরদোর পরিষ্কার রাখাটা ছিল বেড়ালগুলোর দায়িত্ব। করালী নিজে থেকে তেমন একটা কিছু করত বলে মনে হত না। তাই করালীর বাসায় ঢুকলেই বেড়ালের কৃতকর্মের একটা বোটকা গন্ধ পাওয়া যেত।  টয়লেট ব্যবহার করে এমন বেড়াল কলকাতা শহরে আর কটা পাওয়া যাবে? স্বভাবতই বেড়ালের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধু-বান্ধবরা আর করালীর বাড়ি যেতে চাইত না। পোস্টকার্ড এসে জমা হত। ফোনের ঘণ্টি বেজেই যেত। কে-ই বা বেড়াল অধ্যুষিত দুর্গন্ধময় ড্রয়িংরুমে বসে পুরানো জমানার সাদা-কালো সিনেমা দেখতে চাইবে? তাই আস্তে আস্তে করালীকে সবাই ভুলে যেতে থাকল।

আমি নিয়মিত করালীকে ফোন করতাম। বিয়ের পরেও। কিন্তু কৃষ্ণা ব্যাপারটা পছন্দ করত না। করালী আমাদের কলেজ-বন্ধু। একসময় অর্থসাহায্য করেছে। কিন্তু এখন সে এক মাঝবয়সী বেড়াল-বাতিক বেআক্কেলে লোক, যে সুযোগ পেলেই লোকজনকে অপদস্থ করে। এককথায়, করালী এখন আর ততটা প্রয়োজনের বন্ধু নয়। আর যে বন্ধু প্রয়োজনীয় নয়, তাকে ফোন করে সময় আর পয়সা নষ্ট করাটা বাড়াবাড়ি। আর তাই, আমাদের বাড়ির কোনও অনুষ্ঠানে করালীর নিমন্ত্রণ বন্ধ হয়ে গেল। করালীকে ফোন করারও আর কোনও কারণ রইল না। করালী আমার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের পরিধির থেকে অনেক দূরে চলে গেল। তাই মনে হয় বেড়াল নয়; আমাদের নিজেদের বা স্ত্রীর অজুহাত দিয়ে নিজেদের থেকে করালীকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটাই করালীকে আমাদের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল।

কিন্তু করালীর সাথে সম্পর্কটা ভাগ্যের জোরে টিকে গেল। কৃষ্ণার একসময় মনে হল আমি লোকটাও আর যথেষ্ট প্রয়োজনের নই। তাই আমার মত ফেকলু লেখককে ছেড়েছুড়ে সে একজন সফল মানুষকে বিয়ে করল। শুনেছিলাম লোকটা আয়কর বিভাগের একজন হোমরাচোমরা। যাই হোক, একদিক থেকে আমি বেশ খুশি হলাম। মাসে হাজার জায়গায় নেমন্তন্ন রাখতে যাওয়ার বায়নাক্কা নেই। সেখানে মহার্ঘ্য উপহার দেওয়ার ঝক্কি নেই। শৌখিন প্রসাধনে ড্রেসিং টেবিল বা বাথরুম ভর্তি হওয়ার উৎপাত নেই। তার ওপর লেখার সময় অনেক বেড়ে গেল। আয় বাড়ার সাথে সাথেই ব্যয় সংকোচ এবং ব্যাল্যান্স শিট থেকে স্ত্রী বিয়োগ – কোন পুরুষ না এতে খুশি হয়। কিন্তু আমি ঠিক খুশি হতে পারছিলাম না। কারণ খুঁজতে খুঁজতে একদিন দেরাজ থেকে পুরোনো এক বান্ডিল চিঠি বেরোল। তাতে করালীর বেশ কিছু চিঠি ছিল। মনে পড়ল করালীর সাথে যোগাযোগ নেই প্রায় বছর তিনেক হতে চলল। ফোন করলাম। করালী তখন সবে অফিস থেকে ফিরেছে। ২-৪টে কথা হওয়ার পর বলল – “একদিন চলে আয় আমার বাসায়। তোরা তো আর আসিসই না।”

পরের শনিবার করালীর ডেরায় গিয়ে হাজির হলাম। ড্রয়িংরুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেলাম। যেদিকে তাকাই বেড়াল। একদিকে চপ্পল খুলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞাসা করলাম – “এত বেড়াল?” করালী মৃদু হেসে বলল – “জাস্ট হাফ সেঞ্চুরি হয়েছে। পুরো ৫০টা।” করালীর ৪ কামরার ফ্ল্যাটবাড়িতে ৫০টা বেড়াল। তারা কেউ বিছানায় উঠে শুয়ে আছে। কেউ টিভির টেবিলে টিভি সেটের পাশে বসে। কেউ বইয়ের র‍্যাকের মাথায় লেজ ঝুলিয়ে আছে। ব্যাপারটা বেশ সম্মোহক। আর একই সাথে গোলমেলে। কোনও সুস্থ মানুষ এত বেড়াল নিয়ে বাস করে নাকি? আমি করালীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – “আছিস কী করে?” করালী আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে পালটা প্রশ্ন করল – “কৃষ্ণা কই? এলো না?” করালী কৃষ্ণার ব্যাপারটা জানে না। না জানাটাই স্বাভাবিক। এতদিন তো সম্পর্কই ছিল না।

আমি ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলাম – “কৃষ্ণার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে।” করালী একটু চুপ করে থেকে উঠে গেল। ফিরল একটা ট্রেতে বিয়ারের ২টো বোতল আর একটা বড় বাটিতে বেশ কিছু ভাজাভুজি নিয়ে। কিছুটা বিয়ার গলায় ঢেলে করালী তেতো মুখে বলল – “এই জন্যেই মানুষের সাথে থাকা হয়ে উঠল না আমার।” তারপর একটা পকোড়া মুখে ঢুকিয়ে বলল – “যতদিন জ্যান্ত থাকে ততদিন ঝামেলা করেই চলে।” এসব কথার কোনও উত্তর হয় না। তাই প্রসঙ্গ পালটাতে কী বলব ভাবছি। এমন সময় করালী বলল – “একটা গল্প বলি শোন।”

কেরালার একটা গ্রামে এক দজ্জাল মহিলা থাকত। তার মাছ খাওয়ার খুব শখ। সেজন্যে স্বামীর ওপর দারুণ অত্যাচার করত। রোজ সমুদ্র থেকে টাটকা মাছ ধরে না এনে দিলে বরকে পেটাত পর্যন্ত। তা একদিন ভরা বর্ষায় মেয়েটার স্বামী জোয়ারের ভয়ে সমুদ্রে যেতে পারেনি। ঘরে মাছ আসবে না এই ভেবে মেয়েটা সকাল থেকেই অকথ্য গালাগাল শুরু করেছে। সেই বর বেচারা আর কাঁহাতক সহ্য করে। দু’হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল – “হে ঈশ্বর, এত লোক মরে আর এই ডাইনি মরে না কেন।” ব্যাস! রাগে আগুন হয়ে মেয়েটা একটা লাঠি তুলে লোকটার মাথায় বসাতে গেল। কিন্তু কী হল কে জানে। লোকটার মাথাতে তো সেই লাঠি পড়লই না, উলটে পা পিছলে ঘরের দরজায় মাথা ঠুকে মেয়েটা সাথে সাথে অক্কা পেল। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। মরে গিয়েও মেয়েটা তার জ্যান্ত বরকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। মেয়েটার ভূত রাত হলেই ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে, ভয় দেখায়, মাছ খেতে চায়। লোকটা তখন বাধ্য হয়ে গ্রামের রোজার কাছে গেল। রোজা এসে একটা বাঁশের চোঙের মধ্যে মেয়েটার আত্মা পুরে একটা ছিপি দিয়ে বন্ধ করে দিল।

বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে আমি হাঁ করে করালীর গল্প শুনছিলাম। এমনকি আমার পায়ের আঙুল নিয়ে ১টা বেড়াল খেলছে সেটাও লক্ষ্য করিনি। করালী কথা বন্ধ করতে আমি পা সরিয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। গল্পটা কেন বলা হল? করালী আর একটা পকোড়া বাটি থেকে তুলে নিয়ে বলল – “এ ঘটনা আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগেকার। মজার ব্যাপার হল ক’মাস আগে সেই বাঁশের চোঙটা আমার কাছে এসে পৌঁছেছে।”

আমি বিষম খেতে গিয়ে সামলে নিলাম – “মানে যে বাঁশের চোঙার মধ্যে দজ্জাল মেয়েটার আত্মা ছিল?” করালী স্মিতমুখে বলল – “ছিল নয়। আছে। এখনও আছে।” করালীর হাতে ধরা বোতলটার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালাম – “৫০টা বেড়ালের মালিক একটা প্রাপ্তবয়স্ক লোক সন্ধেবেলা তার ড্রয়িংরুমে বিয়ার খেতে খেতে আর একটা প্রাপ্তবয়স্ককে বলতে চাইছে তার কাছে ১০০ বছর পুরোনো একটা বাঁশের চোঙার মধ্যে এক দজ্জাল মহিলার আত্মা বন্দি করা আছে।” করালী ঘাড় নেড়ে মুচকি হেসে বলল – “ঠিক তাই।” বুঝলাম করালী মজা করছে। তাই হালকা গলায় প্রশ্ন করলাম – “তা এমন জিনিস পেলি কোথায়?”

করালী তার বোতলটা খালি করে মেঝেতে শুইয়ে দিল। একটা বেড়াল এসে বোতলের মুখটা চাটতে লাগল। করালী সেই সুরারোপিত দৃশ্য দেখতে দেখতে উত্তর দিল – “ইন্টারনেটে। একটা সাইট আছে। সেখানে আত্মা কেনাবেচা হয়।” এবার আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। করালী মজা করছে কিনা একটু সন্দেহ হল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল – “বিশ্বাস করতে পারছিস না তো? আয় তোকে দেখাই।”

আমায় নিয়ে করালী তার স্টোররুমে হাজির হল। ঘরটা তালা দেওয়া থাকে। বেড়ালদের যাতায়াত নেই। সেজন্যে এ ঘরের গন্ধটা আলাদা। বাতিল ওষুধের মত। একটা ষাট ওয়াটের বাল্বের হলুদ আলোয় ঘরটা কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে। চারদিকে খবরের কাগজ আর পুরোনো পত্রিকা ডাঁই করে রাখা। ভাঙা প্লাস্টিকের বালতি। ফুটো হয়ে যাওয়া একটা ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট। এমন আরও কিছু বাতিল জিনিসপত্র পেরিয়ে দেওয়ালের কাছে একটা ছোট মিটশেফের কাছে গিয়ে করালী বলল – “এর মধ্যে আছে।” দরজা খোলার পর দেখা গেল মিটশেফের ৩টে তাকে বেশ কিছু বাঁশের চোঙ দাঁড় করানো। সব মিলিয়ে অন্ততঃ ডজনখানেক তো হবেই। প্রত্যেকটা চোঙের দৈর্ঘ্য আধ ফুট থেকে এক ফুটের মধ্যে। মাঝের তাক থেকে একটা চোঙ বের করে করালী আমার দিকে এগিয়ে দিল। এর মধ্যে সেই মালায়ালী বৌটার আত্মা ভরা আছে।

হাতে নিয়ে দেখলাম হলুদ একটা বাঁশের চোঙের গায়ে লাল-কালোতে নকশা করা আছে। একপাশে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে কিছু লেখা আছে। চোখের কাছে এনেও বোঝা গেল না সেগুলো কী। হয়ত মালায়ালাম হবে। চোঙটার মুখে একটা কর্কের ছিপি আটকানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ ছিপি সহজে খোলার নয়। চোঙটার ওজন নেই বললেই চলে। একেবারে হালকা। শুনেছি আত্মা বায়বীয় পদার্থ। তাই কোনও ওজন থাকার কথা নয়। করালীর হাতে চোঙটা ফেরত দিতে সেটা যথাস্থানে রাখতে রাখতে করালী বলল – “মোট ১৩টা চোঙ আছে আমার কাছে।” তারপর ঘর থেকে আমায় নিয়ে বেরিয়ে এসে তালাটা আঁটতে আঁটতে বলল – “১৩টা আত্মার মোট দাম পড়েছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।”

একটু পরে করালীর থেকে বিদায় নিলাম। সারাটা রাস্তা ভাবতে ভাবতে এলাম, করালী কেন এমন হয়ে গেল? কেন তাকে বেড়াল পুষতে হয় এতগুলো? কেন তাকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে আত্মা কিনতে হয়? আমরা মানুষরা তাকে ব্রাত্য করে দিলাম বলেই কি? কিন্তু করালী নিজেও তো দায়ী। তনুকে বিয়ে করে স্বাভাবিক সংসার পাততে পারত। এভাবে বিভিন্ন যুক্তিতে করালীকেই তার এই বান্ধবহীন অবস্থার জন্যে দায়ী করে আর তার বাঁশের চোঙওয়ালা আত্মা কেনাকে তার পাগলামি সাব্যস্ত করে আমি নিজের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে গেলাম।

এরপর তার বাসায় না গেলেও মাঝে মাঝে করালীকে ফোন করতাম। একথা সেকথার পর জানতে চাইতাম আত্মা বিকিকিনি কেমন চলছে। জানলাম করালীর লক্ষ্য ছিল ১৩টা আত্মা জোগাড় করা। সেটা হয়ে গেছে। সে আত্মা কেনা বা বিক্রি করার কোনওটাতেই আর নেই। আত্মাগুলো তাহলে তালা মেরে বাড়িতে রেখে দেওয়া কেন? করালী প্রত্যেকবার একই কথা বলত – “সময় হলে ঠিকই জানতে পারবি।”

একদিন করালীকে ফোন করে কোনও উত্তর পেলাম না। এই মোবাইলের যুগে এসেও করালীর সাথে কথা বলার উপায় তার মান্ধাতা আমলের গাবদা ল্যান্ডফোন। তাই করালী বাড়ি না থাকলে তার সাথে কথা বলার কোনও উপায় নেই। পরের দিন রাতে ফোন করেও কোনও উত্তর না পেয়ে উদ্বিগ্ন হলাম। করালী বাড়ি ছেড়ে বেড়াতে গেছে, এমনটা কখনও হয়নি। তাছাড়া একবাড়ি বেড়াল ছেড়ে করালী কোথায় বেড়াতে যাবে? তাই তার বাসায় গিয়ে একবার দেখে আসব কিনা ভাবছি, প্রসন্নবাবুর ফোন পেলাম। প্রসন্ন রায়চৌধুরী করালীর বাবার বন্ধু ছিলেন। উনিও পেশায় উকিল। শুনলাম করালী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। প্রসন্নবাবুকে অনুরোধ করেছে আমার সাথে যোগাযোগ করতে। প্রথমে হাসপাতালে না গিয়ে প্রসন্নবাবু তাঁর সেরেস্তায় আসতে বললেন।

প্রসন্নবাবুর সেরেস্তায় পৌঁছে শুনলাম, করালীর ডিপথেরিয়া হয়েছে। গত এক সপ্তা হাসপাতালে ভর্তি সে। ডাক্তারের মতে করালী বেশীদিন বাঁচবে না। হয়ত আর ২-৩ দিন। ডিপথেরিয়ায় মানুষ মারা যেতে পারে? তাও এই ২০১২-তে এসে? প্রসন্নবাবু ঘাড় নাড়লেন – “জানি না। আমার মনে হয় তোমার বন্ধুর বাঁচার ইচ্ছেটাই নেই আর। মাস দুয়েক আগে একটা উইল করেছিল আর এখন… অনেকটা স্বেচ্ছামৃত্যুর মত ব্যাপার।” এরপর প্রসন্নবাবু একটা বাক্স আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কাঠের তৈরি একটা ঘনক। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতায় আধহাত মত হবে। একটা ছোট্ট আঙটা। সেটা খুলে বাক্সের ভেতরে দেখলাম একটা হলুদ বাঁশের চোঙ। তার ওপর রঙচঙে নকশা। করালীর বাড়িতে দেখা বাঁশের চোঙগুলোর সাথে একটাই তফাত। এর মুখটা আঁটা নয়। বাক্সের মধ্যে একটা কর্কের ছিপি পড়ে আছে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রসন্নবাবুর দিকে তাকালাম। “করালীর ইচ্ছা, এই বাক্সটা নিয়ে হাসপাতালে তার কাছে যাও।” কথা না বাড়িয়ে কাঠের বাক্সটা আমার ঝোলায় পুরে করালীর সাথে দেখা করতে চললাম।

করালীকে দেখে দারুণ কষ্ট পেলাম। মৃত্যুর ছায়া তার চোখেমুখে স্পষ্ট। মৃত্যুপথযাত্রী বেশী দেখিনি এ জীবনে। কিন্তু কেন যেন মনে হল করালী সত্যিই আর বেশীদিন বাঁচবে না। আমায় দেখে সে ফ্যাকাসে হেসে বলল – “তোর ওপর অনেক দায়িত্ব দেওয়া আছে।” আমি বুঝলাম উইলের কথা বলছে সে। বিশেষ পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম – “তুই আগে সেরে ওঠ। বাড়ি চল। তারপর ওসব নিয়ে কথা হবে।” করালী ইশারায় আরও কাছে ডাকল – “আমি তাকে মুক্তি দিয়েছি ঐ চোঙ থেকে। তাই সে আমার ওপর দারুণ রেগে আছে।” তারপর তার বিছানার পায়ের দিকে আঙুল তুলে বলল – “ঐ দ্যাখ। আমার জন্যে সে অপেক্ষা করছে।”

করালীর কথা থেকে যা বুঝলাম, তা অনেকটা এরকম। সপ্তা দুয়েক আগে করালী তার একটা বাঁশের চোঙ থেকে ওড়িশার এক জাদুকরের আত্মাকে মুক্ত করে দিয়েছে। আর তারপর থেকেই করালী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেই জাদুকরের অভিশাপ। কিন্তু যে আত্মাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, সে তো খুশি হবে। অভিশাপ দেবে কেন? “ঐ বাঁশের চোঙের ভেতর নিরাপদে থাকে এইসব দুষ্টু আত্মারা। জীবন মরণের চক্র তাদের ছুঁতে পারে না। নরকে জ্বলার কোনও ব্যাপারই নেই। ঐ চোঙের ভেতর তারা অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারে। আসলে এই মন্ত্রপূত বাঁশের চোঙগুলোও বানিয়েছিল এক শয়তান জাদুকর। তারপর তার শিষ্যদের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে।” করালীর প্রতি করুণা হল। তার মত ঝকঝকে একটা মানুষ এইসব বিশ্বাস করে বসে আছে? কিন্তু করালীর কথা এখনও শেষ হয়নি।

কোনও আত্মা ঐ চোঙের ভেতর একবারই ঢুকতে পারে। কেউ চোঙের মুখ খুলে দিলে তাকে বেরিয়ে আসতেই হয়। আর তারপর তাকে আর পাঁচটা সাধারণ আত্মার মত জীবন-মৃত্যুর চাকায় জড়িয়ে যেতে হয়। কিন্তু করালী চোঙের মুখটা খুলল কেন? “সারা জীবন একটা ঘুপচি বাড়িতে কাটিয়ে দিলাম। পুণ্যি করার সুযোগ তো খুব বেশী হল না। তাই মরার পর এদিক-সেদিক না ঘুরে ভাবছি ঐ বাঁশের চোঙেই কাটিয়ে দেওয়া ভালো।” মানে? করালী কেন চোঙের ভেতর ঢুকতে যাবে? করালী ব্যাখ্যা করে – “চোঙের মুখ যে খুলে দেয়, মৃত্যুর পর তার আত্মা ঐ চোঙের ভেতর বসবাস করার দাবীদার।”

অসহ্য! করালী আমার মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধু। তার জন্যে দারুণ দুঃখ হওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে করালীর এইসব আজগুবি গল্প শুনে দারুণ বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে। কী করে মানুষ এসব বিশ্বাস করতে পারে? করালীর কথা শুনে মনে হচ্ছিল, জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন কাটিয়ে একটা বাঁশের চোঙের মধ্যে বসবাস করার জন্যে সে এখনই মরতে চাইছে।

এবং তার পরদিন করালী সত্যিই মারা গেল। সেদিন সকাল থেকেই সে আচ্ছন্নের মত পড়ে ছিল। করালীর বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসেছিলাম আমি। করালী সারাজীবন কতভাবে সাহায্য করেছে কতজনকে। কিন্তু তার মৃত্যুর সময় আমিই একমাত্র ছিলাম তার পাশে। কোনও আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব আসে নি। কাউকে খবরই দেওয়া হয়নি।

মৃত্যুর পর করালীর কথামত বাক্স থেকে বাঁশের সেই চোঙ বের করে করালীর বুকের ওপর রেখেছিলাম। এভাবে নাকি করালীর আত্মা ঐ চোঙের মধ্যে প্রবেশ করবে। তারপর শক্ত করে কর্কের ছিপি দিয়ে চোঙের মুখটা এঁটে দিয়ে আবার সেই কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে রাখলাম। ব্যাপারটা দারুণ হাস্যকর মনে হচ্ছিল। কিন্তু করালীর শেষ ইচ্ছা।

সৎকারের কাজকর্মে প্রসন্নবাবুও সাহায্য করলেন। শ্মশান থেকে ফেরার পথে একটা বড় মুখ আঁটা খামে করালীর উইলের একটা কপি আর তার বাসার চাবির একটা গোছা তুলে দিলেন আমার হাতে।

নিজের বাড়ি না ফিরে আগে করালীর বাসায় গেলাম। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে বেড়ালগুলোকে দেখাশোনা করার জন্যে করালী পয়সা দিয়ে একটা লোক রেখেছিল। তাকে ছুটি দিয়ে বেড়ালগুলোকে বিভিন্ন পোষ্যপালন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ আছে উইলে। কিন্তু সবার আগে বলা আছে তনুকে ফোন করে করালীর মৃত্যু সংবাদ জানানোর কথা। তাই করালীর আত্মা স্টোররুমে রেখে এলাম। বাকি বাঁশের চোঙগুলো দেরাজে সেই একইভাবে সাজানো আছে। করালীর চোঙটাও তার মাঝে সাজিয়ে রেখে বের হয়ে আসতে যাব, হঠাৎ কোত্থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো। শিউরে উঠেও নিজেকে সামলে নিলাম। শোনার ভুল নিশ্চয়। স্টোররুম থেকে বেরিয়ে এসে তনুকে ফোন করলাম।

প্রথমে নির্লিপ্তি দেখালেও সপ্তাখানেক পর থেকে তনুও আমার সাথে যোগ দিল করালীর উইল অনুযায়ী তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দানকর্মে। দানই বটে। প্রথমদিনই তালিকা মত ১০টা বিভিন্ন সংস্থায় ফোন করলাম। করালী আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিল দেখলাম। নির্বিবাদে ১০ জায়গার লোক এসে গাড়িতে ৫টা করে বেড়াল খাঁচা বন্দি করে নিয়ে চলে গেল। কলকাতায় এতগুলো পোষ্যপালন সংস্থা আছে? আগে ভেবেও দেখিনি। তারপর করালীর সিনেমাগুলো। পুরানো ভিসিআর-এর গাব্দা ক্যাসেট থেকে শুরু করে আধুনিক ডিভিডি ডিস্ক – সব মিলিয়ে প্রায় শ’পাঁচেক। কিছু গেল করালীর পরিচিত দোকানে, যেখান থেকে সেগুলো সংগ্রহ করেছিল সে। আর বেশ কিছু গেল করালীর পুরোনো বন্ধুদের ঠিকানায়। এতজনের ঠিকানা করালী কীভাবে জোগাড় করেছিল জানিনা। কিন্তু কুরিয়ার বা স্পিড পোস্ট কিছুই ফেরত এলো না। অতএব জায়গায় জায়গায় সব পৌঁছে গেছে। সিনেমা বিলির পর পালা এলো করালীর সংগ্রহ করা সেই সব বাঁশের চোঙগুলোর। ১৩টা চোঙের ১১টা পাঠানো হল এমন ১১ জনকে যাদের সাথে জীবদ্দশায় করালীর খুব একটা সখ্য ছিল না বলেই জানতাম। তবু তাদের এমন বহুমূল্য চোঙ পাঠানোর কারণ কী তা করালীই জানে। কেরালার সেই দজ্জাল মেয়েটার আত্মাভর্তি চোঙটা করালী তনুকে দিতে নির্দেশ দিয়ে গেছে। আর করালীর নিজের আত্মাটা থাকবে আমার জিম্মায়। জীবদ্দশায় শেষদিন পর্যন্ত আমি তার বন্ধু ছিলাম। তাই সে চায়, তার আত্মা আমার কাছেই গচ্ছিত থাক। যদিও করালীর এই আত্মা নিয়ে ছেলেমানুষির প্রতি কোনও বিশ্বাসই আমার নেই; তবু কোনও একজন নির্বান্ধব মানুষ আমায় তার বন্ধু ভেবেছে আর মৃত্যুর পরও আমার সান্নিধ্যে থাকতে চেয়েছে – একথা ভেবে চোখটা জলে ভরে এলো।

যদিও তনু এই কয়েকমাস আমায় নানাভাবে সাহায্য করেছে করালীর উইল অনুযায়ী বিভিন্ন ঠিকানায় তার জিনিসপত্র পাঠাতে, কিন্তু করালীর আত্মার সংগ্রহ বিষয়ক কোনও কথাই তাকে জানাইনি। কিন্তু আজ করালীর ফ্ল্যাট বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল। টাকাটা জমা দেওয়ার কথা একটা অনাথ আশ্রমে। চাবির গোছা নতুন মালিকের হাতে তুলে দিয়ে তনুকে ফোন করলাম। করালীর সম্পত্তির বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে। পড়ে আছে শেষ একটা জিনিস। তনুকে জানালাম, করালীর শেষ ইচ্ছা মত তনুর প্রাপ্য জিনিসটা তার হাতে তুলে দিতে চাই। “বাড়ি চলে এসো। ডিনারটা আমার এখানেই সেরে নেবে।”

তনুর বারান্দায় কফি নিয়ে বসলাম আমরা। আলো নেভানো আটতলার এই বারান্দার বেশ নীচে শহর কলকাতার টুকরো শব্দ ভেসে আসছে। একটু চুপ করে থেকে তনুকে বললাম – “করালী তোমার জন্যে একটা আত্মা রেখে গেছে।” ঘর থেকে ছাপিয়ে পড়া আবছা আলোয় দেখলাম তনু কৌতূহলী তাকিয়ে আছে। তাকে খুলে বললাম করালীর আত্মা সংগ্রহের কথা। চোঙের মধ্যে করালীর নিজের আত্মা বন্দি করে রাখার কথা। আমার ঝোলা থেকে কাঠের বাক্সটা বের করে আনলাম। তার মধ্যে দুটো চোঙ পাশাপাশি রাখা। তনুর চোঙটা তার হাতে দিলাম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল – “চোঙের মুখের এই ছিপিটা খুলে দিলে কি ভেতরের আত্মা মুক্তি পাবে?” আমি কৌতুকের সুরে বললাম – “শুধু তা-ই নয়। মৃত্যুর পর তোমার আত্মা ঐ চোঙের মধ্যে বসবাস করার হকদার হবে।” তনু আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল – “চলো এই চোঙের আত্মাটাকে মুক্তি দিই। বেচারি মেয়েটা কবে থেকে এই চোঙের মধ্যে বন্দি।” তর্কের সুরে বললাম – “বন্দি কেন হবে? করালী তো বলেছিল ঐ চোঙের ভেতর স্বর্গসুখের বন্দোবস্ত করা আছে।” তনু চোঙের ছিপিটা টেনে খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল – “তবু তো বন্দিই। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আর কেউ ধরে ঢুকিয়েছিল একচিলতে একটা ঘুপচি জায়গায়।” একটু বিরক্ত হলাম এবার – “তুমি সত্যিই ঐসব ছাইপাঁশ বিশ্বাস করতে শুরু করলে নাকি? তার ওপর ছিপিটা খুলতে চেষ্টা করছ।”আমার দিকে ঘুরে তনু হাসল – “তুমি বিশ্বাস করো না। তাহলে এই ছিপিটা খুললে কী সমস্যা?” সত্যি করেই কি আমিও তাহলে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি করালীর এইসব আজগুবি? নিজেকে অবিশ্বাসী প্রমাণ করতে এবার তনুকে সাহায্য করতে চাইলাম – “এক কাজ করো। তোমার ওড়নাটা ছিপির ওপর চেপে ধরে টান দাও।” ৪-৫ বারের চেষ্টায় ‘ব্লগ’ করে একটা আওয়াজের সাথে ছিপিটা খুলে গেল। আত্মার মুক্তি ঘটলে ব্লগ হয়?  হাসতে হাসতে তনুকে ঠেস দিয়ে বললাম – “ভেবেছিলাম অন্ততঃ একটা হাল্কা ধোঁয়ার মত কিছু দেখতে পাব। আত্মা তো দেখছি খুবই সূক্ষ্ণ জিনিস। একেবারে অদৃশ্য।” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তনুর দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলাম। একটা অদ্ভুত বিষাদ ছেয়ে আছে তার মুখে।

একটু চুপ করে থেকে সে অনুনয়ের সুরে বলল – “আমি মারা গেলে আমার আত্মাটাও বন্দি করে রেখো। করালীর আত্মার পাশে।” শেষদিকে তনুর গলা ধরে এলো। একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। হাত বাড়িয়ে তনুর হাতটা ধরতে গিয়েও সরিয়ে আনলাম।

করালীর আত্মাকে মাঝে রেখে আমি আর তনু আবছা বারান্দায় বসে রইলাম।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>