জয়া শহীদ
পরিচালক, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।
হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে বললাম, ‘রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না।’
রুমী মুখ তুলে কী একরকম যেন হাসল। মনে হলো অনেক বেদনা সেই হাসিতে। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো জানি না, ভোগও করিনি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য, তিক্ততা-বিষ—সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না।’ (একাত্তরের দিনগুলি, পৃষ্ঠা-২০২)
কোনো আক্ষেপ নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাননি মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমী বীরবিক্রম। এই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন তাঁর মাকে ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট। এর পরদিনই গভীর রাতে বাবা, ভাই, বন্ধু, চাচাতো ভাইসহ রুমীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই সময় পাকিস্তানি জান্তার হাতে ধরা পড়ে ক্রাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম, মাসুদ সাদেক চুল্লু, আলতাফ মাহমুদ এবং তাঁর চার শ্যালক, আবুল বারক আলভী, আজাদ জুয়েল, বাশারসহ অনেকে। এমপি হোস্টেলে টর্চার সেলে নেওয়ার পর রুমী তাঁর বাবা, ভাইকে বলেছিলেন, ‘তোমরা কেউ কিছু স্বীকার করবে না। তোমরা কেউ কিছু জান না। আমি তোমাদের কিছু বলিনি। ভয়ংকর অত্যাচারেও একটি তথ্যও রুমীর কাছ থেকে বের করা যায়নি।’
এই অসীম সাহসী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইসলাম রুমীর আজ ২৯ মার্চ ৬৮তম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু রুমীর বয়স বাড়বে না, তিনি আমাদের কাছে কুড়ি বছরের তরুণই থাকবেন।
রুমী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৫১ সালে। কবি জালালুদ্দীন রুমীর মতো জ্ঞানী ও দার্শনিক হবে, এই ভেবে মা জাহানারা ইমাম ছেলের নাম রেখেছিলেন রুমী।
শৈশবে রুমী ছিলেন খুব দুরন্ত। স্বাস্থ্য ছিল খুব ভালো—অসুখবিসুখ হতো না। ছড়া/কবিতা শুনতে খুব ভালোবাসতেন। শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলতেন খুব দ্রুত। ছবি আঁকায়ও খুব ঝোঁক ছিল। অত্যন্ত মিশুক ছিলেন তিনি। রাস্তার অচেনা লোকদের ‘মামা’ বলে ডেকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন।
বাবার বদলির চাকরির সুবাদে দিনাজপুরে স্কুলজীবন শুরু হয়; কিছুদিনের মধ্যে শরীফ ইমাম ঢাকায় এলে আনোয়ারা মনসুরের আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন স্কুলে, তারপর সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ও পরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৬৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্টার মার্কস নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেন।
১৯৭০ সালে ডিসেম্বরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন। ক্লাস আরম্ভ হতে দেরি হওয়ায় বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস শুরু করেন। পাশাপাশি আমেরিকার ইলিনয় স্টেটের শিকাগো শহরে ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (IIT) ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চালায় হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে। আশপাশের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে মেশিনগানের গুলিতে অসহায় মানুষকে মেরে ফেলে। ২৫ মার্চের পর ঢাকা শহর ছিল নরকের মতো। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকে আগুন আর আগুন। গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার।
বাঙালিরা প্রতিরোধ শুরু করেন। রুমী যুদ্ধ যেতে চান। মাকে জানালে মা শুনে আঁতকে ওঠেন। কুড়ি বছর বয়সী একটি ছেলে যুদ্ধের কী বোঝে?
অনেকের মতো রুমী ও হয়তো মা-বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারতেন; কিন্তু লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করতে নেই। সে শিক্ষা তো মা-ই দিয়েছেন। মাকে বোঝাতে লাগলেন, ‘আম্মা, দেশের এই অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত; কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় কোনো ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা?
মা হার মেনে বললেন, ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।’
ছেলে যুদ্ধে চলে গেল। নিজেই গাড়ি চালিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেন মা। কিন্তু পথে ঝামেলার কারণে ফিরে আসতে হলো। সবকিছু ব্যবস্থা করে ১৪ জুন রুমী চলে যান যুদ্ধে।
মা প্রতীক্ষায় থাকেন ছেলের খবর জানার জন্য। কিছুদিন পরে ছেলের দুজন বন্ধু এসে জানায়, রুমী আছেন আগরতলার কাছাকাছি খেলাঘর নামের একটি জায়গায়, ২ নম্বর সেক্টরের আওতায়। খালেদ মোশাররফ ওখানকার সেক্টর কমান্ডার। রুমী ওখানে গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছেন।
খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের সব ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা নকশা চেয়েছেন। উদ্দেশ্য, এত ব্রিজ আর কালভার্ট ভেঙে পাকিস্তানি আর্মিদের যোগাযোগ ও চলাচলকে অচল করে দেওয়া বিচক্ষণ শরীফ ইমাম এটি করলেন।
এই চিন্তা করে সবচেয়ে কম ক্ষতি করে এ কাজটি করতে হবে, যাতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব সহজে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ ও কালভার্ট মেরামত করা যায়।
অত্যন্ত কঠিন কাজ। খুব সতর্কতার সঙ্গে শরীফ ইমাম তাঁর বন্ধু এস আর খান বাঁকা মিলে গোপনে এ কাজগুলো করেন। মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী ও হাবিবুল আলম এসে এগুলো নিয়ে যান।
মুক্তিযোদ্ধারা কেউ না কেউ ঢাকায় আসেন। শরীফ ইমাম জাহানারা ইমাম তাঁদের হাতে টাকা, ওষুধ, টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তাঁদের কাছেই খবর পান রুমী ভালো আছে। মা প্রতীক্ষায় থাকেন রুমী কবে আসবে।
৮ আগস্ট রুমী ঢাকায় আসেন। ছেলেকে ফিরে পেয়ে মায়ের প্রশ্নের শেষ নেই। ওখানে ওরা কোথায় থাকে, কী খায়?
রুমী জানান, টিলার ওপরে বেড়ার ঘরে, তাঁবুতে সবাই মিলে থাকে। খাবার বলতে ডাল, ভাত কখনো লাবড়া, কখনো মাছ। সকালের নাশতার রুটিতে মাঝেমধ্যে সেঁকা পোকাও পাওয়া যায়। এই খাবারও সব দিন জুটত না। গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে, মাঠ থেকে তরমুজ, বাঙ্গি, আনারস তুলে খেয়ে নিতেন।
রুমীদের দল ঢাকায় এসেছে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে।
রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধা বন্ধু হ্যারিস দিনের বেলা গুলশান লেকের ঘাট থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করতেন, যেগুলো পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অপারেশনে ব্যবহৃত হতো।
১৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ওড়ানোর জন্য রেকি করতে গেলে পাকিস্তানি আর্মিদের আক্রমণের মুখে পড়েন রুমীসহ অন্য গেরিলা যোদ্ধারা। তখন বদিউল আলম ব্রাশ ফায়ার করে পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দেন এবং এ যাত্রায় সবার প্রাণ রক্ষা পায়। শুধু জুয়েলের আঙুলে গুলি লাগে।
২৫ আগস্ট রুমী পাঁচ বন্ধুসহ ধানমন্ডির ১৮ নম্বর এবং ৫ নম্বর রোডে দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন সম্পন্ন করেন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাকিস্তানি আর্মি হত্যার পর পালানোর সময় পাকিস্তানি আর্মির একটি জিপ তাঁদের অনুসরণ করলে রুমী তাঁর স্টেনগানের বাঁট দিয়ে পেছনের কাচ ভেঙে ফায়ার করলে চালক গুলিবিদ্ধ হয় এবং জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। রুমীর দ্রুত সিদ্ধান্তের দক্ষতায় সেদিন সব যোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়।
রুমী খুব বেশি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে রুমীর সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা কতগুলো অ্যাকশন করেছে, সেটা বড় কথা নয়। যদি একটি অ্যাকশনে সে সাহস এবং বীরত্ব দিয়ে সফল হতে পারে, সেটাই বড় কথা। রুমী ঢাকার অ্যাকশনে অনেক বেশি সাহসের পরিচয় দিয়েছিল।’
পাকিস্তানি জান্তারা রুমীর বাবা, ভাই, বন্ধু, চাচাতো ভাইকে ছেড়ে দিলেও রুমীকে ছাড়ে না। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে রুমীদের গেরিলা অপারেশনের সব খবরই ছিল। রুমী শুধু ২৫ আগস্ট রাতের অপারেশনের কথা স্বীকার করেন। ভয়ংকর অত্যাচার চালিয়ে ওরা তাঁর কাছ থেকে আর কারও নাম জানতে পারেনি। ছেলের মাথা যাতে হেঁট না হয়, সে জন্য রুমীর প্রাণ ভিক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেননি মা-বাবা।
৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, সেটা পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেরই পছন্দ ছিল না। তাই এর আগের রাতে অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর তাড়াহুড়ো করে শ খানেক বন্দীকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। ধারণা করা হয়, ৪ সেপ্টেম্বর রুমী শহীদ হন।
২৯ মার্চ, ১৯৭১-এ রুমির জন্মদিনে জাহানারা ইমাম ও শরীফ ইমাম আশীর্বাদ লিখেছিলেন, ‘বজ্রের মত হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠ, দেশের অপমান দূর কর, দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসাবার দুরূহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো।’
শহীদ শাফী ইমাম রুমী তা-ই করে গেছেন। পরাধীন, অত্যাচারিত দেশকে মুক্ত করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, রুমী চিরকাল সব প্রজন্মের প্রেরণার অফুরন্ত উৎস। জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি হে বীরযোদ্ধা।