বিষন্নতা আকাশজুড়ে ছাইয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। আজ পৌষের তিন, আর বঙ্গোপসাগরে নিন্ম চাপের প্রভাবে আকাশ মেঘলা। জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় তাতে দেখা যায় রাস্তার খানিকটা, রাস্তার পাশে উঁচু উঁচু মেহগনি গাছ। মেহগনি গাছগুলোর শরীরে লেগে আছে পৌষের ধূসরতা। শীতের এমন গোমড়ামুখো দিন আমার একদম ভালো লাগে না। এইসব দিনে হৃদয়ের গোপন কুঠুরি হঠাৎ হাট হয়ে খুলে যায়, আর অতীত কোন দুঃখ আমাকে কাবু করে ফেলে।
‘কবে এসেছেন?’
‘এই তো, গতকাল দুপুরে।’
‘কবে ঢাকা ফিরবেন?’
‘আগামীকাল সকালে। হাওর এক্সপ্রেসে।’
তারপর আবার ককানোর বিরতি। মতলু ব্যাপারী, অর্থাৎ আমার চাচাতো বোনের শ্বশুর, ময়মনসিংহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফুসফুসে সমস্যা । কয়েকদিন আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। আম্মা বললেনঃ ঢাকা ফেরার আগে তোমার তালই সাহেবকে একটু দেখে যাও। খুবই অসুস্থ। কখন কী হয়! রাণুর ছেলেটাকেও একটু দেখে আসতে পারবে। রাণু মারা যাওযার পর তুমি তো একদিনও ঐ বাড়িতে যাও নাই। মতলু ব্যাপারী তো পরাগকে আমাদের বাড়িতে আসতে দেয় না। আম্মা আসলে অপরাধবোধে ভোগেন। আব্বা মারা যাওয়ার পর আর্থিক সংকটে পড়ে তিনি তাড়াহুড়া করেই রাণুর বিয়েটা দিয়েছিলেন।
ফলত আমি বসে আছি একটা চেয়ারে চুপচাপ, জানালার মুখোমুখি। মতলু ব্যাপারী খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে। গায়ের উপর একটা মোটা কম্বল। খানিকক্ষণ পরপর শ্বাসকষ্টের দমক উনাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। উনার পায়ের কাছেই জানালাটা। জানালা দিয়ে আসা মরা আলো আমার চোখে।
‘আপনার ছেলেরা কেউ বাসায় নাই?’ নিজের অস্বস্তি কাটাতে প্রশ্নটা করলাম।
‘না, কেউ নাই। বড়ছেলের দায়িত্ব তো পুরো জেলার। ময়মনসিংহ কাচিঝুলি বাসা ভাড়া করে থাকে।’
এই বড়ছেলেটার সাথেই রাণুর বিয়ে হয়েছিল। তখন ছেলেটা সবেমাত্র একটা ঔষধ কোম্পানিতে যোগ দিয়েিেছল বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে। এই কয়েক বছরে তার বেশ উন্নতি হয়েছে। আর এদিকে পরাগের জন্মের তিনমাস পর রাণু মারা যায়।
‘আমি জানি। তালই সাহেব। উপজেলায়-উপজেলায় যেতে হয়?’
‘যেতে হয়, যেতে হয়, যেতে হয়। বেতন যত লম্বা দায়িত্বও তেমন।’ আবার শ্বাসকষ্টের দমক। ফুসফুস ভরাতে কষ্ট হচ্ছিল বৃদ্ধের, তবু মনে হলো তিনি কথা চালিয়ে যেতে চান।
‘জ্বরটা কেন যে আবার এল, বুঝতে পারছিনা।’
’ঠান্ডা হঠাৎ বেড়ে গেছে।’ আমি বললাম।
‘হতে পারে, হতে পারে, হতে পারে।’ তিনবার কথাটা বলার পর একটানা কতক্ষণ কাশলেন।
‘মাউইমা বাসায় নেই।’ আমি অনেকটা নিরুপায় হয়েই বললাম। আমি চাচ্ছিলাম পরাগকে দেখে চলে আসতে। আমার আর সেখানে বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না।
‘সে তো গেছে দাওয়া-মাড়ি তুলতে। বড়বউও গেছে তার সাথে।’
বড়বউ মানে তো রাণু মারা যাওয়ার পর বড়ছেলের বউ। বড়বউয়ের কথায় আমার খুব খারাপ লাগল। রাণু ঠিকমতো চিকিৎসাটাও পায় নাই । সময়মতো জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওকে বাঁচানো যেত। মতলু ব্যাপারী এইটুকু করতে রাজি ছিলেন না। বিভিন্ন অজুহাত দেখালেন।
চাচা-চাচী মারা গিয়েছিলেন এক বাস দূর্ঘটনায়। সেই দূর্ঘটনা থেকে রাণু বেঁচে গিয়েছিল। তখন ওর বয়স বড়জোর তিন। সেই থেকে রাণু থাকত আমাদের সাথে। সে ছিল আমার খেলার সাথি। আমি ছিলাম তার থেকে বছরখানেকের বড়।
শীতের বিকাল দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল । আমি বসে বসে ভাবছিলাম ছোটছেলের বউটা এলেও কাজ হতো। একটা ফর্সামতো রোগা মেয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল, হয়ত সে-ই ছোটছেলের বউ।
‘চা খান, রুমন ভাই।’ চমকে তাকিয়ে দেখি সেই রোগা মেয়েটা চা-বিস্কিট নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। চা-বিস্কিটের ট্রে আমি যে চেয়ারটায় বসেছিলাম তার পাশের টেবিলে রাখল। এককাপ চা তার শ্বশুরের হাতে দিলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললঃ
‘পরাগ তার কাকার কাছে বাজারে গেছে। বাবার অষুধ আনতে।’
‘ফিরতে কি দেরি হবে?’
‘মনে হয় না। গেছে তো অনেকক্ষণ হলো।’
‘তাহলে আরেকটু বসি।’
‘বসেন। পরাগতো আপনাদের কথা খুব জানতে চায়।’
একটা ঝনঝন শব্দ আচমকা আচড়ে পড়ল ঘরটাতে। মতলু ব্যাপারী চায়ের কাপটা ছুড়ে মেরেছেন মেঝেতে। আমি দেখতে পেলাম ছোটবউয়ের মুখটা ফ্যাঁকাশে, ভয়ে কাঁপছে সে। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তারপর সব চুপচাপ, এমনকি বৃদ্ধ লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাস এখন স্বাভাবিক।
‘কী সব চা বানায়! মেজাজটাই খারাপ করে দ্যায়।’
কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন বাইরে। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
‘পরাগকে নিয়ে আপনাদের মাথাব্যাথার কোন দরকার নাই। আমি চাইনা সে আপনার বোনের মতো হোক। আপনার বোন ছিল একটা বেয়াদব। আমার মুখে মুখে তর্ক করত। আমি যদি অন্যের জমি দখল করেই থাকি, তাতে তোর কী? আমারটা খাবি, আমারটা পরবি, আবার আমাকে ন্যায়-অন্যায় শেখাবি!’
বহুদিন ধরে আমার বুকে জমে থাকা কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে আসলঃ ‘তাই তাকে মেরে ফেলবেন!’
তারপর প্রথমবারের মতো মতলু ব্যাপারীর চোখের দিকে তাকালাম। দেখি তাতে ঘৃণা দগদগে ঘায়ের মতো জ্বলছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। আমাকে এখন বেরুতেই হবে এই বাড়ী থেকে।
গেটের কাছে পরাগের সাথে দেখা হলো। বাজার থেকে ফিরেছে। আমাকে চিনতে পারল না। চেনার কথাও নয়। তার জন্মের পর এই দ্বিতীয়বারের মতো আমাদের দেখা হলো। প্রথমবার দেখেছিলাম রাণুর কোলে, তখন ওর এক মাসও হয়নি। এখন তার সাত বছর। মুখটা মায়ের আদলে গড়া, কিন্তু বড় বেশী ¤্রয়িমাণ। বিপন্ন অস্থিত্ব নিয়ে বড় হচ্ছে সে। একটা ভয়ের জগতে বসবাস করছে।
আমি পরাগের মাথায় হাত রাখলাম। সে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো। আর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম রাণুর মুখোমুখি।
‘বুঝেছিস, পৃথিবীটা আকৃতিতে কমলালেবুর মতো।’
‘জানি।’
‘কে বলেছে?’
‘ভূগোল স্যার।’ ‘স্যার আরও বলেছেন কেউ যদি জাহাজ নিয়ে পৃথিবীর একজায়গা থেকে যাত্রা শুরু করে, তাহলে সে ঠিক ঐ জায়গাতেই আবার ফিরে আসবে।’
‘তাহলে তো তুই অনেক কিছু জানিস্ ।’
‘জানিই তো! আমি কী ঠিক করেছি জান?’
‘না, জানি না। না বললে জানব কিভাবে?’
‘আমি ঠিক করেছি, বড় হয়ে আমি নাবিক হব।’
‘কেন? নাবিক হবি কেন?’
‘তাহলে পৃথিবীটা ঘুরে আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারব।’
বাড়িটা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম । টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়ে গিয়েছিল। আকাশটাকে দেখাচ্ছিল মৃত মাছের চোখের মতো। আমি দ্রুত হাটতে শুরু করলাম। আমার শীর্ণ দেহ, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটি। তবুও জীবনে প্রথমবারের মতো কমলালেবুর মতো এ দুনিয়াটাকে চষে ফেলতে ইচ্ছা করল। কোথাও যদি হারিয়ে যাওয়া রাণুর আবার দেখা মেলে!
কবি, গল্পকার
প্রকাশিত বই:
কবিতা: ভরা কটাল
ছোটগল্প: হাসিকান্না স্টোর