সন্ধ্যা, নওশাদ এবং আমার মাঝে সালভাদর দালির গলিত ঘড়িটা ঢুকে পড়েছে। ফলে যা যা ঘটেছে, তা অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ কাল-পরিক্রমায় ঠিকমতো বিন্যস্ত করা যাচ্ছে না।
আসলে নওশাদের মাথা আউলে গেছে। উল্টাপাল্টা বলে তো বটেই, কাজও করে আউলা ঝাউলা। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে ডাক্তারের ওষুধের প্রভাবে অনিচ্ছায় অচেতনে ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় মানসিক বৈকল্য; জাত নিয়ন্ত্রণহীন চিৎকার-চেঁচামেচি, এতো বেলা হয়েছে অথচ আমাকে কেউ এখনও খেতে দিল না! সন্ধ্যা, সন্ধ্যা, সন্ধ্যা—সন্ধ্যা’র নাম ধ’রে অস্থির প্রেমিকের মতো ডাকাডাকি–তারপর কল্পিত অভিযোগের ঝুলি খুলে অর্থহীন বকবক। এত বেলা অব্দি সন্ধ্যা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ, আর সবাই কাজে ফাঁকি দিচ্ছে! আমাদের কাছে অর্থহীন বটে, নওশাদ নিবিষ্ট তার মুহূর্তে, অভিযোগে।
ততোদিনে ঝি-চাকররাও অতিষ্ঠ। ক্ষমতাহীন, পদ-পদবীহীন,অকর্মণ্য একটা মানুষের অহেতুক উৎপাত কতোটাই সহ্য করে সংসারের কর্মব্যস্ততা? ভাঙা কুলো কে যত্ন ক’রে ঝুলিয়ে রাখে?
উৎপাত বাড়াবাড়ি বেড়ে গেলে একমাত্র ছেলে-বউ উপায়ন্তর না পেয়ে আমাকে ফোন করে। আসলে একমাত্র আমিই নওশাদের এই মানসিক বিপর্যস্ততার কারণ জানি। আমি গেলেই নওশাদ শান্ত হয়। খুব শান্ত হয়ে দায়িত্ববান স্বামীর মতো সব দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা সংহত করে সন্ধ্যার বর্তমান অবস্থা জানতে চায়–জানতে চায় ঠিক কতোদিন লাগবে সন্ধ্যার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে। আত্মপ্রতারণা অস্বীকার ক’রে কিংবা দক্ষ অভিনেতার মতো গোপন ক’রে আমি ও-কে সান্ত্বনা দেই, এই ধর্ মাসখানেক। খুশি হয়ে যায় নওশাদ। ও সুস্থ হয়ে গেলে এবার কিন্তু নেপাল যাবো, তৈরি থাকিস। আমি আসলে নওশাদের জন্য সবসময় তৈরিই থাকি। নওশাদ আমার প্রিয়তম বন্ধু। সন্ধ্যাও।
আমি মানসিক রোগের ডাক্তার নই। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগটিকে সনাক্ত করেছেন ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। নওশাদ নিজেকে সন্ধ্যার স্বামী ভেবে সন্ধ্যার সাথে জীবন যাপন করে। ততোদিনে এই ডিজঅর্ডারের কারণে তার মন্ত্রিত্ব গেছে। মানসিক রোগী হিসাবে দলের পদও হারিয়েছে।
নওশাদ যখন আমাকে ফোন করে তখন গভীর রাত। হাইপার টেনশনের কারণে নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই। আমার জানা অজানার তোয়াক্কা না করে ঠিক কখন ঘুমের ওষুধ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, ঠাওর করতে পারি না। মধ্যরাতের ফোনের আওয়াজে অবশ্যম্ভাবী অকল্যাণের সুর থাকে। বুকের ধড়ফড় এড়ানো যায়না। ঘুমের গভীর স্থির জলে হঠাৎ যেনো ছুঁড়ে দেয় কেউ বিশালাকৃতির কোনও পাথর। ঘুম ভেঙে যায়–কেননা স্বপ্না’র জন্য, নওশাদের জন্য প্রবল উৎকণ্ঠা আমার নিয়মের দিন-যাপনকে অস্থির চঞ্চল করে রাখে, এমনকি ঘুমটাও নির্বিঘ্ন নয়।
আমি জানি নওশাদ কেন ফোন করেছে। নওশাদের কণ্ঠে প্রবল তাড়া। ‘আসতে পারবি?’ ‘আসছি, এখনই আসছি,’ বলে ফোনটা দ্রুত কেটে দেই। মাঝরাতে এসির বাতাসে আমার শরীর ঘামতে থাকে, জিমে ওয়ার্ক আউট করা তরুণের মতো। আমি আমার নার্ভাসনেস অস্বীকারের অহেতুক চেষ্টা করি না। সেতারা টের পায়, উঠে আমার দিকে টিস্যু বক্স এগিয়ে দেয়; মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পানির গ্লাসে পানি এগিয়ে দেয়। সান্ত্বনা দেয়; “আরে সমস্যাটা নওশাদ ভাইয়ের। তোমার তো নয়। এত ঘাবড়াচ্ছো কেন?” সত্যি তো, আমি কেন যে এত ঘাবড়াচ্ছি! সমস্যাটা তো আমার নয়। টিভিটা অন করি। টিভিতে ব্রেকিং হচ্ছে…
আবার বেজে ওঠে মোবাইলটা। মাহীর ফোন। নওশাদের ছেলে। আমি রিসিভ না করে সেতারার হাতে দেই। সেতারা এ-পাশ থেকে বলতে থাকে, “মাহী, বাবা তোমার আব্বাকে খবরটা জানাও। লুকিয়ে লাভ নেই।“ সেতারা স্পিকার অন করে দেয়, আন্টি মিথ্যা বলেই পার পাওয়া যাচ্ছে না। সত্য বললে তো রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে।
মাহী খুব অনুরোধ করতে থাকে। আন্টি একবার পাঠান না আংকেলকে। আমি মাহীর সাথে সেতারার কথা শেষ করার অপেক্ষা করি না। বেরিয়ে পড়ি গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে। আমার বের হয়ে যাওয়ার উদভ্রান্ততা আমার কাছেই অচেনা লাগে। হয়তো সেতারারও তাই লাগে। সেতারা পেছনে থেকে দুয়েকবার ডাকে, শোন শোন আমিও সাথে যাই। আমার শোনার সময় নেই। একদমই সময় নেই। আমাকে নওশাদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতেই হবে।
আমি সবসময় নওশাদের সাথে আছি। আজও আছি। রাতের গভীরতায় হাহাকার কেবল আমি শুনতে পাই। নিয়ন বাতির সারি, ধুলোয় সাদা গাছের পাতায় আনন্দ হারিয়ে যাওয়া শূন্যতা। রাস্তায় দ্রুত গতিতে চলতে থাকা কয়েকটা মালবাহী ট্রাকের বিকট শব্দ, বরং যান্ত্রিক অসহ্যতাই ফিরিয়ে দিচ্ছে শহরের বুকে। হালকা পাতলা যাত্রীসহ দুয়েকটা অসহায় পাবলিক বাস, তাড়া নেই–অথচ জীবন চালিয়ে নিতে হবে অথর্ব কর্মক্ষমতাহীন বৃদ্ধের মতো। একটা প্রাইভেট কারে কয়েকজন তরুণ, উচ্চস্বরে বি টি এসের গান বাজিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, আগামী তারুণ্যের ধারাবাহিকতা ঘোষণা দিয়ে। পাঁচ লক্ষ বছরের হোমো স্যাপিয়েন্স কেবল প্রকৃতির ধারাবাহিকতা। এই শূন্যতা, এই হাহাকার, এই মুহূর্তে যা পীড়িত করছে আমাকে–এক সমাধানহীন জটিল রসায়ন বৈ নয়। হৃৎস্পন্দন থেমে গেলে পৃথিবীর কোনও কোণে এর আর কোনও হদিস থাকে না।
আমাকে দ্রুত পৌঁছাতে হবে নওশাদের কাছে। আমি সবসময় সব পরিস্থিতিতে নওশাদের সাথে আছি। এই আজও দুপুরবেলা–শেষ যখন নওশাদ সন্ধ্যাকে দেখতে যায়, ঠিকমতো উঠে বসতে পারে না সন্ধ্যা। তবু নওশাদকে দেখে চোখেমুখে উপচে উঠছিলো আনন্দ। ঠিকরে বেরোচ্ছে। তুমি এখনও আমাকে আগের মতো ভালোবাসো নওশাদ। আজীবন ভালোবাসা বঞ্চিত সন্ধ্যা, শুধু ভালোবাসা পেতেই ভালোবাসে। ভালোবাসাকেই ভালোবাসে। সন্ধ্যা কী বোকা! নাকি ভাগ্যাহত। প্রকৃত ভালোবাসার ঝর্নাধারা কখনও স্পর্শ করতে পারেনি, কেবল মরীচিকাকে জল ভেবে হোঁচট খায় বারবার।
নওশাদ চেয়ার ছেড়ে বসে বিছানায়, যেন সন্ধ্যার উঠে বসার কষ্টটুকু করতে না হয়। মুঠোয় মুঠো পুরে দৃঢ়তার সাথে বলে, “হ্যাঁ, আমি তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি, সন্ধ্যা। আগের মতোই।“ সন্ধ্যা’র চোখে বিশ্বাসের তৃপ্তি। রোগযন্ত্রণার কষ্ট ছাপিয়ে বিগত জীবনের প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা-ভোলা স্বস্তি। এই বা কম কী! মৃত্যু কিছুই নয়, মৃত্যু তো এক অজানা রহস্য। সন্ধ্যা’র এই স্বস্তি আমাদের বাকি জীবনের তৃপ্তি; বেঁচে থাকা আমার কিংবা নওশাদের। দু’জনেই তো পড়তে পারছি রোগাক্লান্ত সন্ধ্যা’র গ্রীবার ভাঁজে লুকানো শান্তির ভাষা, শেষ মুহূর্তে। হয়তো আমাদের আগামী বেঁচে থাকায় স্বান্ত্বনার পর্দা হয়ে ঝুলবে সন্ধ্যা’র সেই মুখের ভাঁজ।
‘এবার আমার মরেও শান্তি’–কথাটা সিনেমার ডায়লগের মতো শোনায়–যেসব সিনেমায় অভিনয় করে সন্ধ্যা। কিন্তু কথাটা (সিনেমার ডায়লগটা) চোখের ঠিকরে পড়া আলোর সাথে মিশে, দালির দ্য পেসেন্স অব টাইমের একটা গলিত ঘড়ি হয়ে তিন দশক ফুঁড়ে চলে যায়, কে এম ডি সরকারি কলেজের বারান্দায়। কিশোরী মোহন দাস সরকারি কলেজ। নিজেরা শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ না পেলেও ভাটি অঞ্চলের অঢেল ভূ-সম্পত্তির মালিক কৈবর্ত দাসেরা ভাটির প্রায় প্রতিটি শহরে এ-রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গেছেন।
স্বৈরাচার-বিরোধী তীব্র আন্দোলনে কলেজটি উত্তাল, সারাদেশের ধারাবাহিকতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সভায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণ। শামছুন্নাহার হলের জাসদ ছাত্রলীগের নেত্রী মুমূর্ষু হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ঢাকা মেডিকেলে। প্রতিবাদে-বিক্ষোভে নওশাদের নেতৃত্বে তুমুল স্লোগানে ফেটে পড়ছে কলেজ চত্ত্বর—‘একদফা একদাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি।‘‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না।‘ শহীদ-মিনারে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো ভাষণ দিচ্ছে নওশাদ। আমি নিরাপদ দূরত্বে অডিটোরিয়ামের বারান্দায় বসে শুনছি নওশাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা। আমার সাথে সন্ধ্যা। মিটিং শেষ করে সন্ধ্যার সাথে প্রেম করবে নওশাদ। আমাকে পাহারায় থাকতে হবে। মফস্বলের কলেজে প্রেম করা পলাশীর আম্রকাননের গোয়েন্দাগিরির মতো কঠিন।
আমি অবশ্য এই মিছিল মিটিং প্রেম কিছুরই ধারে-কাছে নেই। আমি কলেজটির সেরা ছাত্র। স্কুলেও ছিলাম। প্রথাবদ্ধ প্রতিষ্ঠার অসম্ভব চাপ আছে আমার ওপর। নিম্ন-মধ্যবিত্তের সহজাত আকাঙ্ক্ষা। আমাকে ডাক্তার হতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে আছি শুধু বন্ধুত্বের খাতিরে। নওশাদ আমার একমাত্র বন্ধু। বয়সে যদিও দু’বছরের বড়। কিন্তু এক পাড়ায় একসাথে ক্যারাম, দাড়াগুটি, বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলে বড় হয়েছি। নওশাদ আমার শ্রীকান্তের ইন্দ্রদাদা।
দেখতে দেখতে হঠাৎ ভাংচুর শুরু হয় কলেজে; পুলিশ আসে। মিছিল নিয়ে কলেজ চত্বরের বাইরে যেতেই ধরা প’ড়ে জেলে যায় নওশাদ। সেই বিকেলে ভারাক্রান্ত সন্ধ্যাকে আমি বাসায় পৌঁছে দেই রিক্সায়; পাশাপাশি ব’সে। সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আমি সামান্য একটু সাহস যোগাড় করে ওর ওড়নার খুঁট দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দেই। মুখে কোনও কথা যোগায় না।
নিচ থেকে দেখা যায়, গভীর রাতেও আলো জ্বলছে নওশাদের ঘরে। আমি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নওশাদের ঘরে পৌঁছাই। আমাকে দেখে নওশাদ হাতের নাগালে সাত আসমান নয়, আমাকে নয়, যেন সন্ধ্যাকেই পায়। শান্ত হয়ে সোফায় বসে। আমিও পাশে বসি। আমি তো সবসময় নওশাদের সাথেই আছি।
“ঐ সেদিন,” শুরু করে নওশাদ, “বল্, তুই ছিলি না যেদিন সন্ধ্যা আমার অফিসে এলো।“ “হ্যাঁ, আমি ছিলাম।“ বলেই সন্ধ্যাকে ডাকে নওশাদ, “সন্ধ্যা,সন্ধ্যা আমাদের কফি দাও।“ দালির ঘড়িটি গলে গলে পড়ে।
হ্যাঁ, নওশাদের অফিসে বসে আছি। প্রতিদিন রাতে চেম্বার শেষ করে নওশাদের অফিসে যাওয়া আমার রুটিন। ওয়েটিং রুমের মুখগুলোর দিকে তাকানো আমার অভ্যাস নয়, কথাও নয়। নওশাদ তখন মন্ত্রী, কতোজন কত ন্যায়-অন্যায় তদবিরে দিনভর বসে থাকে। আমার দেখে কী হবে! দেখলেই কী চিনতাম! আপাদমস্তক পর্দায় নিজেকে ঢেকে নওশাদের কক্ষে ঢুকে সন্ধ্যা। আমি এসির অতিরিক্ত শীতল বাতাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেয়ার ঘুরিয়ে নওশাদের টেবিলে রাখা বাংলা, ইংরেজি পত্রিকা উল্টাচ্ছিলাম। নওশাদের সামনে বসে মুখের পর্দা সরালে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে নওশাদ। ওর চিৎকারে আমিও। “সন্ধ্যা। কত বছর পর!”
দালির ঘড়িটি আবার গলে-গলে পড়তে থাকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ অগ্রাহ্য করে। নওশাদ জেলে যায়; আর আমি চলে যাই ডাক্তারি পড়তে, সন্ধ্যার বিয়ে হয়ে যায় একদিন। জানাই ছিল এই পরিণতি। অবস্থানের সাথে বেমানান, বেয়াড়া রকমের সুন্দরকে বেশিদিন আগলে রাখার সাহস কম পরিবারেরই থাকে।
নওশাদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার হোস্টেলে এসে সে কী কান্না। ছেলে মানুষ এভাবে কাঁদে! তা-ও নওশাদের মতো সাহসী নেতা! বাইরে যার হিরোর ইমেজ। নওশাদকে কাঁদতে দেই, নিজেই নিজেকে অতিক্রম করার কোন বিকল্প নেই। রাতে আমাকে পড়ার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে যায় এক অন্ধকার গলিতে। গাঁজার পোটলা নিয়ে হোস্টেলের ছাদে। সাথে আমি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নওশাদ। আর-এক দিন আর-এক অন্ধকার গলিতে কিছু উৎকট মেয়ের কাছে। আমার সেটা প্রথম অভিজ্ঞতা। প্রফ পরীক্ষা ড্রপ দিয়ে এক বছর পিছিয়ে যাই আমি।
সন্ধ্যার সাথে যখন আবার দেখা হয়, তখনও আমি নওশাদের সাথে আছি। সন্ধ্যা রাণী দাস এখন আলেয়া বেগম। এই সন্ধ্যা থেকে আলেয়া হওয়ার প্রক্রিয়াটি ঠিকঠাক জানা নেই আমাদের। অনভ্যস্ত মুখে সন্ধ্যাকে কোনও রকমেই আলেয়া ডাকতে পারি না।
আমরা হঠাৎ তাকে আবিষ্কার করি সিনেমার পোস্টারে। সেদিনও আমরা একসাথেই। আমি তখনো ডাক্তার হয়ে বের হইনি। নওশাদ ঢাকায় এসে নেতার ডান হাত হয়ে যায়। নওশাদের তখন ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাট, গাড়ি, টাকার কাড়ি সবে হওয়া শুরু। ওর সাথে পার্টি অফিসে যাই। আড্ডা মারি। শাকুরায় যাই। টাকিলা আর ভাজা মুরগির ঠ্যাং খাই। অনভ্যাসের টলটলায়মান পা ধীরে-ধীরে স্থির হয়। অন্যরকম জীবনে নওশাদ সন্ধ্যাকে ভুলে যায়।
একদিন মল্লিকা সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যাবার সময় গাড়ি থেকে বিরাট পোস্টার চোখে পড়ে। হ্যাঁ, সন্ধ্যা, সন্ধ্যা তো। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে ব’লে আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। পাশের দোকানে হিমশীতল বাতাসে বরফকুচি দেয়া, ঘেমে ওঠা নারী-শরীরের মতো বাঁকধরা গ্লাসে লাচ্ছি খাই। আর দু’জনে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না সন্ধ্যা’র সিনেমাটা দেখতে যাবো কী যাবো না। বুঝতে পারি না সন্ধ্যা সিনেমায় নামলো কবে! কেন নামলো! শহরের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দর মেয়েটা শেষ পর্যন্ত সিনেমায় নামলো। আমরা আসলে দ্বিধাগ্রস্ত হই–নায়িকা হওয়ার সব যোগ্যতা নিয়ে সন্ধ্যা’র আসলে মিহির চৌধুরীর স্ত্রী হয়েই জীবন কাটানোই ভবিতব্য, নাকি নিজের যোগ্যতার প্রতি সুবিবেচনা ক’রে সিনেমায় নামাটাই সঠিক হয়েছে।
সন্ধ্যা কেঁদে জানায় তার একমাত্র ছেলে হত্যা মামলায় জেলে। মাস ছ’য়েক আগে, এক রাতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে, পথচারী এক ভিক্ষুককে হত্যা করেছিলো। নানা মানবাধিকার সংস্থা আর পেপার পত্রিকার অত্যাচারে বিপর্যস্ত ওর বেঁচে থাকা। উকিল,ব্যারিস্টারের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা চলে গেছে, কিন্তু না হচ্ছে ছেলের জামিন, না মিলছে একটু দমফেলার স্বস্তি। নওশাদের টেবিলে কান্নায় ভেঙে পড়ে সন্ধ্যা, নাকি আলেয়া! নওশাদ খুব ব্যস্ত হয়ে ফোন করে নানা জায়গায়। সন্ধ্যার অশ্রু যুবকবেলার মতো অস্থির করে নওশাদকে, আমাকেও।
তারপর কয়েক বছর আমরা দেখি ঢাকা শহরের হলগুলোতে সন্ধ্যার বিশাল বিশাল পোস্টার। পত্রিকা খুললেই তার ছবি। ভাসতে ভাসতে আমাদের কানে আসে সন্ধ্যা এখন দেশের যুবকদের হার্টথ্রব। গাড়িতে বসে পত্রিকার ছবি উল্টিয়ে নওশাদ হাসে আমার দিকে তাকিয়ে, আমি তার দিকে। আমরা দু’জন রাত বারোটায় টিকেট কেটে সন্ধ্যার সিনেমা দেখি। পর্দায় ওর নাম আলেয়া। কক্সবাজারের ঝাউবনে গান গাইতে গাইতে যখন নায়কের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ক্যামেরা নানা অ্যাঙ্গেলে তাঁর শরীরের বাঁকগুলো ক্লোজ শটে শত শত দর্শকের কামুক দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট করে দেয়; দর্শকরা সমস্বরে সিটি বাজায়। আমি বুঝি নওশাদ চোখ বন্ধ করে ফেলে। আমিও কী খোলা রাখি নাকি! বাসায় ফিরে নওশাদ ঘন ঘন সিগারেট টানে। রাতে ঘুমাতে পারে না। আমিও।
আমি জানি, নওশাদও জানে একদিন না হোক, এক সপ্তাহেই সন্ধ্যা’র ছেলেকে মুক্ত করে আনা সম্ভব নওশাদের পক্ষে। কিন্তু সেটা হয় তিন মাসে। এই তিন মাসে আমাদের সাথে সন্ধ্যার আবার যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। ছেলের জামিনের জন্য পথের অসহায় ভিখারি কিংবা ধূর্ত পাতিনেতার মতো অন্য দশজন ভিজিটরের সাথে নওশাদের ওয়েটিংরুমে সন্ধ্যার বসে থাকা আমার ভালো লাগে না। আমি ওকে চেম্বারে এনে বসাই। মহেন্দ্র আমাদের চা দেয়, পানি দেয়। আমি আর সন্ধ্যা বসে থাকি নওশাদের ফ্রি হবার অপেক্ষায়। গুরুত্বপূর্ণ দফতরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিছুক্ষন আবেগের কাছে স্থগিত রেখে নওশাদ সন্ধ্যা’র কথা শোনে। বাইরে থেকে দেখা রুপালি পর্দার ঝাঁ-চকচকে ঈর্ষণীয় জীবনের আড়ালে-ঢাকা অসুখী অতৃপ্ত জীবনের রূপকথা। মিহির চৌধুরী’র সন্দেহবাতিক, অত্যাচার, সিনেমার পরিচালক এহসান আহমেদের সাথে দেখা হওয়া, সিনেমায় নামা, এহসান আহমেদকে বিয়ে করা, স্ত্রীর মর্যাদা, সম্মান অর্থ-বিত্তের ভাগ কিছুই না পাওয়া–উল্টো ওর সব সাইনিং মানি আত্মসাৎ করা–কতো গভীর দুঃখের খাদ-খনন যাপনের বাঁকে বাঁকে।
একবার নয়, কয়েকবারই বিদেশ ভ্রমণের সময় নওশাদ সন্ধ্যাকে সাথে নিতে চায়। সন্ধ্যা, সন্ধ্যা’র রোদগলা নরম বাতাসের মতো সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে। “অনেক তো হলো, এবার একটু থিতু হই”, আমাকে বলে চুপিচুপি। নওশাদকে বলে, “থাকুক না। তোমার রেপুটেশনের ব্যাপার। আমার ভবিষ্যৎ না হয় শেষ, তোমার তো রয়েছে। তবু একবার কক্সবাজার অন্তত।“ মধ্যচল্লিশে দরজা লাগিয়ে দেয় নওশাদ আর সন্ধ্যা। আমি সবসময় নওশাদের সাথে থাকি। সেদিনও লনের সামনে বসে আছি।
এরপর নওশাদ ব্যস্ত হয় নিজের জগতে। কম তো নয় দায়িত্ব, গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রী সে। বেশ অবহেলা হয়েছে কয়েক মাস। সন্ধ্যা নতুন করে নির্ভিরশীল হয়, কিংবা নতুন করে প্রেম আবিষ্কার করতে চায় সে নওশাদের কাছে। কিন্তু নওশাদ ফোন ধরে না। বিরক্ত হয়। “ফোনটা ধর তো তুই”, আমাকে বলে। “আরে, আমার কাজ-কম্ম আছে না। এই বয়সে এমন ঝুলে পড়লে হয়?” আমার বুকের ভেতরে কোথায় টনটন করে। সময় আবার দালির ঘড়ি হয়ে পড়ে। এই সন্ধ্যার জন্য কী না করে নওশাদ! দেয়াল টপকে দেখা করতে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের হাতে মার খায়। সন্ধ্যা’র ভাইয়েরা নওশাদকে বাড়ির আমগাছের সাথে বেঁধে রাখে একদিন। দু’পাড়ায় মুরুব্বিদের বিচার বৈঠক, কতো কী! আমি আর নওশাদ সিঁদ কাটা চোরের মতো বুকে বল জমাই, “চল্ সন্ধ্যা’র বাসায় যাই।“ নওশাদ ইচ্ছার তীব্রতা আর আহত হবার দ্বিধায় দ্বিখণ্ডিত; যদি সন্ধ্যা আমাদের না চিনে, যদি বাসার দারোয়ান না ঢুকতে দেয়! আমি উৎসাহে টগবগ করি, “আরে সন্ধ্যা আমাদের চিনবে না তাই হয়?” আমার উৎসাহে কিছু সাহস জমাট-বাঁধা দইয়ের মতো সঞ্চিত হয় আমাদের হৃদয়ে। আমরা প্রবল আগ্রহে ওর বাসার সামনে যাই। আহা! নায়িকা সন্ধ্যা’র বাসার সামনে ভীড়; আমাদের যে কোন যুবকের মতো কতোদিন ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে আসা, একান্ত সন্ধ্যা এখন সবার। এই ভার কতো দুর্বহ হয়ে বিঁধেছে কতোকাল!
খবরটা প্রথম আমি নওশাদকে দেই, “সন্ধ্যা’র লাস্ট স্টেজ ক্যান্সার। বাঁচবে না। তোকে একবার দেখতে চায় শেষবার।“ দেখা করে এসেই আউলা হয়ে যায় নওশাদ। খালি বলে, “আমি সন্ধ্যাকে ভালোবাসি। “হ্যাঁ, বাসিস তো!” আমিই ওকে অতীতের সব জ্ঞাত অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য দিয়ে নিশ্চিত করি।
তবে সুযোগটা কেন নিতে গেলাম? আমি নষ্ট হয়ে গেছি। তোরা ভেবেছিস আমি নেশা-টেশা ছেড়ে ভালো হয়ে গেছি; আসলে আমি নষ্ট হয়ে গেছি। সুযোগ নিই মানুষের দুর্বলতার। আমি যাকে কক্সবাজার নিলাম, সে সন্ধ্যা নয় রে। যে কোন মেয়ে। যে কোন মেয়েকে আমি চাইলেই যে কোন জায়গায় নিতে পারি। এই আত্মদহনের কোন উত্তর নেই আমার কাছে। আমি চুপ করে থাকি।
নওশাদ ডাকে, সন্ধ্যা সন্ধ্যা! চলো সিনেমা দেখে আসি। কই যাবি, মল্লিকায় না বলাকায়? আমাকেই অপশন দেয় নওশাদ। ইচ্ছে করে আমি ওকে বাস্তবতা জানাই। আরে হল নয়, এটা সিনেপ্লেক্সের যুগ। সন্ধ্যাকে আমি মরতে দেব না। বাঁচাবো। চঞ্চল হয়ে ওঠে নওশাদ। আউলা ঝাউলা নওশাদকে আমি কোনভাবেই বাস্তবের জল-মাটিতে ফেরাতে পারি না।
আরো পড়ুন: হন্তারক দিন । রুমা মোদক
আমি আঁতিপাঁতি খুঁজি কোথায় সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয় লিভার ক্যান্সারের। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে অর্ধকোটি টাকা বরাদ্দ হয় এককালের তারকা আলেয়ার জন্য। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের চিকিৎসাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে হয় আমার কাছে।
বাঁচানো যায়নি সন্ধ্যাকে। খবরটা নওশাদকে জানানো দরকার। সবকয়টা টিভি চ্যানেল ব্রেকিং দেখাচ্ছে।
নওশাদ স্মৃতিতে জাবর কাটে; “যেদিন আমি জেলে গেলাম, সন্ধ্যাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে…।“ “কী বলছিস নওশাদ,” আমি দৃঢ়ভাবে বাধা দেই, “তুই কোথায়?” “আমি তো সন্ধ্যার সাথে! ঐ যে দেখ, রাস্তায় সুনসান নীরবতা। পুলিশের টহলে বন্ধ হয়ে গেছে সব সারিবাঁধা শাটার। কোনও একটা বন্ধ শাটারের অবরুদ্ধতা ভেঙে ভেসে আসছে, “ও দুটি চোখ চিরদিন হয়ে থাক মোর গয়না…”
আরে সন্ধ্যাকে যেদিন কক্সবাজার নিয়ে গেলাম, নওশাদের চোখে অশ্রু নয়, গভীর অনুশোচনা। এবার আর নওশাদের মিথ্যাচার সহ্য হয় না আমার; পাগল হয়েছে ব’লে সন্ধ্যাকে নিয়ে যা তা বলবে? “তুই কোথায়?” “আমি তো, এইতো ইনানী বিচের বালুচরে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছি সন্ধ্যার সাথে।“ “আমি তো তুই না।“ সুদৃঢ় বিশ্বাসে প্রতিবাদ করি আমি।
নওশাদ এবার সান্ত্বনার স্বর রাখে আমার প্রতিবাদে। “জানিস্, সন্ধ্যা আজ মারা গেছে।“ “আরে সন্ধ্যা মারা গেছে মানে?” আমি নিয়ন্ত্রণহীন ক্রোধে ফেটে পড়ি। বিশ্বের সব সেরা সেরা হাসপাতালের সেরা ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করছি আমি। মাউন্ট এলিজাবেথে মেইল করেছি। কাল ভোরে সন্ধ্যা’র ফ্লাইট। সন্ধ্যা মারা গেছে বললেই হবে? আমি মূলত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। আমি এবং নওশাদ, কে আসলে কাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি!
১৯৭০ সনের ০৭ মে হবিগঞ্জে জন্ম। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে লেখালেখির মাধ্যমেই হাতেখড়ি। শুরুটা আরো অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগতকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ প্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ, একবগগা, খরখরে কিন্তু অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। গল্প লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন বৈশাখী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে সেরা গল্পকারের পুরস্কার, ফেয়ার এন্ড লাভলী সেরা ভালোবাসার গল্প পুরস্কার। ২০১৪ সাথে মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘তনুশ্রী পদক’। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তর্জাল সাহিত্য পোর্টালে লেখালেখিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী অনিরুদ্ধ কুমার ধর ও যমজ সন্তান অদ্বিতীয়া অভীন্সা পদ্য ও অদ্বৈত অভিপ্রায় কাব্যকে নিয়ে হবিগঞ্জে বসবাস করছেন।
মঞ্চে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা থিয়েটার প্রবর্তিত, ফওজিয়া ইয়াসমিন স্মৃতি পদক,থিয়েটার প্রবর্তিত জাকারিয়া পদক।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৫টি। নাটক ২ টি ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস সহ প্রকাশিত গ্রন্থ ৯টি।