| 27 নভেম্বর 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

আজ আছি কাল নেই । সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

 

কে, দীনবন্ধু নাকি? এখানে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছ?

আরে ভবেশনাকি? তুমি এ সময়ে! কোথায় চললে? বাড়ি ঢুকলে না? আমার পাশ দিয়েই তো দুরমুশ করতে করতে গেলে, বেরিয়ে এলে কেন? অফিস থেকে ফিরলে, চা-জলখাবার খাবে। কুশল বিনিময় করবে সারাদিনের পর। এমন আধলা ইট-খাওয়া লেড়ি কুকুরের মতো মুখ কেন গো?

তোমার পাশে একটু স্থান হবে ভাই?

হবে, বারোয়ারি রক, ধুলো ঝেড়ে বোসো। বেশি ওপাশে যেয়ো না। কেলো এইমাত্র বেপাড়ার এক মস্তান কুকুরের সঙ্গে চুলাচুলি করে এসে সবে ন্যাজ গুটিয়ে শুয়েছে। মেজাজ চড়ে আছে। ঘাঁক করলেই তলপেটে চোদ্দোটা। ফুঁ হুঁ করে ধুলো উড়িয়ে ভবেশ বসে পড়ল। বসার সময় হাতের আঙুলে কী একটা ঠেকল। দীনবন্ধুর বাজারের ব্যাগ। কপি, মুলো, ভিজে ভিজে পালংশাক চারপাশে ছেদরে আছে। দীনবন্ধু অফিস থেকে ফেরার পথে রোজই বাজারটা সেরে আসে। অভ্যাসটা মন্দ নয়। শীতের ছোট্ট সকালে খানিক সময় বেরোয়। একটু তারিয়ে তারিয়ে দাড়ি কামানো যায়। নয়তো তাড়াহুড়োয় ধরো আর মারো টান। ছাল-চামড়া গুটিয়ে সাফ।

ভবেশ বলল, একী, বাজার নিয়ে বসে আছ? দু-কদম এগোলেই তো বাড়ি। বাজারটা রেখে এলেই পারতে। এই নোংরায় ফেলে রেখেছ? পালং-এ ইনফেকশান ঢুকবে।

দীনবন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হাতে ঘড়ি নেই, কটা বাজল তোমার ঘড়িতে?

আটটা বাজতে দশ।

উঃ এখনও ঝাড়া দেড় ঘণ্টা।

বুঝতে তাহলে পেরেছ কেন বসে আছি?

হ্যাঁরে ভাই পেরেছি একটু চা হলে মন্দ হত না।

এখান থেকে হেঁকে বিভূতিকে বলো, ভাঁড়ে দুটো চা। দুটো লেড়ো বিস্কুটও দিতে বলো।

দীনবন্ধু আর ভবেশ খানছয় বাড়ির ব্যবধানে থাকে। দুজনেই ভালো চাকরি করে। নির্বিরোধী ভদ্রলোক বলে পাড়ায় যথেষ্ট সুনাম আছে। এ তল্লাটে সস্তায় জমি পেয়ে দুজনেই বাড়ি তৈরি করে। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে সংসারধর্ম পালন করছে। সেই কথায় আছে, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তাঁতির হেলে গরু কিনে। দুজনেরই বাড়ির ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে পাঁচটি করে অ্যালুমিনিয়ামের আঙুল আকাশের গায়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ খুঁজছে। চ্যাটালো তার বেয়ে সেই আশীর্বাদ ভেন্টিলেটার গলে কাচের পর্দায় কখনও নৃত্যে, কখনও কথকতায়, কখনও সংগীতে গলে গলে পড়ে। সবচেয়ে মারাত্মক দিন শনিবার। সেদিন হয় বাংলা, না হয় হিন্দি ছায়াছবি। গেরস্থের আর্তনাদ, পাঁচু প্রাণ যায়।

