manas sarkar,irabotee.com,ইরাবতী.কম,ইরাবতীcopyraight by irabotee.com,

স্বাগত 

Reading Time: 3 minutes

(১)

চোখটা একবার রগড়ে নিয়ে আবার ভাল করে দেখল অভিলাষ। নাহ, ঠিকই আছে। অভিলাষ ঘোষ, রোল নম্বর, কালকে নেটেও একই জিনিষ দেখেছে। বিশ্বাস করতে পারেনি। আজ সাত সকালেই ছুটে এসেছিল শ্রীরামপুরে। বহু দিনের স্বপ্ন আজ ওর স্বার্থক – এবার ওর ইঞ্জিনিয়ার হওয়া আর কেউ আটকাতে পারবে না। কম খেটেছে শেষ একটা বছর। সবই প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল–বন্ধুবান্ধব, টিভি। এমনকী, যে কম্পিউটার ছাড়া ওর একটা মিনিট চলত না, তাকে অবধি। অবশ্য এর সঙ্গে যোগ করতে হবে বাবার টাকাকেও। কোনও কিছু যেন অপূর্ণ রাখতে চায়নি বাবা অভিলাষের কেরিয়ারের পিছনে। আর একজনকেও এই মুহূর্তে না মনে করে পারল না। শ্রীজীব স্যারকে। জয়েন্ট প্রথম দু’-হাজারে ওকে নিয়ে আসতে যে মানুষটা ওর পিছনে নিরলস পরিশ্রম করেছে, সেটা আর কেউ নয় – এই স্যারই। জয়েন্টের ম্যাথ আর ফিজিক্স দেখাতেন। শক্ত-শক্ত অঙ্কগুলোকে যেভাবে স্যার মিলিয়ে দিতেন, হাঁ করে তাকিয়ে থাকত ও আর বন্ধুরা। সাদা অঙ্ক খাতাটায় কালো কালির পেন দিয়ে যে ভাবে অঙ্কগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন, মনে হত কতগুলো কালো মুক্ত ছড়িয়ে আছে ঐ পাতাগুলোয়। অদ্ভুত সব দার্শনিক কথা বলতেন স্যার। কালো কালি নাকি জ্ঞানের প্রতীক। কালো কালিতে অঙ্ক না করলে নাকি পুরো জ্ঞান অঙ্কটায় প্রয়োগ করা যায় না। প্রাইভেট টিউশন ওনি করেন বেছে-বেছে। চন্দননগরের মতো জায়গাতে আই, আই, টি আর জয়েন্ট স্টুডেন্টদের তাই স্যারকে ঘিরে আগ্রহের শেষ নেই। মুহূর্তটাকে কীভাবে সেলিব্রেট করবে, জানা নেই অভিলাষের। সবচেয়ে আগে বাবাকে একটা ফোন করতে ইচ্ছা হল। আনন্দঘন মুহূর্ত বড় টালমাটাল। কথাও বিভ্রান্ত হয়। নিজেকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল ও।

(২)

কাউন্সেলিং শেষ হতেই চন্ডীপুর প্লেসমেন্টটা অভিলাষের কাছে নিশ্চিত হয়ে গেল। শ্রীজীব স্যার ওকে প্রায় নিশ্চিত করেই দিয়েছিলেন। খুব একটা অবাক হল না। একে কেমিক্যাল, তার উপর চন্ডীপুরের মতো ফ্যাকাল্টি পাবে–আনন্দের সীমাটা কোথায় চোখে পড়ছিল না ওর। এতদিনের স্বপ্নটার বাস্তব রুপ প্রতি মুহূর্তেই অভিলাষকে এক মোহময় জগৎ-এ আবিষ্ট করে তুলছিল। কেরিয়ার মনস্ক মানুষের বোধহয় একটা ত্রুটিই যে, কেরিয়ার ছাড়া অন্য সবকিছুতে বড় অচেতন। বড় নিষ্প্রভ। আনন্দের যাবতীয় ঢেউগুলো তাদের কেরিয়ারকে ঘিরেই ওঠে। অভিলাষ ভেসেই চলেছিল। সবচেয়ে আগে ওখানে গিয়েই একটা ভাল প্রাইভেট টিউটরের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা কলেজ ফ্যাকাল্টির মধ্যে হলেই ভাল হয়। স্যার বলেছিলেন, ফার্স্ট আর সেকেন্ড সেমিস্টারে প্র্যাকটিক্যালটা বড্ড বড় ফ্যাক্টর। কোনওভাবেই এটাকে নেগলেক্ট করলে চলবে না।  বি.ই.-তে রেজাল্ট ভাল না করতে পারলে এম.ই.তে-ও যে চান্স পাবে না – চিন্তাটা মাথায় জাঁকিয়ে বসছে ক্রমশ।

(৩)

বাবাকে চিরকালই অভিলাষ মানসিকভাবে ভীষণ শক্তপোক্ত দেখে এসেছে। সেই বাবাকেই আজ যখন হোস্টেল চত্বর থেকে বেড়িয়ে যেতে দেখল, ওর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিল। ওর ছোট্ট জীবনে আশা-ভরসা যদি কেউ যুগিয়ে থাকে, সেটা ওর বাবা। বাবার চোখের জল স্পষ্টই বলে দিচ্ছিল, ভেতরে কতটা ঝড় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বাবার সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রাটাও চোখের সামনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ছেলে মা-কে ছেড়ে চলে আসবে এর থেকে কষ্টের কিছু নেই। তবুও অভিলাষ শোকে আকুল হতে পারেনি। বাবা কিন্তু যাবার সময় ওকে সেটা করে দিয়ে গেল। বারবার বাবা বুঝিয়েগেছে, সম্ভাব্য কী কী বিপদ ওর সামনে আসতে পারে। তার মোকাবিলাই বা কীভাবেকরতে হবে? যে সুযোগ অভিলাষ পেয়েছে, তা খুব কম মানুষই পায়। ওর মনে হচ্ছিল, একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। নীচটা ছোট আর দূর তো লাগবেই।

(৪)

ঠোঁটটা এখনও জ্বলে চলেছে অভিলাষের। একশ ওয়াটের জ্বলন্ত বালবে চুমু। কোনওদিন কল্পনাই করেনি। চুমু জিনিষটা নিয়ে ও এই প্রথম এত ভাবল। চুমু তো খাবার জন্যই। কিন্তু, ওটা শুধু ঠোঁটে খাবার জিনিষ নয়। চুমু মানুষের মনে সুখের পরশ বয়ে আনে। কোথায় সে পরশ! এত বিস্বাদের হলে ও আর কোনদিন চুমু খাবে না।

(৫)

সময় যেরকম মানুষের জীবনে আসে, সেভাবেই তাকে নিতে হয়। ভাল না লাগলেও। অভিলাষের জীবনে এখন এই ভাল না লাগা সময়টা এসেছে। অভিলাষের চারপাশটা সমসময়েই ওর পক্ষে ছিল। ফলে, কেরিয়ার, জীবনে এগিয়ে যাবার স্বপ্নটা সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে। অ-প্রধান জিনিস গুলোই আজকাল ওর জীবনে প্রধান হয়ে উঠছে।খাদ্য মানুষকে পুষ্টি দেয়। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা গুলোকে এগিয়ে নিয়ে চলে। এ খাদ্যে একেবারেই নুন নেই। চোখের জলে প্রচুর নুন আছে। চোখের জল দিয়ে খাদ্যের স্বাদ কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের বদলে এখন সেটাই এক্সপেরিমেন্ট করে চলেছে অভিলাষ।

(৬)

ভীর ঘুমে মানুষ স্বপ্ন দেখে। মনের চেতন জগত থেকে ক্রমশ অচেতন জগতে প্রবেশ করাটাই স্বপ্ন। কিছু স্বপ্নে আসে সুখ, আর কিছু স্বপ্ন জীবনকে করে তোলে দুঃসহ। চেতন-অচেতন জগৎ সব কেমন যেন মিশে যাচ্ছে অভিলাষের।  ও যেন একটা গাছ হয়ে গিয়েছিল। ডালপালাগুলোকে কারা যেন মুচড়ে-দুমড়ে ভাঙছিল। ওরা বলে চলেছিল, গাছটা নাকি বেঢপ। ওরা শুধু একটু সেপ দিতে চায়। ভরে আসা কুঁড়িগুলোর আর্তনাদ চরমে উঠছিল, পাতা ঝড়ছিল, গাছটা যাচ্ছিল শুকিয়ে। বাগানের আরো দু’-একটা গাছেরও আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। গাছটার গোড়ায় একমগ অ্যসিড ঢালতেই গাছটা ন্যাড়া-বুচো হয়ে বিশ্রী চেহারা নিল।

(৭)

আবার নির্যাতন ছাত্রাবাসে, এক ছাত্রের আত্মহত্যা পত্রিকা, বিশেষ প্রতিনিধি, চন্ডীপুর। র‍্যাগিং-কে যতই বে আইনি ঘোষণা করুক সরকার, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজগুলোয় ছাত্র নির্যাতন নিঃসন্দেহে বেড়ে চলেছে। এবার শিকার চন্দননগর থেকে পড়তে আসা অভিলাষ ঘোষ নামে এক কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজের অধ্যক্ষ অভিভাবকদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েন।  ঘটনার সূত্রপাত ওই ছাত্র প্রথম বর্ষে ভর্ত্তি হওয়া থেকেই। অভিলাষের রুমমেট ও খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা স্বর্ণাভ দাসের মতে, “ভীষণই ফ্রাসটেডেড হয়ে পড়ছিল। ওকে যখন-তখন সিনিয়র দাদারা ডিসটার্ব করত। কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল শেষ এক সপ্তাহ।” কারা এ ব্যাপারে ঠিক জড়িত জানতে চাওয়া হলে অবশ্য সে এ ব্যাপারে একেবারেই মুখ খুলতে চায়নি স্বর্ণাভ। তবে আকার-ইঙ্গিতে এটা স্পষ্ট যে, অভিলাষকে মারধোরও করা হয়েছিল। শোকে পাথর হয়ে যাওয়া অভিলাষের বাবা অবশ্য এদিনই চন্ডীপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অধ্যক্ষ অবশ্য সব রকমের বিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন ও দোষী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। অভিলাষের ফেসবুকে শেষ পোষ্ট ছিল, ‘প্রফেশনাল পৃথিবীতে সমস্ত বন্ধুদের স্বাগত জানাই’।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>