সৌরভ পাল
এমন একটা মানুষের কথা লিখতে বসেছি, ‘তাঁরে আমি চোখে দেখিনি, তাঁর অনেক, অনেক গল্প শুনেছি/ গল্প শুনেছি, গল্প শুনে তাঁরে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি…’, গল্পটা আসলে গান। ছেলে বেলায় টেপ রেকর্ডারটায় বাবা একের পর গান বাজাচ্ছেন। ভাল লাগুক আর নাই বা লাগুক কানে ভেসে আসত এমন কিছু সুর যা, পরে কখনও হয়ত আমার ঠোঁটে গুন গুন করেছে। এটা বোঝার বয়সটা তখনও হয়নি, কে গাইছেন কে সুর করেছেন। বোঝার চেষ্টা করেছি শব্দগুলি কী। কথাগুলি কী। তখন ওই একটা A4 পাতায় ছবি আঁকতে বসলে গাছ, বাড়ি আর এক বধূ ছাড়া বিশেষ কিছু আসত না। ছবিটা আঁকার সময় বুঝতে পারতাম ওই সকালে আমি একটা গান শুনেছিলাম নাহ, ‘কোনও এক গায়ের বধূর কথা শোনাই শোনো…’। আঁকাটা যেমনই হোক, ছবিটি দেখে মাঝে মাঝেই মনে হত আমি কি তাহলে ওই ‘গায়ের বধূ’র ছবিটা এঁকে ফেললাম। মনে মনে বেশ আনন্দ হলেও এটা এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে ‘গায়ের বধূ’র মুখটাই আমি ঠিক করে আঁকতে পারিনি, সেটা সলিল চৌধুরীর ভাবনা হয়টা কীভাবে! সম্ভব নয়, কিন্তু ওই বোধহয় অবচেতন মনেই সলিলে জীবনে মরণের শুরু, কিছুটা অবচেতন মনেই।
অনেকটা বড় হয়েছি। মাঝে কত কিছুই না এসেছে। গান মানে তখন কম্পোজার বা সুরকার কথাটার গভীরে যেতে পারিনি, গান মানে তো শাহরুখের সিনেমার গান, সঙ্গীত মানে তো বিসর্জনের বাদ্যি। সোজা কথায় যে আমাকে আনন্দ দেয়। গান ভাবাবে, কাঁদাবে, বিপ্লব করাবে? এমনটা হয় নাকি? আজ্ঞে হয়।
১৮ বছরের ছেলে, আমি। কলেজ ফেস্টে দেদার নাচ, আড্ডায় বিপ্লব। দক্ষিণ মেরু আর উত্তর মেরু পৃথিবীর দুই প্রান্তে, কিন্তু এটা বিশ্বাস করতে শুরু করলাম বিপরীত মেরুতেই আকর্ষণটা হয়। বদলা নয়, বদল কিনা জানি না, শুনলাম, ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা সলিলের সুর (ক্ষমা করবেন এইভাবেই আড্ডাতে সলিলচারণা হত)। ‘…তোমার আমার সবার স্বপন মেলাই প্রাণের মোহনায়, কীসেরে মানা, হবে চেনা হবে জানা। পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা’, ২০১০ সালে একটা ছেলের গায়ে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে ১৯৫৪ সালের একটা গান। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ‘ও’। প্রেম কাহারে বলে সেদিন বোধহয় আরও ভাল করে বুঝলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে না হলে কোনও প্রেমিক, তাঁর প্রেমিকাকে চুমু খাওয়ার বদলে “পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা” এমনটা বলে! বলতে পারে! কী জানি হয়ত বলে। সত্যিই বলে। এটাই ঘটেছে। বাস্তব। যা কল্পনা করিনি, তা ঘটল। অনুভব বাড়ল, সেখান থেকেই।
প্রেমানুভূতি! ‘ও’ হাতটা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আমার কন্ঠে গান গাইলে যা দাঁড়াবে তার থেকে গরুর গলায় হাম্বা হাম্বা সুরটা বেশি মধুর। কিন্তু লাইনগুলো যেন বুকের ভেতরের পাঁজর থেকে হাত বাড়িয়ে ‘ও’কে ডাকছে ‘না, যেও না, রজনী এখনও বাকি, আরও কিছু দিতে বাকি, বলে রাত জাগা পাখি’। হ্যাঁ। রাতগুলো জাগতেই হচ্ছিল। ঘুম আসত না। চোখের কোণাগুলো সাদা হয়ে থাকত, ঘুম পারিয়ে দিত ‘সলিল সমুদ্র’। কানের কাছে নয়, হৃদপিণ্ডটার ভিতরে ‘মেটালিকার কনসার্ট’, বাজছে, ‘ওগো আর কিছু নেই তো নাই, বিদায় নেবার আগে তাই তোমারই নয়নে পাওয়া, তোমারে সুরে গাওয়া এ গান খানি রেখে যাই’। সেদিনও বালিশ নোনতা হয়েছিল, আজও হয়। সান্ত্বনা কেবলই সলিল। ভাবলেই কেমন মনে হয়, যে মানুষটা বেঁচেই নেই সেই মানুষটার আবিষ্কার আরও একটা মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়ে যাচ্ছে!
না, সলিল সমুদ্রে কেবলই চোখের জল দিয়ে গিয়েছি আর ‘স্রোতে ভেসে গেছি’ তেমনটা নয়। ধীতাং ধীতাং বলে… আজ হাসির টলরোলে নতুন জীবন গড়ি আয়’, গানগুলি নিজেকে ভাঙতই যেন জীবন গড়তে।
১৯৫৮ সালের ছবি। নাম মধুমতী। প্লিজ ব্যাকডেটেড বলবেন না, গানটা কোনও দিন ব্যাকডেটেড হতেই পারে না, “সুহানা সফর অওর ইয়ে মৌসম হাসি… হামে ডর হে হাম খো না যায়ে কহি”। বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন আপনার ভয় নেই ‘হারিয়ে যাওয়ার’? ওই মানুষটার তো (প্রিয়জনদের সলিল দা, আমার কেবলই সুরের সলিল) উল্টো লাইনগুলোই প্রাপ্য, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ায়র নেই মানা’, হ্যাঁ হারাবো ‘স্যার’, সলিল সুরেই হারাবো।
১৯৭১। বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। রক্তস্নান করছে গোটা বাংলাদেশ। সলিল চৌধুরীর সৃষ্টি ‘মুক্তি আন্দোলনের গান’। ‘চেয়ে দেখো নতুন শুকতারা’, গানটার বয়স ৪ দশক হয়ে গেলেও আজও শুকতারা খুঁজতে আকাশে তাকিয়ে নয় নিজেকে ভাসাতে হয় সলিল সুরে। অনেক লেখাপত্রে পড়েছি সলিল চৌধুরীকে নাকি প্রায়ই মুম্বই আসার জন্য অনুরোধ করতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গিয়েছেন, কিন্তু পাকাপাকিভাবে নয়। মুম্বইয়ের মায়া নগরীর মায়া ওঁকে বাধতে পারেনি, বরং গ্রাম বাংলাই তাঁকে মোহিত করেছে। আর ওই জন্যেই আকাশে যখন বিদ্রোহের গর্জন তখন গান আর সুরকেই প্রতিবাদের ভাষা করলেন তিনি। এখনও সাদা আর লাল ঝান্ডার সঙ্গে যখন ‘কমরেড’ সুদীপ্তর ঘুমোনো দেহটা এগিয়ে যাচ্ছিল, কোরাস হচ্ছিল ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’। তখনও আমার ঠাকুরদাদারা ওই ব্রিটিশ বর্বর জাতিটার মার খাচ্ছে, ক্রীতদাস দশার ওই দিনগুলি, যা ইতিহাস থেকে জেনেছি, ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই, নৌবিদ্রোহের সমর্থনে রচিত হয়েছিল ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে’। সেদিন সুদীপ্তটা ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু জাগছিল জনজোয়ার। আর অবশ্যই সৃষ্টির ওই মানুষটা, দেখছিলেন সব। দূর থেকেও। চাকার ব্যাথা, শ্রমের মর্ম, বুঝেছিলেন অনেকেই, যিনি সুরে ‘হরতাল’ গানে ‘চাকা বনধ্’ করাতে পেরেছিলেন, সেই মানুষটাই সলিল চৌধুরি।
মানুষটার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল ছিল না। পরতেন না কোনও কালো কিংবা নীল পাঞ্জাবীও। সাদামাটা পোশাকের মানুষটার মধ্যে এত আগুন ছিল যা সময়ে-সময়ে স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠেছে। ভেবেই দেখুন না একবার, ভারতে নয়, এখান থেকে অনেকটা দূরে যেখানে আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী ১ লাখি জনতার সামনে ২ লাখি আওয়াজের করতালি কুড়িয়ে নিয়ে এলেন, ২০১৩ তে সেই ওয়েম্বলিতে পাকিস্তানের গায়ক শফকত আমানত আলি পারফর্ম করলেন, আর কার গানটা গাইলেন, জানেন? একটাই নাম, সলিল চৌধুরি। ‘মিতওয়া’ গানের সুরটাও এতটা মিষ্টি ছিল না, যতটা মিষ্টতা আর প্রেমানুভূতি ছিল ‘ও সাজনি, বরখা বাহারা আয়ি’ (বাংলায়-না, যেও না, রজনী এখনও বাকি) গানে। নিজেকে লুকিয়ে রাখা একটা মানুষের আন্তর্জাতিক হওয়ার প্রমাণ আর দিতে হয়? লন্ডনের ওয়েম্বলিতে একজন বাঙালির গান গাইছেন একজন পাকিস্তানি। এইটুকুই যথেষ্ট।
আজ থমকে যাওয়া সময়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ও গানওয়ালা আরও একটা গান গাও’। আরও বলতে ইচ্ছে করে যুদ্ধ যখন লেগেইছে তাহলে আরও একবার এভারেস্টের চূড়ায় চোঙা ফুকে গাওয়া হোক,”বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে, এত বিদ্রোহ কখনও কেউ দেখেনি আগে, দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ…।” স্যার আপনাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে। বেশি নয়, আপনার দুটো লাইনই আপনাকে লিখব, আপনি ছাড়া “সুরহীন, তালহীন, কালহীন/বড় শূন্য শূন্য দিন’।
শেষটা হোক ‘বিপ্লব’ দিয়েই-
হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো
জান কবুল আর মান কবুল
আর দেব না, আর দেব না রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো
চিনি তোমায় চিনি গো, জানি তোমায় জানি গো
সাদা হাতির কালা মাহুত তুমি না
জান কবুল আর মান কবুল, আর দেব না …মোদের প্রাণ হো
পঞ্চাশে লাখ প্রাণ দিছি, মা-বোনেদের মান দিছি
কালো বাজার আলা করো তুমি না
জান কবুল আর মান কবুল, আর দেব না …মোদের প্রাণ হো
মোরা তুলবো না ধান পরের গোলায়,
মরবো না আর ক্ষুধার জ্বালায়, মরবো না
ধার জমিতে লাঙল চালায়, ঢের সয়েছি, আর তো মোরা সইবো না
এই লাঙল ধরা কড়া হাতের শপথ ভুলব না
জান কবুল আর মান কবুল, আর দেব না ..মোদের প্রাণ হো
.