| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

আমি, এখন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

এখন আমি যে চশমাটি পরে আছি, এটা আমার চশমা নয়। এটি জনৈক আর হালদারের চশমা।
আমি প্রথম চশমা নিই ১৯৮৬ সালের বসন্তকালে।
আমার বিবাহ হয়েছিল রেজিস্ট্রি করে। এবং তারপর কালীঘাটে মালাবদল করতে যাইনি। মেয়েরা গলায়ে মালা পরিয়ে দিলে কেমন, আমি তা জানি না। সিনেমা-থিয়েটারে দেখেছি, ওই সময় ভারি সলাজভাবে মেয়েরা মুখ ঘুরিয়ে রাখে। তখন বেশ লাগে তাদের দেখতে। সব মেয়েকেই সুন্দরী দেখায় তখন।
আমার কিন্তু অনেকটা সেইরকম মাল্যবান লাগল, যখন আমার শিল্পীবন্ধু অশোকনাথ চৌধুরী একদিন রাতের দিকে তার ঢিলেঢালা চশমাটা আমার নাকের ওপর বসিয়ে দিয়ে বললেন ‘এবার পড়ুন তো দেখি!’ বলে সেদিনের কাগজখানা এগিয়ে দিলেন। আমার চোখের সামনে আবছা অক্ষরগুলো সহসা ঝলমল করে উঠলো। সেই সঙ্গে ঝলমল করে উঠলো যেন আমার গোটা জীবনটাই। অশোকনাথের চশমার ডাঁটি থেকে ঝুলতো একটা সোনালি কর্ড। তাই বোধহয় আরও মালা-মালা লেগেছিল। প্রথম চশমার মধ্যে দিয়ে প্রথম দেখা বইটির নাম আজও ভুলিনি। ‘জেন অ্যান্ড দ্য আর্ট অফ মোটর সাইকেল মেনটেনান্স’ এমনতরই নাম ছিল বইটির। অশোকনাথ জানতে চাইলেন ‘রাত কত হইল?’ আমি বললাম, ‘চল্লিশ পেরুচ্ছি’।
‘তবে তো আপনার যথাসময়েই চালসে হয়েছে। এবার আপনাকে একটা রিডিং গ্লাস নিতে হবে’।
শান্তনু ঘোষ নামে এক বাঙালী কালো সুদর্শন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের মহানুভবতা আমাকে অচিরেই নিয়ে গেল শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালের আই ইনফার্মারিতে। সেখানে চোখের সামনে বিবিধ কাচ রেখে ‘এটা পডুন’, ‘ওটা পডুন’ বলতে বলতে এক নবীন চিকিৎসক আমার বর্ণপরিচয় করালেন নতুন করে। প্রায় ৩৫বছর পরে। শেষে একখানা কাগজ পেলাম, যাতে লেখা :
RE+2.25 তারপর দুর্বোধ্য কিছু
LE+2.75 “ “ “
কিন্তু একসঙ্গে তৎকালীন ১২০ টাকা একত্র করতে না পারার দরুন প্রথম চশমা চক্ষুগত হতে আমার প্রায় ৬মাস দেরি হয়ে যায়। সেই তৈলাক্ত বাঁশ ও উৎসাহী বাঁদরের গল্প আর কী। টাকা ৫০-এ পৌঁছলেই হুড়ুস করে শূন্যে নেমে যায়। তথা মদ খেয়ে ফেলি।
নতুন চশমা পেয়ে তো দারুন উৎসাহ। ক্ষুদ্রকায় ন-পয়েন্টে ছাপা ‘জেন অ্যান্ড…’ বইটা চশমার কল্যাণে পড়ে ফেললাম আদ্যোপান্ত। যাকে বলে গড়গড় করে। আমি দেখলাম, বইটি আদৌ মোটর সাইকেল বিষয়ে নয়। কেননা, সেখানে বলা হয়েছে, একটি যন্ত্রযানের শরীর, জীবন ও দর্শনের কথা। তা, একটি যন্ত্রের তো ও-সব থাকার কথা নয়। নিশ্চয়ই, মানুষের জীবনের কথা। অতএব, প্রথম চশমা চোখে পড়া প্রথম বইটি আমাকে জানাল, একটি চশমার অভাবে শুধু অক্ষর নয়, জীবনকেও আমি এতদিন কত ঝাপসা দেখছিলাম।
বড় দুঃখজনক পরিস্থিতিতেই প্রথম চশমাটি আমাকে হারাতে হয়। এবং মাত্র মাসখানেক যেতে না যেতেই। ওই সময় সদর স্ট্রিটের ডাঃ আর এন রহমানের চেম্বারে যারা আকন্ঠ মদ্যপানের সুযোগ পেত, আমি মনে করতাম, সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যেই আমি একজন। কিন্তু জীবনের সব সুসময়ই আসলে একটি ছলনা। সেগুলি আসে শেষ পর্যন্ত একটি চরম দুর্দিনের কাছে টেনে নিয়ে যাবে বলেই। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না।
একদিন ডাক্তারের চেম্বারে রাত একটা বেজে গেল। কোনোক্রমে আমি একটা শেয়ারের ট্যাক্সি পেলাম ধর্মতলা থেকে। যাবে শ্যামবাজার। ট্যাক্সির ভেতর গাদাগাদি বসে কিছু তরুন ছেলে – তারাও মাতাল। কথাবার্তায় বুঝি, বিকেলে তারা ইন্দিরা গান্ধীর মিটিংয়ে গিয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারকে তারা অশ্রাব্য গালাগালি করছিল। এদিকে আমি একজন (মাতাল হলেও) ঘোর বামপন্থী। প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপর ধমকানি (ওদের তরফে)। , তখন আমি আর থাকতে পারলাম না। মদ আমিও খেয়েছি। এবং যথেষ্ট। এবং ওরা সবাই মিলে যা খেয়েছে, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি। অন্তত, আমার তাই মনে হয়েছিল। তা নইলে ওদের নেত্রীর নাম ধরে আমি বলতে যাবো কেন যে, আমি সেই শ্রদ্ধেয়ার…পুটকি মারি, মদের জরেই না! অন্যথায় আমি তো একা।
যেমন কর্ম তেমনি ফল। ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে মেরে একদম কিমা বানিয়ে দিল। প্রথম থাপ্পড়টা ভাগ্যিস পড়েছিল ডান গালে। তাই বাঁদিকে উড়ন্ত চশমাটা দেখতে পেয়েছিলাম। ওরা চলে গেল, মুখের রক্তচাঁচা রক্তাপ্লুত হাত নর্দমায় ডুবিয়ে আমি চশমাটা খুঁজতে লাগলাম। পেলামও। কিন্তু তখন কাচদুটো চুরচুর হয়ে গেছে। ফ্রেমের একটা ডাঁটি নেই।
দিনদুই পরের কথা। বৌবাজারের অপ্টো-ডেন্টো এম্পোরিয়াম(ইন্টারন্যাশনাল) ‘খাঁটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান’। মালিকও বিশিষ্ট সজ্জন। ননীবাবু। খুব যত্ন করে ফ্রেমের মাপ-টাপ নিতে লাগলেন। ‘দেখুন’ আমি তাঁকে বিনীতভাবেই জানাই, ‘আমার নাকটা ঠিক অতটা মোটা নয়। ইয়ে, মানে, নাকের ফাঁদনাটা বেশ ছোটই হবে’। উনি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সে আমি বুঝেছি’। আমি বললাম, ‘মানে কাল রাতে পিছলে গিয়ে বাথরুমে…’। অন্তর্যামী বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সে আমি বুঝেছি’। আসলে, আমার নাকটা তখনও, কী পটল বলে ওগুলোকে, বোম্বাই বলা যাক, ওইরকম ফুলে ছিল। যাই হোক, যদিও আমি আমার প্রথম চশমাটি হারাই নিঃসন্দেহে পলিটিক্যাল কারণে, তা বলে, পলিটিক্যাল সাফারার হিসেবে সেজন্য কোনো দাবি আমি রাখি না।
এভাবে বিগত ১৬বছরে ১১টি চশমা আমার জীবনে এসেছে, ও গেছে। তারা যখন হারিয়ে গেছে বা ভেঙে, ‘ওগো চশমা, তুমি কি তোমার চোখ খুঁজছ’… বলে কতদিন পথে পথে ঘুরেছি। আর যখন তারা চোখে নেই, টেবিলের ওপর, কি বাথরুমের তাকে, খোলা জানলা দিয়ে রৌদ্রচ্ছটা কি বৃষ্টির ছাঁট এসে লেগেছেতাদের কাচে, দূর থেকে তাদের একখন্ড আমার বলেই তো মনে হয়েছে। কান্না পেলে, চোখের বদলে আমি কত-না বার কাচ মুছেছি চশমার! এবং পূর্বোক্ত ১১টি চশমা আসা-যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমার যে চশমা-হারা জীবন, তখন পথেঘাটে ট্রামেবাসে অফিসে যাদের কাছে চশমা চেয়েছি ও চেয়ে পেয়েছি, তাদের প্রত্যেকের কাছে আমি ঋণী। আমি ঋণী আমাদের অফিসের বৃদ্ধ আর্দালি কেনারাম মন্ডলের কাছেও, যিনি হাত-চিঠি যোগে আবেদন পাওয়া মাত্র নিজ নাসিকাগ্র থেকে চশমা কেটে প্রায় তিনঘন্টার জন্য আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। ওই সময় আমাদের স্বাস্থ্য দপ্তরের স্বয়ং সেক্রেটারিকে আমাকে কয়েকটি ফাইল বোঝাতে হয়েছিল। ঝাড়া তিনঘন্টা ধরে। বস্তুত, চশমা-ব্যাপারে আমার অফিসের বহু সহকর্মীর অকুন্ঠ সহযোগীতা আমি পেয়েছি। ফোকাল, বাই-ফোকাল, প্লাস, মাইনাস, ধাতু ও সেলুলয়েড ফ্রেমের সবরকম চশমাই আমি পরে দেখেছি। বস্তুত, আমার স্ত্রীর দিবানিদ্রাগুলির সদ্ব্যবহার করতেও আমি ছাড়িনি।
আমি শুরুতেই বলেছি, এখন আমি যে চশমাটি পরেছি তা আমার নয়। এটি জনৈক আর হালদারের। এতদিন ধরে লাগাতাড়ে পরের চশমা আমি আগে কখনও পরে থাকিনি। চশমাটি বেশ মানিয়েছে আমাকে। পাওয়ার ফিট করেছে চমতকার। রিমলেস চশমা পরার সৌভাগ্য এর আগে আমার হয়নি।
এই নতুন চশমাটি আমি কি করে পেলাম তা বলার আগে আমার নিজস্ব শেষ চশমাটি কী করে হারালাম, সেটা বলে নেওয়া অসংগত হবে না। তবে এই কাহিনীটি বলতে গিয়ে, একটু দঃখই হবে আমার। আমারই জন্যে। কেন না, এই একমাত্র চশমা আমার, যে আমাকে ছেড়ে যায়নি। যা ছিল, আমার প্রতি শেষ মূর্হুত পর্যন্ত বিশ্বস্ত।
প্রায় ৬মাস আগের কথা। রাত ১২টার সময় তমোনাশ বললো, স্কচ আছে। কোথায় দীপ সেনের বাড়িতে। কোথায়। ল্যান্সডাউন রোডে। তমো নিয়েও গেল আমাদের বিশাল এক মাল্টিস্টোরিডে। দরোয়ান দেখলাম ওর চেনা। কিন্তু অত রাতে লিফট নেই। দশ তলা পর্যন্ত এক এক করে হেঁটে উঠে ও গরু খোঁজা খুঁজে দীপ সেন বলে কারো হদিশ পাওয়া গেল না। দু-দুটি ফ্ল্যাটে সেনেরা থাকে বটে। কিন্তু, বেল টিপলে সাততলার প্রথমটি থেকে বেরিয়ে এলেন নাইটি গাউন পরা একজন, (ভাগ্যিস রোগা দুবলা), বললেন, আরাধ্য ফ্ল্যাটটির জন্য আমাদের একতলায় দারোয়ানের কাছে যাওয়াই শ্রেয়। ‘যদি এমন কোনো ফ্ল্যাট থেকে থাকে’ বলে তিনি দরজা বন্ধ করলেন। দ্বিতীয় সেনরা থাকেন দশতলায়। চেন-লাগানো দরজা ঈষৎ ফাঁক করে ভেতর থেকে এক গম্ভীর ভারী গলা আমাদের জানাল, আমরা যেন আর ১০মিনিট অপেক্ষা করি। কারণ, পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। নেশাতুর শোকে, দুঃখ ও অপমানে, আমি দাঁড়িয়েছিলাম ল্যান্ডিং-এর বারান্দায়। এবং একবার নীচে তাকাতেই সে যে কী প্রচন্ড ভার্টিগো হল আমার! মনে হল, লাট্টুর মত ঘুরছে বাড়িটা। নীচে লাফিয়া পড়ার অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছেকে সংযত করতে, ভাগ্যিস চোখ থেকে খুলে চশমাটা তখুনি ফেলে দিয়েছিলাম। সুদূর দশতলা থেকে আমার শেষতম চশমার ফুটপাথ সংস্পর্শে এসে চূর্ণ হওয়ার শব্দ আমি নিঃসন্দেহে শুনতে পেয়েছিলাম। এ কথা আমার চেয়ে ভাল আর কেউ জানেনা যে, সে আজ নেই, হায়, তাই আমি আজও বেঁচে। এটি আমার ১নং বা শেষ নিজস্ব চশমার মৃত্যু কাহিনী। আমার ১১টি চশমার প্রত্যেকটির পিছনে এরকম গল্প আছে। বস্তুত, এ নিয়ে একাদশ অধ্যায়ে একটি উপন্যাস লেখা যেতেই পারে। এবং ‘প্রথম অধ্যায়’, দ্বিতীয় অধ্যায়ে’র বদলে লেখা যেতে পারে ‘প্রথম চশমা’, ‘দ্বিতীয় চশমা’ – এভাবে। উপন্যাসটির নাম হতে পারে : এখন আমার কোনো চশমা নেই। কেন না, আগেই বলেছি এখন আমি যে চশমা পরে আছি, সেটি আমার নয়। একজন আর হালদারের।
এই চশমাটি আমি পেয়ে গেছি যারপর নেই অভাবিতভাবে। ইতিহাসে পড়েছি, ঊর-সভ্যতার জন্য খননকার্যের সময়ে প্রথমে উঠে আসে একটি মৃন্ময় পালঙ্ক। চশমাটি সেভাবেই উঠে এল যেন। এবং এই একমাত্র চশমা, যা পাওয়ার জন্যে, বলতে গেলে, আমাকে কোনোরকম চেষ্টাই করতে হয়নি। এটি আমার হাতে চলে এসেছে ফুটপাথে এক ভিখারি কিশোরের আপ্রাণ অবদানের জন্য।
হল কী, মাস-দুই আগে, তখন আমার চশমা নেই। তাখন রাত ৯টা। এলফিন থেকে টং হয়ে বেরিয়ে, আমি এগোচ্ছি ছোটা ব্রিস্টলের দিকে, এমন সময় একটি গাড়ি এসে ছেলেটাকে ধাক্কা মারল। ধাক্কা মৃদুই। কিন্তু, আশ্চর্য, তাতেই স্পট ডেড। রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমি গাড়ির জানলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ‘ইউ ফাকিং বাস্টার্ড’ বলে ভদ্রলোকের চশমা চেপে ধরলাম। আর ভদ্রলোকও লোক জমার আগেই, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন হুশ করে। তাখন বুঝিনি। কিন্তু, পরে আমার কনুইয়ের কাছটা বেশ ফুলে উঠল।
চশমার ডাঁটিতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা ‘আর হালদার’ নামটি আমি পরের দিনই আবিষ্কার করি। গাড়ির নাম্বার কেউ দেখেনি, কিন্তু, সেটি ছিল সাদা আম্বাসাডার এবং মালিকের নামও পাওয়া গেছে। পুলিশে খবর দেওয়াই যেত। বলাবাহুল্য আমি সে ভুল করিনি। কারণ অবশেষে, এতদিনের সেই চশমাটি আমি পেয়েছি, যার যে-কোনো চক্ষু-চিকিৎসককে টেক্কা দিয়ে আমার চোখের পক্ষে একেবারে যথার্থ হয়েছে। রিমলেস, এত সুন্দর চশমা আমি আগে কখনও পরিনি। চমৎকার ফিটও করেছে। এত সুন্দর চশমা, ‘একি এদেশে তৈরি’ – সবাই জানতে চাইছে।
না, এই চশমাটি আমি সহজে হারাতে পারি না। নাম-না-জানা ফুটপাথের ছেলেটার মৃত্যুর দামে আমি এটা পেয়েছি। শুধু সুন্দর নয়। এটি তাই বহুমূল্য।
ঠিক করেছি, চোখের বদলে, চশমাটি আমি আই-ব্যাঙ্ককে দান করে যাব।

 

 

কৃতজ্ঞতা: আজকাল

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত