Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,sadat-sayem

ভাসাবো দোঁহারে: দ্বিতীয় গোলাপ । সাদাত সায়েম

Reading Time: 3 minutes

পল্লব প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াতেই ট্রেনটা ছেড়ে দিলো। ট্রেনের জানালা  দিয়ে সে ঝিনুতারাকে দেখতে পেলো।ঝিনুতারাও পল্লবকে দেখলো। ঝিনুতারা তার ডান হাতটা অর্ধেক তুলে কী ভেবে আবার নামিয়ে নিলো। পল্লব একবার ভাবলো দৌড়ে উঠে পড়বে ট্রেনে; ঝিনুতারাকে বলবেযা হবার হয়েছেএবার বাসায় চলোকিন্তু সে ট্রেনে উঠলো না। সে তার জেদের কাছে হেরে গেল।

এদিকে ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে খানিক দূর গিয়ে আউটার সিগন্যালে থেমে গেল। ঝিনুতারা ভাবলো নেমে পড়বে। প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত যখন এসেছে পল্লব! কিন্তু সাথে সাথে গতরাতের ঝগড়াটা মনে পড়ে যেতেই তার মনটা বিষিয়ে উঠলো। 

ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে যাবার পর পল্লব প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে দেখল ট্রেনটা আউটার সিগন্যালে থেমে গেল। সে একটা প্রত্যাশা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো, কিন্তু ট্রেন থেকে কেউ নেমে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে আসলো না। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলো।  

তারপর হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম। শীতের বিকাল বড্ড মনমরা হয়ে স্টেশনটাকে ঘিরে ধরলো। পল্লব বাসার দিকে পা বাড়ালো। 

তাদের বিয়েটা হয়েছিল গত বসন্তে। পরিচয় হয় তার মাস দুয়েক আগে। ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে শীতে সেন্টমার্টিনে বেড়াতে গিয়েছিল পল্লব ও ঝিনুতারা। তখন তো তারা একে অপরের কাছে অপরিচিত ছিল। ট্যুরে পরিচয় হয়। পরস্পর পরিচিত হবার পর সেন্টমার্টিনে তাদের সময় আশ্চর্যরকম ভালো কাটতে শুরু করেছিল।

ফলে সেন্টমার্টিন থেকে ঢাকায় ফিরেও পল্লব ও ঝিনুতারা যোগাযোগ বহাল রাখলো। ভালো কোন সিনেমা আসলেই তারা একসাথে দেখতো, মজার কোন খাবার খাওয়ার জন্য কিংবা শুধু একসাথে পার্কে হাঁটার জন্য বের হতো।

এইসব হাঁটাহাঁটি ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে তারা পরস্পরকে আরও ভালো ভাবে জানলো। পল্লব জানলো যে ঝিনুতারার একটা বিয়ে হয়েছিল। বছর দুই আগে সংসার ভেঙ্গে যায়। বাধ্য হয়ে তাকে সরে আসতে হয়েছিল। বিয়ের পরপরই প্রেমিক পুরুষটির বোল পাল্টে গিয়েছিল। যে অসহ্য অবস্থার ভেতর দিয়ে ঝিনুতারা দেড়টা বছর পার করেছে, সেসব বলে ঝিনুতারা কাঁদতো। পল্লবকে ঝিনুতারার দুঃখ স্পর্শ করেছিল ভীষণভাবে।

তাদের এই সর্ম্পককে একটা গতি দিতেই যেন প্রকৃতি এগিয়ে এলো। বসন্ত তার সকল সম্ভার নিয়ে এমনকি এই ধোঁয়া-ধুলিময় শহরেও হাজির হলো। পল্লব ভাবলো এইবার তার প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে গেছে। চার বছর আগে রুমুর সাথে ব্রেক-আপ হয়ে যাবার পর পল্লব ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিল। ছাড়াছাড়ি বলা ভুল হবে, রুমু আসলে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুনেছে রুমু বিয়ে করেছে আর ভালোই আছে। তারপর থেকে পল্লব একটা প্রশ্ন নিয়ে সমসময় ভাবত: তার কি এমন কেউ আবার হবে যাকে সে একটা লাল গোলাপ উপহার দিতে পারবে। ঝিনুতারার সাথে তার সম্পর্কটা তাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিলো। 


    আরো পড়ুন:হিমাংশু স্যারের সাইকেল


স্টেশন থেকে বাসায় ফিরে পল্লবের খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। মনে হলো এই বাসাটা আসলে তার না, অন্য কারো। আসলে বিয়ে করার আগেই সে আর ঝিনুতারা বাসাটা ভাড়া নিয়ে আস্তে আস্তে বাসাটা গুছিয়েছে। তারা দুজনেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতো। আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে। ছুটির দিনগুলোতে তারা দুজনে বাসার জন্য এটা সেটা কিনতো আর বাসাটা সাজাতো। ফলে ঝিনুতারাকে বাদ দিয়ে বাসাটা কল্পনা করতে পারছিল না পল্লব। সে ভাবলো তাকে এখন একা একা এই পীড়ন ভোগ করতে হবে। ঝিনুতারা তো চলে গেছে তার খালার বাড়ি দিনাজপুরে, তাকে আর স্মৃতির বেদনা পোহাতে হবে না!

হ্যাঁ, স্মৃতি বা সঠিক করে বললে অতীতই তাদের সম্পর্কটার মধ্যে একটা সংকট বয়ে এনেছিল। তাদের বিয়ের পরপরই ঝিনুতারার সাবেক বর সক্রিয় হয়ে উঠলো। ফেসবুক মেসেঞ্জারে ইনিয়ে বিনিয়ে এটা সেটা লিখতো। প্রায়ই কবিতা লিখে পাঠাতো। তার সাথে কোন যোগাযোগ না করার জন্য ঝিনুতারা বলেছিন, কিন্তু কাজ হয় নি। আগের ঘটনার জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করে ঝিনুতারাকে তার কাছ চলে যেতে কাকুতি মিনতি করতো। ঝিনুতারা পল্লবকে সব জানাতো। প্রথম দিকে পল্লব এইসব গা করতো না, কিন্তু লোকটার কবিতা পাঠানো অব্যাহত থাকলে জীবনে প্রথমবারের মতো কবিতা লিখতে না পারার জন্য নিজেকে তার ছোট মনে হতে থাকলো। এই হীনমন্যতাই গতরাতের ঝগড়ার মধ্যে তার মুখ থেকে বের করে আনলো এমনসব কথা যা ঝিনুতারার পক্ষে সহ্য করা ছিল অসম্ভব।

দিনাজপুর গিয়ে ঝিনুতারার ভীষণ কান্না পেল। প্রথম বিয়ের পর থেকেই বাবা-মা ও ভাই-বোনের কাছে তার কোন সম্মান ছিল না। ছোট ভাই-বোন পর্যন্ত সুযোগ পেলেই কথা শোনাতো। তাই সে ভয়ে ভয়ে থাকতো। পছন্দের কাউকে বিয়ে করলে এতোটা মূল্য দিতে হবে তা তার জানা ছিল না। তাই খালার কাছে পল্লবের সাথে ঝগড়ার কথা কিছু জানালো না। বলল তীব্র শীতের অনুভূতি নিতেই সে দিনাজপুরে এসেছে। যদিও তখন শীতের শেষাশেষি তবে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ চলছিল উত্তরবঙ্গ জুড়ে। বলল, সে কয়েকটা দিন থাকবে। অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। পল্লব ছুটি পায়নি। ঢাকাতে তো আর তেমন একটা শীত পড়ে না এইসব। 

কয়েক দিন পর শীত কেটে প্রকৃতিতে আবার বসন্ত এসে গেল। আর পল্লব নিজেকে আবিষ্কার করলো দিনাজপুর গামী ট্রেনে। ট্রেন থেকেই ঝিনুতারাকে মেসেজ দিয়ে জানালো। বিকালে ট্রেনটা দিনাজপুর স্টেশনে থামলে সে প্ল্যাটফর্মে ঝিনুতারাকে দেখতে পেল। ট্রেনের দরজা দিয়ে নামার সময় ঝিনুতারা পল্লবের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। পল্লব ঝিনুতারার হাতটা ধরল। দুজনের হাতের তালুতে এমন কোন উষ্ণতা ও স্পর্শকাতরতা ছিল যে ঝিনুতারার প্রথমবারের মতো মনে হল পল্লব তার দুঃখকে নয় তাকেই ভালোবাসে আর পল্লব ভাবলো ঝিনুতারা অতীত থেকে বের হয়ে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে। 

পল্লব ও ঝিনুতারা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের গেটের দিকে গেল, তখন পল্লব হঠাৎ থেমে গেল। ঝিনুতারাও থামল এবং অবাক হয়ে পল্লবের দিকে তাকালো। পল্লব কোটের পকেট থেকে বের করে আনলো একটা লাল গোলাপ আর বাড়িয়ে ধরলো সোজা ঝিনুতারার দিকে।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>