অনুবাদ গল্প: শখ-রুথ রেন্ডেল । অনুবাদক: সানজিদা হক
লেখক পরিচিতি: ইংরেজ ঔপন্যাসিক রুথ বারবারা রেন্ডেল, যিনি ব্যারোনেস রেন্ডেল অফ বাবার্গ CBE, ১৯৩০ সালে যুক্তরাজ্যের এসেক্সে জন্মগ্রহণ করেন, মারা যান ২০১৫ সালে। তিনি জনপ্রিয় থ্রিলার এবং মনস্তাত্ত্বিক, হত্যা রহস্য বিষয়ক লেখাগুলোর জন্য। বারবারা ভাইন ছদ্মনামেও তার উপন্যাস রয়েছে। তার সৃষ্ট ‘ইন্সপেক্টর ওয়েক্সফোর্ড’ চরিত্রটির জন্য তিনি সবচেয়ে বেশী পরিচিত এবং এই চরিত্র নিয়ে গল্পগুলোর সিরিজ সফলভাবে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে। তিনি ‘ক্রাইম রাইটার্স এসোসিয়েশন’, ‘মিস্ট্রি রাইটারস অফ আমেরিকা’ সহ অন্যান্য সংস্থা কতৃক নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
অনুবাদকৃত গল্প ‘অ্যান আইটসাইড ইন্টারেস্ট’ তার ‘দ্যা ফিভার ট্রী’ শিরোনামের গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।
আমার শখ ছিলো মানুষকে ভয় দেখানো। আসলে সেটা ছিলো এক ধরণের অবশেসন এবং মানুষজন না বলে আরো নির্দিষ্ট করে বলা উচিৎ শুধুমাত্র নারীদের কে।
অন্যকে ভয় দেখানো একটা মজার বিষয়, এটা তারাই বোঝে যারা সফলতার সাথে কাজটি করতে পারে। মনে হয় ক্ষমতার সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে। বেশীর মানুষই সত্যিকার অর্থে চেষ্টা করেনা তাই তারা জানেওনা, কিন্তু যারা করে তাদেরকে দেখুন। বিচারক, পুলিশ, কারারক্ষী, কাস্টম অফিসার, ট্যাক্স ইন্সপেক্টর। উনারা দারুণ সময় কাটান তাই না? তাদেরকে কখনো অন্য কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে দেখবেন না। মানুষকে ভয় পাওয়ানো তাদের মগজে ঢুকে আছে, তারা এতে মাতাল হয়ে থাকেন, তারা ভয় দেখিয়েই বাঁচেন। আমিও তেমন। অন্যপুরুষ মানুষকেউ হয়তো পাবে যান বা ছেলেদের নিয়ে ফুটবলে, আর আমি যেতাম ‘এপিং ফরেষ্টে’ মহিলাদের ভয় দেখাতে। এটাকে আপনারা একধরণের অবসর বিনোদন বলতে পারেন।
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি যা করতাম সেখানে এমন কিছু ছিলো না—মানে, নোংরা কিছু। আপনারা জানেন আমি কি বোঝাতে চেয়েছি, আশা করিবিস্তারিত বলতে হবে না। আপনাদের বলতে পারি আমি মোটেও বিকৃতমনা না বরঞ্চ বলা যায় আমি কঠোর নীতিবাদী। আমি একা, বঞ্চিত ধরণের লোকও না। আমি বিবাহিত জীবনে সুখী এবং একটি ছোট ছেলের বাবা, উচ্চতা ছয় ফুট, দেখতে মন্দ না এবং আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি আমি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে পুরাপুরি সুস্থ।
অবশ্যই আমি আমাকে বোঝার এবং আমার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার শখটি কি আমার একঘেয়েমী দূর করার প্রতিষেধক ছিলো? অন্যদের সাথে তুলনা করলে আমার জীবন নিষ্প্রভবলাযায়। ‘এঙ্গলো-মেরিকান এয়াওয়েজের’ টার্মিনালে টিকেট বিক্রি করা, যাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, ‘মাজ ওয়েল হিলের’ তিন বেডরুমের বাসা, রবিবার গুলোতে শ্বাশুড়ির সাথে চায়ের দাওয়াত এবং ‘সাউথডেভনের’ ফ্ল্যাটগুলোতে পনের দিনের বাৎসরিক ছুটি কাটানো।বিয়ে করেছি খুব অল্প বয়সেই।আমার জীবনে এডভেঞ্চার নামের কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিলোনা। বড় ধরণের ঘটনা একটাই ছিলো যখন ভাবা হয়েছিলো আমাদের একটি বিমান গ্রীসে হাইজ্যাক হয়েছে। সেটা আসলে ভুল সংকেত ছিলো।
আমার স্ত্রী একটু ভীতু প্রকৃতির মেয়ে।মনে রাখবার তার সঙ্গত কারণও ছিলো,যেহেতু আমরা ‘হাইগেইটউড’ এবং ‘কুইনসউডের’ কাছাকাছি থাকতাম। একজন মহিলা এই জায়গাগুলোতে একা একা চলাচল করতো তার জীবন হাতে নিয়ে। ক্যারোল ঘটা করে গল্প শোনাতো—এখনো শোনায়।
‘বিকাল পাঁচটা বিশে! একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে। লোকটা মহিলাটিকে ধর্ষণ করে আর চেহারাতেও কাটাছেঁড়া করেছে। তার মুখে আর ঘাড়ে সতেরোটি সেলাই লেগেছে।’
আমার স্ত্রী গাড়ী চালায় না। কোথাও গেলে যদি সন্ধ্যা হয়ে যায় তাহলে ওকে আনতে আমার বাস স্টপে থাকতে হয়। এমনি ‘মাজওয়েল হিলের’রাস্তাতেও হাঁটবেনা দুইপাশে বন থাকার কারণে।
‘এরকম জায়গায় যদি একা কোন লোক দেখো তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই তোমার মনে হবে সে ওখানে কি করছে। একটা কমবয়সী লোক উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটছে। এমন না যে তার সাথে কুকুর আছে। তখন তোমার শরীর শক্ত হয় আসে। এক ধরণের ভীতিকর শিরশিরে অনুভূতি হয় সমস্ত শরীরে। তুমি যদি আমাকে না নিতে আসতে তাহলে আমি মনে হয় কখনো বেরই হতাম না।‘
সেসময়ই কি আমার মাথায় চিন্তাটা এসেছিলো? যাই হোক না কেন এটা আমাকে নারী এবং ভয় পাওয়া নিয়ে ভাবায়। একজন পুরুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা একদম আলাদা ধরণের, সে অন্ধকারে নয়তো নিরিবিলি জায়গায় ভয় পাওয়ার কথা চিন্তাই করেনা। আমি জানি যে আমি করিনি তাই বাইরে একা থাকা অবস্থায় মহিলাদের এই ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা যে কতটুকু গুরুতর তা ক্যারোলের কাছ থেকে বোঝার আগ পর্যন্ত কখনো ভাবিনি। পুরো বিষয়টা বোঝার পর এক ধরণের হাস্যকর উত্তেজনার অনুভূতি হয়ছিলো।
এবং এরপরই আসলে আমি একজন মহিলাকে ভয় দেখিয়েছিলাম—হঠাৎ করেই।আমি সচরাচর কাজে যাই ‘কুইনসউডের’ ভিতর দিয়ে ‘হাইগেইট টিউব স্টেশন’ পর্যন্ত এরপর নর্দান লাইনের ট্রেন ধরে লন্ডন। আবহাওয়া বেশী খারাপ হলে স্টেশনে যাই বাসে করে। তবে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলাচলের সংক্ষিপ্ত রাস্তাটিই আমার জন্য সুবিধাজনক।
মার্চের কোন এক সন্ধ্যা ছয়টায় জঙ্গলের রাস্তা ধরে ফিরছিলাম। গোধূলী সময়, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো। রাস্তার লাইটগুলো যেগুলো একটা থেকে আরেকটা বেশ একটু দূরেই অবস্থিত, জ্বালানোই ছিলো। কিন্তু আমি প্রায়ই চিন্তা করে দেখেছিএগুলো বরং অন্ধকার জায়গাগুলির থেকে বেশী ভীতিকর আর অশুভ পরিবেশ তৈরী করে। একটা লাইটপোস্ট পার হওয়ার পরে পরবর্তী লাইটপোস্ট যেটা প্রায় একশ গজ দূরে হালকা আলো দিচ্ছে, সেটা পর্যন্ত যেতে মাঝের হালকা ছায়া ছায়া রাস্তা পার হতে হয়। এবং পৌঁছানোর পর দেখা যায় এসিড হলুদ রঙ্গা আলো নগ্ন ডালপালায় জ্বলজ্বল করছে এবং এরপর আবার পরবর্তী অন্ধকার রাস্তাটুকু পার করার বোঝাপড়া করতে হয়। আমি চিন্তা করতাম বনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে একজন নারীর কেমন লাগবে এবং হ্যাঁ আমি আমার পৌরুষ এবং ভয়হীনতা নিয়ে গর্বিত ছিলাম।
তখন একটা মেয়েকে আসতে দেখলাম। সে ‘প্রাইয়োরী গার্ডেন্স’ থেকে আসা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো। আমার মাথায় এলো আমি যেভাবে দ্রুত হাঁটছিলাম ‘উড ভেইলের’ দিকে, সেটা যদি বজায় রাখি, বাসায় পরিবারের কাছে ফেরার, রাতের খাবার খাওয়ার তাড়া আছে এরকম একজন মানুষের মতো তাহলে মেয়েটির সতর্কতা কম থাকবে । আসলে তখন পর্যন্তও নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য ছিলোনা যখন আমার গতি কমিয়ে ফেললাম, তারপর থেমে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই বুঝলাম আমাকে এভাবেই চালিয়ে যেতে হবে। মেয়েটি চলে আসলো যেখানে রাস্তাগুলো একত্রিত হয়েছে এবং একটা লাইটপোস্টও ছিলো। সে একবার চকিত চোখে আমাকে দেখলো। আমি খুব শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম আর তার দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকালাম। সম্ভবত সচেতনভাবে শয়তানী উদ্দেশ্যই চোখদুটো একদম স্থির আর চকচকে হয়ে গেলো, আমার মুখ ঝুলিয়ে ফেললাম।
যাই হোক, মেয়েটি দ্রুত ঘুরে গেলো এবং আগের থেকে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। তার পায়ের উঁচু হিলের জুতার কারণে বেশী জোরে যেতে পারছিলোনা। আমি তার পিছনে পিছনে যেতে লাগলাম। গজখানেক বাকি থাকতেই তার কাছাকাছি চলে গেলাম। আমি তার ভয়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সে প্রচুর পরিমাণে সুগন্ধি লাগিয়েছিলো, তার ঘাম যেনো সেটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।আমি থেকে থেকে জান্তব আর ফুলের ঘ্রাণ মেশানো গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমি সেটাকে গভীর ভাবে নিশ্বাসে নিচ্ছিলাম। সে দৌড়ানো শুরু করলো আমিও জোরে হাঁটতে লাগলাম। তারপর সে যেটা করলো তা ছিলো একদম অপ্রত্যাশিত। সে থামলো, ঘুরে দাঁড়ালো, কাঁপাকাঁপা আতঙ্কের গলায় চিৎকার করে বললো: ‘আপনি কি চান?’
আমিও থেমে গেলাম আর তার দিকে আগের মতোই তাকিয়ে রইলাম। সে তার হাতব্যাগ আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ‘নিন এটা!’
মশকরা অনেক দূর গড়িয়েছে। যাই হোক আমার বাসা কাছেই তাছাড়া বউ বাচ্চার কথাও ভাবনায় ছিলো। আমি ককনী উচ্চারণে বললাম, ‘তোমার ব্যাগ রাইখ্যা দাও সোনা। আমারে তুমি ভুল ভাবতেছো।‘
এবং তারপর তাকে আশ্বস্ত করতে রাস্তা ছেড়ে পিছিয়ে গেলাম আর তাকে ‘উড ভেইলের’ আলো আর ঘরবাড়ীর দিকে পালিয়ে যেতে দিলাম। কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না কেমন একটা ক্ষমতার দাপট আমি অনুভব করছিলাম—মানে একধরণের বিজয়ী, গর্বিত পৌরুষত্বের অনুভূতি। আমি অসাধারণ অনুভূতি নিয়ে দেমাগী চালে বাসায় ঢুকলাম আর ক্যারোল জিজ্ঞেস করলো আমি কোন লটারী জিতেছি কিনা?
যেহেতুসততার সাথে সবকিছুর বিবরণ দিচ্ছিতাই জঙ্গলে ঐদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটা আরেকটি বিষয় জানাতে চাই, যদিও এই ধরণের কিছু বলা আমার প্রবৃত্তিরবিরুদ্ধে। সেই রাতে ক্যারোলের সাথে বলা যায় অনেক দিন পর পুলক জাগানো ভালোবাসাবাসি করেছিলাম যেটাদুজনের জন্যই উপভোগ্য ছিলো। আমি ভালো করেই জানতাম এটিহয়েছে ঐ মেয়েটার সাথে করা এডভেঞ্চারটির কারণেই।
পরেরদিন লাইট বন্ধ করে ঘরের চারকোনা আয়নায় নিজেকে খেয়াল করলাম এবং মেয়েটির দিকে যেভাবে তাকিয়েছিলাম সেই অভিব্যক্তি দিলাম। আপনাদের বলি, আমি নিজেই প্রায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আগেই বলেছি আমি দেখতে খারাপ না তবে প্রকৃতিগত ভাবে শুকনা আর ফ্যাকাশে, ফলে আমার মুখমন্ডল কোনাকৃতি আর কৃশকায়। আবছা আলোয় মনে হচ্ছিলো চোখ দুটো গর্তে ঢুকানো আর ঝুলে যাওয়া মুখে কেমন একটা ফাঁকা, নির্বোধ ভাব। পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে পুরোটা দেখলাম, কাঁধ কুঁজো, স্থির দৃষ্টি, হাত ঝুলে আছে দুইপাশে।কোন সন্দেহছিলো না যে আমার ভিতরে নারীদের ভীতসন্ত্রস্তকরার সুপ্ত সম্ভাবনা আছে।
বলা হয় সুন্দর শুরু মানে অর্ধেক সাফল্য। প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয়টি ছিলো আরো বড় এবং এটা করতে সপ্তাহখানেক লেগে গিয়েছিলো। বারবার নিজেকে বলতাম, বোকার মতো কাজ করোনা, এসব পাগলামি ছাড়ো। তাছাড়া এটাও জানতাম আমার বাড়ীর দোরগোড়ায় এই কাজটাকে অভ্যাসে পরিণত করলে অচিরেই বিপদে পড়ে যাবো। কিন্তু আমি এটা নিয়ে ভাবা বন্ধ করতে পারছিলাম না।মনে পড়ছিলো সেই সন্ধ্যায় কতো চমৎকার লেগেছিলো, মাথা উঁচু করা একটা সত্যিকারের পুরুষের মতোই নিজেকে মনে হচ্ছিলো।
কৌতুককর বিষয় ছিলো যে প্রথম ঘটনা এবং এর পরবর্তী ঘটনার মাঝে আমার সাথে বেশ কিছু অপমানজনক কাহিনী ঘটে।বিমানের টার্মিনালে এক মহিলা আমাকে থুথু দেয়। একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। অবশ্যই সে মাতাল ছিলো, শুল্ক-মুক্ত স্কচে তার মাথা স্থির ছিলোনা কিন্ত সে আমাকে থুথু দেয়, আর আমাকে টিকেট হলের মাঝখানে, টুরিস্টদের ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এবং ইউনিফর্ম থেকে থুথু মুছতে হয়। তারপর একজন যাত্রীর সাথে অভব্য আচরণের জন্য আমাকে তিরস্কার করা হয়।সেটা ছিলো আমার সাথে সম্পূর্ণ একটি অন্যায্য আচরণ।সত্যি কথা বলতে আমি তক্ষুনি চাকরী ছেড়ে দিতাম কিন্তু স্ত্রী-সন্তান আছে আর নতুন করে চাকরী পাওয়াটাও সহজ নয়। এর উপর বাড়ীতেও শুরু হয়েছে ঝামেলা। ক্যারোল ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে সে এবারের বাৎসরিক ছুটি নতুন জায়গায় তার বান্ধবী শিলা আর তার বর মাইকের সাথে কাটাবে। আমি সোজা বলে দিয়েছি এতো খরচ করা আমার পক্ষে সম্ভব না,বরং উল্টো শুনতে হলো কেন আমি মাইকের মতো উপার্জন করতে পারিনা।
আমার পুরুষত্ব একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। এরপর শিলা আর মাইক আমাদের দাওয়াত দিলো ওদের সাথে সময় কাটাতে। ওরা আগে প্রতিবেশী ছিলো এখন তারা ‘এসেক্সে’ নতুন বাড়ীতে উঠেছে। তো ড্রাইভ করে আমি, ক্যারোল আর টিমোথি যাত্রা করলাম আর আমার সাথে ‘এপিং ফরেস্টের’ পরিচয় ঘটলো।
লন্ডনের উত্তর-পূর্ব সীমানা বরাবর ৬৪ স্কয়ার মাইলের জঙ্গল। গাছ-গাছালি ঘেরা জায়গাটি দিয়ে ড্রাইভ করার সময় মনে হয় যেনো ক্রমশ গ্রামের ভিতরে চলে যাচ্ছি অথচ লন্ডন মাত্র১৪-১৫ মাইল দূরেই। জঙ্গলটি সবুজ আর নীরব। গাড়ী থেকে দেখলে যেরকম কলুষতাহীন মনে হয় অবশ্যই সেরকম হবে না। এক মহিলাকে পার হয়ে গেলাম যে কিনা ছোট একটি নিরীহ ধরণের টেরিয়ার কুকুর নিয়ে হাঁটছিলো—সেটা দেখে আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেলো। আমি কেনো এখানে চলে আসিনা? কেনো আমার ভয় দেখানোর চেষ্টা এখানে করিনাযেখানে কেউ আমাকে চেনেনা?
দুই দিন পর সেটা আমি করি। তখন বসন্তকাল। প্রায় আটটা পর্যন্ত আলো থাকতো। গাড়ী নিয়ে যাইনি। কারণ মনে হয়ছিলো যে ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার অভিনয় করবো তার গাড়ি থাকবে। ভ্রমণটা খুবই বাজে ছিলো। আমার মতো দৃঢ় সংকল্প না থাকলে যে কেউ পিছিয়ে যেতো। বহু ভাবে সেখানে পৌঁছে একটা পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে ফুটপাথে না যেয়ে জঙ্গলের কয়েক গজ ভিতরে থাকলাম। ‘থেইডানের’ বাড়ীগুলোর কাছাকাছি যেয়ে ফিরতি পথ ধরার আগ পর্যন্ত কোন একা মহিলা চোখে পড়েনি। প্রায় একশ গজ যাওয়ার পর মেয়েটি শেষ মাথার বাড়ীগুলির একটা থেকে বের হয় এলো। মেয়েটি অল্পবয়সী, পরনে জিন্স আর জ্যাকেট, হাতদুটো পকেটে ঢুকানো।
এটা পরিষ্কার যে সে ‘ওয়েক আর্মসের’ দিকে যাচ্ছিলো। বা আমি তাই ভেবেছিলাম। কিছুক্ষণ তার সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে গেলাম। নানান ঝোপঝাড়ের কারণে দেখা না যাওয়ায় প্রায় সিকি মাইল পার হয়ে মেয়েটি থেকে এগিয়ে যেয়ে ফুটপাথে উঠে তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আয়নায় করা অনুশীলন অনুযায়ী তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটি ঘাবড়ায়নি। সে সাহসী ছিলো।অল্পই ইতস্তত করেছিলো। তবে আমাকে পার হয়ে যাওয়ার দুঃসাহস করেনি। বরঞ্চ সে রাস্তার ওপারে চলে গিয়েছিলো। রাস্তায় কোন ভীড় থাকেনা আর যতদূর দেখা যায় একটা গাড়ীও ছিলোনা।
সে রাস্তা পার হয়ে জোরে হাঁটতে লাগলো। আমিও রাস্তা পার হয়ে তার পিছু নিলাম। তারপর সে দৌড়ানো শুরু করলো তাই আমাকেও দৌড়াতে হলো আর তার কাছাকাছিই থাকলাম। এভাবেই চললো কয়েক মিনিট, ‘ওয়েক আর্মস’ এখনো মাইল খানেক দূরে, মেয়েটি হঠাৎ ঘুরে রাস্তা পার হয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিলো সেদিকে দৌড়ে যেতে লাগলো। আমি তাকে তাড়া করা বন্ধ করলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম আর হেসে ফেললাম। জোরে জোরে অনেকক্ষণ ধরে হাসলাম। নিজেকে অনেক সুখী আর মুক্ত মনে হচ্ছিলো। সর্বজয়ী ক্ষমতার স্বাদ পেলাম আমি—যে আমি একা, নম্র, সাধারণ, অনুজ্জ্বল, সেইআমি কিনা এতটা ভয়ের সঞ্চার করতে পারি।
এরপর থেকে নিয়মিত ‘এপিং ফরেস্টে’ যাওয়া শুরু হলো। বলা যায় পনেরো দিন পর পর যাওয়া হতো। বদলি কাজের সুবাদে মাঝে মাঝে দিনের বেলাও যেতে পারতাম। দিনের বেলা অনেক মহিলারা বাসায় একা থাকতো আর বাইরে বের হলে সাথে পুরুষ সঙ্গীরা কেউ থাকতো না।আমি কখনোই দুই সপ্তাহের বেশী সময় লাগাতাম না, ঘন ঘন যাওয়া হতো যখন মানসিক অবস্থা খারাপ থাকতো ক্যারোলের সাথে ঝগড়া হলে বা অর্থনৈতিক কারণে হতাশায় ভুগলে।এটা যে আমার কতো উপকারে এসেছিলো সেটা যদি আপনাদের বোঝাতে পারতাম। ভেবে দেখেন খুব জোরে গাড়ী চালাতে, ডিস্কোতে নাচানাচি বা কোনকিছুতে মাতাল হলেআপনাদেরকেমন লাগে, নারীদের ভয় দেখিয়ে সেরকমই এবং এরচেয়েও বেশী কিছু পেয়েছি। এ ছিলো প্রায় প্রেমে পড়ার মতো অনুভূতি।
আর এতে তো কোন ক্ষতি ছিলো না তাই না? আমি তাদেরকে আহত করিনি। ফরাসী প্রবাদে আছে, এটা আমাকে অনেক সুখ দিয়েছে আর তোমাকে অল্প কষ্ট। এটা সেরকমই ছিলো আমার আর তাদের জন্য। অবশ্য তাদের জন্যও এটা সুখহীন কিছু ছিলো না। চিন্তা করে দেখেন, পরে তারা এটা নিয়ে কথা বলে কতো মজা পেয়েছে, ক্যারোলের মতো সব বিস্তারিত, রংচং লাগিয়ে বর্ণনা করে নিজেদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু করেছে।
আমার ধারণা আমার খোঁজে তারা অনুসন্ধানকারী দল তৈরী করেছে। স্বামীরা, ছেলেবন্ধুরা এবং বাবারা দলবেঁধে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে আর শিকার করার আনন্দ নিয়ে বেশ মৌজ মাস্তিতে সময় পার করছে। যাই হোক, আমি আসলে কি করেছি? আদতে কিছুই না। কারো শ্লীলতাহানি করিনি, কাউকে অপমান করিনি, স্পর্শ করার চেষ্টাও করিনি কাউকে। শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাদেরকে তাড়া করেছি—না বলা উচিৎ তারা দৌড় দিতো বলে আমাকেও দৌড়াতে হতো।
এতে তো কোন ক্ষতি হয়নি। মানে আমার সেরকমই ধারণা ছিলো। আমি ভেবে পাইনি এতে আসলে ক্ষতিকর কি আছে, এবং বিশ্বাস করুন এটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি কারণ আমিও অন্যদের মতোই অপরাধবোধে ভুগেছি। এটা নিয়ে ভেবেছি, অপরাধবোধ সরিয়ে রেখে নিজেকে সমর্থন দিয়েছি।
একজন পুরুষ তাড়া করলে কোন তরুণীর কখনো হার্ট এটাক হয় না বা তারা পড়ে মরে যায় না। কোন ছেলের তাকিয়ে থাকার কারণে তরুণীরা কখনো মানসিকভাবে চোট পায়না। সবচেয়ে বয়স্ক মহিলা যাকে ভয় দেখিয়েছিলাম সে ছিলো সেই টেরিয়ার-ওয়ালী মহিলা, যার বয়স চল্লিশের বেশী হবেনা। সে ‘কুইনস উডের’ মেয়েটির মতোই একই কথা বলেছিলো, একইরকম রুদ্ধস্বরে বলেছিলো, ‘কি চান আপনি?’
আমি কোন উত্তর দেইনি। তাকে আর তার ছোট অকাজের কুকুরটিকে দয়া দেখিয়ে গাছের ছায়ায় মিলিয়ে গিয়েছি। পরবর্তীতে এই কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে অধ্যাপকের গাম্ভীর্য নিয়ে উত্তর দিয়েছি ‘এইতো শৈবাল সংগ্রহ করছি ম্যাডাম।‘
আমি যে কতোটা নিরীহ ছিলাম তার প্রমাণ হলো ঐ এলাকায় পুলিশের কোন চিহ্ন ছিলোনা। আমি নিশ্চিত কেউ পুলিশের সাথে কথা বলেনি কারণ বলার মতো কিছুই ছিলোনা। তাদের কাছে ছিলো শুধুমাত্র কল্পনা আর প্রচারমাধ্যম তাদেরকে যেসব বিশ্বাস করিয়েছে সেগুলো।
তবুও এর জন্য ক্ষতি হয়েছিলো। অপূরণীয় ক্ষতি আর দূর্ভোগ আর লজ্জা।
জানা কথা আপনারা ভাবছেন যে ঘটনা বুঝে ফেলেছেন। যা হওয়ার কথা হয়ে গিয়েছে। মহিলাদের ভয় দেখানো লোকটার উপযুক্ত শিক্ষা হয়েছে। হ্যাঁ সেরকমই আমার সাথে হয়েছে মানছি তবে সেটা আমাকে দমাতে পারেনি।
এক জুডো ব্ল্যাক বেল্ট ধারী দ্বারা উড়ে গিয়ে দূরে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা আর শরীরে দুই একটা আঁচর আসলে পেশাগত ঝক্কিরই অংশ। আমি খুশী যে একজন ভদ্রলোকের মতোই আচরণ করেছি। তাকে আমি বকা দেইনি, গালিগালাজ করিনি। উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝেড়ে তার দিকে ছোট করে মাথা ঝাঁকি দিয়ে ‘ওয়েকের’ রাস্তায় হাঁটা দিয়েছি। ক্যারোল জানতে চেয়েছিলো জামা-কাপড়ে সবুজ ছোপ গুলো কিভাবে হলো, আমার মনে হয় সে এখনো বিশ্বাস করে যে আমি কোন মহিলার সাথে কোন পার্কের ঘাসে শুয়ে সময় কাটিয়েছি। যেন এই ধরণের কাজ আমি করবো!
আমার উপরে হওয়া আক্রমণ আমাকে নিরুৎসাহিত করলেও থামাতে পারেনি। আমি তিনটি সপ্তাহ যেতে দিলাম। তিনটি দুঃসহ আকুল করা সপ্তাহ। জুলাইয়ের এক সূর্যকরোজ্জ্বল সকালে ‘ওয়েকের’ রাস্তায় ফিরে গেলাম আর তারপর সবচেয়ে সন্তোষজনক অভিজ্ঞতাটি হলো। একটি মেয়ে জঙ্গলের ভিতরের সংক্ষিপ্ত পথ ধরে হাঁটছিলো। আমি তার সমান্তরালে হাঁটছিলাম আর মাঝে মাঝে আমাকে দৃশ্যমান করছিলাম। সে দেখেছিলো কারণ ‘কুইনস গেইটের’ সেই মেয়েটার মতোই তার ভয়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে তাকে পার হয়ে সামনে দাঁড়ালাম। অপেক্ষা করছিলাম। সে আমার মুখোমুখি হতে সাহস পায়নি। ঠিক ভেবে পাচ্ছিলো না কি করবে।দূরত্ব থাকতেই সে ঘুরে গেলো, আমি তার পিছু নিলাম। ঝোপের ভিতর দিয়ে যেতে লাগলাম, সে ভাবলো আমি হয়তো চলে গিয়েছি। তারপর আবারো তার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এবার সে বামদিকে ঘুরে দৌড়াতে লাগলো। এবার তাকে যেতে দিলাম। সবসময় যেভাবে জোরে জোরে অদম্য ভাবে হাসতাম সেভাবে হাসতে হাসতে তাকে যেতে দিলাম। তার কোন ক্ষতি করিনি। নিশ্চয়ই সে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছিলো যখন ভেবেছিলো আমার কাছ থেকে সে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পেরেছে। তারপর বাসায় যেয়ে তার মা, বোন বা স্বামীর কাছে সব খুলে বলেছে।
আপনারা বরং বলতে পারেন আমি তার উপকারই করেছি। সে সাবধান হবে, জঙ্গলের রাস্তায় আর একা একা বের হবে না ফলে সত্যিকারের বিকৃতমনা, যৌন নির্যাতকের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে আমার কারণেই।
এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার তাইনা? আমাকে আপনারা মানব সেবক বলতে পারেন। আমি তাদের দেখিয়েছি কি হতে পারে। আমি সেই হালকা বৈদ্যুতিক ধাক্কা যেটা বাচ্চাদের শেখায় কখনো তার নিয়ে খেলতে নেই। মানে আমি সেটাই বিশ্বাস করতাম। যতদিন পর্যন্ত না এই শিক্ষা হলো যে ছোট একটি ধাক্কাও মৃত্যু ঘটাতে পারে।
জঙ্গলের বাইরে ‘ওয়েকের’ রাস্তায় ছিলাম, তখন আমার ভাগ্য প্রসন্ন হলো। তখন শরৎকাল, তাড়াতাড়ি যেয়েও তখন সন্ধ্যা ছয়টা আর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো। বেশী আশা ছিলো না যে কোন মহিলা এতো বোকা হবে যে এই রাস্তা দিয়ে অন্ধকারে একা একা যাবে। আমি আস্তে আস্তে আগাচ্ছিলাম, সামনে একটা গাড়ী দেখতে পেলাম ফুটপাথ ঘেঁসে পার্ক করা। দূর থেকেই এক ধরণের বিদঘুটে আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো যখন গাড়ী চালু করার চেষ্টা হচ্ছিলো।
চালকের সাইডের গাড়ীর দরজা খুলে একজন মহিলা বের হয়ে এলো। সে একাই ছিলো। গাড়ীর পিছনে যেয়ে লাইট নিভিয়ে সজোরে দরজা লাগিয়ে দিলো, তারপর তালা লাগিয়ে ‘থেইডানের’ দিকে হাঁটা শুরু করলো। আমি গাছের আড়ালে থাকায় সে তখনও আমাকে দেখতে পায়নি। এবার কোন পদ্ধতি নেওয়া যায় যেটা ভাবতে ভাবতে তার পিছু নিলাম। তো ঠিক করলাম তাকে দৌড়ানোর চেষ্টা দিয়েই শুরু করবো। ফুটপাথে তার একশ গজ পিছনে চলে এলাম তারপর পা দিয়ে যতটা পরা যায় শব্দ করতে করতে তার দিকে দৌড় লাগালাম। যা ভেবেছিলাম সে থেমে যেয়ে ঘুরলো। সে হয়তো আমাকে ত্রাণকর্তা ভেবেছিলো যে গাড়ীর বিষয়ে একটা কিছু করবো। সে চারদিকে একবার দেখেনিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। যেইমাত্র সে আমাকে দেখতে পেলো আমি দ্রুত ঘুরে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেলাম। সে একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে, ঘুরে আবার হাঁটা শুরু করলো। সে তখনও ভয় পায়নি।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো আর আকাশে চাঁদ ছিলোনা। আমি জঙ্গলের ভিতরের গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে খুবই নিঃশব্দে হেঁটে প্রায় তাকে ধরে ফেললাম, দূরত্ব মাত্র তিন বা চার গজ। গাড়ী ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে গিয়েছে আর ‘থেইডানের’ লাইট এখনও অনেক দূরে। রাস্তাটা অন্ধকার হলেও একেবারে নিকষ কালো অন্ধকার ছিলো না। আমি ইচ্ছে করে একটা শুকনো ডালে পা ফেলে সেটাকে ভেঙ্গে ফেললাম। সে দ্রুত ঘুরে যেয়ে আমাকে দেখতে পেলো।
ভীষণ চমকে গেলো সে। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে আগের থেকে দ্রুতগতিতে হাঁটতে লাগলো। অবশ্য আমার সাথে পেরে উঠার তার কোন সম্ভাবনাই ছিলো না, একজন পাঁচ-ফুটি মহিলা বনাম এক ছয়-ফুটি পুরুষ। তার জোর কদম হাঁটা ছিলো আমার আয়েশ করে হাঁটার সমান। এতোক্ষণ পর্যন্ত রাস্তায় কোন গাড়ীর দেখা পাওয়া যায়নি। এইবার একটা এলো। দূরের বাঁক থেকেই ওটার আলো দেখা যাচ্ছিলো। মহিলাটি ফুটপাথের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হিচহাইকারের মতো হাত তুলে গাড়ী থামার সংকেত দিলো। আমি দেখতে লাগলাম কি ঘটে। কারণ আমি মোটের উপর করেছিটাই কি? সাথে সাথে থাকা ছাড়া? কিন্তু চালক গাড়ী থামালো না। থামানোর কথাও না, ওর জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। আমরা খুব ভালো করেই জানি কি ধরণের লোক পরিপাটি পোশাকের সুন্দরী হিচহাইকারের জন্য গাড়ী থামাবে, তার উদ্দেশ্য কি।
এর পরের গাড়ীটাও থামেনি। আমি ততক্ষণে তার থেকে সামনে এগিয়ে আছি, তখনও জঙ্গলের ভিতরে। গাড়ীর হেডলাইটের আলোয় তার চেহারা দেখতে পেলাম। সে ছিলো সুন্দরী তবে সেটা আমার আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিলোনা। কিন্তু দেখলাম সে সুন্দরী এবং অনেকটা ক্যারোলের মতো। ছোটখাটো চিকন গড়ন, ধারালো চেহারা, কোঁকড়ানো সোনালী চুল।
গাড়ীর লাইট পার হয়ে গেলে অন্ধকার যেন আরো ঘন হয়ে যাচ্ছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম তার উদ্বেগ কিছুটা কমেছে যেহেতু পাঁচমিনিট ধরে আমাকে দেখতে পায়নি। হয়তো ভেবেছে আমি চলে গিয়েছি।আমারও মন চাইছিলো সোয়া ঘন্টা হলো এইবার খতম করি। সাধারণত মজা শেষে তাই করতাম।
ঈশ্বর! যদি সেটাই করতাম। আমি চালিয়ে গেলাম চরম বোকার মতো চিন্তা করে।ভেবেছিলাম পিছনে ফিরে যেয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা না করে তার গন্তব্য ‘থেইডানে’ যেয়ে টিউব ট্রেন ধরবো। তো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাকে যেতে দিতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি।
কোন এক বিকৃত প্রয়োজনে জঙ্গল থেকে বের হয়ে ফুটপাথে উঠে তার পিছু নিলাম। খুব নিঃশব্দে, নরম পায়ে হেঁটে তার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। আমার উপস্থিতি সে টেরও পায়নি, এবং এরপর হালকা শিষ দেওয়া শুরু করলাম। সেটা ছিলো ঈশ্বরের বন্দনা স্তবক ‘দ্য লর্ড ইজ মাই শেপার্ড’। কি একটা বাছাই! সে চরকির মতো ঘুরলো। মনে হলো সে কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। ভয় তার গলা চেপে ধরেছে। সে আবার ঘুরে দৌড়ানো শুরু করলো। দেখা গেলো সে খুব জোরে দৌড়াতে পারে, একটি ছোটখাটো, দূর্বল, সোনালীচুলো নারী।
রাস্তায় গাড়ীটির হেডলাইটের আলো দেখা গেলো। সেগুলো ছিলো ফুল বীম হেডলাইট। চারপাশের জঙ্গলে পড়া চোখ ধাঁধানো নীলচে-সাদা আলোয় প্রতিটা গাছ চেনা যাচ্ছিলো আর সেগুলোর ছায়াগুলি গাছের গোড়া থেকে দূরে ছিটকে যাচ্ছিলো। আমি পাশে লাফ দিয়ে লম্বা ঘাসগুলোর ভিতরে গুড়ি মেরে বসে গেলাম। মেয়েটি দৌড়ে রাস্তায় চলে গেলো, দুই বাহুউপরে তুলে চিৎকার করে উঠলো: ‘সাহায্য করুন! আমাকে সাহায্য করুন!’
লোকটি থামলো। আমি ক্ষণিকের জন্য উদ্বিগ্ন হলাম এটা ভেবে যে লোকটি হয়তো বের হয়ে আমাকে খুঁজতে আসবে। কিন্তু সে সেটা করেনি। লোকটা ভেতর থেকেই যাত্রীদের দিকের দরজা খুলে দিলো। মেয়েটি ভিতরে ঢুকলো, তারা বড়জোর আধা মিনিট বসে অপক্ষা করলো, তাপর সাদা রঙ্গের ‘ফোর্ড ক্যাপ্রি’ চলতে শুরু করলো।
গাড়ীটাকে পাহাড়ের মাথায় অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর উপলব্ধি করলাম বিপদ এখনো কাটেনি। মেয়েটি অথবা গাড়ীচালকের ‘লা’টন’ পুলিশ স্টেশনে ফোন দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। আমি জানতাম আমাকে খুব তাড়াতাড়ি ‘থেইডান’ পৌঁছতে হবে।
সেটাই করলাম। চলার পথে আর কোন যানবাহন চোখে পড়েনি। স্টেশনে প্রায় আধা ঘন্টা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। তবে কোন পুলিশও আসেনি। আবারও পার পেয়ে গেলাম। কিছু মাত্রায়।
একজনের অপরাধের শাস্তি পাওয়ার থেকেও খারাপ বিষয় আছে সেটা হলো শাস্তিই না পাওয়া। যা করেছি তার জন্য ভুগছি, আবার করতে না পেরে–মানে নিজেকে সেসব করতে না দিয়ে। এবং কখনোই মেয়েটির চেহারা ভুলবোনা। সুন্দর, অসহায়, ভীত সন্ত্রস্ত। এটা প্রায়ই স্বপ্নে দেখা দেয়।
এটা প্রথমবার আমার সামনে হাজির হয় খবরের কাগজের ছবি হয়ে। ‘ওয়েক রোডে’ তাকে ভয় দেখানোর দুদিন পর। এটা ছিলো তার মৃত্যু নিয়ে মূল খবর তাই তার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। আগের দিন সকালে, মৃত্যুর বারো ঘন্টা পর, ছুরিকাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত, বিকৃত মৃতদেহটি ‘এপিং’ এবং ‘হারলৌর’ মাঝামাঝি একটি মাঠে পাওয়া যায়। পুলিশ একটি লোককে খুঁজছে, ধারণা করা হচ্ছে সে সাদা রঙ্গের ‘ফোর্ড ক্যাপ্রি’ চালায়।
তার উদ্ধারকর্তাই তার হন্তারক। তাহলে আমি কি?
তিনি ফার্মেসী বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতায় যুক্ত আছেন।