অদ্য সেই শনিবার। বাংলা ছায়াছবির আসর, অশ্রুসিক্ত ছবি। খটখটে ছবি হলেও দর্শকের অভাব হয় না। পালে পালে পিলপিল করে আসতে থাকেন নেণ্ডিগেণ্ডি, পুঁচিপেঁটকি নিয়ে। দীনবন্ধু টিভি কিনেছিল এরিয়ারের টাকায় স্ত্রীকে খুশি করার জন্যে। আহা। একা একা বাড়িতে থাকে, সন্ধেটা তোমার ভালোই কাটবে। স্ত্রীও খুব নেচেছিল। টিভি আসবে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে কচুরি ভেজে স্বামীকে খাইয়েছিল। জুট কার্পেট পাতা লবিতে টিভি সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। ছাদে ফোঁস করে ফুঁসে উঠল টিভিঙ্গুলি। সারা পাড়াকে জানান দিতে লাগল, আমি এসেছি, আমি এসেছি। তোমরা এসো হে। একবার বুঝিয়ে দিয়ে যাও, কত ধানে কত চাল।

ভবেশ টিভি কিনেছিল গৃহবন্দি, অবসরভোগীবৃদ্ধ পিতার সান্ধ্যসঙ্গী হিসেবে। দোতলায় পিতার সুবৃহৎ শয়নকক্ষে নীল পর্দা আঁটা সেই যন্ত্র এখন শক্তিশালী যন্ত্রণা। ডজনখানেক বিভিন্ন স্বভাবের বুদ্ধের পীঠস্থান। তাঁদের হাঁচি, কাশি, নাসিকাঝর্তন, কলহ, মতামত প্রকাশের ঘনঘটায় প্রতিটি। সন্ধ্যা ভবেশকে স্মরণ করিয়ে দেয়, য পলায়তি স জীবতি।

দুই কৃতকর্মভোগী কৃতী পুরুষ পাঁচুবাবুর রকে বসে ভাঁড়ের চা খাচ্ছে। মশা তাড়াচ্ছে। নর্দমার চাপা গন্ধ শুকছেন আর মনে মনে বলছেন, একেই বলে, বাঁশ কেন ঝাড়ে আয় মোর হিন্দিস্থানে। ভাঁড়টাকে সাবধানে পায়ের তলার বদ্ধ নর্দমায় বিসর্জন দিয়ে ভবেশ বললে, ভট করে চা খেয়ে। ফেললুম, বড় বাইরে পেলে মরব।

মরবে কেন? বাড়িতে গিয়ে নামিয়ে আসবে।

বাথরুম খালি পেলে তো! বারোটা শর্করারোগী মিনিটে মিনিটে ছুটছেন, আর প্রতিবার হাতে জল নিয়ে সেইখানে আর গোড়ালিতে শাস্ত্রসম্মত ঝাপটা মারছেন। চোখ বুজিয়ে বাথরুমের অবস্থাটা একবার অবলোকন করার চেষ্টা করো ভাই। কর্পোরেশনও লজ্জা পাবে।

তোমার বাথরুম? আমি মানসচক্ষে আমার বসার ঘর দেখছি আর আঁতকে আঁতকে উঠছি।

দীনবন্ধুর বসার ঘর ঠেসে গেছে। অনাহূতরা সারি সারি বসে আছেন বিশিষ্ট অভ্যাগতদের মতো। কাউকেই ফেরাবার উপায় নেই। শত্রুতা বেড়ে যাবে। বলে বেড়াবে বেটার অহংকার হয়েছে। ভগবানের গুনছুঁচ যেদিন বেলুন ফুটো করে দেবে সেদিন চামচিকির মতো চুপসে গাবগাছের তলায় পড়ে থাকবে। দীনবন্ধুর স্ত্রী শাপশাপান্তকে ভীষণ ভয় পায়। লাল আলোয়ান গায়ে ওই যে বসে আছেন মিনুর দিদিমা। দু-হাঁটুতে বাত। অন্য সবাই মেঝেতে কার্পেটের ওপর থেবড়ে আছেন, তিনি বসেছেন সোফায়। মুখপোড়া বাত আর জায়গা পেলে না, ধরল এসে হাঁটুতে। কত্তা যাবার সময় ওইটি দিয়ে গেলেন। গোবিন্দের মা কোণের দিক থেকে বললেন, ওকথা বলছেন কেন, কত্তা একটা বাড়ি রেখে গেছেন, তিনটি ছেলে দিয়ে গেছেন, চার মেয়ে। আর কী চাই?

আ মোলো কথার ছিরি দেখ। আমরা আজকালের বিবি ছিলুম না তোদের মতো। সারা জীবন পেটে একটা কিছু না থাকলে আমাদের কালো শরীরটা খালি খালি মনে হত। কত্তা গর্ব করে বলতেন, সুখদা আমার দুরকল, একটু ঠুকরেছ কী অমনি ঝপাং। হাত ঠেকালেই সোনা। তোমরা হলে ফাঁকিবাজ। একটা কি দুটো, অমনি ছুটলে। কাটিয়ে কুটিয়ে ফাঁকা হয়ে ফিরে এলে।

দীনবন্ধুর স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলল, কী হচ্ছে দিদিমা? বাচ্চারা বসে আছে।

তুমি আর সাউকুড়ি করতে এসো না। ওরা সব বাচ্চার বাবা। দেখলে না ঠুলির বিজ্ঞাপনের সময়। কীরকম হাসাহাসি করছিল! তুমি মা এযুগের মেয়ে। তুমি ওসব বুঝবে না। তোমরা হলে মেয়েমানুষ। আমাদের কালে মুতের কাঁতা শুকোতে পেত না। দাও এক গেলাস জল দাও। আ মর, সিনেমা বন্ধ করে মাগি সেই থেকে বকেই মরছে। আহা কী রূপের ছিরি! চুলে বব করে বসে আছেন। বুকের দিকে না তাকালে ছেলে কি মেয়ে বোঝে কার বাপের সাধ্য!

বুলডগের মতো মুখ করে মিনুর দিদিমা পাগলে পাগলে হাওয়া খেতে লাগলেন।

একেবারে লাগোয়া বাড়ির চার বউ রেলের পিস্টনের মতো আসা-যাওয়া করছেন! স্থির হয়ে বসার উপায় আছে কি? পাশে ছড়ানো সংসার। টিয়াপাখির ঠুকরে ঠুকরে পেয়ারা খাওয়ার কায়দায় চার বউয়ের টিভি দেখা চলেছে। ব্যোমে পায়রা বসার মতো। বড় বউ যেন দিশি গোলাপায়রা। বয়সের মাঝসমুদ্রে বয়ার মতো শরীর। তিনি একটি বেতের মোড়া দখল করেছেন।

তাঁর সন্তান-সন্ততিতে চারপাশে গোল করে মাকে ঘিরে রেখেছে। বসতে-না-বসতেই তাঁর খেয়াল হল, আলমারির গায়ে চাবিটা ঝুলিয়ে রেখে এসেছেন। সৃষ্টি পড়ে আছে আলমারিতে। দিনকাল ভালো নয়। বড়মেয়েকে বললেন, চাবিটা নিয়ে আয় তো। বড়মেয়ে ছবিতে মশগুল। প্রেমিক প্রেমিকাকে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে গান ধরেছে, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন। হত? লাল্লা লালা লালা। বড় বললে, থাক না। মা একটা চাপা হুঙ্কার ছাড়লেন, টিভি দেখা ঘুচিয়ে দেব তোর। মেয়ে অন্যমনস্কে উত্তর দিল, যাও যাও, সব করবে। মা হুঙ্কারে বললেন, দেখবি?

মিনুর দিদিমা বললেন, দুটোকেই বের করে দাও।

বড়বউ মুখ বেঁকিয়ে ভেংচি কেটে বললেন, কত বড় সাহস! যার ধন তার ধন নয় নেপোয় মারে দই। আপনি বের করে দেবার কে?

মিনুর দিদিমা হুঙ্কার ছাড়লেন দীনবন্ধুর স্ত্রীকে, বউমা, বউমা।

বড়বউ ততোধিক জোরে বললেন, বউমা কী করবে? বউমা এসে আমার মাথা কেটে নেবে?

টিভির পর্দায় নায়ক-নায়িকারা তখন কোরাসে চেল্লাচ্ছেন, লা লালা, লাল্লা, লাল্লা।

মেজোবউটি যেন সিরাজু পায়রা। লাট খেতে খেতে এলেন, এসেই বললেন, যাও, দেখগে যাও, তোমার নতুন সুজনিতে হোটর ছেলে পেচ্ছাব করেছে।

তোশক ভিজছে, তোশক ভিজেছে? বড়বউ মোড়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেই, ধাক্কায় মোড়া কাত হয়ে মহাদেবের ডম্বরুর মতো গড়াতে গড়াতে গদাইয়ের মার কোলের ছেলেটার মাথায় গিয়ে খোঁচা মারল। আঁচলচাপা ছেলে চুকুর চুকুর দুধ খাচ্ছিল। অষ্টপ্রহর তিনি চুষতে না পেলে চিল্লে বাড়ি মাথায় করেন, মোড়ার খোঁচায় বোঁটা ছেড়ে তিনি হাইফাই স্পিকারের মতো ওঁয়া ওঁয়া, হোঁয়া…ওঁয়াও করে মিউজিক ছাড়লেন। প্রেমিক-প্রেমিকার তুমি, তুমি, হুইসপার চাপা পড়ে গেল। মেজো পুতুলনাচের ধসে-পড়া পুতুলের মতো জমির হাতখানেক ওপর দিয়ে লাট খেয়ে একপায়ে ঝপাৎ করে বসে পড়ে বললেন, কার মিউজিক? কার মিউজিক রে?

পম্পা, শম্পা, চম্পা তিন বোন। বাপ-মা দুজনেই চাকুরে। মাথায় মাথায় তিন বোন। পম্পা শরীরের চেয়েও ঘেরে বড় ম্যাক্সি পরে, একবার করে আসছে, বসছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। আসা আর যাওয়ার পথে পোশাকের ধাক্কায় সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। প্রথমে উলটে গেল। টেবিলল্যাম্প। শেডফেড ছিটকে চলে গেল। মিনুর দিদিমা বললেন, দীনুর কাণ্ড দেখ। মাথার ওপর এত আলো, তাতে হচ্ছে না। ব্যাঙের ছাতার মতো আলো গজিয়েছে মেঝে থেকে।

দ্বিতীয়বার ছিটকে পড়ল কাটগ্লাসের অ্যাশট্রে। সিগারেটের টুকরো, ছাই, দেশলাই কাঠি কার্পেটের ওপর ছত্রাকার। তার ওপর থেবড়ে বসলেন পাশের বাড়ির সেজোবউ। বসতে বসতে। বললেন, বেশিক্ষণ বসব না। ডাল চাপিয়ে এসেছি। যেন সমবেত মহিলামণ্ডলী তাঁর কাছে। জানতে চেয়েছিল তিনি কতক্ষণ বসবেন। কেন বসবেন না।

হঠাৎ সামনের সারির এক বাচ্চা আর একটা বাচ্চার ঝুঁটি ধরে বেশ বারকতক ঝাঁকিয়ে দিল। লেগে গেল দুজনের ঝটাপটি। তার-ফার ছিঁড়ে লন্ডভন্ড হওয়ার আগেই দীনুর বউ দৌড়ে গিয়ে দু-পাশে সরিয়ে দিল। এ বলে তুই বাপ তুললি কেন, ও বলে তুই বাপ তুললি কেন? দিনুর বাড়ি যে মহিলা কাজ করেন, এরা তার বংশপরম্পরা। কান ধরে বার করে দিলে কাল থেকে তিনি আর কাজে আসবেন না। দুজনকে দু-কোণে বসাতে হল। সেখান থেকেই তারা মুখ ভ্যাঙাভেঙি করতে লাগল। একজনের বই ভালো লাগেনি, সে হাত-পা ছড়িয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে আছে। ঠ্যাং ধরে টেনে সরিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। এখুনি বাড়ি ঘেরাও হয়ে যাবে। দীনুর বন্ধুরা এসে দীনুর মাথা কামিয়ে, ঘোল ঢেলে ছেড়ে দেবে।

বড়বউ লাফাতে লাফাতে ফিরে এসে মেয়েদের হুকুম করলেন, যা, ঘোটর বিছানায় করে আয়। ভাসিয়ে দিয়ে আয়। মেজো হাতের তালুতে চিবুক রেখে দাঁতচাপা সুরে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, করে আয়, যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল।

যে মেয়ে চাবি আনতে রাজি হচ্ছিল না, ঝগড়ার গন্ধ পেয়ে সে তিরবেগে ছুটল। ছোট-মেয়ে বোকা, সে ক্রমান্বয়ে জিগ্যেস করতে লাগল, দিদি কী করতে গেল মা? ওপাশ থেকে কে একজন বলে উঠল, হিসি।

দিনুর স্ত্রী থাকতে না পেরে রাগ রাগ গলায় বললে, টিভি বন্ধ করে দিই।

মিনুর দিদিমা বললেন, বাড়িতে বায়োস্কোপি বসালে অমন একটু হবেই মা! অধৈর্য হলে চলে?

নায়ক নায়িকাকে একটু আদর-টাদর করছিলেন। কোণের দিকে বখা বাচ্চাটা সিক করে সিটি মেরে উঠল। ওরই মধ্যে প্রবীণা একজন আপত্তি করলেন, এতটা বাড়াবাড়ি ভালো নয়। ভদ্দরলোক ছোটলোক এক হয়ে গেলে যা হয়।

ব্যস, লেগে গেল ধুন্ধুমার। ছোটলোক! কথার ছিরি দ্যাখো। নিজে ভারী ভদ্দরলোক। ছেলে তো ছ-মাস বাইরে ছ-মাস ভেতরে।

মিনুর দিদিমা হঠাৎ বলে উঠলেন, হ্যাঁগা, এই বুঝি তোমাদের উত্তমকুমার?

পম্পা পাল তুলে ফড়ফড় করে চলে গেল। বাতাসে দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডার খসে পড়ল।

পম্পা হ্যাট্রিক না করে ছাড়বে না জানা কথা। দৃকপাত নেই। বসেই একগাল হেসে বললে, কী সুন্দর!

বড়র মেয়ে ফিরে এসে বললে, ওদের চাদরে হলুদের হাত মুছে দিয়ে এসেছি। গোদা পায়ের ছাপ মেরে এসেছি।

সেজোবউ বললে, কাজটা ভালো করোনি।

মেজো বললে কেন করেনি? বেশ করেছে। ওদের সঙ্গে ওইরকমই করা উচিত। যেমন কুকুর তেমন মুগুর। শাস্ত্রে আছে।

সেজো বললে, বাচ্চা ছেলে শীতের সময় একটু করে ফেলেছে। তোমরা দুজনে আদাজল খেয়ে মেয়েটার পেছনে লেগেছ।

তোমাকে যে উল দিয়ে হাত করেছে। তুমি তো বলবেই।

দীনবন্ধু ভবেশকে বললে, আর তো পারা যায় না। সময় যে চলতে চায় না। বাজল ক-টা?

প্রায় মেরে এনেছি।

কুকুরটা উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দিল। দীনু বললে, ব্যাটাও পেছনে লেগেছে। সেই থেকে খ্যাচর খ্যাচর গা চুলকাচেচ্ছ আর ভটাস ভটাস গা ঝাড়া দিচ্ছে।

ভবেশ ঘড়ি দেখে বললে, এবার ওঠা যেতে পারে। শেষ হয়েছে সিনেমা।

বাড়ি ঢুকে দীনবন্ধু প্রথমে গেট বন্ধ করল। দুটো পাল্লাই হাট খোলা ছিল। সদরে ঢোকার মুখে ধেড়ে পাপোশ পায়ের ধাক্কায় মাতালের মতো কাত হয়ে পড়েছিল। দীনু ধুলোসমেত টেনেটুনে সেটাকে যথাস্থানে নিয়ে এল। টেবিল ল্যাম্পটাকে সোজা দাঁড় করাতে করাতে বললে, এটা কী হয়েছে! হকি খেলছিলে নাকি?

দীনুর স্ত্রী বললে, ওইরকমই হবে।

একী! দামি অ্যাশট্রে, এখানে উলটে পড়ে আছে! তোমরা সত্যি! মিনুর দিদিমা সিগারেট খাচ্ছিল?

দীনুর স্ত্রী বললে, ওইরকমই হবে।

একী! এখানে কে চিনাবাদামের খোসা জড়ো করেছে? তুমি সত্যি একেবারে কাছাকোঁচা খোলা।

ওইরকমই হবে।

তার মানে? সামনের শনিবার স্ট্রেট বলে দেবে, হবে না, ঢুকতে দেওয়া হবে না।

আমি পারব না, পারলে তুমি বোলো। দীনু চাপা গলায় বললে, আপদ।

তোমারই আমদানি।

দীনু কার্পেটের ওপর ঝাড়ু চালাতে চালাতে বললে, ধূপ জ্বালো, ধূপ। সারা ঘর ভেপসে উঠেছে।

টিভির সামনে এসে মনে মনে সেই প্রার্থনা আবার জানাল, হে পিকচার টিউব, দয়া করে বিকল হও।

এদিকে ভবেশবৃদ্ধ সিধুজ্যাঠাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে দিতে একই প্রার্থনা বিধাতার দরবারে পেশ করল। বৃদ্ধ কাশতে কাশতে বললেন, চোখে ছানি, দেখতে পাই না, তবু সময়টা বেশ কাটে। একটা হিসেবও পাওয়া যায়, কে রইল কে গেল। আজ আছি কাল নেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত