| 19 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

চিকিৎসক

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comআমাদের গ্রামে শ্বেত সন্ত্রাস যত এগিয়ে আসছিল, আমরা ডাঃ মফিজুল ইসলামকে ততই কোণঠাসা হতে দেখছিলাম। শেষপর্যন্ত নিজেরি ঘরে নিজেকে বন্দি করে তিনি বুঝি লুকিয়ে যেতে চাইছিলেন। সবকিছুর থেকে তিনি হার মেনে নিয়েছিলেন। একজন ব্যর্থ, হেরে যাওয়া মানুষের মতই তিনি খাটের উপর চুপচাপ বসেছিলেন। আমরা যখন তাঁর ঘরের দরজাটা খুলি, তখন বাইরে প্রবল শীত, সঙ্গে মিনমিনে বৃষ্টি নেমেছে। আমাদের কারুর কাছে ছাতা ছিল না। দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল আমরা ঠান্ডায় কাঁপছি। তবু ডাঃ মফিজুল ইসলাম আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন না। আমরা নিজেরাই আলনা থেকে তোয়ালে নিয়ে গা-মাথা মুছে নিচ্ছিলাম। আমাদের ভাবতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল খাটের উপর যে ভাঙাচোরা মানুষের আদলটি রয়েছে, তিনিই আমাদের ডাঃ মফিজুল ইসলাম। আদলটির ঘাড় নেমে এসেছে বুকের উপর। পরনের লুঙ্গিটি হাঁটু অব্দি তোলা। তাতে লোমশ পা-দুটি দেখা যাচ্ছিল। কতদিনকার স্থবিরতা যেন এই পা-দুটিকে জাপ্টে বসে আছে। এই পা-দুটি কখনও যে সচল ছিল! সেই স্মৃতিটুকুও বুঝি বা এইখানে নিশ্চল।

উপরের প্যারাগ্রাফটাই এই গল্পের অন্তিম দৃশ্য। কেননা ডাঃ মফিজুল ইসলামকে উপরোক্ত অবস্থায় দেখবার পরেই আমি তাঁকে নিয়ে একটি গল্প লেখবার কথা ভেবেছিলাম। এবং এটাও ঠিক করে নিয়েছিলাম যে গল্পটির মধ্যে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত তৈরি করে সহজেই আমি ডাঃ মফিজুল ইসলামের এই হেন অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হব। পাঠক তখন হেরে যাওয়া, ভেঙে পড়া ডক্তারমশাইকে দেখে যারপরনাই দুঃখ পাবেন। তাঁর দুঃখে নিজেও সামিল হতে পারবেন।

এখন অন্তিম দৃশ্যটি প্রথমেই বলে ফেলায় আমি বেশ ধন্দে পড়েছি। গল্পের শেষটুকু জানা হয়ে গেলে কি গল্প পড়ার মজা খানিক কমে যায়? আমি নিজেও এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর জানি না। কিন্তু ঘটনাটা যখন আমিই ঘটিয়েছি, তখন আমার কাছ থেকে নিশ্চয় আপনারা কিছু কৈফিয়ত আশা করছেন। ভদ্র পাড়ার রীতি এমনিই। তাই যথেষ্ট উদ্বেগের সঙ্গে এইটুকু জানাই, একজন পাঠক শুধুমাত্র গল্পটিই পড়েন না। তিনি গল্পের হয়ে ওঠাটাকেও পড়েন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে (এইভাবে যুক্তি দিলে যুক্তিটাকে বেশি যক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়) পাঠক গল্পের ‘হয়ে ওঠা’টার মধ্যেই যাবতীয় রসের সন্ধান পেয়ে থাকেন। সেই কারণেই তিনি তাঁর ভাললাগা গল্পটির কাছে বারবার ফিরে যান।

যেমন, এইক্ষণে আমি ডাঃ মফিজুলের কাছে ফিরছি। সুতরাং, পুনরায় শুরু করা যাক।

ডাক্তারের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতটি ছিল নিদারুণ যন্ত্রণার। তখন দশ-এগারো বয়েস হবে আমার। গোড়ালির ঠিক নিচে একটা ফোঁড়া হয়েছিল। তার চোটে পা ফুলে ঢোল। এদিকে সামনেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। আর আমি হাঁটতেও পারছি না।

প্রথম প্রথম তেলাকচু পাতা বেটে তার রস লাগান হয়েছিল। এতে নাকি ফোঁড়ার বিষ কেটে যাবে। কোথায় কী! বরঞ্চ যতদিন দিন যায়, আমি বুঝতে পারি, ফোঁড়ার ভেতর যন্ত্রণা কটকট করছে। একদিন বারান্দায় বসে আছি। সকাল দশটার রোদ এসে পড়েছে পায়ের উপর। মনে হল, আমার ডান পা-টা ক্রমশ নীল হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে কার যেন কান্নার আওয়াজ পেলাম। আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামল।

হাঁটা তো আগেই বন্ধ হয়ে গেছিল। এবার দাঁড়াতেও ভয় করতে শুরু করল।

অতঃপর পাড়ার মোড়ের নতুন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারটির কাছে যাওয়া হল।

সব দেখেশুনে ডাক্তারবাবু বললেন, দেখ, ফোড়াটা দুইভাবে ঠিক করা যাবে। যদি কেটে দি’ তাহলে এক্ষুনি সেরে যাবে। আর ওষুধ দিলে প্রথমে পাকবে, তারপর আপনা থেকেই ফেটে গিয়ে সেরে যাবে। সিলিকা ৩০ খুব ভাল ওষুধ। কিন্তু তাতে একটু টাইম লাগবে অবশ্য। এদিকে তোর পরীক্ষা তো সামনে। এখন কী করব তুই ডিসাইড কর।

এর আগে এমন কোন ডাক্তার দেখিনি যিনি রুগীকে অপশন দিচ্ছেন। আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম।

বাবা বলল, কেটেই দিন।

আমি আঁতকে উঠলাম, না!

ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। বাচ্চা তো, কাটতে গেলে ভয় পেয়ে যাবে। আমি ওষুধ দিচ্ছি। এই, জিভটা বার কর।

আমি মা-কালীর মত জিভ বার করলাম।

ডাক্তারবাবু পাঁচ ফোঁটা ওষুধ দিলেন। জিভটা পুড়ে গেল।

পরের দিনেই আমার ফোঁড়াটা সেরে গেছিল। তবে এর পেছনে ওষুধের কোন ভূমিকা ছিল না।

হয়েছিল কী, আমি বারান্দায় শুয়ে শুয়ে পরীক্ষার পড়া করছিলাম। দিদিও আমার পাশে বসে পড়ছিল। কিন্তু যখনি বুঝতে পারছিল মা আশপাশে নেই, সে আমার ক্যাম্বিস বলটা নিয়ে ক্যাচ প্রাক্টিস শুরু করে দিচ্ছিল। আজহারুদ্দিন ছিল তার প্রিয় ক্রিকেটার।

আজহার খুব বড় ক্রিকেটার। তিনি খুব বড় ফিল্ডার। কিন্তু এইখানে তিনি মানব-বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তাঁর নামে ছোড়া বলটি দিদির হাত ফসকে ঠিক আমার ফোঁড়ার উপর এসে পড়েছিল!

তারপর যা হবার তা-ই হল। পুঁজ-রক্তে ভেসে গেল মাদুর। আমার চোখ লাল হয়ে উঠল। আমি চেঁচালাম। আর কী আশ্চর্য, নির্দ্বিধায় দিদিকে সবক শেখাতে সাঁই সাঁই করে দৌড় করালাম পুকুরপাড় অব্দি।

এর কয়েকদিন পর পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, ডাক্তারবাবু বুঝি কোন কলে যাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে সাইকেল থামিয়ে বললেন, কী, কমলো তো! হোমিওপ্যাথির কত জোর দেখেছিস? এ হল গরীবের চিকিৎসা পদ্ধতি। বড় বড় ওষুধ ব্যবসায়ীরা ষড়যন্ত্র করে হোমিওপ্যাথিকে কোণঠাসা করে রেখেছে।

আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম না। রাগে আমার গা কষকষ করছিল।

তবে ডাক্তার ছেড়ে দেবার পাত্র নন। একদিন বাবার মাধ্যমে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন।

এমনিতে ডাক্তারের চেম্বার ফাঁকাই থাকত। যেতেই তিনি ভেতরে ডেকে নিলেন। রুগীর চেয়ারে বসিয়ে বললেন,

-চা খাবি?

-আমি বাইরে চা খাই না।

-হা হা। একগাল হেসে ডাক্তার বললেন, বাইরের চা না। বাড়ির চা। ফ্লাস্কে আছে।

তিনি উত্তরের প্রত্যাশা না করেই কাপে চা ঢাললেন, তা নবী দিবসে কী করা হচ্ছে?

নবী দিবসে বস্তুত কিছুই করার থাকে না। মা পরাটা-সিমুই রান্না করে। কিছু ফকির মিসকিন আসে, তাদের খেতে দেয়। আমরাও খাই। তবে এইসময় বিভিন্ন বাড়িতে মিলাদ বসে। কখন হয়ত বাড়ির বড়দের সঙ্গে সেইসব জায়গায় যেতে হয়। মিলাদে মলিসাব নবীর জীবনকাহিনি সুর দিয়ে বলেন। ধর্মের বাণী ছড়ান। চারদিকে গোলাপ পানির গন্ধ ভাসে তখন।

ডাক্তারবাবু বললেন, কবিতা জানিস? মুখস্থ আছে কিছু?

-হ্যাঁ।

-কী কবিতা?

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রকৃতির প্রতি’।

-বাহ। শোনা তাহলে। দেখি তুই কেমন পারিস।

আমি শুরু করলাম, শত শত প্রেমপাশে টানিয়া হৃদয় / একি খেলা তোর / ক্ষুদ্র এ কোমল প্রাণ, ইহারে বাঁধিতে / কেন এত ডোর?

-বাহ! ডাক্তার লাফিয়ে উঠলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন গ্রেট। আমি ওঁর গানও খুব পছন্দ করি। তুই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিস?

-হ্যাঁ। জন-গণ-মন।

ডাক্তারবাবু আবার হেসে উঠলেন, তাই তো। ঠিক বলেছিস। এই গানটাতে কী সুন্দর করে ম্যাপ আঁকা আছে দেখেছিস? খুব ভাল। আচ্ছা তোরা নতুন কবিদের কবিতা পড়িস?

আমি দু-দিকে মাথা নাড়াই।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনেছিস?

না তো।

ঠিক আছে। আমি তোকে ওঁর কবিতা পড়াব। তার আগে আমার প্ল্যানটা বলি। নবী দিবসের সন্ধেবেলা তোর মত আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমরা একটা প্রোগ্রাম করব। ঐদিন তুই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটা আবৃত্তি করবি, কেমন।

কিন্তু আমি তো ওর কবিতাটা জানি না।

সেতো আমি রয়েছি। আমরা একসঙ্গে পড়ে নেব।

কিন্তু প্রোগ্রামটা কোথায় হবে।

খোলা মাঠে। ডাক্তারবাবু রহস্য মিশিয়ে বললেন, রেললাইনের ধারের মাঠটায়। ঠিক সন্ধে ছ’টায়।

নবী দিবসের আর মাত্র সাত দিন বাকি। আমি রোজ স্কুলের শেষে ডাক্তারের বাড়ি চলে যেতাম। ছোট্ট ঘর। বারান্দার একাংশ ঘিরে রান্নাঘর বানানো হয়েছে। ঘরে ঢুকলেই মনে হবে লোকটি বুঝি এইখানে বেশিদিন থাকবেন না। চারিদিক অগোছাল। খাটের উপর গাছি করা বই। দরজার পাশে একখানা বড় ব্যাগ রাখা। যেন ডাক পড়লেই তিনি এই ব্যাগখানা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারবেন।

ডাক্তারবাবু আগে থেকেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটি বার করে রেখেছিলেন।

বইটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, ৯২ পৃষ্ঠায় চলে যা।

সেই পৃষ্ঠায় ‘রাজা আসে যায়’ কবিতাটি ছাপা রয়েছে।

পড়।

আমি দুলে দুলে পড়তে থাকলাম, রাজা আসে যায়  রাজা বদলায় / নীল জামা গায়  লাল জামা গায়।

হচ্ছে না।

ডাক্তারবাবু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি পড়ছি। আগে আমার পড়াটা শোন।

এইভাবে আমাদের ট্রেনিং শুরু হল। ডাক্তারবাবু মাঝে মাঝে আমাদের জন্য মিষ্টি কিনে রাখতেন। ঠিক হল নীলুফার খাতুন উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবে।

এদিকে আমি কবিতা আবৃত্তি করব, তাও আবার স্টেজে, মায়ের খুশির সীমা নেই। সে সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো করে রান্না সেরে নিয়েছে। বাবার কাজ আছে। বাবা যেতে পারবে না। তবে মা তো আর একলা যাবে না, চারপাশের অনেককেই সে রাজি করিয়ে নিয়েছে।

প্রথমবার স্টেজে ওঠার স্মৃতি বুঝি কেউ ভুলতে পারে না। আমি এখন স্পষ্ট দেখা পাচ্ছি, রেললাইনের মাঠের ওপারে সূর্য নেমে গেল। স্টেজের উপর দুটো হ্যালোজেন তাক করা। একখানা হ্যালোজেন দর্শকদের দিকে।

পৌঁছুতেই ডাক্তারবাবু আমাকে স্টেজের পেছনে নিয়ে চলে গেলেন। মা-কাকিমারা দর্শকদের আসনে গিয়ে বসল।

নীলুফার ফ্রক পরে এসেছে। তার মুখ ফ্যাকাসে। সে কারুর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। ঠোঁট নাড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে নিজের মনেই গানটা বারবার গেয়ে চলেছে।

অবশেষে ডাক্তারবাবু নীলুফারের নাম ঘোষণা করলেন।

নীলুফার গাইতে শুরু করল, সবারে করি আহ্বান

তার গলা শুনে বোঝার উপায় নেই সে এতক্ষণ টেনশানে ছিল।

আমাদেরও ভয় কিছুটা কেটে গিয়েছিল।

সুবীর আবৃত্তি করল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা। কোন কবিতাটি এখন আর মনে পড়ছে না। সুবীরের পরেই আমি।

আমি স্টেজে উঠে প্রথমে সকলকে নমস্কার জানালাম। তারপর শুরু করে দিলাম। আমি চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। কিছুতেই কারুর দিকে তাকাব না তা আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম।

অনুষ্ঠান শেষ। মা প্রায় রাজার মত আমাকে ঘরে নিয়ে ফিরল। মা বুঝতেই পারেনি এইটিই ছিল শুরু, এইখান থেকেই আমরা পথচলা শুরু করেছিলাম।

এদিকে ডাক্তারের পসার ক্রমশ বাড়ছিল। তাঁর চেম্বার আর আগের মত ফাঁকা থাকে না। পরীক্ষার পর ঠিক হল আমরা প্রতিদিন দুপুরবেলা ডাক্তারের ঘরে গিয়ে রিহার্সাল করব। এবার আবৃত্তি নয়; ডাক্তারবাবু আমাদের নিয়ে কোরাস টীম বানাবেন।

কয়েকদিনেই বোঝা গেল আমাদের সবার থেকে অনেক এগিয়ে নীলুফার। তার গলায় সুর এমনিতেই খেলা করতে পারে। দু-তিনজন বেসুর। আমি নিতান্তই অসুর।

যাহোক, কোরাস টীম মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছিল। ঠিক হল নীলুফার কয়েকটি গান একাই গাইবে। এর মধ্যে ওর গলায় ‘হাবিবগঞ্জের জালালি’ গানটি অপূর্ব লাগত।

আমরা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলাম। ডাক্তারবাবু আমাদের পাবলো নেরুদার কবিতা পড়ে শোনাতেন। আমরা মে’ দিবসের কাহিনি জানছিলাম। আমরা কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম কারখানার মাথায় লাল পতাকা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। পতাকাটির পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জালালি নামক কবুতরটি।

কবুতরটি কি হাবিবগঞ্জ থেকে এসেছিল? সুনামগঞ্জে ছিল তার বাড়ি? সুরমা নদী কোথায়? সেই নদীতে সূর্যের আলো বিকেলবেলা আলপনা আঁকে?

কিন্তু টীম যখন প্রায় তৈরি, আমরা দু-একটা প্রোগ্রামও করে ফেলেছি, নীলুফার কারুকে কিছু না জানিয়ে কামাই করতে শুরু করে দিল। ও না এলে রিহার্সাল ঠিকঠাক জমত না। একদিন ডাক্তারবাবু ওকে খুব বকা দিলেন। নীলুফার ওর কামাইয়ের কোন কারণ জানাল না। ওর চোখ দিয়ে শুধু জল নেমে আসছিল।

ও কাঁদছিল, আর আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ওর ডানা বুঝি ভেঙে গিয়েছে। ওর অন্য কোথাও যাবার কথা ছিল। আমাদের গ্রাম, আমাদের রাস্তাঘাট ওর জন্য নয়; ওর প্রকৃত বাসা সুরমা নদীর তীরে, সুনামগঞ্জে ওর আব্বা-মা থাকে, হাবিবগঞ্জ ওর নানার বাড়ি। নীলুফার আমাদের নয়। ও অন্য কারুর। এইখানে ওকে আঁটকে রাখা হয়েছে।

কয়েকদিন পর ওর বাড়ির লোকে জানাল নীলুফার আর আমাদের সঙ্গে রিহার্সাল করতে পারবে না। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।

সেইদিনের জন্য ডাক্তার রিহার্সাল বন্ধ করে দিলেন।

আমাদের একটা কিছু করতেই হবে। এইভাবে মেয়েটাকে মরতে দিতে পারব না।

ডাক্তার নিজের মনেই চেঁচিয়ে উঠলেন। আমরা একে একে বাড়ি ফিরে এলাম।

শেষপর্যন্ত ডাক্তারবাবু কিরকম চেষ্টা করেছিলেন, সেটা আমরা ঠিক জানিনা। তবে কিছু তো একটা হয়েছিলই। কারণ পরেরদিনেই নীলুফারকে তার নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তারবাবুও বেশ কয়েকদিন চেম্বার খোলেননি। তার রূগীর সংখ্যা সাময়িকভাবে কমে গিয়েছিল।

নীলুফারের বিয়ে হয়ে গেল। তার বিয়ে আমাদের দ্রুত বড় করে দিল। গান নেই, কবিতা নেই, ডাক্তারও বিশেষ কথা বলেন না। আমরা নিজেদের আবিষ্কার করলাম মাধ্যমিক পরীক্ষার্থি হিসেবে।

পরীক্ষার পর জন্ডিস। সুতরাং, আবার ডক্তারের খোঁজ পড়ল।

তিনি এলেন। হাতে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’।

শোন, সারাদিন শুয়ে থাকবি। দু’ ঘণ্টা অন্তর গ্লুকোজ খাবি। এই লাইকোপোডিয়াম ৩০ দিয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিকমত খাবি। আর বই পড়বি। লেখাপড়া করবার জন্য জন্ডিস খুব ভাল রোগ। আমি তিনদিন পর আবার আসব।

ডাক্তার চলেন গেলেন। রয়ে গেল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই প্রথম আমি একা একা কবিতা পড়া শিখলাম। এখন আর আবৃত্তি করতে হবে না। কোন কিছু মুখস্থ করতে হবে না। পড়ব নিজের জন্যই। না ভাল লাগলে পড়ব না।

স্বপ্নে আমি দেখেছিলাম তাকে

মাটির সরায় আঁকা আমার মা

মাথার উপর কোজাগরীর আলো

পায়ের পদ্মে জলের যন্ত্রণা

কিংবা

আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে

ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ;

উপড়ে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবাদ্বিপ্রহরে

নিশাচর শ্বাপদেরা; করুক আহ্লাদ

তার শৃঙ্খলিত ছিন্নভিন্ন হাতপা নিয়ে

শকুনেরা। কতটুকু আসেযায় তাতে

আমার, যেআমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,

তোমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে

তিনদিন পর ডাক্তারবাবু এসে বললেন, করেছিস কী! জন্ডিস তো বেড়ে গিয়েছে। কালকেই ব্লাড টেস্ট করাতে হবে।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সত্যিই আমার জন্ডিস বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিলুরুবিন সাড়ে পাঁচে উঠে গেছিল। তবে আমি তাঁর উপর বিশেষ রাগ করিনি। কেননা, ভুলব কিভাবে, তিনি তো পুনরায় আমার সঙ্গে ডাক্তারের যোগাযোগও করিয়ে দিয়েছিলেন।

সুতরাং, সেরে উঠেই নতুন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এবার ডাক্তার নাটকের দল গড়বেন। নাটক শেখাবেন কে? ডাক্তার মিটিমিটি হাসেন। আরও কিছুদিন তিনি রহস্য বজায় রাখতে চান।

মাসখানেকের মধ্যে দশ জনকে জোগাড় করা গেল। এর মধ্যে দুজন মাত্র মেয়ে।

ডাক্তার বললেন, এতেই হবে।

দিনক্ষণ ঠিক করে প্রথম মিটিং-এর ব্যবস্থা করা হল ডাক্তারের বাড়িতেই।

আমি চা বানালাম। মিষ্টি কিনে আনা হয়েছিল।

ডাক্তার সিগারেট ধরালেন, শোন নাটক করা কিন্তু ছেলেমানুষির ব্যাপার না। এটা একটা টীম ওয়ার্ক। সব থেকে আগে দরকার আমাদের পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। আমরা যদি একে অপরকে বিশ্বাস করতে না পারি তবে আমরা কোনদিন ভাল নাটক করতে পারব না। এবার তোরা পরস্পরের সঙ্গে নিজেরাই পরিচিত হয়ে নে’।

ডাক্তারবাবু আমাদের ফেলে রেখে চলে গেলেন। আমরা পরস্পরকে নাম-ঠিকানা বললাম।

সুবীর বলল, নাটক তো করব। কিন্তু কোন নাটক?

এর উত্তর আমদের কাছে অজানা।

দীপা এতক্ষণ চুপ ছিল। হঠাৎ বলল, আমার না ভয় করছে। আমি কোনদিন স্টেজে উঠিনি। আমি কতবার ওঁকে না বলে দিয়েছি। তবু শুনলই না। সোজা বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে নিয়েছে। তখন বলল, নাটক নাকি সবাই করতে পারে। আর এখন বলছে এইটা ছেলেমানুষির ব্যাপার না। ইস! আমার যে কী হবে।

দীপার মত হাল আমাদের প্রত্যেকের। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সবাই মিলে গিয়ে বলব, নাটকের ব্যাপারটা আজকের মত এখানেই থাক।

ও বাবা! বলব কী! দরজা খুলতেই দেখি ডাক্তার একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। মুখে সিগারেট। মেঝেতে ওজন মাপার যন্ত্র।

ডাক্তার বললেন, তোদের সকলের ওজন করিয়ে নিচ্ছি। এখন থেকে খাবারটাবারের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নিতে হবে।

মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ডাক্তার নিজেই কথা বলে এসেছিলেন। মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি – এই তিনদিন স্কুল ছুটির পর একটা ক্লাসঘর আমাদের জন্য বরাদ্দ হল।

ডাক্তার সবাইকে জানিয়ে দিলেন, মনে থাকবে তো? মঙ্গল, বৃহস্পতি,শনি – ঠিক বিকেল ৫টা। একমিনিটও দেরি যেন না হয়।

দিন পনের এমনিই কেটে গেল। কী যে হচ্ছে তা নিজেরাই বুঝতে পারছি না। সপ্তাহে তিনদিন ৫টা থেকে ৭টা আমাদের মধ্যে গল্প জমে উঠল। আমরা যেকোন বিষয় নিয়েই কথা বলতে পারতাম। খেলা আর সিনেমা নিয়েই কথা হত বেশি। নাটক নিয়ে আমরা একটাও কথা বলতাম না।

একদিন দীপা আর নাজিয়াকে ডেকে ডাক্তারবাবু বললেন, তোরা যত পারিস জোরে চেঁচা।

ওরা কিছুতেই গলা খুলে চেঁচাতে পারছিল না।

ডাক্তারবাবু বিরক্ত হয়ে উঠলেন। আচমকা সুবীরকে ডেকে বললেন, তুই চেঁচা।

সুবীর আমাদের মধ্যে সবথেকে সাহসী। সেও ডাক্তারের বকা খেল।

একে একে আমরা প্রত্যেকেই চেষ্টা করলাম।

জীবনে এই প্রথমবার বুঝলাম আমরা এতদিনেও চেঁচাতে শিখিনি!

অবশেষে একদিন তিনি এলেন।

ডাক্তারবাবু সকলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন, তোমাদের নির্দেশক। নন্দিতা। নন্দিতা খুব গুণী মানুষ।

নন্দিতাদি প্রায় ডাক্তারবাবুর সমবয়সী। ডাক্তারবাবুর মধ্যে তখনও কিছু অবিভাবকসুলভ আচরণ রয়ে গেছিল। নন্দিতাদি কিন্তু বন্ধুর মতই আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন।

নন্দিতাদি বললেন, আচ্ছা তোরা কেউ সুকুমার রায়ের ‘চীনেপট্‌কা’ গল্পটি পড়েছিস? আমরা এই গল্পটা নিয়েই নাটক করব।

‘চীনেপট্‌কা’ গল্পটি আমি আগে পড়েছিলাম। তবে বিশেষ কিছু মনে ছিল না।

নন্দিতাদি বললেন, আমি এইটাই চাইছিলাম। আমাদের কারুর গল্পটি পড়া নেই। এইটা ভাল হয়েছে। এখন তাহলে আমরা গল্পটা ফ্রেশ মাইন্ডে পড়তে পারব।

নন্দিতাদি আমাদের প্রত্যেককেই গল্পটির জেরক্স দিয়ে দিলেন। বললেন, বৃহস্পতিবার আমরা গল্পটা পড়ে কী কী ভেবেছি তাই নিয়ে কথা হবে। তবে সবথেকে আগে যেটা জরুরি তোরা কিন্তু কেউ আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করবি না। মনে থাকবে?

স্কুলের পড়া মাথায় উঠল। আমাদের মাথায় চীনেপট্‌কা ফাটতে শুরু করে দিয়েছে। একটিই গল্পকে বারবার করে পড়ছি। পাগলা দাশু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। গল্প ছাড়িয়ে আমরা তার কেরামতি দেখতে পাচ্ছিলাম।

বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটির পর তুমুল ঝড় উঠল। আমি চোখের সামনে একটা আম গাছকে পড়ে যেতে দেখলাম। গাছটি ছিল আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তার পাশেই। ছোটবেলায় আমরা এই গাছটাকে কেন্দ্র করে কতরকমের খেলা খেলতাম। আমাদের ছোটবেলার একটা অধ্যায় যেন গাছটির সঙ্গে শেষ হয়ে গেল!

ঝড়ে ট্রেনের তার ছিঁড়ে গিয়েছে। ট্রেন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ। আজ বোধহয় নন্দিতাদি আসতে পারবে না। ঘরেও আমি থাকতে পারছিলাম না। গাছটি পড়ে গিয়েছে, সেইদিকে কারুর কোন হেলদোল নেই।

মা বলল, গাছটাতে অনেকদিন তেমন ফল ধরত না। ভালই হয়েছে।

বাবা বলল, কালকের মধ্যেই গাছটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। গাড়ি যাবার রাস্তা তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

আমি এই প্রথম বাবা-মাকে ঘেন্না করতে শুরু করলাম। কারুকে কিছু না জানিয়ে পেছনের রাস্তা দিয়ে মাদ্রাসায় চলে গেলাম।

গিয়ে দেখি সকলেই উপস্থিত। খানিকপর নন্দিতাদি পৌঁছে গেল।

ঝড়ের পর বৃষ্টি নেমেছিল। নন্দিতাদি ভিজে চুপসে গিয়েছে।

ডাক্তার চেঁচিয়ে উঠলেন, হুর্‌রে। আমি এখুনি গরম গরম চা নিয়ে আসছি।

নন্দিতাদি ওড়না দিয়েই গা-হাত মুছে নিল। তারপর দীপাকে বলল, তুই গল্পটা খুব ছোট্ট করে বলে দে’।

দীপা শুরু করল – এই গল্পটার প্রধান চরিত্র পাগলা দাশু। পাগলা দাশুর সঙ্গে রামপদর কিছুতেই বনিবনা হয়না। ঘটনাটা ঘটছে রামপদর জন্মদিনে। জন্মদিনে রামপদ একহাঁড়ি মিহিদানা নিয়ে স্কুলে এসেছে। সে সবাইকে মিহিদানা খেতে দিয়েছে। একমাত্র বাদ দাশু। কথক রামপদকে বলে, “দাশুকে কিছু দে।” রামপদ দাশুকে মিহিদানা দিলে দাশু তা হাত পেতে নেয়। কিন্তু নিজে খায় না। সকলের সামনে দারোয়ানের ছাগলটাকে ডেকে খাইয়ে দেয়। এই পুরো ঘটনাটা ঘটছিল টিফিনের সময়। টফিনের পর ক্লাস শুরু হয়েছে, পন্ডিত মশাই ছাত্রদের নদীর শব্দ রূপ করতে দিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। মাস্টার ঘুমিয়ে গেলে যা হয়, ছাত্ররাও নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন খেলা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু দাশু চুপচাপ। বাধ্য ছেলের মত সে বই পড়ছে। এমন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে পটকা ফাটবার শব্দ হল। হতেই থাকল। পণ্ডিত মশাই ভয় পেয়ে একলাফে টেবিল ডিঙ্গিয়ে ক্লাসের মধ্যিখানে এসে পড়লেন। মিনিট পাঁচেক পর দারোয়ান সাবধানে তক্তাটা সরালে দেখা গেল মিহিদানার সেই হাঁড়িটা। সমস্ত সন্দেহ এসে পড়ল রামপদর উপর। সে কানমলা খেল। অন্যান্য শিক্ষকরাও উপস্থিত হয়েছেন। রামপদ বুঝি আরও বড় শাস্তির জন্য তৈরি হচ্ছিল। কেউ তার কোন কথা শুনতে রাজি নয়। এমন সময় আচমকায়, দাশু বলল, আমিই পট্‌কায় আগুন দিয়েছি। গল্পটি শেষ হচ্ছে দাশুর উক্তিতে – “আমার পট্‌কা রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। বাস্‌। ওর মার খাওয়াই উচিত।

দীপা খুব সুন্দর করে গল্পটি বলল। ডাক্তার অভিভূত।

নন্দিতাদি বলল, আচ্ছা, তোরা কি কেউ বলতে পারিস, দাশু কেন পটকায় আগুন লাগানোর কথা অমন অম্লানবদনে সবাইকে জানিয়ে দিল? সে তো পুরোটাই চেপে যেতে পারত, তাই না? এই, নাজিয়া তুই বল্‌। তুই কী ভাবছিস।

নাজিয়া বলল,     ক্লাসের অন্য ছেলেরা নিশ্চয় পরে পণ্ডিত মশাইকে জানিয়ে দিত। অন্যরা বলে দেওয়ার আগে দাশু তাই নিজেই জানিয়ে দিয়েছে। হয়ত সে ভেবেছিল নিজে জানালে শাস্তি কিছুটা কম পাবে।

নন্দিতাদি বলল, কিন্তু আমি তোর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। তোদের মধ্যে আর কেউ কিছু বলবে?

সুবীর বলল, দাশুর মধ্যে মজা হল, সে ভয়ও পায় না, আবার নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়ে মহৎ হবার বান্দাও সে নয়। গল্পের শেষে তো সে নিজেই বলছে রামপদর মার খাওয়াই উচিত।

অসাধারণ। নন্দিতাদির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

ডাক্তার ইতোমধ্যে চা নিয়ে এসেছিলেন। নন্দিতাদি চা-এ চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা আমরা যদি কিছু সময়ের জন্য গল্পটা থেকে ক্লাসরুমটাকে বাদ দিই, তাহলে কী দাঁড়ায়? ধরা যাক একটা স্পেস – ওটা ক্লাসরুম নয়, ঘর নয়, কিছুই নয়; একটা স্পেস – এই স্পেসটাতেই ঘটনাটা ঘটছে। এইবার আমরা ছাত্রদেরও বাদ দিয়ে দিই। মানে দাশু, রামপদ, কথক, পণ্ডিত মশাই…এরা সবাই আছে; কিন্তু এরা কেউ ছাত্র নয়, কেউ পণ্ডিত নয়। এরা কতকগুলো মানুষ, যারা একটা স্পেসের মধ্যে এই ঘটনাটা ঘটাচ্ছে। অর্থাৎ, একজন ঘুমোচ্ছে – লোকটার ঘুমনোর কথা ছিল না, কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে – যাদের চুপ করে থাকবার কথা, দাশু পটকায় আগুন দিচ্ছে, আবার পটকা ফাটাবার অভিযোগে রামপদ শাস্তি পাচ্ছে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে দাশু নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছে। সে দোষ স্বীকার করে নিচ্ছে, কিন্তু রামপদর দিকে মোটেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। অন্য দিকে পণ্ডিত মশাইকে ঘুমিয়ে পড়বার জন্য দোষ দিতেও পিছপা নয়। একটা টোটাল ক্যাওস। যুক্তিহীন একটা স্পেস। এইখানে কোন কিছুই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আচ্ছা এই স্পেসটাকে কী আমরা চিনতে পারছি? আমাদের চারপাশটা কি এমনি যুক্তিহীন নয়? তোদের কী মনে হয়?

আমরা সবাই চুপ। আমরা বুঝতে পারছিলাম আসল গল্প লুকিয়ে থাকে গল্পের বাইরেই। সেই ‘বাইরে’টাতে পৌঁছনোই একজন পাঠকের প্রধান কাজ।

নন্দিতাদি আমাদের প্রত্যেককেই কিছু কিছু কাজ দিল। সুবীরের ভাগে পড়ল সবথেকে আগে এসে ক্লাসরুম ঝাঁট দেবার। নাজিয়া তাকে সাহায্য করবে। দীপা প্রতিদিন ডাক্তারের বাড়ি থেকে হারমোনিয়াম নিয়ে আসবে – আমি তার সঙ্গে যাব। নাসির, অয়ন, মোবারকের উপর ভার পড়েছে কস্টিউম রেডি করবার।

একটু একটু করে আমাদের নাটক এগোচ্ছিল। একটু একটু করে আমরা আমাদের পরিবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম।

পরের দিনেই গাছটাকে কেটে সরিয়ে ফেলার বন্দবস্ত করেছিল বাবা। কাঠ বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পাওয়া গেল।

মা বলল, ফ্রিজটা পুরনো হয়ে গিয়েছে। আর কিছু টাকা দিয়ে নতুন ফ্রিজ নিয়ে এলেই হয়।

দিদি বলল, আমার মোবাইল!

আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না।

নানার ইন্তেকাল হল।

আমি সবাইকে অবাক করিয়ে কবর দিতে গেলাম না।

সেদিন সন্ধেবেলা ডাক্তারবাবু ডেকে পাঠেলেন।

গিয়ে দেখি ডাক্তারের চেম্বারে নাসির, মোবারক, দীপা হাজির।

কী ব্যাপার?

ডাক্তার একটা লিফলেট ধরিয়ে বললেন, পড়ে দেখ।

লিফলেটটাতে একটা জমায়েতের কথা বলা হয়েছে। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিসহ সকল দমনমূলক আইন বাতিলের দাবী নিয়ে জনসমাবেশ।

ডাক্তার বললেন, এই দিন নন্দিতা একটা পথনাটিকা করবে। তোরা পারলে চলে আসিস।

দীপা বলল, বুধবার তো স্কুল!

ডাক্তার হাসলেন। কোন উত্তর দিলেন না।

প্লাটফর্মে সুবীর, নাসির, মোবারক উপস্থিত। নাজিয়াও এসেছে। দীপা নেই।

শিয়ালদহে নামতে দীপার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও কোথা থেকে দৌড়ে এসে নাজিয়ার মাথায় ঝাপর দিল, ইস! ট্রেনটা ছেড়েই দিছিল। আমি কোনরকমে দৌড়ে উঠেছি।

কলেজস্কোয়ারে জমায়েত হবার কথা দুপুর একটা থেকে। আমরা প্রায় ১০মিনিট পরে পৌঁছলাম।

খুব বেশি লোক নেই। শ’খানেকের মত জমায়েত হয়েছে। একজন রোগামত লোক ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমরা ডাক্তারকে খুঁজছিলাম। তখনও ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হয়নি।

চিনিনা, এমন একজন আমার শার্টে একটা কাগজ পিন-আপ করে দিল। কাগজটিতে স্লোগান লেখা।

আচমকা কে যেন পিঠে হাত দিয়ে ডাকল। তাকিয়ে দেখি নীলুফার! সে হাসছে। পেছনে ডাক্তার।

সুবীর চেঁচিয়ে উঠল, তুই কোথা থেকে?

নীলুফার হেসেই চলেছে। ওর চোখের কোণদুটো চিকচিক করছে।

এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, ওর কোলে একটা মাস ছয়েকের বাচ্চাও রয়েছে।

নীলুফার বলল, তোরা আমাকে ভুলে গিছিলি, না?

কী আর বলব!

ও নিজেই আবার বলল, নিশ্চয় ভুলে গিছিলি। তা না হলে খবর নিতিস।

বারে, কার কাছ থেকে খবর নেব?

নীলুফার ডাক্তারের দিকে চাইল। ডাক্তার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

নীলুফার নাছোর, তোদের নাটকের দল নাকি পুরো জমে উঠেছে?

না তো। তবে এইবার জমবে। আমাদের একজন গায়কের দরকার ছিল। সুবীর বলল।

নীলুফার উত্তর করল না।

দীপা জিজ্ঞেস করল, পুঁচকেটার নাম কী?

নাসিম। নীলুফারের গলা ভারী ভারী শোনাল।

ডাক্তার সবাইকে তাগাদা দিয়ে উঠলেন, এই তোরা কী গল্প করতে এখানে এসেছিস? বক্তৃতাগুলো ভাল করে শোন। একটু পরেই নন্দিতার পারফরমেন্স।

আমরা গোল করে দাঁড়িয়েছি। মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় নন্দিতাদি একা। ওর চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। ও দর্শকদের দিকে তাকাচ্ছে। নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছে। আবার তাকাচ্ছে। নন্দিতাদির চোখের সামনে সবকিছু ভস্ম হয়ে যাচ্ছে যেন। ও একবার দেবী হয়ে উঠছে, একবার রাস্তার ভিখারি। সে রাক্ষসী, সে হন্তারক, সে পিশাচ। পরক্ষণেই সে যেন কী অনায়াসে আমাদেরি একজন হয়ে উঠছে।

পারফরমেন্সের শেষে গামছা বিছিয়ে চাঁদা তোলা হল। পুরো টাকাটাই রাজনৈতিক বন্দীদের  জন্য তৈরি তহবিলে দিয়ে দেওয়া হল।

ডাক্তার আমাদের প্যারামাউন্টে নিয়ে গেলেন। বললেন, এখানকার ডাব সরবত বিখ্যাত।

আমরা সবাই একটা করে ডাব সরবত নিলাম।

নীলুফার বারবার তাড়া দিচ্ছিল। বলছিল, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ডাক্তারবাবু।

আরে এতদিন পর এলি, চুপ করে বস।

কিছুপর নন্দিতাদি আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমরা আবার কফি হাউসে গেলাম। ততক্ষণে নীলুফারের মুখ চুপসে গিয়েছে।

আমরা চায়ের দোকান থেকে জল গরম করে এনেছিলাম। তাতে দুধ মিশিয়ে বাচ্চাটাকে খাওয়ানো হল। কলেজস্ট্রীট থেকে বেরতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছিল।

আমাদের নাটক বেশ এগিয়ে গিয়েছে। আমরা নিজেরাই স্ক্রীপ্ট লিখছি। কস্টিউম ডিজাইন করছি। আলো নিয়ে ভাবছি। নন্দিতাদি উচ্চারণ ঠিক করিয়ে দিচ্ছে।

ডাক্তার বললেন, ২৩শে জানুয়ারি নাটকটি করব।

নন্দিতাদি শিওর নয় আমরা এত তাড়াতাড়ি তৈরি হতে পারব কী না।

আচমকা সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।

খবরটা দিল নাজিয়া। নীলুফার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। স্থায়ীভাবে।

মানে?

নাজিয়া জানাল, শ্বশুরবাড়ি থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

কী বলছিস?

হ্যাঁ। ঘরের বউ কারুকে না জানিয়ে মিটিং-মিছিল করেছে। এর থেকে বড় অপরাধ আবার হয় নাকি।

ডাক্তারের মাথায় বর্জ্রপাত! তিনি মুহুর্তেই স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ঘটনাটা এখানেই থেমে থাকল না। স্কুল থেকে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হল সামনেই ইস্তেমা। ফলে কিছুদিনের জন্য ক্লাসরুমে আমাদের রিহার্সাল বন্ধ করতে হবে।

ইস্তেমার কথাটা মিথ্যে নয়। প্রতি বছর এমন সময় ইস্তেমা হয়। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের মনোভাবে স্পষ্ট আমরা হয়ত আর কোনদিন রিহার্সালের জন্য স্কুলটিকে ব্যবহার করতে পারব না।

নন্দিতাদি বলল, তোরা আমার বাড়ি আসতে পারিস।

আমরা তাতে কেউ রাজি হলাম না। বললাম, এইখানে কোথাও না কোথাও ঠিক জায়গা পেয়ে যাব।

কিন্তু ডাক্তার প্রায় গায়েব হয়ে গেলেন। একদিন শোনা গেল তাঁর চেম্বারটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। রাস্তায় “ডাঃ মফিজুল ইসলাম” লেখা বোর্ডটি পড়ে থাকতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।

অবশেষে ইস্তেমা! হাজার হাজার লোক কতদূর থেকে এসেছে। তাদের সকলের মাথায় ফেজ টুপি। বেশির ভাগের পরনের পোশাকটিও সাদা। স্টেশন রোডে আর হাঁটতে পারা যাচ্ছে না। শ্বেত ও শুভ্র বর্ণের উল্লাসে আমরা খড়কুটোর মত ডিগবাজি খেতে খেতে কোথায় যেন ভেসে চলছিলাম। আমাদের কাছে ফিরে তাকাবার আর কোন কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

সুবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। দীপা আর নাজিয়া এই সময় বাইরে বেরতে পারবে না। মোবারককে বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয়েছে সে যেন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে। নাসির কোনরকমে লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারল।

সুবীর বলল, নন্দিতাদিকে একবার জানাই।

নন্দিতাদিকে ফোন করা হল। নন্দিতাদি এককথায় রাজি।

ঠিক হল সন্ধ্যেবেলা আমরা সবাই মিলে ডাক্তারের বাসায় যাব। এভাবে আমরা সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি না।

বিকেল থেকে বৃষ্টি নামল।

নন্দিতাদি জানিয়ে দিয়েছেন বৃষ্টির কারণে তার আসতে খানিক দেরি হবে। আমরা ঠিক করলাম নন্দিতাদির জন্য আর অপেক্ষা করব না। দিদি ডাক্তারের বাড়ি চেনে। সে ঠিক সেইখানে চলে যাবে।

সুতরাং, আমরা তিনজন শ্বেত ও শুভ্র বর্ণের ঝলকানিকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

যখন দরজার সম্মুখে, ততক্ষণে ভিজে চুপসে গিয়েছি।

সুবীর দরজাটি ঠেলল। দরজাটি ভেতর থেকে বন্ধ করা ছিল না।

ঘর অন্ধকার। তবু মানুষটির আদল বোঝা যাচ্ছে।

সুবীর বলল, ডাক্তারবাবু আমরা এসেছি।

মানুষটা বুঝি একবার মুখ তুলল। তারপর আবার ঘাড়টা নামিয়ে আনল বুকের উপর।

নাসির আলো জ্বালাল।

ডাক্তার হাত নাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিতে বললেন।

আমরা আলো নিভিয়ে দিলাম।

সুবীর বলল, ডাক্তারবাবু আমরা রিহার্সালের জন্য জায়গা ঠিক করে ফেলেছি।

ডাক্তার নিরুত্তর।

আমি বললাম, চা খাবেন? চা করে দেব।

মানুষটা দুদিকে মাথা নাড়ল।

নাসির বলল, আপনি পুলিসে একটা কমপ্লেন করুণ। কারা চেম্বার ভেঙেছে আমরা তো জানি। আমরা সাক্ষী দেব।

ডাক্তার কোন কথাই বললেন না।

হঠাৎ-ই দরজায় খুট শব্দ। ডাক্তার চমকে উঠলেন।

নিশ্চয় নীলুফার। আমি ওর জন্য দরজা খুলে রেখেছিলাম।

ডাক্তারের কথায় আমরা কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।

সুবীর দরজা খুলে নন্দিতাদিকে ঘরে নিয়ে এল।

ও তুমি!

ডাক্তারবাবু আবার মুখ নামিয়ে নিলেন।

আমরা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছিলাম। নন্দিতাদি ডাক্তারের জন্য একটা বই নিয়ে এসেছে।

নাসির চা করল।

আমরা অযথা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কোন কথার কোন মানে হচ্ছিল না।

আচমকা একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ পেলাম।

ডাক্তার চমকে উঠলেন, কে? কে ওখানে?

আমরা তাকিয়ে দেখলাম দরজার ওপারে কেউ একজন ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ডাক্তারবাবু আমাদের প্রায় সরিয়ে দিয়ে নিজেই দরজাটা খুলে দিতে ছুটে গেলেন।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত