গানের ইন্দ্রধনু যাঁর গলায় রং ছড়ায়, সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন আজ, অক্টোবরের চার তারিখ। সেই ইন্দ্রধনুর রঙেই রাঙিয়ে নিলাম কালি, কলম, মন। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ – গানটি গেয়েছি নিজের গলায়।
এ কাহিনীর শুরু রবিবার সকালে। রবিবার মানেই গানের দিন। কোন ছোট্টবেলা থেকে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। পঁচানব্বইয়ের তরুণ সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ঘড়ি ধরে ফোনে এলেন। অতি উৎসাহী ছাত্রী গুরুকে মুখ খোলবারই সুযোগ দিল না।
“সন্ধ্যা মুখার্জির জন্মদিন আগামীকাল, সোমবার।“
সঙ্গীতাচার্য সচকিত, “তাই নাকি? আহা! কী গলা!”
আমি উৎসাহিত এবার। বিশাল ভান্ডার থেকে দুটি মণিমাণিক্য যদি কুড়িয়ে নেওয়া যায়।
“বয়সে আপনার থেকে কয়েক বছরের ছোটই হবেন। একানব্বইয়ে পড়লেন।“
“আমি তখন স্কটিশে পড়ি, বুঝলি? থার্ড ইয়ার আমার। ফার্স্ট ইয়ারে এসে ভর্তি হল উৎপলা। উৎপলা ঘোষ। কিছুদিনের মধ্যেই সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে গানের রেকর্ড বেরোল তার। ‘এক হাতে মোর পূজার থালা আরেক হাতে মালা‘। মিষ্টি গলা। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল সে।“
অমূল্য ঝাঁপিটি খুলছে আস্তে আস্তে। খুলুক। আমি শুনতে থাকি।
“তার দু‘তিন বছরেই আমরা চমকে উঠলাম আরেকটি মেয়ের গানে। কী অসামান্য গলা, টোনাল কোয়ালিটি! এমনটি কেউ কোনোদিন শোনেনি। কী আবেদন, ইমোশন তার গানে! দুটো গানের একটা রেকর্ড বেরোল HMV থেকে। একদিকে ‘তুমি ফিরায়ে দিয়ে যারে’, অন্যদিকে ‘তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো।’ একেবারে ভাসিয়ে নিল সবাইকে।“
“সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়?” আমি আস্তে বলি।
“হ্যাঁ রে, সেই কথাই তো বলছি। সন্ধ্যার বাংলা গান ছিল একটা ফেনোমেনন, মানে একটা সত্যিকারের ঘটনা। অমন স্বর্ণকন্ঠী আর হবে না। সে সময়ের সবাইকে মনে রেখেই বলছি। কত গুণী গায়িকার সমারোহ তখন। উৎপলা ঘোষের কথা তো বললামই। আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালো গাইছেন। গীতা দত্তও সমসাময়িক। কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় কী যেন ছিল, সে একেবারে সটান শ্রোতার মনে গেঁথে যায়।“
“দেখা হয়েছিল, কাকু? সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে প্রথম হয়েছিলেন। আপনিও তো তাই।“
“না না, উনি আমার অনেক পরে এসেছেন। উনিশশো পয়ঁত্রিশ, ছত্রিশ আর সাঁইত্রিশ সালে আমি অল বেঙ্গলে প্রথম হই।“
“সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইলেন উনিশশো তেতাল্লিশ সালে।” আমি চটপট যোগ করি। “নিজেই বলেছেন, তাঁর মেজদা হারমোনিয়াম সঙ্গত করলেন। অল বেঙ্গলে ভজনে ফার্স্ট হলেন। তারপর উনিশশো ছেচল্লিশ সালে ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষা। সেখানেও ফার্স্ট। তারপর থেকে সবরকমের গান গাইতে লাগলেন। লোকগান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি তো আছেই, তাছাড়াও উচ্চাঙ্গ সংগীত। খেয়াল ঠুংরি।“
“দাঁড়া, দাঁড়া, একটু সবুর কর। খেয়াল ঠুংরি বললি, তাই না?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনো মনে আছে ছোটবেলায় রেডিওতে রাত ন‘টার প্রাইম স্লটে সন্ধ্যা মুখার্জির খেয়াল শোনার জন্যে সে কী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা! বড়ে গোলাম আলির কাছে রীতিমত গান্ডা বেঁধে শিখেছেন।“
“সে কি আর আমি জানি না?” ধমকে দিলেন। “সেই গল্পই তো শোনাবো তোকে। শোন, জ্ঞানবাবুর (জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ) ডিকসন লেনের বাড়িতে একদিন গেছি কী একটা কাজে। উনি বেরিয়ে এসে কথা বলছেন। হঠাৎ কানে এল সুর, একেবারে ঐশ্বরিক গলার আওয়াজ। চমকে গিয়ে বললাম, ‘খাঁ সাহেবের গলা না?’ জ্ঞানবাবু স্বীকার করলেন, তিনিই। আমি তখন সম্মোহিত, অনুরোধ করলাম, ‘একটু শুনতে পাই নে?'” সঙ্গীতাচার্য থামলেন।
“বড়ে গোলাম আলি? তিনি তো ডিকসন লেনে এসে থাকতেন। শুনতে পেলেন তাঁকে?” আমি অধৈর্য।
সঙ্গীতাচার্য স্মৃতিচারণ করছেন, “জ্ঞানবাবু বললেন, ‘আসুন, আমার সঙ্গে গেলে কিছু বলবেন না।‘ গেলাম গানের ঘরে। দেখি সুরমণ্ডল হাতে বসে আছেন বড়ে গোলাম আলি খাঁ। পায়ের কাছে দুই শিষ্যা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়। গুণকেলি রাগের তালিম চলছে। খাঁ সাহেব গাইছেন, শুনে শুনে তুলে নিচ্ছেন শিষ্যারা। কিছুক্ষণ কাটল। খাঁ সাহেব একটু বিরতি নিলেন। হাতের সুরমণ্ডলে টুং টাং সুর বাজছে। হঠাৎ…”
“হঠাৎ কী?” উত্তেজনায় দমবন্ধ করে আছি।
“বলাকওয়া নেই, ধরে দিলেন, ‘আয়ে না বালম, ক্যা করু সজনি…’ আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। ভাষা হারিয়ে গেছে সবার। মনে হল যেন সংগীতের ঈশ্বর নেমে এলেন আমার সামনে। সংগীতের কোন স্তরে পৌঁছলে তবেই এমন গাওয়া যায়! এ গান শেখা যায় না, শুধু চুপ করে বসে শুনতে হয়।” চুপ করলেন তিনি।
“সে গানই তো সন্ধ্যা মুখার্জি গাইলেন বাংলায়, মুনাব্বর আলির তদারকিতে। ‘আসে না প্রীতম, কী করি সজনি।’ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের অনেকগুলো ঠুংরিই বাংলায় গেয়েছিলেন। এখনো কানে লেগে আছে।” আমি বলি।
সঙ্গীতাচার্য নীরব। হারিয়ে গেছেন গানে গানে। তাঁকে অব্যাহতি দিই। সাধ হয় সেই বাংলা ঠুংরিখানি গাইতে। গেয়ে তার লিংক দিলাম নিচে।
এবার জননীকে ধরা যাক। তিনিও তিরাশি। সন্ধ্যা মুখার্জির গান শুনে ও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে যৌবন কাটিয়েছেন।
প্রথম কথাটাই বললেন, “আমরা তো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলতে অজ্ঞান ছিলাম রে। মধুর চেয়েও মিষ্টি গলা, সেই সঙ্গে সূক্ষ্ম গলার কাজ, প্লেব্যাক গানের রানি ছিলেন। তখন তো সিনেমা দেখতেই যেতাম তাঁর গান শুনব বলে। সুচিত্রা সেনের লিপে সন্ধ্যার গান। অগ্নিপরীক্ষা, সপ্তপদী, উফ, সে কি ভোলার?”
“অগ্নিপরীক্ষা যেন কতবার দেখেছিলে মা? সাত বার না?” লঘুকণ্ঠে শুধোই। জননী এ গল্প আমায় নিজে করেছেন।
কান দিলেন না। “আহা, এখনো সব ভুলে যাই, যখনই কানে আসে, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু, আজ স্বপ্ন ছড়াতে চায়, হৃদয় ভরাতে চায়…'” জননীও চুপ করলেন। মুখে আর কথাটি নেই।
সন্ধ্যা মুখার্জি সবাইকে চুপ করিয়ে দেন। সব কথা, সব অনুভূতি হারিয়ে যায় তাঁর কণ্ঠলাবণ্যে, তাঁর গানের আবেদনে। আজ একানব্বইতম জন্মদিনে সেই নিরহংকারী, ব্যক্তিত্বময়ী, গায়ে আঁচল জড়িয়ে গাইতে বসা সাদাসিধে চেহারার গীতশ্রীর পায়ে রেখে দিলাম একটি প্রণাম। তাঁর গানের ইন্দ্রধনু স্বপ্ন ছড়াবে, হৃদয় ভরাবে আরো আরো অনেক দিন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তাই এই গানটি দিয়েই আমার গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা।
ঋণস্বীকার: সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী সন্ধ্যা চট্টোপাধ্যায়
ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুদিনের চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ‘এ’ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা’র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পারসিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত ‘অভিব্যক্তি’ ও ‘অবসর’ পত্রিকার সম্পাদক।
‘ও কলকাতা’ ই-ম্যাগাজিনে ধারাবাহিক ‘সুরের গুরু’ প্রকাশিত হচ্ছে রাগসংগীতের শিল্পীদের নিয়ে। এছাড়া ‘বাংলালাইভ ডট কম’, ‘বাতায়ন’, ‘পরবাস’, ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক’, ‘গুরুচণ্ডা৯’, ‘ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।