সমর সেন

Reading Time: 4 minutes

সমর সেনের জন্ম কলকাতায় হলেও (১৯১৬-৮৭) তার পূর্বপুরুষের শিকড় তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ছিল। তার পিতামহ বিশিষ্ট লোক গবেষক দীনেশ চন্দ্র সেন ছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষ। বাবা অরুণ চন্দ্র সেন ছিলেন অধ্যাপক। সমর সেন ছাত্র জীবনে খুবই মেধাবি ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তার জন্য ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু তিনি পূর্ববর্তী তিরিশি কবিদের অনুসরণ করে অধ্যাপনায় যোগ দেন। কিন্তু অধ্যাপনায় স্থিত হননি। রেডিওর ইংরেজি বিভাগের কাজ, রুশ ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ, বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ, এসব নানান কিছু করে তিনি সাংবাদিকতায় স্থিত হন। সাংবাদিকতাও করেছেন বেশ কয়েক জায়গায়। শেষ পর্যন্ত ইংরেজি সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ার (Frontier)-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে ১৯৬৮ থেকে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। প্রথাসিদ্ধ জীবন বেছে না নেয়াতে অর্থ কষ্ট হয়েছে অনেক কিন্তু কখনোই আপস করেননি।

সমর সেনকে বলা হয় বাংলা ভাষার প্রথম নাগরিক কবি। যদিও ঈশ্বর গুপ্ত অনেক আগেই কলকাতার নাগরিক যন্ত্রণা নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘কিলু গোয়ালর গলি’। কিন্তু শুধু নাগরিক শব্দের সমাবেশই নাগরিক কবিতা নয়। যে নগর মর্মকে স্পর্শ করে সেই নগর চেতনা একটা ভিন্ন বিষয়। সমস্যা হচ্ছে সমর সেনের সৃষ্টি খুব বেশি নয়। তিনি তার বয়সের ১৮ থেকে ৩০ বছর অর্থাৎ ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ মাত্র এক যুগ কবিতা লিখে দুম করে কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। এরপরও তিনি বেঁচে ছিলেন চার দশক। কিন্তু আর কবিতা লেখেননি। কবি হিসেবে যখন তিনি পরিচিতি পাচ্ছিলেন, অনুজরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রজরা তার কবিতা-প্রভাবিত হয়ে উঠছিলেন, সেই সময় তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। এরকম ঘটনা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তো বটেই, বিশ্ব কবিতায়ও বিরল।

১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ সাল, এই সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ‘কয়েকটি কবিতা’ (১৯৩৭), ‘গ্রহণ’ (১৯৪০), ‘নানাকথা’ (১৯৪২), ‘খোলাচিঠি’ (১৯৪৩) এবং ‘তিনপুরুষ’ (১৯৪৪)। পরে ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘সমর সেনের কবিতা’। এই শেষোক্ত বইয়ে সংকলিত হয়েছে ঊনআশিটি কবিতা।

 

বিস্মৃতি

……………

ভুলে যাওয়া গন্ধের মতো
কখনো তোমাকে মনে পড়ে।
হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস।
আর মেঘের কঠিন রেখায়
আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে।
হলুদ রঙের চাঁদ রক্তে ম্লান হ’লো,
তাই আজ পৃথিবীতে স্তব্ধতা এলো,
বৃষ্টির আগে শব্দহীন গাছে যে-কোমল, সবুজ স্তব্ধতা আসে।

 

বিরহ

…………..

রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে
পাহাড়ের স্তব্ধ গভীরতায়।

তুমি এখনো এলে না।
সন্ধ্যা নেমে এলো : পশ্চিমের করুণ আকাশ,
গন্ধে ভরা হাওয়া,
আর পাতার মর্মর-ধ্বনি।

স্বর্গ হ’তে বিদায়

……………….

সমুদ্র শেষ হ’লো,
আজ দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো।
সমুদ্র শেষ হ’লো
গভীর বনে আর হরিণ নেই,
সবুজ পাখি গিয়েছে ম’রে,
আর পাহাড়ের ধূসর অন্ধকারে
দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো।
সমুদ্র শেষ হ’লো,
চাঁদের আলোয়
সময়ের শূন্য মরুভূমি জ্বলে।

 

বসন্ত

……………….

বসন্তের বজ্রধ্বনি অদৃশ্য পাহাড়ে।
আজ বর্ষশেষে
পিঙ্গল মরুভূমি প্রান্ত হতে
ক্লান্ত চোখে ধানের সবুজ অগ্নিরেখা দেখি
সুদূর প্রান্তরে।

 

স্তোত্র

………………..

আদিদেব একা সাজে পুরুষ প্রকৃতি।
মহাজন চাষি তিনি সবাকার গতি।
কৃষ্ণকালো বড়ো মেঘ জুড়েছে আকাশ।
শ্যামবর্ণ মূর্তি তার চাষির আশ্বাস।
ধান দেখে মহাজন বলেছে সাবাস।
আকাশে শুনেছি আজ মেঘের বিষাণ।
ঘরে-ঘরে বুঝি আজ রাসলীলা গান।
সাপ যত বসে আছে শিকারের তালে।
রাত্রি এল, মৃত্যু লেখা ব্যাঙের কপালে।
মহাজন গান গায় নদারৎ ধান।
অন্ধকার প্রেতলোকে ভাবে ভগবান।
অক্ষম এ রায়বার ঈশ্বর কথনে।
প্রভুর বন্দনা শুনি বেনের ভবনে।

 

 

নচিকেতা

………………

“কে এসেছে কালরাত্রে কৃতান্তনগরে?
এখন হাটের বেলা, এখানে মজার খেলা,
সারি-সারি শবদেহ সাজানো বাজারে।
বজ্রনখ উলূক রাত্রির কালো গানে
দেশভক্ত বিভীষণ, মত্সবন্ধু বকধার্মিকের
কাঁধে হাত রেখে, দেখ, চলে,
মহম্মদী বেগ্ খর খড়্গ শানায়,
বাজার ভরেছে আজ হন্তারক দলে।
দুঃসাহসে তুষ্ট আমি। আশীর্বাদ করি,
পৃথিবীতে জন্ম যেন না হয় তোমার।”

“রক্তজবা সূর্য ওঠে পর্বত শিখরে,
বৃষ্টিবিন্দু দাও দেব বটের শিকড়ে।
অনাবৃষ্টির আকাশ হোক অন্যরূপী
তিন কুল ভ’রে দাও জনে ধনে জনে সুখী।”

 

মহুয়ার দেশ

…………………………….

 

মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে

অলস সূর্য দেয় এঁকে

গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ,

আর আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায়।

সেই উজ্জ্বল স্তব্ধতায়

ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে

শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।

অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ,

সমস্তক্ষন সেখানে পথের দুধারে ছায়া ফেলে

দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য,

আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস

রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে।

আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,

নামুক মহুয়ার গন্ধ।

 

 

 

এখানে অসহ্য, নিবিড় অন্ধকারে

মাঝে মাঝে শুনি

মহুয়া বনের ধারে কয়লার খনির

গভীর, বিশাল শব্দ,

আর শিশিরে-ভেজা সবুজ সকালে

অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক,

ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়

কিসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>