| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

ইরাবতী এইদিনে গল্প: ন্যাশন ৫৭০ | মনি হায়দার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

আজ ১ মে কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদীর পাড়ে নৌকাটা ভেড়ায় মাঝি। মাথার ওপর লাল সবুজ নীল হলদে রঙের কাপড়ের বাদাম। বাতাসে বাদাম বিপুল বিক্রমে ফুলে উঠছে। মাঝি নৌকা সামলানোর চেষ্টা করছে। নদীর ঢেউ আর বাতাসের বেগে নৌকা দুলছে প্রবল। আবার নামছে মুষলধারায় বৃষ্টি। নৌকা তীরের শক্ত মাটিতে ঠেকছে আবার দূরে সরে যাচ্ছে। বৃষ্টি, প্রবল বাতাসের মধ্যে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নামে আগন্তক। শক্ত সামর্থ শরীর। বলিষ্ঠ বাম হাতে তীক্ষ্ণ বর্ষা। মাথায় বর্ষাতি। ডান হাতে কাচে ঘেরা আলোর আধার।  নৌকা থেকে নেমে নৌকার দিকে ফিরে দাঁড়ায় আগন্তক।

হরিবোল?

কন বাবাজী।

আমি না আসা পর্যন্ত এইখানে থাকবি। নৌকায় রান্না করবি। খাবি, ঘুমাবি।

হরিবোল চিৎকার করে, আপনে কবে আসবেন?

আমি বলতে পারি না, কবে আসবো। কিন্তু আমি যখনই আসি, তোরে এখানে যেন পাই। তোকে না পেলে, আমি আর দেশে ফিরে যেতে পারবো না।

বৃষ্টিতে নেমে আসা মাথার পানি মুছতে মুছতে জবাব দেয় হরিবোল, আইচ্চা।

আগন্তক বর্ষার মধ্যে পা ফেলে যাত্রা শুরু করলো। ঘন অন্ধকারের কারণে বোঝা যাচ্ছে না, এখন রাত না দিন। আগন্তুক, যখন যাত্রা শুরু করেছিল, দু’দিন আগে, তখন আকাশ ছিল মেঘমুক্ত। দরিয়া ছিল শুনসান। কিন্তু একটা দিন যেতে না যেতেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। বইতে শুরু করে উজানের বাতাস। নদীর পানি হেসে ওঠে ভয়ংকরভাবে। একটা নৌকার হাল ধরে রাখতে পারছিল না হরিবোল। হরিবোলকে সাহায্য করে আগন্তক। দাড় টানতে শুরু করে। দুই দিন দুই রাত ঝড় আর তরঙ্গে সঙ্গে লড়াই করে, নৌকা এসে ভেড়ে কূলে। আর মাত্র চারদিন হাতে আছে আগন্তকের। যেভাবেই হোক, কাঙ্ক্ষিত দ্রব্য নিয়ে ফিরে যেতে হবে, নিজের এলাকায়। প্রিয় জায়া মারা গেছেন। তার শেষ অভিলাষ অবশই পূরণ করবে, আমাদের গল্পের নায়ক, আগন্তুক। স্ত্রী জাহ্নবীকে ভীষণ ভালোবাসে আগন্তুক। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রিয় স্ত্রী জীবন বিসর্জন দিয়েছে। পুত্রসন্তান প্রাপক দাদীর কাছে। জাহ্নবীকে কঠিন হিম ঘরে রাখা হয়েছে। আগন্তক যখন জাহ্নবীর শেষ প্রার্থনার দ্রব্যটি নিয়ে যেতে পারবে, তখনই হিম ঘর থেকে বের করে গোসল করানো হবে দ্রাক্ষারসে।

আগন্তক ছুটছে। ছুটতে ছুটতে ভিজতে ভিজতে আগন্তক এসে দাঁড়ায় বিলের সামনে। চারদিকে থৈ থৈ পানি। যতদূরে চোখ যায়, পানি পানি আর পানি। হতভম্ব আগন্তক বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, চলে যাবো? কেমন করে পার হবো এই বিল? কিন্তু আমার স্ত্রী জাহ্নবীর শেষ মনোবাঞ্চা পূরণ করতে পারবো না? না, আমাকে পারতেই হবে। আগন্তুক বিলের পার ধরে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। বৃষ্টি কমে আসছে কিন্তু পড়ছে। বৃষ্টি মেখে মেখে আগন্তক হাঁটতে হাঁটতে থাকে। অনেক দূর হাঁটার পরে আগন্তুক একটা ভেলা ভাসতে দেখে বিলে। বিলে ঝাপিয়ে পরে সাঁতার কাটতে শুরু করে। সাঁতার কেটে ভেলায় উঠে পায় একটা লগি। লগি হাতে আগন্তুক ভেলা সামনের দিকে ঠেলেতে শুরু করে। পানি কেটে কেটে ভেলা এগিয়ে যায়, এগিয়ে যায়, এগিয়ে যায়।  যেতে যেতে  বেলা যখন পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়েছে, বৃষ্টি একেবারে নেই। ডুবে যাওয়ার আগে সূর্য দিনের শেষ আলোর চিহ্ন রেখে যায়। ক্লান্ত আগন্তক আলোর ধারা দেখে খুশি। দূরের দৃষ্টিতে একটা গ্রামের আবছা ছায়াও দেখতে পায় আগন্তুক। তার ভেতরটা চনমন করে ওঠে। তাহলে, এসে গেছি লোকালয়ে। লোকালয়ে গেলেই আমার প্রিয় স্ত্রীর আকাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি পেয়ে যাবো। আগন্তুক কপালে মুছে থাকা ঘাম মুছে দ্বিগুন উৎসাহে, লগি মারতে থাকে। সূর্যের শেষ রশ্মিও মিলিয়ে যায়, আগন্তক ভেলা ভেড়ায় তীরে।

ভেলা মাটি স্পর্শ করতে না করতেই আগন্তুক লাফ দিয়ে মাটিতে ওঠে। উঠেই আগন্তুক সামনে তাকায়। একটু দূরে কয়েকটা ছোট ছোট কুটির দেখতে পাচ্ছে আগন্তুক। মুখে হাসি, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে…। দৌড় শুরু করে আগন্তুক। দৌড়ে কুটিরের কাছে যায়। কয়েকটা কুটিরে মিট মিট আলো জ্বলতে শুরু করেছে। ভেজা শরীর নিয়ে আগন্তুক একটা কুটিরের সামনে দামনে দাঁড়ায়, ভাই?

কুটির নয়, আসলে এগুলো ক্ষুদ্র দোকান। দোকানদার পুঁথি পাঠ করছিল। ভাই শব্দে চোখে শক্ত পাওয়ারের খুলে তাকায় দোকানদার, বলেন।

আপনার দোকানে সুবাসিত সাবান আছে?

সুবাসিত সাবান?

হ্যাঁ। সুবাসিত সাবান।

আছে।

আগন্তকের চোখে মুখে স্বস্থির আলো, দিন। আমাকে একটা সুবাসিত সাবান দিন।

দোকানদার তাকের উপর হাত দিয়ে একটা সাবান আগন্তকের হাতে দেয়, নিন।

আগন্তুক সাবান হাতে নিয়ে অবাক, এইটা সুবাসিত সাবান?

মাথায় নাড়ায় দোকানদার, জি।

না, আমি এই সাবানের চেয়েও ভালো সাবান চাই।

আমার কাছে নেই, দোকানদার সাফ জানিয়ে দেয়।

সাবান রেখে আগন্তুক তাকায় অন্যান্য দোকানের দিকে, দেখি। ওইসব দোকানে আছে কি না! এগিয়ে যায় আগন্তুক। একে একে সবকটি দোকানে যায়, আগন্তুক। প্রত্যেকে দোকানে দোকানে ঘোরে, সবাই একই সাবান দেখায়। বিস্মিত আগন্তুক, এ কোন দেশে এলাম? এক দোকানদারের কাছ থেকে এক জগ পানি পান করে, আমি আরও উন্নতমানের সুবাসিত সাবান চাই। কোথায় পাওয়া যেতে পারে?

আপনি গঞ্জে যেতে পারেন।

গঞ্জ কোথায়?

এখান থেকে আশি ক্রোশ দূরে।

আশি ক্রোশ দূরে? কীভাবে যাওয়া যায়?

ওই যে দূরে দেখতেছেন কাঁপা কাঁপা আলো, ওইটা গরুর গাড়ির আলো। সামনের রাস্তা ধরে গরুর গাড়ি যাইতেছে গঞ্জে। আপনি ওই গাড়িতে যেতে পারেন।

আগন্তুক দৌড়ে বড় রাস্তায় আসে। ক্যাচ ক্যাচ ক্যাচ ক্যাচড় ক্যাচড় শব্দে কিছুক্ষণ আগে একটা গরুরগাড়ি চলে যায়। আাগন্তুক পরের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। রাত ক্রমশ বাড়ছে। মশা আক্রমণ করছে। চটাশ শব্দে মশা মারছে। মশা মারতে মারতে একটা গরুর গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ায়।

গঞ্জে যাবেন? গাড়োয়ান জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ যাবো। আগন্তুক দ্রুত গরুর গাড়িতে উঠে বসে।

হেই হঠ হঠ..গাড়োয়ান গরুর পিঠে আঘাত করে। গরুর গাড়িতে আবার শব্দ ওঠে, ক্যাঁচ ক্যাঁচ, ক্যাঁচড়। শেষ রাতের দিকে গরুর গাড়ি গঞ্জে পৌঁছুলে আগন্তক ভাড়া মিটিয়ে একটা হোটেলে ঢোকে। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে আগন্তক আগ্রহের সঙ্গে গঞ্জে এক লোককে জিজ্ঞেস করে, ভাই বড় মুদী মনোহারী দোকান কোন দিকে?

ওই যে সামনের দিকে গিয়ে ডানের রাস্তায় প্রবেশ করলেই মুদী মনোহারীর বড় বড় দোকান পাবেন।

ধন্যবাদ আপনাকে, আগন্তুক দ্রুত সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। হেঁটে ডানের রাস্তায় ঢুকেই দেখতে পায় সারি সারি মুদী মনোহারী দোকান। হাসি ফোটে আগন্তুকের মুখে। ভাবেন, এতো সুন্দর পরিপাটি সাজানো দোকানে আমার কাংখিত সুবাসিত সাবান অবশ্যই পাবো। এবং আমার প্রিয়তম মানুষটির শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে সক্ষম হবো। দিনটা ভারী সুন্দর। বৃষ্টি নেই। আকাশটা পদ্মপুকুরের পানির মতো ঝকমক করছে। আগন্তুক একটা কাচের দরজা ঠেলে একটা দোকানে প্রবেশ করেন। সুবেশী বিক্রেতা স্বাগত জানিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী প্রয়োজন আপনার?

সাবান। সুবাসিত সাবান।

সুবানিত সাবান! আপনি অপেক্ষা করুন। আমি এখনই দিচ্ছি। বিক্রেতা সারিবদ্ধ সাজানো দ্রব্যাদির মধ্যে থেকে সুদৃশ্য একটি প্যাকেট এনে আগন্তুকের হাতে দেয়, নিন।

আগন্তুক পরম আগ্রহের সঙ্গে সুদৃশ্য প্যাকেটটি খোলে। এবং খুলেই হতাশায় বিক্রেতার দিকে তাকায়, এই সাবানতো আমি গ্রাম এলাকায় পেয়েছিলাম। এই সাবান নয়, আমি চাই এমন একটি সাবান, যে সাবান সুবাসিত গন্ধে আমোদিত।

আমাদের গঞ্জে আমরা একটা এই সাবানই বিক্রি করি, জানায় বিক্রেতা।

আর কোনো সাবান বিক্রি করে না এই গঞ্জ?

মাথা নাড়ায় বিক্রেতা, জি।  আপনি ঠিকই বলেছেন। সারা গঞ্জে আপনি মাত্র এই একটা সাবানই পাবেন। আর কোনো সাবান পাবেন না।

অসহিষ্ণু আগন্তুক বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ায়, এতো পরিশ্রম করার পরও আমি আমার প্রিয়তম মানুষটির শেষ অভিপ্রায় অনুযাযী একটা সাবান সংগ্রহ করতে পারবো না!

আগন্তুকের বিষণ্ণ মুখ আর আর্ত-হাহাকারে বিচলিত বিক্রেতা দয়ার্তবোধ করে, আপনি আমাদের রাজধানী শহরে যেতে পারেন। সেখানে দূর বৈদেশ থেকে অনেক মানুষ  আসে। আসে অনেক সওদাগর। আমার মনে হয়, আপনার কাঙ্ক্ষিত সাবান আপনি রাজধানী শহরে পেয়ে যাবেন।

আপনি সত্যি বলছেন? অকূল দরিয়ায় ডুবে যেতে যেতে যেনো আগন্তুক একটি ভরসার খড় পেয়ে যায়।

আমি অনুমান করে বলছি। রাজধানী শহরে গেলে আপনি সুবাসিত সাবান পেয়েও যেতে পারেন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে,আপনি অনেক দূর থেকে এসেছেন একটি সুবাসিত সাবানের জন্য। অথচ পাচ্ছেন না। আমি আপনার কষ্ট অনুভব করেই বলছি, রাজধানী শহরে গেলে হয়তো আপনি সাবানটা পেয়ে যেতে পারেন।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কীভাবে যাবো?

আমাদের এই গঞ্জের উপকণ্ঠ থেকে ঘোড়ায় টানা শকট যায়। অবশ্য এখান থেকে রাজধানীর অনেক দূর। প্রায় এক হাজার ক্রোশ। যেতে যেতে আপনার দিন তিন রাত লেগে যাবে।

লাগুক, আমি যাবো। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ একটা পথ বাতলে দেয়ার জন্য। আপনার কল্যাণ হোক—আগন্তুক সময় নষ্ট করতে চায় না।

দ্রুত হাঁটতে শুরু করে সামনের দিকে, যেখানে ঘোড়ার গাড়ি ছাড়ে রাজধানী শহরের উদ্দেশে। দ্রুত হেঁটে আগন্তুক পৌঁছে যায় ঘোড়ার গাড়ি টানা স্টেশনে। রাজধানী অভিমুখে একটা গাড়িতে উঠে বসে আগন্তুক। গাড়ি চলতে শুরু করে। তিন দিন তিন রাত পার করে অশেষ কষ্ট আর বিড়ম্বনা সহ্য করে মধ্য দুপুরের পরে, বিকেলের প্রথম প্রহরে ঘোড়ার গাড়ি রাজধানী শহরে পৌঁছায়। অবসন্ন ক্লান্ত শরীরের আগন্তুক একটা সরাইখানায় ঢুকে প্রথমে গোসল সেরে, খাওয়া-দাওয়া করে, তিলক মাত্র বিশ্রাম না নিয়ে রাস্তায় নামে। সারি সারি অট্রালিকার মাঝে কোনটা দোকান বোঝাই যায় না, বিশেষ করে শহরে আসা নতুনদের জন্য। অনেক হেঁটে কোনো দোকান দেখতে পায় না আগন্তুক। দোকান দেখতে না পেয়ে আগন্তুক যখন ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে, দেখতে পায় একজন বয়স্ক নাগরিককে। বয়স্ক নাগরিককে জিজ্ঞেস করে, রাজধানী শহরের দোকানপাট কোথায় অনুগ্রহ করে আমাকে বলবেন?

আপনি নিশ্চয়ই বিদেশী?

অনেকটা তাই।

আজ সরকারী ছুটির দিন। তাই রাজধানীর সব দোকানপাট বন্ধ।

দোকানপাট বন্ধ!

আগামীকাল সকাল থেকে আবার সব পাবেন।

আগন্তুক গভীর দুঃখের দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, কী আর করা? একটা সুবাসিত সাবানের জন্য যখন এত দীর্ঘ যাত্রা, এসে পৌঁছুলাম রাজধানী শহরে, নিশ্চয়ই জাহ্নবীর কাঙ্ক্ষিত সাবান কাল পাওয়া যাবে। তবুও খালিহাতে আমি ফিরে যাবো না আমার প্রিয়তম জাহ্নবীর কাছে। আবার ফিরে আসতে বাধ্য হয় সরাইখানায়। সরাইখানার বিছানায় শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগন্তুক শরীর ভেঙ্গে ঘুম আসে। সেই যে যাত্রা শুরু করেছিল, আর তো বিশ্রাম নেই। এই অবসরে এক রাতের বিশ্রাম পাওয়া গেলো। পরের দিন খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গলে আগন্তুক হাত মুখ ধুয়ে, নাস্তা সেরে আবার পথে নামে।

পথে নেমেই দেখতে পায়, সারি সারি দোকান। দ্রুত একটা  মনোহরী দোকানে প্রবেশ করেই বিক্রেতার কাছে সাবান চায়। বিক্রেতা সুদৃশ্য একটা প্যাকেট এনে হাতে দেয়, নিন।

গঞ্জের চেয়েও উন্নতমানের একটা প্যাকেট, হাতে নিয়েই ঘ্রাণ নেয় আগন্তুক। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ প্রবেশ করে নাকের ভেতরে। উৎফুল্ল আগন্তুক দ্রুত প্যাকেট খোলে এবং হাতাশার অবিভ্যাক্তি নিয়ে তাকায় বিক্রেতার দিকে, এটা কী দিলেন আমাকে?

কেন, সুবাসিত সাবান?

কিন্তু সাবানের নাম ৫৭০ কেনো? আমি সেই প্রান্ত গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছি। সেই গ্রাম, গঞ্জ আর প্রায় এক হাজার ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে রাজধানীতে এসেও একই সাবান, ৫৭০! লালচে এই সাবান তো আমি চাইনি। আমি চাই স্নিগ্ধ সুবাসিত একটা সাবান, যে সাবান মানুষ অন্তিম সময়ে ব্যবহার করে। আমার প্রেমিকা জাহ্নবীর সর্বশেষ ইচ্ছে ছিল…

কিন্তু জনাব এই দেশে এই একটাই সাবান তৈরী এবং বিক্রি হয়।

একটাই সাবান তৈরী এবং বিক্রি হয়. আগন্তুক হতবিহব্বল। এটা সম্ভব?

আপনি তো নিজেই সাক্ষী। সেই প্রান্ত গ্রাম থেকে গঞ্জ, গঞ্জ থেকে রাজধানীতে এলেন, কী দেখতে পেলেন?

হতাশার সঙ্গে বলে আগন্তুক, একটাই সাবান ৫৭০। কিন্তু কেন?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আপনি জ্ঞান বৃক্ষের কাছে যেতে পারেন। উনি আপনাকে চমৎকার বুঝিয়ে বলবেন।

জ্ঞানবৃক্ষকে কোথায় পাবো?

ওই যে সরাইখানা দেখছেন, ওই সরাইখানার পেছনে একটা ইদারা আছে। ইদারার সঙ্গে ছোট্ট একটা কক্ষ পাবেন। সেই কক্ষে থাকেন জ্ঞানবৃক্ষ মানব। তিনিই আপনাকে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন।

আগন্তুক চললো জ্ঞানবৃক্ষের কাছে। ইদারার কাছের ছোট্ট কক্ষে সাদা চুলে আচ্ছাদিত বলিষ্ঠ গড়নের একজন মানুষ বসে বসে আপন মনে এস্রাজ বাজাচ্ছেন। দরজার সামনে আগন্তুক দাঁড়াতেই এস্রাজের উপর আঙুলের কারুকাজ বন্ধ করে বললেন, ভেতরে আসুন। ভেতরে ঢুকতেই জ্ঞানবৃক্ষ বললেন, বসুন।

আগন্তুক সামনের মোড়ার উপর বসে তাকালো জ্ঞানবৃক্ষের দিকে, তাকিয়েই অবাক। জ্ঞানবৃক্ষের চক্ষু নেই। আছে দুটি কোটর। তাহলে জ্ঞানবৃক্ষ দেখছেন কী করে?

আপনিতো ৫৭০ সাবান সর্ম্পকে জানতে এসেছেন, নাহ?

জি, মাথা ঝাকায় আগুন্তুক।

শুনুন, আমাদের এই দেশটা প্রাচীনকাল থেকে সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা। ফলে, সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে এসেছে বিদেশের বহু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সেই সামাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অনেক লড়াই করেছে আমাদের ভূমিপুত্ররা। কিন্তু বিদেশীদের আধুনিক অস্ত্র আর কূটকৌশলের কাছে বার বার হেরে গেছে ভূমিপুত্ররা। হারতে হারতে লড়াই করতে করতে যখন আমাদের মুমুর্ষ ইতিহাস, সেই সময়ে  গোপালগঞ্জের বাইগার নদী তীরে জন্ম নেয় এক রাখাল বালক। সেই বালক জীবনের প্রথম অনুভবের দিন থেকে শুরু করেন বিদ্রোহ। বিদ্রোহ করতে করতে এক সময়ে গোটা জাতি একটি বিন্দুতে, একটি কণ্ঠস্বরে, একটি শব্দ স্বাধীনতায় দীক্ষিত হলে, বিদেশী বর্বর শত্রুরা রাতের অন্ধকার প্রহরে নিরস্ত্র জনতার উপর আক্রমণ চালায়।

যেহেতু জীবনের সকল রক্তবিন্দু শ্রম ঘাম আর সাহসের চাবুক শানিয়ে স্বাধীনতায় ব্যাকুল জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেছিলেন সেই নেতা, ফলে খুব শীঘ্রই প্রতি আক্রমণের আঘাতে আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় বিদেশী বর্বর শত্রুরা। তিক্ত বিষাক্ত পরাজয়ের সাধ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় ওরা। ফলে, শত সহস্র বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি প্রথম পায় স্বাধীন রাষ্ট্র, স্বাধীন পতাকা। নেতা শুরু করলেন চির আরদ্ধ স্বাধীন দেশকে স্বপ্নের আলোয় গড়ে তুলবার এক অসীম লড়াই। সেই লড়াইয়ের ক্ষণে পরাজিত শত্রুরা এক শ্রাবণ রাতের শেষ প্রহরে দানবীয় বর্বরতায় হত্যা করে পৈশাচিক উল্লাসে নেতাকে, তাঁর চিরপ্রণম্য স্ত্রী বেণুকে, দশম বর্ষীয় পবিত্র পুত্র রাসেলসহ আরও অনেককে। হত্যার পর নিহত জনক আগামেমনন..কে করবে শায়িত করার আগে যে পবিত্র সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়েছিল, সেই সাবানের নাম ৫৭০। বাঙালি জাতি সেই থেকে দুনিয়ার সব সাবান অস্বীকার করে, একমাত্র ৫৭০ সাবান ব্যবহার করে আসছে। কারণ আমরা বাঙালি জাতি মনে করি, এই সাবানের চেয়ে কোনো সাবান পবিত্র আর মানবিক হতে পারে না।

আগন্তুক দাঁড়ালেন, আমি আমার প্রেমিকার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী এই মানবিক ও পবিত্র ৫৭০ সাবানই নিয়ে যাচ্ছি আমার দেশে।

কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেলো আগন্তুক দৃপ্ত পায়ে। জ্ঞানবৃক্ষ এস্রাজ বাজাতে শুরু করলেন শামসুর রাহমানের অমর কবিতাকে ধারণ করে—নিহত জনক আগামেমনন কবরে শায়িত আজ…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত