| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

সঞ্জীব চৌধুরীর গল্প-সমষ্টি

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

[অকালপ্রয়াত গায়ক ও লেখক-কবি সঞ্জীব চৌধুরীর এই গল্প-সমষ্টিটি গল্পলেখক পারভেজ হোসেন-এর ছোট কাগজ সংবেদ-এর দশম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯৯৪ সালের জুন মাসে। গল্পের পর্বগুলিতে লেখক ও একটি চরিত্র বার বার ঘুরে ঘুরে এসেছে। গল্পকার ও চরিত্রের এই উপস্থিতিটুকু বাদ দিলে প্রত্যেকটি গল্প আলাদা।]


অবদমনগুলি
আগুন আর বাতাস তাঁকে তৈরি করেছিলো। তিনি, ক্লিওপেট্রা, শুভ্র সুডৌল, অবস্থান্তরে ঈষৎ লাল – যখন সূর্য ওঠে। তিনি ঋজু এবং সাবলীল হাঁস। জল তাঁকে স্পর্শ করে না, কাদা তাকে কলঙ্কিত করে না। যখন জনতার স্রোতে তিনি হাঁটেন, তখন চুম্বকত্ব প্রাপ্ত হন। লোহা, ইস্পাত, আলপিন…ঐহিহাসিক নিয়তির কারণে তাঁর শরীরে আছড়ে পড়ে। বস্তুগুলি লেপ্টে থাকে। তিনি সচেতন এবং কোনো কিছুই তাঁকে বিচলিত করে না। উদাসীন তিনি, অথবা নন। বোঝা যায়, অথবা একেবারেই দুর্বোধ্য। তবু বৃষ্টিতে চিক্কন। আর কদাচিৎ বলেন, ‘একদিন বিচ্ছিরি রকম মোটা হয়ে যাবো।’

‘মোটা হবেন কেন?’

‘আমার মা মোটা। আমার বাবা মোটা। আমার বাবার বাবা মোটা। বংশের মধ্যে মোটার একটা ধাঁচ আছে তো !’

‘ও।’

মাগো, যদি ধুমসি হয়ে যাই!’

‘বয়স কত হলো?’

‘এই…চব্বিশ-টব্বিশ।’

‘তাহলে মোটা হওয়ার রিস্ক আর নাই।’

‘একথা কেন বললেন?’

‘সান্ত্বনা দিলাম আর কি!’

অতপর তিনি ঠোঁট ফোলালেন। আর আমিও এতে করে যারপরনাই ফুলে উঠলাম। আমার স্বাস্থ্য ভালো হলো। খিদেও বেড়ে গেলো। সকাল বিকাল দুপুর-সারাক্ষণই খাই খাই করতে লাগলাম। প্লেটের পর প্লেট ভাত উজাড় করে দিতে থাকলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে রহস্যময় হাসি হাসেন। বলেন, ‘আপনার খিদে কিন্তু কমছে না’ – মুখের কথা কেড়ে নেয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করি না, বলি, ‘বরং বাড়বেই।’

‘আমি কিন্তু এর মধ্যে একটুও মোটা হই নি। গত দু’মাসে এক কেজি ওজনও বাড়ে নি।’

রিকশায় চলতে চলতে দু’জনের গায়ে বাতাস লাগে। তাঁর শরীর কী উষ্ণ! উষ্ণতা শোষণ করি চোখ বুজে। আমার আবারও খিদে পায়। আগুনের হলকা লাগে গায়ে। ফোস্কা পড়ে। আর তখনই তিনি রিকশাটা থামিয়ে দেন। বলেন, ‘আমি এখানেই নামবো।’ তখন অযথাই মন খারাপ হয়। অযথাই বুকপকেটে আর্তনাদ করে ওঠে লোহা, ইস্পাত, আলপিন…বলি, ‘আমিও কি নামবো?’ তিনি তাঁর উষ্ণ হাত নাড়েন। বাতাসে তরঙ্গ ওঠে। রোদের আঁচ লাগে। আমার স্মরণ হয়, তিনি আগুন আর বাতাস দিয়ে তৈরি।

তিনি, ক্লিওপেট্রা, অবস্থান্তরে ঈষ্ণৎ লাল। কিন্তু তাঁর হাত নাড়ার প্রকৃত অর্থ আমি অনুবাদ করতে পারি না। নামবো, না চলে যাবো – এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই তিনি চোখের আড়াল হয়ে যান। তিনি এরকমই। আমিও এরকমই।

রিকশাওলা মাথা চুলকায়, ‘এখন তাইলে কই যামু?’

‘গলির মোড়ে ভাই ভাই রেস্টুরেন্টে যান গিয়া।’

এত খিদেই আমার পেয়েছিলো যে কিছুক্ষণ পর হোটেল বয় এসে জানালো, ‘স্যার, কাঁচামরিচ আর লবণ ছাড়া সব কিছু শ্যাষ হইয়া গ্যাছে।’

আর এই কথা ক্রমে রাষ্ট্র হলো। ঢাকা শহরের সকল বন্ধু-বান্ধব কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটনাটা জেনে গেলো। কেমন করে-সেটা অবশ্য এখনো আমার কাছে রহস্য। কেউ কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্নও করেছে। জানতে চেয়েছে, ‘কয় পিস মাংস খাইলি?’ নিজে উত্তর দেয়ার আগেই অন্যজন গলা বাড়ায়, ‘মোট চৌষট্টি পিস।’

আমি নিজেও কম অবাক হই না। এসব কী হচ্ছে? এসব গুজব না সত্যি? বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। যখন গায়ে বাতাস লাগে আর আগুনের হলকা টের পাই এবং যখন স্মরণ হয় আমার ঐতিহাসিক নিয়তির কথা, আমি পুনরায় ক্ষুধার্ত হয়ে উঠি। বড়ো সাধ জাগে…

ফ্লাশব্যাক

পুরাকালে এক দার্শনিক ছিলেন। খুবই বড়ো মাপের। সত্য অনুসন্ধানই ছিলো তাঁর জীবনের চরম লক্ষ্য। প্রতিদিন রাতে বাতি নিভিয়ে চোখ বুঁজে তিনি ভাবতেন, ‘আমি কোথা থেকে এলাম, কোথায় বা যাবো?’ ‘কীভাবে সৃষ্টি হলো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড?’ ‘এর উদ্দেশ্য বা কী?’ তিনি মরিয়া হয়ে এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন। আর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে অন্ধকার ঘরে একাকী তিনি, বন্ধ চোখ – তার লিঙ্গ ক্রমশ উত্থিত হতো। এবং হস্তমৈথুনে তিনি লিপ্ত হতেন। প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘেঁটে যেটুকু তথ্য জানা গেছে, তা এই – দার্শনিক জীবিত ছিলেন একশ’ বছর। বৃদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সত্য অন্বেষণে এবং হস্তমৈথুনে একদিনও বিরতি দেন নি। আমৃত্যু তিনি ছিলেন একা। অন্ধকার ঘর, বন্ধ চোখ। এভাবেই একদিন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি অসংখ্য বিদ্যোৎসাহী এবং গুণগ্রাহী বন্ধু-বান্ধব রেখে যান।

খণ্ডন খণ্ড খাদ্যকার
খাওয়া নিয়ে আমি দিনকে দিন ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ছি। এত খাই। সারাদিন খাই। যখন খাই, গোগ্রাসে গিলি। যা খুশি তাই খেতে পারি, খেতে বসলে বন্ধু-বান্ধবরা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়ায়। তাদের চোখ বড়ো হয়, গোল হয়। শ্বাস দ্রুত হয়, অবাক হয়ে তারা বলে, ‘দেখো দেখো, ও খাচ্ছে!’ যারা অতি-উৎসাহী তারা রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগায়। খামোকাই চেঁচামেচি করে, ‘বাবুর্চি সাব, ওরে মাছের মুড়াটা দেন।’

ইদানিং কেউ আমাকে দাওয়াত করে না। ভয় পায়। ক্রমশই একা হয়ে পড়ছি, ভীষণ একা। আবার খরচ যোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। জমে উঠছে ঋণের বোঝা। কিছুই ভালো লাগে না। কিছুতেই মন বসে না। এক ধরনের চাপা অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করেছে। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় রাস্তায়। হঠাৎ করেই। দু’এক মুহূর্ত। হাত নাড়েন। বলেন, ‘চলছে তো ঠিকমতো?’ আমি তাঁর কথার অর্থ ঠিকমতো বুঝতে পারি না। বেকুবের মতোই বলি, ‘হ্যাঁ চলছে বেশ।’ তিনি রহস্যময় হাসি ফোটান ঠোঁটের কোণে। চোখ নাচিয়ে বলেন, ‘এই যে দেখুন, একটুও মোটা হই নি।’ আমি হাবার মতো বলি, ‘আপনার মোটা হওয়ার চান্স আর নাই।’

কখনো কখনো তিনি বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কী উষ্ণ তাঁর শরীর! রিকশা চেপে হাওয়া খাই। কিন্তু মন বসে না। কিছুতেই কিছু হয় না। আমার খিদে পায়। আমার ভীষণ খিদে পায়…

আর এ-কথাটাই কাউকে কখনো বোঝাতে পারি না।

সামান্য ক্ষতি
মহিষী করুণা। রাণী তিনি। অসীম তাঁর ক্ষমতা। অনন্তকাল ধরে পাটরাণী। যে দেখে, মুগ্ধ হয়। কথিত আছে, তাঁর শরীর বেয়ে পড়ে জ্যোৎস্না – ধবলকান্তি। কুয়াশা। যখন জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি হাত নাড়েন, তখন চুম্বকত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি সচেতন। কোনো কিছুই তাঁকে বিচলিত করে না। উদাসীন তিনি, অথবা নন। তবু বৃষ্টিতে চিক্কন। আর কদাচিৎ বলেন, আমাকে রচনা করো হে রবীন্দ্রনাথ, মৃত্যুর আগেই! তখন রাত। একটু পড়েই বারোটা বাজবে। মহিষী করুণা বসে আছেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সাজাচ্ছেন নিজেকে। একটু একটু করে। চোখের কোণে কাজল। ক্ষীণ বাঁকা ভুরু। হালকা লিপস্টিক। শরীরে সারাক্ষণ সুরভীর প্রতিশ্র“তি। কী অপূর্ব তিনি, যেন প্রসাধনীর চিহ্ন মাত্র নেই। স্তনবৃন্ত ফুটে ওঠে চিরযৌবনের ভারে। আয়নায় নিজের মুখ। এক চিলতে হাসি ফোটে – বহুদূরের রহস্য। জানতেন দা ভিঞ্চি। মহিষী করুণা তাঁর নাইটির ফিতায় ঢিল দেন। তখনই নামে জ্যোৎস্নার ঢল। আর তা ছাপিয়ে যায় পাশের ঘরে। সেখানে উলঙ্গ রাজা। তাঁর হাতে গোটা-দুই ট্যাবলেট – কামবর্ধক। তিনি গলাধঃকরণ করেন। আর ভাবেন, আমি পুরুষ, আমি পুরুষ…তিনি ভাবতেই থাকেন। মেডিটেশন। মহেঞ্জোদারোর ষাঁড়। অ্যারাবিয়ান ঘোড়া। বাৎসায়ন।

আর তখন বারোটা বাজতে না বাজতে লুটিয়ে পড়েন রাজা। রাণীর উলঙ্গ পায়ে। তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্ত রাণী হিংস্র চোখে প্রতিদিনের মতো বলেন, ছিঃ! রাজাকে পায়ে দলে উঠে দাঁড়ান। ছুটে যান পাশের ঘরে। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন একান্ত সহচরীকে। আর রাত দু’টো গড়িয়ে গেলে তৃপ্ত, অবসন্ন তাঁরা দু’জন মেঝের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন – উলঙ্গ, বিবস্ত্র।

ও ঘরে নিদ্রাহীন রাজা তখনও মন্ত্র জপেন, আমি পুরুষ, আমি পুরুষ…তিনি জপতেই থাকেন। দ্বন্দ্বের সূত্রপাতটা কখন হয়েছিলো? কেই জানে না। কেউ বলতে পারে না। এমনকী রবীন্দ্রনাথও না। রাজা আর রাণীর মধ্যে কী বিস্তর দূরত্ব জনতা জানে না। এ সম্পর্কে কোনো কিংবদন্তী রচিত হয় নি। কেননা রাজা আর রাণীকে নিয়ে সমালোচনা সংবিধান-বিরোধী। তাই জনতা প্রতিদিন এই শুনে আশ্বস্ত হয় – আমাদের রাজা-রাণী অমর। তারা অনন্তকাল অবধি সুখী।

কিন্তু রাণীর সহচরী বিশাখা পরে কিন্তু কথা ফাঁস করে দেয়। আমরা যতোটুকু শুনেছি বিশাখার কাছ থেকেই শুনেছি। আমরা জানি, এসবই সত্য। এর পরের ঘটনা অবশ্য খুবই সংক্ষিপ্ত। রবীন্দ্রনাথ তা বিশ্বস্তভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তার বিবরণ বাইরে বিশাখা কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য অনুযায়ী মাঘ মাসের এক দিনে শীতের বাতাস বইতে থাকার দরুন রাণীর ভীষণ শীত বোধ হয়। তিনি গ্রাম জ্বালিয়ে আগুন পোহান। অক্ষম পুরুষত্বহীন রাজা এবার তার পৌরুষ দেখাতে এগিয়ে এলেন, কঠিন শাস্তি দিলেন তিনি প্রগল্ভ রাণীকে। আদেশ করলেন, যতো ঘর পোড়ানো হয়েছে, সবগুলোর মেরামত করার খরচ যোগাতে হবে রাণীর নিজেকেই। রাজকোষ থেকে কানাকড়িও দেওয়া হবে না। রাজা মনে করেছিলেন খুব জব্দ করা গেলো। নিজের অপমানের শোধ তুলতে পেরে খুব আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন তিনি। কিন্তু রাণী এবারও হারলেন না। তিনি বেসরকারীভাবে সাহায্যের আবেদন জানালেন জনগণের কাছে। বললেন, দান করুন, মুক্তহস্তে। জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়লো সাহায্য দিতে। একজন ব্যবসায়ী একাই দিলেন পাঁচ লক্ষ টাকা। এক লাখ, পঞ্চাশ হাজার – এরকমও দিলেন অনেকে। আর হাজার একশ’র তো হিসাবই নেই। সবার মুখে একই কথা – একটা ভুল হয়তো রাণী করেছেন, কিন্তু দেখো কী তাঁর জনদরদী মন। আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়েছেন। তাঁর দানবাক্সে জমা হলো প্রায় দশ কোটির মতো। দু’কোটি টাকা খরচ করে গ্রামটাকে আগের চাইতেও দশগুণ সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন। সকলে ধন্য ধন্য করলো। আর রাণীর হাতে থাকলো নেট আট কোটি টাকা। রাজা আবারও হারলেন – গোপনে।

স্বপ্ন কিংবা অশ্লীলতা
হাজী ওসমান গনি আমার বিশেষ বন্ধু। তাকে সব কথাই বলা যায়। দু’কান হয় না। একদিন তার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। বিকট একটা অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সেটি তাকে বলা দরকার। গিয়ে দেখি বারান্দায় ওসমান গনি আর তিনি বসে আছেন। তিনি, ক্লিওপেট্রা, তখন ঈষৎ লাল। বেশ আড্ডা চলছে। আমাকে দেখে গনি তেমন একটা উচ্ছ্বাস দেখালো না। বললো, ‘ও তুই।’ এটুকুই। নিজেকে ধম্যমণি করে ফেলার তাগিদ সহসা আমাকে গ্রাস করে ফেলে! হড়বড় করে বলতে থাকি, ‘বুঝলি, মাস্টারবেট করতে লইছিলাম গতকাল। চেইনটা খুইলা যেই ধরতে গেছি ওমা, দেখি কী, একটা সাপ। হিস হিস করতাছে। নিজেই তাজ্জব। ভয় খাইয়া গেলাম। ভাবলাম, এইটা কেমনে হইলো!’

ওসমান গনি শক্ত মুখে আমার দিকে তাকায়। বুঝতে পারি ভুল হয়ে গেছে খানিকটা। কিন্তু গল্পটা তো সত্য ছিলো। স্বপ্নে জানি, এটা সত্য। ঐ স্বপ্নে তিনিও তো ছিলেন। স্বপ্নের ভেতর তিনি আমার চেয়েও অসভ্য ছিলেন। কিন্তু সে সব তো কিছুই বলি নি। তাঁকে তো আর ছোট করা যায় না। কিন্তু এর পরও ওসমান গনি আমাকে পাত্তা দেয় না। হঠাৎ দেখি প্রসঙ্গক্রমেই তারও কী একটা ঘটনা যেন মনে পড়ে গেছে। বললেন, ‘শোনেন গনি ভাই, গতকাল কী একটা কাণ্ড হলো…।’ এরপর তিনি আর গনি ফিসফিস করতে থাকেন। আমি কিছুই শুনতে পাই না। বড়ো রাগ হয়। কষ্টও হয়। বিষয়টা কী? গনিকে বলা যায়, আর আমাকে বলা যায় না? আমি মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দরকার নেই আমার, কাউকেই দরকার নেই, কোনো শালাকেই না। আর তখনই গনি ধমকে ওঠে। চোখের সামনে তর্জনী নাচাতে নাচাতে বলে, ‘শালা হাড়ামজাদা, ভদ্রঘরের মেয়ের ইজ্জত লুটতে তোমার লিঙ্গ একটুও কাঁপলো না! মামার বাড়ি পাইছ? আমি বললাম, ‘কে বলেছে?’ গনি গলা চড়িয়ে বললো, ‘তিনি বলছেন, এই এক্ষণ বলছেন।’

‘দোস্ত, ব্যাপারটা তো স্বপ্নে, মানে তাঁরও সম্মতি ছিলো।’

‘চুপ বাঞ্চোৎ। স্বপ্ন চুদাইও না আমার লগে। বিচ্চি গাইলা ফালামু।’ আর এই সময় তিনি সহসাই আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। বলেন, ‘বাদ দেন তো গনি ভাই, মনে হয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে। ব্যাপারটা হয়তো স্বপ্নেই ঘটেছে। আমারও উল্টা-পাল্টা হতে পারে। কী সিলি ব্যাপার!’

গনি চেঁচায়, ‘বাদ দিব ক্যান? আমি স্বপ্ন-টপ্ন বুঝি না, ফ্রয়েডও বুঝি না। ও আপনার দিকে চোখ লাল করছে এইটাই তো যথেষ্ট।’ গনি মুঠো পাকায়! এগিয়ে আসে আমার দিকে। ওর হঠাৎ এত ক্ষেপে ওঠার কারণটা ঠিক মালুম হচ্ছে না। আগে কখনো এরকম দেখি নি। আমি বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। উল্টা মার লাগাবো? বুঝতে পারি না। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই গনি আমার কলার চেপে ধরে। আর উড়ে আসেন তিনি। জাপটে ধরে আড়াল করেন আমাকে। আর এভাবেই সবকিছু ভুলে যাই আমি। কী উষ্ণ তিনি! আমি চোখ বুজি। শোষণ করি তাঁর উষ্ণতা। পরম নির্ভরতায় তার বুকে মাথা এগিয়ে দিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়তে থাকি। কিন্তু গনি আমাকে ছাড়ে না। গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলে, ‘ইউ স্কাউন্ড্রেল, গেট আউট।’ আর তক্ষুণি স্বপ্নের ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসি আমি। পিপাসা বোধ করি। ভীষণ পিপাসা।

গ্রাম্যপ্রক্ষেপ
সেবার গরমের দিনে গ্রামে গেলাম। ঢাকার পাশেই গ্রামটা। নাম ‘তিন-মোহনা’। দেখলাম চিমসা এক তরুণ একপাল ভেড়া নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। তখন সকাল। তার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম। চিমসা বড়ো নির্বিকার। আমার দামী শার্ট-প্যান্ট তাকে বিচলিত করলো না মোটেও। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলে হুঁ-হাঁ উত্তর দেয়। মনে মনে চটে উঠলাম। শালা! মুখে হাসিটা অবশ্য ঝুলিয়েই রাখলাম। এমনি-এমনিই একসময় জানতে চাইলাম, ‘ভেড়ার মাংসের দর কতো মিয়া ভাই ?’

চিমসা এবার থমকে দাঁড়ালো। হাতের পাঁচনটা আমার দিকে উঠিয়ে ধরে কঠিন গলায় বললো, ‘ভাইজান ভেড়া লইয়া ব্যবসা আমি করি না। আমার ভেড়া বেশ্যামাগী না। যারা ব্যবসা করে তাগো কাছে যান।’ এরপর আর কোনো প্রশ্ন করার মানেই হয় না। সাহসও পেলাম না। শালা চিমসা!

এই গ্রাম সেই গ্রাম নয়। এখানে পাখা নাড়লেও বাতাস লাগবে না। কষে দুটো গাল দিয়ে বেলাবেলি ঢাকা ফিরে এলাম। তার আগে অবশ্য অনেক ছবি তুলেছি কামেরায়। গরু, ভেড়া, ছাগল, মুরগী, ব্লাউজবিহীন গ্রাম্য বধুর রকমারি ছবি। ‘রূপসী বাংলা’ সিরিজটা এসব ছবি দিয়ে ভরিয়ে তোলা যাবে বলেই বিশ্বাস।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত