স্মরণে সাইদা খানম
সাইদা খানম (১৯৩৭-২০২০)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে আমাদের স্নাতক সম্মান শ্রেণির ক্লাস শুরু হলো ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসের একেবারে শুরুতে। সেটা ১ তারিখও হতে পারে, হতে পারে ৩ তারিখও। প্রথম দিনের ক্লাসশেষেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে। ক্লাসে শিক্ষকের বক্তৃতাই বই খোঁজার আগ্রহকে তীব্র করে দিয়েছিল। সম্ভবত প্রথম দিন দুটি ক্লাস হয়েছিল। দুটিই ছিল সম্মোহন সৃষ্টিকারী ও পাঠোদ্দীপক। ওইদিন বিকেলেই পাবলিক লাইব্রেরিতেও গিয়েছিলাম, মনে পড়ে। যাই হোক, বিভাগের সেমিনারে যাঁকে পেলাম তিনি লাইব্রেরিয়ান সাইদা খানম। তাঁর অন্য কোনো পরিচয়ই আমাদের কাছে সেদিন জ্ঞাত ছিল না। সেদিন তিনি আমাদের উত্তেজিত তারুণ্যের নতুনতর পাঠস্পৃহাকে সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছিলেন। তাঁর স্বভাবসুলভ ধীরস্থির রুচিশীল শিক্ষিত কণ্ঠ আমাদের উচ্চকণ্ঠ-উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করেছিল। আমরা প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে উচ্চকণ্ঠের অভিঘাত দিয়ে লাইব্রেরির শান্ত নিস্তব্ধতায় সেদিনের মতোই প্রায়শ ব্যাঘাত সৃষ্টি করতাম। সেখানেই ছিল তাঁর ঘোরতর আপত্তি ও নিজকণ্ঠের শাসন। কিন্তু অচিরেই তিনি আমাদের গ্রন্থপাঠের ঐকান্তিক আগ্রহ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছিলেন। ফলে প্রয়োজনীয় বইটি পাওয়ার ব্যাপারে তাঁর অনেক আনুকূল্য ও স্নেহপূর্ণ প্রশ্রয় পরবর্তীকালে পেয়েছি।
তারপর একে একে জেনেছি, তিনি বাংলা সাহিত্য ছাড়াও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। জেনেছি, তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী ফটোগ্রাফার সাংবাদিক। জেনেছি, তিনি অতি উচ্চ শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক আবহবিশিষ্ট পরিবারের সদস্য। জেনেছি, তিনি বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আবদুল আহাদের বোন। জেনেছি, ভাইয়ের মতোই তিনিও অকৃতদার। যতই জেনেছি ততই শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছি। তিনি ১৯৭৪ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বাংলা বিভাগের সেমিনারে কর্মরত ছিলেন।
বইয়ের প্রতি আগ্রহের প্রাগঢ়তাই তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে ক্রমশ ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল। আমাদের প্রগতিভাবনা ও উন্নত সাংস্কৃতিক বোধের অভিলাষ এই ঘনিষ্ঠতাকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়েই তুলেছিল। সেই সম্পর্ক শুধু বিভাগের লাইব্রেরিয়ান-ছাত্র সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর তৃষিত মাতৃমনের স্নেহস্পর্শ আমরা প্রায়ই অনুভব করতাম। আমাদের স্নাতকোত্তর পর্বে (১৯৮১-৮২) একবার ইদের দিনে আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। তিনি আমাদের এই গ্রন্থপিপাসু, বিভাগের পরীক্ষায় ভালো ফললাভকারী, কয়েকজনকে নিজ হাতের রান্না খাইয়ে বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলেন।আজ তাঁর স্মৃতির প্রতি প্রণতি জানাই। অনন্তলোকে তাঁর প্রশান্তি কামনা করি।
সৈয়দ আজিজুল হক
বাংলা বিভাগ/ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক, পর্যটক, আলোকচিত্র শিল্পী।