অসমিয়া গল্প : সবুজ টেলিফোন
সবুজ টেলিফোন
মনোজ কুমার গোস্বামী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
ক্রিং ক্রিং ক্রিং -মধ্যরাতের নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে অমিতাভ বরুয়ার ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল।
৩০-৩৫বছর আগে অসমিয়া গল্প,রহস্য গল্প বা ডিটেকটিভ উপন্যাস এভাবেই আরম্ভ হত।মধ্যরাতে সশব্দে টেলিফোন বেজে উঠে,কোনো দুঃসংবাদ আসে,এমন কি কখনও বা অন্যপ্রান্তে কেবল রহস্যময় নীরবতা।গভীর রাতে টেলিফোনের শব্দ বহন করে আনে রহস্য,রোমাঞ্চ,সাসপেন্স,কখনও আতঙ্ক।
কেবল অমিতাভ বরুয়াই নয়,সেই যুগে মধ্যবিত্ত মানুষের বাড়িতে টেলিফোনটা ছিল পরিবারের অন্যতম চরিত্র। সুখী গৃহীকোণ,শোভে গ্রামোফোন -বলে বাংলায় একটা কথা প্রচলিত ছিল।আশির দশক পর্যন্ত অসমিয়া মানুষের বাড়ির ক্ষেত্রেও ‘সুখী গৃহকোণ,শোভে টেলিফোন’বললে তাদের সামাজিক অবস্থান,আভিজাত্য,রুচি ইত্যাদির ইঙ্গিত পাওয়া যেত।
আমাদের নগাঁওয়ের বাড়িতে টেলিফোন এসেছিল অনেক দেরি করে। এর আগে আমরা খুব জ্ররুরি পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী অনন্ত বরুয়ার বাড়ি যেতাম। অনন্ত কাকা টেলিকম বিভাগে কাজ করতেন। কাকা,একটা ফোন করতে পারি কি? কর,কর,তবে লাইনটা ঠিক আছে কিনা ?কখনো বা অনন্ত কাকার ছেলে দৌড়ে আমাদের বাড়ি আসে—আপনাদের ফোন আছে। ধরে আছে।তাড়াতাড়ি আসুন।আশেপাশের কয়েকজন আবার অন্যদের নিজের যোগাযোগের নাম্বার হিসেবে অনন্ত কাকার নাম্বারটাই দিয়ে দেয়। ব্রেকেটে পিপি বলে লিখে দেয়। এর অর্থ আমি আজ ও বুঝতে পারলাম না। তবুও সেটা ছিল এক অন্য ধরনের সামাজিক যোগাযোগ বা ঘনিষ্টতার সময়। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক গাঢ় এবং উষ্ণ ছিল।
একটা সময়ে আমাদের বাড়িতেও টেলিফোন এল। কালো রঙের,রূপালি ডায়েলের বেশ বড়সড় আকৃ্তির একটা টেলিফোন। আমরা মাঝে মধ্যে এমনিতেই কৌতূহলবশতঃক্রেডল থেকে রিসিভারটা তুলে কানে দিয়ে ডায়াল টোন আছে কিনা শুনি -আছে,ঠিকই আছে। আছে। দিনে একবার দুবার ফোন বাজে। তাতেও ফোন ধরার জন্য আমাদের মধ্যে দোউড়াদৌড়ি পড়ে যেত। সেই বয়সে রিসিভার তুলে হ্যালো বলার মাদকতাই ছিল আলাদা।
-কী খবর তোমাদের ? স্কুলে যাচ্ছ তো ?ভালোভাবে পড়াশোনা করছ? অন্য প্রান্ত থেকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে। তিনসুকিয়ার উত্তম পিসেমশায়।সপ্তাহে একবার ফোন করে বাবার সঙ্গে কথা বলে। কুশল বার্তা নেয়। রুটিন ফোন। ফৌজদারি পট্টির বরুয়া মাসির ফোন ও প্রায়ই আসে। দ্রুত মায়ের খোঁজ করে,সময় নেই,বাড়িতে অতিথি এসেছে। খরিচা দিয়ে কীভাবে শোল মাছের তরকারি রাঁধতে হয় ,টম্যাটো দিতে হবে কিনা । মাঝে মধ্যে সুখবর আসে। বাপার ছেলেটি ম্যাট্রিকে তিনটে লেটার সহ প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। মাজনীর একটি মেয়ে হয়েছে,ঘন্টা দুয়েক আগে,নার্সিং হোমে। ওজন ভালোই।
আমরা যখন টেলিফোন ব্যবহার করতে শিখেছি তখন ট্রাঙ্ককল নামে ব্যবস্থাটা এসটিডি নামে নামান্তরিত হয়েছে। কিন্তু ট্রাঙ্ককল করাটা যে কি বিড়ম্বনা সে কথা আজ ও মনে আছে। সকালে নগাঁও থেকে যদি ডিব্রুগড়ের কারুর সঙ্গে কথা বলতে হয়,তাহলে সন্ধ্যেবেলা এক্মচেঞ্জ থেকে ফোন আসে-আপনি ডিব্রুগড়ের জন্য ট্রাঙ্ককল বুক করেছিলেন ?নিন কথা বলুন।ততক্ষণে হয়তো কথা বলার প্রয়োজনই শেষ হয়ে গেছে। কখন ও কখন ও আগের দিন বুক করা ট্রাঙ্ককলে পরের দিন কল পাওয়া যেত। ততক্ষণে নগাঁও থেকে গাড়িতে আসা-যাওয়া করে ডিব্রুগড়ে কথাটা বলে আসা যায়।
কিন্তু সেই রহস্য গল্পের মতো মাঝরাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে টেলিফোন বেজে উঠে অজানা আশঙ্কায়। কখন ও শেষরাতে। কি অমঙ্গলীয় শব্দ।বুক কেঁপে উঠে-
-হ্যালো ? কে?
-মামা মারা গেছে। ওপাশে কান্নার শব্দ। মামা ? ছোট মামা?হে ভগবান-কীভাবে? ইস।
২০০২ সনে আমাদের গুয়াহাটির ভাড়াবাড়িতেও টেলিফোন চলে এল।তখন টেলিফোন সংযোগ পাওয়াটা রীতিমতো ভাগ্যের কথা। একজন একজন সাংসদকে অনুরোধ করে তাঁর কোটা থেকে টেলিফোনটা পাওয়া গেল।
জীবনের অনেক আনন্দ বেদনা,ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী টেলিফোনটা। বীরেন ভট্টাচার্য,ভবেন্দ্রনাথ শইকীয়া,চন্দ্রপ্রসাদ শইকীয়া,সৌরভ চলিহা,হোমেন বরগোহাঞি,হীরেন গোহাঁই-বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তির কণ্ঠস্বর ফুটে উঠেছিল সেই টেলিফোনের ডায়েফ্রামে। তাঁদের ফোন নাম্বার আমার কণ্ঠস্থ ছিল,রিসিভারে অবলীলাক্রমে তাঁদের কণ্ঠস্বর চিনতে পারতাম। । তাছাড়া আসত বিভিন্ন সতর্কীকরণ,প্রেম এবং প্রত্যাখান।অনেক অস্থির সময়ে টেলিফোনের বিভিন্ন বার্তা রিসিভারের ডায়াফ্রেমের মতো কাঁপিয়ে তুলেছিল আমার জীবনকে।
আমার মনে পড়ছে একবার একজন প্রবীণ মন্ত্রী রাত সাড়ে নয়টার সময় আমি জেগে আছি না ঘুমিয়ে পড়েছি জানার জন্য ফোন করলেন। তাঁর মনে দুঃখ,এক সময়ের অতি ঘনিষ্ট মুখ্যমন্ত্রীর তিনি কোপদৃষ্টিতে পড়েছেন। আজ কিন্তু তিনি কাউকে ‘কেয়ার’করেন না,কারণ তিনি ‘অমুকের’ছেলে-এইবলে তিনি নিজের জীবন কাহিনি আরম্ভ করলেন,একেবারে স্কুলজীবন থেকে।তখনই নাকি স্কুলের হেডমাস্টার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন-এই ছেলে অনেক দূর যাবে।একহাতে রিসিভার ধরে আমি হ্যাঁ,হ্যাঁ বলে সব কথায় সায় দিয়ে ভাত খেলাম,মুখ ধুলাম,তারপরে বিছানায় গেলাম।
বারোটা বেজে গেল,দুটো বাজল। মন্ত্রীর সেই দীর্ঘ জীবন বৃত্তান্ত শুনে শুনে মাঝে মধ্যে ক্লান্তি আর নিদ্রায় আমার দুই চোখ বন্ধ হয়ে এল। জেগে ঊঠে শুনি অন্যপ্রান্তে মন্ত্রী গভীর দুঃখে তাঁর জীবনের উত্থান-পতন বর্ণনা করে গেছেন। মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করেছেন আপনি শুয়ে পড়েছেন নাকি ?একসময় জানালা দিয়ে ভোরের আলো দেখা গেল। সকালের পাখির কূজন শোনা গেল। আস্তে করে আমি বললাম-ভোর হল। আজ এতটুকু থাক। মন্ত্রী অনিচ্ছার সঙ্গে ফোন রাখলেন। সেই রাতের সেই সাত ঘন্টার বার্তালাপ আমার জীবনের দীর্ঘতম টেলিফোনিক কথোপকথন।
কয়েকবছর পরেই জোয়ারের মতো এল মোবাইল ফোন। ধীরে ধীরে ল্যাণ্ড লাইন ফোনগুলি অবহেলিত হয়ে ঘরের এক কোণে ধুলোয় ধূসরিত হয়ে পড়ে রইল। এতদিনে লাইনম্যানের দৌরাত্ম্য,কেবল ফল্ট,ক্রস কানেকশান ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে ভারাক্রান্ত ছিল টেলিফোনের গ্রাহকরা। মোবাইল ফোন যেন এই সমস্ত থেকে মুক্তি দিল। এই ধরনের অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে অনেকেই পুরোনো টেলিফোনগুলি বিসর্জন দিল। আবাল বৃদ্ধ বনিতার হাতে হাতে নতুন নতুন মডেলের মোবাইল ফোন শোভা বর্ধন করতে লাগল। সেই জোয়ারের ঢেউ পুরোনো টেলিফোনের নাম্বারগুলি মুছে দিল,অনেক টেলিফোন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল,অনেক টেলিফোন আর ব্যবহৃত হল না। একটা জেনারেশন নীরবে হারিয়ে গেল। বয়োবৃদ্ধ নলিনীধর ভট্টাচার্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না,তাঁর ল্যাণ্ডলাইন নাম্বার আজ কে মনে রাখবে ?
ঘনঘন স্বাধীনতার ফোন আসছিল-মানে স্বাধীনতা ফুকনের। অনেক দূর থেকে আসার মতো ক্ষীণ অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতা একটি উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্য-প্রচার বিভাগের সহকারী সচিব।প্রথমে স্বাধীনতার ফোন এসেছিল সংগঠনের বিবৃতি ইত্যাদি প্রকাশ করার অনুরোধ নিয়ে। ধীরে ধীরে সে আমার সঙ্গে অন্যান্য কথাও বলতে শুরু করে। সে খুব বই পড়ে,নিজে কবিতাও লেখে।অনেক খবরের কাগজ,পত্র পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কখনো-কখনো আমি মজা করে বলি-‘তোমরা বন্দুক চালানো মানুষ।কবিতা কীভাবে লেখ ?’
তা নয় দাদা,আপনি ভুল বুঝেছেন।অপর প্রান্ত থেকে স্বাধীনতার অস্ফুট কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। মানুষ তো দূরের কথা,আমি জীবনে একটা কবুতরও মারিনি।কোমরে একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াই,ভীষণ ভারী।সংগঠনের নিয়ম। সঙ্গে রাখতেই হবে।
-কবিতা পাঠিও। সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করব। আমি উৎসাহ দিতে বলি-কিন্তু তোমাদের বিবৃতি সব সময় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
দুই একটি কবিতা আসে।কিন্তু ঘন ঘন সংগঠনের বিবৃতি আসে।বিবৃতি প্রকাশের জন্য স্বাধীনতা তাগিদা দেয়। কখনও বের হয় কখনও হয় না। তার ব্যক্তিগত খবর জিজ্ঞেস করি।বাড়িতে অসুস্থ বৃ্দ্ধা মা রয়েছেন। বাড়ির কথা মনে পড়ে। তবে সংগঠনের নিয়ম তো মেনে চলতেই হবে।কিন্তু স্বাধীনতার কবিতাগুলি পড়ে আমি চমকে উঠলাম-খাঁটি অনুভূতি,নির্ভেজাল আবেগ এবং চমকপ্রদ শব্দ বিন্যাস। তারপর অনেকদিন স্বাধীনতার কোনো খোঁজ খবর পেলাম না। তখন সেনা পুলিশের অভিযান আরম্ভ হয়েছে,গ্রামে গঞ্জে উগ্রপন্থীর খোঁজে সামরিক-অর্ধসামরিক বাহিনি হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতা কোথাও লুকিয়েছে,ফোন আসা বন্ধ হল।
এভাবেই বহু চরিত্র আমি যাকে জীবনে দেখিনি,টেলিফোনটার মাধ্যমেই তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছে।এর মধ্যে ‘যম’এর কথা উল্লেখ না করলে এই কাহিনি অসমাপ্ত থেকে যাবে।
একদিন রাতে অফিস থেকে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে ফিরেছি,টেলিফোনটা বেজে উঠল-হ্যালো ?কে বলছেন?
-তোর যম।অপর প্রান্ত থেকে কঠোর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
-বলুন,কেন ফোন করেছেন ? ক্লান্ত হলেও আমি ধৈর্য না হারিয়ে আমি বললাম।
তারপর জোয়ারের মতো ভেসে এল অশ্নীল-অশ্রাব্য গালি-গালাজ। কী উপলক্ষে ফোন করেছে বলে না,উদ্দেশ্য কী বলে না,নিজের নামও বলে না। মাঝে মধ্যে গুলি করে প্রাণ্নাশ করার হুমকি দেয়। সাধারণত টেলিফোনে যারা হুমকি দেয় তাদের সাহসের অভাব থাকে। আমিও উলটে ধমক দিলাম। এই ধরনে প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট চলল।আমি ‘যম’কে বলি -টেলিফোনে কত ধমক দিবি,সামনে আয়,আমি বাড়িতে বসে রয়েছি।
না,যম সামনে আসে না। একটা সময়ে গোটা ব্যাপারটা বিরক্তিকর হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে ‘যম’ফোন করলেও আমি ‘এখন বাড়িতে লোক রয়েছে,পরে করিস বলে ফোন রেখে দিই। কখনও বন্ধু-বান্ধব এলে ওদেরই কথা বলার জন্য এগিয়ে দিই। গালি-গালাজগুলি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে গেল। যম বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ফোন ধীরে ধীরে কমে এসে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত জানতে পারআজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না আমাকে অবিরত মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে যাওয়া সেই ‘যম’কে ছিল,আমার সঙ্গে টেলিফোনে সে এতটা সময় কেনই বা অযথা খরচ করল ?
এভাবেই বারবার টেলিফোনটা বেজে উঠে।অন্য প্রান্তে কে আছে জানি না। হতে পারে কোনো বন্ধু,কোনো শ্ত্রু বা অপরিচিত কেউ। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার ফুটে উঠলে কথা বলার একটা পূর্ব প্রস্তুতি থাকে।কিন্তু ল্যাণ্ড ফোনে সেই সুযোগ নেই।তার শব্দে একটা অনিশ্চয়তা ভরা রোমাঞ্চ থাকে।
-ক্রিং ক্রিং ক্রিং
-হ্যালো কে?
-আমি স্বাধীনতা।-ওপাশ থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।আমি স্বাধীনতা,সে চিৎকার করে উঠে।
-ও স্বাধীনতা,তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? খবরা খবর নাই ? আমি আন্তরিকতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করি,ভালো আছ তো?
-আছি দাদা। ভালো আছি।
-বাড়ির খবরা খবর নিয়েছ?
-নিতে পারিনি দাদা,নেবার সুবিধা নেই। ভালোই আছে মনে হয়। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
-কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ?
-উপায় নেই দাদা।বড় জটিল সময়।তার মধ্যেই কবিতা লিখছি।সম্পূর্ণ হলেই আপনাকে পাঠাব। দুটো লাইন শুনুনঃ
‘স্বপ্ন খুঁজে বেড়ানো আমার ক্লান্ত জীবনে
হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকিনি,
বটবৃক্ষে্র ছায়ায় কেবল নিয়েছি বিশ্রাম
একদল ক্ষুদে পিঁপড়ের সংগ্রাম চাই,
ভুলে গেছি বাড়ি ফেরার পথ,
পদুলিতে আমার জন্যও অপেক্ষা করে আছে মা।‘
দ্রুত সময় পার হয়ে যায়। স্বাধীনতার কবিতাটার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করলাম। আর ফোন আসেনি। ডাকেও কবিতাটা আসেনি। ইস,স্বাধীনতা বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেছে,কিন্তু সে জানে তার জন্যও বাড়িতে বৃ্দ্ধা মা তার জন্য অধীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে। এই কবিতাটা হাতে এলেই আমি প্রকাশ করব।
মনে পড়ছে বন্ধু প্রশান্ত রাজগুরু অনেক বছর আগে ‘সবুজ টেলিফোন’নামে একটা গল্প লিখেছিলেন। একদিন আমার টেলিফোনটাকেও স্বাধীনতা ফুকনের সম্পূর্ণ কবিতা সবুজ করে তুলবে। কখনও জীবনের বহু অসম্পূর্ণতাকে কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে পূর্ণতা দান করে,কোনো আকস্মিক সংকেত জীবনকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে শেখায়,সেভাবেই আমার টেলিফোনটাও বেজে উঠবে কোনো শুভবার্তা নিয়ে-আমি সেই আশা নিয়েই অপেক্ষা করছিলাম।
একদিন সন্ধ্যেবেলা আমাদের যোরহাটের সাংবাদিকের টেলিফোনে আমি কেঁপে উঠলাম,সে খবর দিয়েছে-দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসবাদী স্বাধীনতা ফুকন নিহত। যোরহাট জেলার কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেনার গুলিতে স্বাধীনতার শরীর ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে।সেই অঞ্চলটিতে কিছুদিন ধরে সে আত্মগোপন করে ছিল। গুপ্তচ্র বিভাগ কোনোসূত্রে খবর পেয়েছিল যে একটা পাব্লিক টেলিফোন বুথ থেকে উগ্রপন্থী স্বাধীনতা বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছিল। সেই পিসিও টার উপরে নজরদারি রাখছিল। আজ ভোরবেলা টেলিফোন বুথটার সামনে স্বাধীনতা সেনার গুলিতে ঢলে পড়ে।তার মৃতদেহ বর্তমানে আরক্ষীর জিম্মায়।মৃত্যুর সময় স্বাধীনতার হাতে ছিল একটা নাইন এম এম পিস্তল,কিছু আপত্তিজনক নথিপত্র এবং একটি অসম্পূর্ণ কবিতা…
‘স্বপ্ন খুঁজে বেড়ানো আমার ক্লান্ত জীবনে
হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকিনি,
বটবৃক্ষে্র ছায়ায় কেবল নিয়েছি বিশ্রাম
একদল ক্ষুদে পিঁপড়ের সংগ্রাম চাই,
ভুলে গেছি বাড়ি ফেরার পথ,
পদুলিতে আমার জন্যও অপেক্ষা করে আছে মা।‘
আজও আমার টেলিফোনটা রয়েছে।যদিও প্রায় অব্যবহৃত।উপরে ধুলোর পাতলা আস্তরন,বোঝা যায় না ফোনটার রঙ ঠিক কালো ,লাল না সবুজ। ঘরের এক কোণে পরিত্যক্তের মতো থাকলেও টেলিফোনটা মাঝে মধ্যে বেজে উঠে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়ে দেয়-সে আছে,এখন ও একেবারে ডেড হয়ে যায়নি।
লেখক পরিচিতিঃ ১৯৬২ সনে অসমের নগাঁও জেলায় গল্পকার,লেখক,সাংবাদিক মনোজ গোস্বামীর জন্ম হয়। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র শ্রীগোস্বামী অসমের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র নতুন দৈনিক’,’দৈনিক জনসাধারণ’ইত্যাদি পত্র পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।বর্তমানে ‘ডিওয়াই ৩৬৫’ নামে উত্তর পূর্বাঞ্চলে একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের ম্যানেজিং এডিটর।‘সমীরণ বরুয়া আহি আছে’,’অ্যালুমিনিয়মর অঙ্গুলি’, ‘পাঁচজন বন্ধু’লেখকের বিশিষ্ট গ্রন্থ।
অনুবাদক