| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

রুম্পার পিএসসি ইন্টারভিউ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

`How features are abroad
I am skilless of, but, by my modesty, 
The jewel in my dower, I would not wish 
Any companion in the world but you, 
Nor can imagination form a shape
Besides yourself to like of (III.ii.).’

দূর- ‘দ্য টেম্পেস্ট’-এ মিরান্ডার সংলাপ মুখস্থ করা ছেড়ে রুম্পাকে কিনা এখন নবম শ্রেণির পাটিগণিত করতে হচ্ছে। ‘একটি তৈলাক্ত বাঁশ বাহিয়া বানরটি এগারো হাত উঠিয়া আবার দুই হাত নামিলো’ থেকে শুরু করে ভুলে যাওয়া যত ঐকিক, ল.সা.গু. বা গ.সা.গু.- এসব কি পোষায়? কি আর করা? সামনে বিসিএস। এছাড়া আছে ইথিওপীয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালার নাম মুখস্থ করা, পৃথিবীর বৃহত্তম ব্রিজ বা ক্ষুদ্রতম পাখির নাম মুখস্থ করা। মাস্টার্সের পরই প্রথমবার বিসিএস দেবে কিনা এটা নিয়ে খুবই সংশয়ে ছিল রুম্পা। ঢাকা ভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী মানে বাজারে চাকরি কিছু মিলবেই। ইউএনডিপির একটি প্রজেক্টে হুট করে হয়েও গেল তার। তবে, সেখানে রুম্পার বস কিনা ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইতিহাসে পাশ করা। রুম্পা মাস ছয়েক খুব মন দিয়ে অফিসের লেখালিখির যাবতীয় কাজ ইংরেজিতে করতে থাকে, মিটিংয়ে ডোনারদের সাথে বাত-চিত করে। তবে দ্রুতই রুম্পাকে খুবই অবাক করে দিয়ে তারই তৈরি করে দেয়া প্রেজেন্টেশন বা রিসার্চ রিপোর্ট নিয়ে অফিসের এমন সব মানুষ আজ ব্যঙ্কক কি কাল সুইজারল্যান্ড ট্রেনিংয়ে যায়, তাদের এমনকি বাংলা লেখাও খুব সুবিধার নয়। বস উল্টো তবু রুম্পাকেই সবসময় খড়গের উপর রাখেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রুম্পা তার জীবনের প্রথম চাকরিতেই সত্তর হাজার টাকার বেতনের কাজে এক বিকেলে সহসা রেজিগনেশন লিখে এসে বাসায় ফিরে হিস্টিরিয়া রোগীর মত আচরণ করতে থাকে। দ্বিতীয় চাকরিটা খুবই অদ্ভুত…সত্তর হাজারের কাছ ছেড়ে বাড়ির পাশে একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে পনেরো হাজার টাকায় ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিল রুম্পা। তিন মাস ভালই গেল। তিন মাস পর ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে বললো যে যে ছাত্র-ছাত্রীকে সে ফেল করিয়েছে, তাদের যেন সে পাশ করিয়ে দেয়।
‘পাশ করবো মানে? আমার ত’ ধারণা ছিল যে পাবলিক ভার্সিটিতে আমরা মিডল ক্লাস ঘরের ছেলে-মেয়ে। আমাদের চেয়ে প্রাইভেট ভার্সিটিতে আপার ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি অন্তত: ভুল হবে না। এত ভুল লিখেছে সব এক/এক জন!’
‘ইসরাত- আপনি খামোকা আর্গ্যু করছেন কেন?’
এভাবেই দুই কথা দুই কথায় চার কথা হয়ে উইলো প্রাইভেট ভার্সিটির গভর্ণিং বডির সাথে ইসরাত ওরফে রুম্পার এমন লাগা লাগলো যে সেই চাকরিই ছাড়তে হলো তাকে।
‘আমার মনে হয় এবার তুই বরং বিসিএস দে।’
‘না- আব্বু- এই তুমি যেমন ঘুষ খেতে পারো না বলে সারাজীবন আম্মা শুধু ঘ্যান ঘ্যান করে গেল। আম্মুকেও ত’ আসলে কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়েছে। বিসিএস দিয়ে কি হবে?’
‘শোন্- তিন মাস দুই লাখ টাকাই আয় করলি। তারপর ছেড়ে দিলি বা ছেড়ে দিতে হলো। এর চেয়ে সারা জীবন কুড়ি হাজার টাকার চাকরি করাই কি ভাল না? প্রাইভেট জব তোর জন্য না। তুই এ জাতীয় জব ট্যাকল করার মত যথেষ্ট পরিমাণ স্মার্ট বা চালাক-চতুর না। শুধু মেধা বা পরিশ্রম দিয়ে প্রাইভেট জব চলে না।’
‘সেটা অবশ্য ঠিকই।’
‘তোর কষ্ট করতে হবে না। কাল আমিই তোর জন্য বিসিএস গাইড কিনে আনব অফিস থেকে ফেরার সময়।’
এই শুরু হলো শেক্সপীয়র থেকে জোসেফ কনরাডের বই সব একপাশে সরিয়ে রেখে পৃথিবীর নানা দেশের মুদ্রা, রাজধানী, রাষ্ট্রপ্রধানদের নাম মুখস্থ করা। মাঝে মাঝে কান্না পায় রুম্পার। ভাল লাগে না এত বিরক্তিকর পড়া-শুনা। তাও কিনা এই ছাব্বিশ বছর বয়সে। তবে, চোখের সামনে একটা নতুন স্বপ্নও দেখা দিয়েছে তার। ইংরেজি ত’ সে মোটামুটি অনর্গল বলতে পারে। বিসিএসে আর ফরেন সার্ভিসেই বরং চেষ্টা করবে সে।

 

২.

বিসিএসে প্রিলিমিনারি আর লিখিত- এই দু’টো পরীক্ষাতেই মোটামুটি ভালভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছে রুম্পা। এখন সামনে ভাইভার প্রস্তুতি। যেহেতু তার প্রথম পছন্দ সে দিয়েছে ফরেন সার্ভিস, সারাদিনই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বই-পত্র পড়তে হয় তাকে। আর এই কয়েক মাসের ভেতরে দেশে বেশ বড়সর কিছু বদলও হয়েছে।
‘একদিক থেকে ভালই হয়েছে, আব্বু। দুই দলের কেউই ক্ষমতায় নাই।’
‘কিন্ত সেটা ত’ মুস্কিলও।’
‘কেমন?’
‘ধর- একদল ক্ষমতায় থাকলে ফারাক্কা, টিপাইমুখ, সীমান্তে হত্যা নিয়ে ইন্টারভিউয়ে প্রশ্ন বেশি আসবে আর একদল ক্ষমতায় থাকলে জেনেভা কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞা কি এমন প্রশ্ন আসবে। যেহেতু এমূহুর্তে এই দুই দলের কেউই ক্ষমতায় নেই আর জলপাই উর্দিরা বিশেষ করে এবারের জলপাই উর্দিঅলারা ঠিক কোন দিকের উর্দি এটা যেহেতু আমরা কেউই বুঝতে পারছি না- এটা আরো সমস্যা।’
‘তাহলে কি হবে?’ রুম্পা নার্ভাস হয়।
‘আপাতত: দু’দিকের পড়াই পড়তে থাক। পাকিস্থান কেন বিহারীদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না পড়তে থাক, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যও পড়। আবার ঐ ফারাক্কা, টিপাইমুখ বা সীমান্তে হত্যা নিয়েও পড়। খুব ঠান্ডা মাথায় ভাইভা বোর্ডে সব উত্তর দিবি মা! খুব স্ট্র্যাটেজিক্যালি। প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের ধরণ শুনেই বুঝতে পারবি কে কোন্ দিকের, কে কোন্ পক্ষের? সেটা বুঝে যত ট্যু দ্য পয়েন্ট, যত অবজেক্টিভলি উত্তর দেয়া যায় দিবি। বাকিটা আল্লাহ্ভরসা!’

 

৩.

কালই ভাইভা। বিকেলে অরিত্রী আপু এসে ওনার ইন্টারন্যাশনাল ল’-এর কিছু নোট দিয়ে গেছেন। ‘ল অফ দ্য সী’ বা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন নিয়েও কিছু প্রশ্ন আসতে পারে ভাইভা বোর্ডে। অতীতে এই ভাইভা বোর্ড ফেস করা এক বড় ভাই জানিয়েছেন।
‘এত নার্ভাস কেন? তুমি ত’ ভাল ছাত্রী!’
‘কি জানি আপু! অন্যান্য সময় ত’ বোঝা যায় সরকার কোন্ পক্ষের? সেই অনুযায়ী প্রশ্ন হয়। এক পক্ষ ক্ষমতায় থাকলে ধরা যাক মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে কোন  দুই দেশ এমন প্রশ্ন আসবে। আর এক পক্ষ ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য অসাম্য কত এ বিষয়ে প্রশ্ন আসবে। এখন কারা আসলে দেশ চালাচ্ছে সেটা ত’ বোঝা যাচ্ছে না।’
‘হুম্- সত্যিই কিছু বুঝছি না। সে যাক। আমি আসি রুম্পা।’
‘আপনার কাজ যেমন চলছে?’
‘এই কিছু দিন লাখ টাকা কামাই আবার কিছুদিন বেকার থাকি। সরকারী চাকরির পরীক্ষা ত’ দিলাম না। তোমরা ত’ তা-ও মাত্র চার ভাই-বোন। আমাদের অনেক ভাই-বোনের সংসারে বাবা ঘুষ খেতে পারতেন না- বাবার পিওনের বাসায় দাওয়াতে গেলে দেখতাম আমাদের বাসায় তখনো ফ্রিজ নেই, পিওনের বাসায় ফ্রিজ। সো- যে ডিসিশন নেওয়া হয়ে গেছে ত’ গেছে। এখন এভাবেই চলছে আর কি!’
‘হুম্- সাবধানে এসেন।’
‘বাসা থেকে আসার পথে দেখলাম রাস্তা-ঘাট এমনিতে পরিষ্কার। জ্যাম নেই। তাই বলে সেনা শাসনকে ত’ সমর্থন করা যায় না।’
‘আর আব্বু ত’ বলে এই জলপাই উর্দি ঠিক কোন্ পক্ষের জলপাই উর্দি তা’ বলা যাচ্ছে না। তাহলেই বোঝেন কি বিপদ!’
রাতে কেমন এলোমেলো ঘুম হলো রুম্পার। স্বপ্নে সে দেখলো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের নুড়ি পাথরে পা রেখে সে হাঁটছে আর নগ্ন দুই পায়ের পাতা তার বিক্ষত হয়ে উঠছে রক্তে। সামনে দু’টো নৌকা আর একটা আধাভাঙ্গা জাহাজ।
‘কন্টিনেন্টাল শেলফ- ইইজেড অর এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন- ডিমারকেইশন অফ সী’-
‘কি বিড়বিড় করছিস?’ আম্মু এসে রুম্পাকে ঘুম থেকে ধাক্কা দিয়ে তোলে।
‘সাতটা বেজে গেছে। ওঠ্- গোসল কর। শাড়ি পরে যাবি না সালোয়ার-কামিজ? শাড়ি পরলে ত’ তুই ভাল পরতে পারিস না। আমাকেই পরাতে হবে।’
আব্বু দরজার ওপাশ থেকে মাথা গলায়।
‘শাড়ি পরেই যা। ফরেন সার্ভিসের ভাইভা মানে বিদেশে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করা। তোর গত জন্মদিনে যে লাল-সবুজ জামদানিটা দিয়েছিলাম না ওটা- হ্যাঁগো- ওকে আয়রণ করে দাও না!’
‘যাচ্ছি আয়রণ করতে। তুই রেডি হ। মাছের ঝোল-ভাত হয়ে গেছে।’

 

৪.

লাল-সবুজ জামদানি পরে, আয়নায় ভেজা চুল আঁচড়াতে গিয়ে রুম্পা নিজেই নিজেকে চিনতে পারেনা। এমনিতে সে একেবারেই মেক আপ করেনা। লিপস্টিক কেন, কাজলও মাখে না চোখে। পুরু চশমা পরে। তবু শুধু শাড়ি পরেই নিজেকে একদম অন্যরকম লাগছে।
নাকে-মুখে মাছ-ভাত খেয়ে, বাবার সাথেই সিএনজি ভাড়া করে পিএসসি-তে ভাইভা রুমের সামনে পৌঁছে গেল রুম্পা। সিরিয়ালে সে পাঁচ নম্বরে। সময় লাগবে কিছু। বাবা গতকাল খোঁজ-খবর নিয়েছেন। এবার দুই দলেরই দু’জন দু’জন চারজন ভাইভা বোর্ডে মূল প্রশ্নকর্ত্তা হিসেবে আছেন। রুম্পা যেন প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে খুব সতর্ক থাকে, খু-ব।
কল এলো প্রায় সোয়া বারোটার দিকে। ফরেন সার্ভিসের ভাইভা। প্রশ্নোত্তর সবই ইংরেজিতে।
‘ওয়েলকাম ইয়াং লেডি! কনগ্র্যাটস ফর পাসিং ইন দ্য রিটেন এক্সাম। ইন্ট্রোডিউস ইওরসেল্ফ।’
রুম্পা হাসিমুখে তার নাম, কোন্ ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করেছে সেসবই বলে।
‘সো ইসরাত…টেল আস সামথিং এ্যাবাউট ইওর পার্সেপশন অন দ্য বার্থ অফ বাংলাদেশ এ্যাজ আ নেশন!’
খাইছে! রুম্পার বুক ধড়ফর করে ওঠে। ভাইভা বোর্ডে দু’পক্ষের দু’জন দু’জন চারজন। কি বলবে সে? ৭ই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দান থেকে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন বলে অন্য দু’জন নম্বর কমিয়ে দেবে? আর ২৬শে মার্চ বেতারে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার বিবৃতি পাঠ করেছেন বলে অন্য দু’জন রেগে যাবে? কড়া এসির ভেতরেও রুম্পার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।
‘ডিয়ার স্যার…বাংলাদেশ হ্যাজ এচিভড হার ফ্রিডম থ্রু আ নাইন মান্থস লং ব্যাটল অফ স্যাক্রিফাইস এ্যান্ড ব্লাডশেড…দিস ল্যান্ড অফ গ্রিনস, ল্যান্ড অফ রিভারস, ল্যান্ড অফ মাইটি বে অফ বেঙ্গল হ্যাড টু পে ভেরি হার্ড প্রাইস ফর হার ফ্রিডম!’
দারুণ। রুম্পা নিজেই বুঝতে পারে সে তার পথ পেয়ে গ্যাছে। বাংলাদেশ যে শাপলা-শালুকের দেশ…ল্যান্ড অফ ওয়াটার লিলিস…গান ও কবিতার দেশ…ল্যান্ড অফ সংস এ্যান্ড পোয়েমস…গড়গড় করে পাঁচ মিনিট দিব্যি চলে যায়।
‘গুড। ইওর ইংলিশ ইজ গুড। নাউ দ্য সেকেন্ড কোশ্চেন ইজ…’
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন। কোন ব্যাপার? পড়া ত’ আছেই। বহু দূরের একটি বিষয়ে প্রশ্ন। ফারাক্কা বাঁধ না, বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়া না, গণহত্যার সংজ্ঞাও না।
ভাইভাবোর্ডের লোকগুলো যেন দয়ালু দেবদূতের মতই নানা বিপত্তিকর প্রশ্ন এড়িয়ে এরপর জাতিসঙ্ঘের গঠনতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন করে। রুম্পা সেসবেরও মসৃণ জবাব দিতে থাকে। যেমন জবাব দিতে হয় একজন কূটনীতিক হবার অভিলাষী তরুণকে। কূটনীতিক কি নন সেই মাছের মত যিনি পিচ্ছিল কাদার ভেতরেও আটকে না গিয়ে সরে যেতে পারবেন?

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত