মার্কসবাদী বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গ যেভাবে এখনো প্রাসঙ্গিক
১৯১৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি বার্লিনে ডানপন্থী মিলিশিয়া বাহিনী ফ্রেইকর্পসের আততায়ীরা তার মাথায় গুলি করে হত্যা করে, একটা খালে তার লাশ ফেলে দিয়েছিল।
লেখক, দার্শনিক এবং যুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী রোজা লুক্সেমবার্গের তখন ৪৭ বছর বয়স।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জার্মানিতে ফ্রেইকর্পসের উত্থানের কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছিল, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং জার্মান কাইজারকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
কিন্তু মৃত্যুর ১০০ বছর পরেও কেন রোজা লুক্সেমবার্গকে স্মরণ করা হয়?
কারণ যতদিন বেঁচে ছিলেন, রোজা সামাজিক বৈষম্য, লিঙ্গ অসমতা, প্রতিবন্ধীদের সাথে অন্যায্য আচরণ এবং প্রথাগত রাজনৈতিক মতবাদের বিরোধিতা করে গেছেন। সেসব প্রসঙ্গ আজো একই রকম প্রাসঙ্গিকই রয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাপী এখন কট্টর উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে যুদ্ধ ও দারিদ্রের শঙ্কাও।
যে কারণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংবা সমাজ সংস্কারের কাজ করেন পৃথিবী জুড়ে এমন মানুষেরা প্রায়শই নিজেদের বক্তব্যে রোজার আদর্শ আর কাজের উদাহরণ দেন।
কেবল এই সপ্তাহেই বার্লিনে রোজা লুক্সেমবার্গ বা ‘রেড রোজা’র স্মরণে দশ হাজার মানুষের একটি র্যালীর প্রস্তুতি চলছে।

নিজের রাজনৈতিক ও দার্শনিক জীবনের শুরু থেকেই প্রথাগত রাধা আর চ্যালেঞ্জকে পাত্তা না দেবার বিরল কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন রোজা। একে জন্মেছিলেন নারী হয়ে, তায় আবার কিছু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেই সঙ্গে রুশ দখলে থাকা পোল্যান্ডে জন্মেছিলেন একটি ইহুদি পরিবারে।
১৮৭১ সালে জন্ম নেবার পর যে সমাজে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার কথা তার।
তিনি সেটা তো মেনে নেনই নাই, বরং তিনি সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী পাওয়া প্রথম অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীর অন্যতম।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতাসহ নিজের নানা মতাদর্শের জন্য বেশ কয়েকবারই কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে। মার্ক্সসীয় আদর্শে বিশ্বাসী হবার পরেও তিনি ছিলেন জার্মানিতে বামপন্থী রাজনীতির কট্টর সমালোচকদের একজন।
রোজাকে নারী স্বাধীনতার প্রধান প্রবক্তাদের একজন বিবেচনা করা হয়, কিন্তু জীবদ্দশায় কোনদিন নিজেকে তিনি নারীবাদী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না।
কেন রোজা আজকের প্রতিবাদকারীদের আদর্শ?
কার্টুনিস্ট কেইট ইভান্স রোজার জীবনী কার্টুন তৈরি করেছেন, তিনি বিবিসিকে বলেছেন, কেন রোজা আজকের প্রতিবাদকারীদের আদর্শ।

১. ‘ আমি ধনীদের চেতনা ভারাক্রান্ত করে দেব ভোগান্তি আর গোপন , তিক্ত ব্যথার অশ্রু দিয়ে ‘
১৮৮০ সালে ওয়ারশতে স্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থাতেই রোজার এমন ভাবনা ছিল, মানুষে মানুষে বৈষম্য এবং দারিদ্র তাকে পীড়া দিয়েছিল।
২. ‘ পুঁজিবাদ পুরো বিশ্বকে ঘিরে ফেলছে, তবু সে নিজে টিকে থাকতে পারে না, এর অন্য অর্থনীতির ওপর ভর করার দরকার হয়। ‘
অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন রোজা। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, পুঁজিবাদ মৌলিকভাবে অস্থিতিশীল এবং চূড়ান্তভাবে এটি বিপর্যয়কর। ২০০৮ সালে পুরো বিশ্ব তার কিছুটা নমুনা দেখেছে।

৩. রোজা লুক্সেমবার্গের বিখ্যাত উক্তি ছিল “সমাজতন্ত্র না হয় বর্বরতা”
রোজার স্থিরবিশ্বাস ছিল পুঁজিবাদ সংকটে পড়লে কেবল একটিমাত্র উপায়ই খোলা থাকবে।
৪. সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, আর সেজন্য তিনি মানুষকে নিজের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বরাবর।

৫. মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে শক্ত অবস্থান ছিল রোজার।
তিনি বলেছিলেন, কেবল নিজের সমর্থকদের জন্য যে স্বাধীনতা তা আসলে কোন স্বাধীনতাই না। স্বাধীনতা মানে অতি অবশ্যই বিরোধীদের মত প্রকাশের অধিকার।
তিনি আবার একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

৬. যুদ্ধবিরোধী ছিলেন রোজা
তার ভাষায় যুদ্ধ হচ্ছে একটি পদ্ধতিগত, সংগঠিত এবং বড় ধরণের হত্যাকাণ্ড।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন বিরোধী হিসেবে তিনি জেলও খেটেছেন।

৭. পৃথিবী বদলানোর জন্য কোন অজুহাতেই পিছিয়ে যাওয়া সমর্থন করেননি তিনি।
একজন শরণার্থী, নারী এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মত বড় বাধা নিয়েও তিনি নিজে সে কাজটি করে গেছেন।
সমাজে যত রকম বাধাই থাকুক না কেন, একজন মানুষের উচিত তা কাটিয়ে সামনে এগুনো—সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন।

