গাইনের গীতকেও বলা হয় গাজীর গীতঃ সঞ্জয় সরকার

Reading Time: 5 minutes

আজ ১৭ এপ্রিল।সংবাদিক,ছড়াকার,প্রাবন্ধিক সঞ্জয় সরকারের  জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা। পাঠকদের জন্য তার একটি লেখা।


বিলুপ্তপ্রায় গাইনের গীত
বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, ঢপ, কিচ্ছা বা পালাগানের মতো নেত্রকোনার গ্রামীণ জনপদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গীতরঙ্গ ‘গাইনের গীত’। নেত্রকোনার পাশ্ববর্তী জেলা ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জেও একসময় এর প্রচলন ছিল। তবে নেত্রকোনার গ্রামাঞ্চলে গাইনের গীতের কদর ছিল ব্যাপক। এ জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও হাট-বাজারে প্রায় সময়ই অনুষ্ঠিত হতো গাইনের গীত। আজকের দিনে আর আগের মতো গাইনের গীত দেখা যায় না। অত্যন্ত ক্ষয়িষ্ণুভাবে টিকে আছে লোকসঙ্গীতের এই জনপ্রিয় ধারাটি।
কবে, কখন গাইনের গীতের প্রচলন হয়েছিল—তা আজ আর জানা সম্ভব নয়। কারণ, লোকসঙ্গীতের এই ধারাটি নিয়ে তেমন কোনো গবেষণামূলক কাজ হয়নি। লোকসাহিত্য সংগ্রাহকরা বিভিন্ন সময়ে লোকসঙ্গীতের অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করলেও ‘গাইনের গীত’-এর ইতিহাস এবং এর গীতগুলোও সংগ্রহে কেউ কখনো এগিয়ে আসেননি। এ কারণে গাইনের গীতের উদ্ভব ও বিকাশকাল সম্পর্কিত সব তথ্যই অনুমাননির্ভর। ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার দাবি করেছেন—‘১৮৬০ থেকে ১৯৬০ সন পর্যন্ত এর যৌবনকাল।’ এর স্বপক্ষে তেমন কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়—গাইনের গীত সুদীর্ঘকাল থেকেই নেত্রকোনাসহ এ অঞ্চলের গ্রামাঞ্চলে গীত হয়ে আসছে।
নেত্রকোনা অঞ্চলে গাইনের গীতের গায়কদের ‘গাইন’ (গায়েন>গাইন) বলা হয়। তেমনি গাইনের গীতকেও বলা হয় ‘গাজীর গীত’। এর কারণ, গাইনের গীতের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে গাজী-কালু-চম্পাবতী’ কাহিনি। গাইনরা তাঁদের গান ও কথার মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের গাজী জিন্দাপীরের কাহিনীর বর্ণনা করে থাকেন। গারো পাহাড়ের কুল ঘেঁষে অবস্থিত নেত্রকোনা অঞ্চলে একসময় প্রচুর ঝাড়-জঙ্গল ছিল। আর এসব গভীর ঝাড়-জঙ্গলে বাস করতো বাঘসহ হিংস্র জীব-জন্তু। গাজী-কালু-চম্পাবতী কাহিনিতেও বাঘের বর্ণনা রয়েছে। আছে বীরত্বের উপাখ্যান। ধারণা করা হয়, বাঘসহ হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের উপদ্রব থেকে মুক্ত থাকার অভিপ্রায়েই গাইনের গীতের মাধ্যমে গাজী জিন্দাপীরের বন্দনার প্রচলন শুরু হয়েছিল। দেখা যেত, গ্রামীণ নারীরা প্রায় সময় ধর্মজ্ঞানে মানত করে গাইনের গীতের আয়োজন করতেন। ভয়, বিপদ-আপদ বা বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি এবং কল্যাণকর কাজকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে পল্লীর মানুষ এখনো ধর্মজ্ঞান করেই গাইনের গীত শোনেন। মুসলিম পীরের কাহিনি অবলম্বনে হলেও গাইনের গীতের স্রোতা কিন্তু হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন।
গাইনের গীত দাঁড়িয়ে পরিবেশন করা হয়। পরিবেশনকালে গাইন গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করেন। তাঁদের নাচের অঙ্গভঙ্গি মাঝে মাঝে হাস্যরসাত্মক হয়ে ওঠে। যেমন—যখন কোনো নারীর বর্ণনা করেন তখন নারীর অঙ্গভঙ্গি দেখান। আবার যখন কোনো পুরুষের বর্ণনা করেন তখন নাচের অঙ্গভঙ্গিতে পুরুষের আচরণ প্রকাশ করেন। গাইনের দলে থাকেন দুই-তিন জন সহশিল্পী। এঁদের একজনকে বলা হয় ‘পাইল’। তিনি গান চলাকালে গাইনের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করে কথাবার্তা বলেন, আবার মাঝে মাঝে গানও করেন। আর দলের বাদবাকিদের বলা হয় ‘বাইন’। বাইনরা ঢোল, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, একতারা, দোতরা, বেহালা প্রভৃতি বাদ্যবাজনা বাজান। সাম্প্রতিক কালে গাইনের গীতে হারমোনিয়াম বাজাতেও দেখা যায়। বাইনরা বাদ্য বাজানোর পশাপাশি গানের দিশা গেয়ে থাকেন (দোহার ধরেন)। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা মেনে গাইনের গীত পরিবেশন করা হয়। গানের শুরুতে বাইনরা বাদ্য-বাজনা সহযোগে কনসার্ট বাজান। এরপর গাইন প্রথমে বন্দনা গেয়ে গান শুরু করেন। বন্দনায় সাধারণত আল্লাহ রসুল বা গাজী জিন্দাপীরের প্রশস্তি তুলে ধরা হয়। উদাহরণস্বরূপ : ‘আল্লা আল্লা বল ভাইগো নবী কর সার/ নবীর কলেমা পড় হইয়া যাইবে পাড় / আল্লা আল্লা বল ভাইগো যত মমিনগণ/ গাজী জিন্দা পীরের কথা শুন দিয়া মন / সুন্দরবন মোকামে বন্দি গাজী জিন্দাপীর/ সোয়া লক্ষ নবী বন্দি আশি হাজার পীর ’
বন্দনার পর গাইন আসরে উপস্থিত শ্রোতাদের সঙ্গে আদাব, সালাম বিনিময়সহ নিজের ও ওস্তাদের পরিচয়-ফিরিস্তি তুলে ধরেন। যেমন—‘সভা কইরা বইছুইন যত হিন্দু মুসলমান/ সকলের চরণে আমার আদাব-সেলাম / রসিক গাইন নামটি আমার চানপুরে বাড়ি/ ওস্তাদ আমার কমর উদ্দিন তাকে মান্য করি / আমি অতি মুর্খমতি বিদ্যা-বুদ্ধি নাই/ গান গাইয়া তুষ্ট করার সাধ্য আমার নাই ’
এরপর গাইন মূল গানে প্রবেশ করেন। গানে ও কথায় খণ্ড খণ্ডভাবে গাজী-কালু-চম্পাবতী কাহিনির বর্ণনা দিতে শুরু করেন। যেমন—‘ওরে গাজী কালু একো সাথে/ চলিতেন কাননপথে/ পাক নাম জপতে জপতে/ যেখানে গিয়ে রাত্র হয়/ তথায় গিয়া দুই ভাই রয়/ সকালবেলা করে আগমন/ হায় হায়রে এইভাবে চলিয়া যায়/ সামনেতে গিয়া পায়/ বন একটা অতি ভয়ঙ্কর/ কাষ্ঠকাঠে গিয়া যথা/ দুনো পীর গিয়া তথা/ কহে কথা মিষ্ট মিষ্ট সুরে/ আমরা অতিথ ভাই/ থাকিবার জাগা চাই/ যদি কৃপা করে নিরাঞ্জনে/ এই কথা শুনিয়া তারা/ জোর হাতে হইলেন খাড়া/ চলেন প্রভু আমাদের বাড়িতে/ গিয়া তারা তাড়াতাড়ি/ একও ঘর খালি করি/ তার ভিতরে শয্যা দেয় বিছাইয়া/ দিল আইন্যা জলকানি/ দুনো পীরের পদখানি/ দয়া হইল শয্যার উপরে।’
গাইনের গীত বেশিরভাগ সময় গ্রামের বাড়িতে গাওয়া হয়। আর এ কারণে বেশিরভাগ শ্রোতাই থাকে নারী। এজন্য নারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনেক গান পরিবেশন করেন তাঁরা। রতিশাস্ত্র অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের নারী-পুরুষদের বর্ণনা করেন গাইনরা। পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী ও হস্তিনী নারীর বিভিন্ন আচরণ তুলে ধরেন গানের ভাষায়। তেমনি বর্ণনা করেন চার প্রকারের পুরুষদের কথাও, যেমন—মৃগয়া, শশক, বৃষ ও অশ্ব। কোন ধরনের নারীর সঙ্গে কোন ধরনের পুরুষের সম্পর্ক হলে ভবিষ্যত্ ভালো হয় তারও বর্ণনা দেয়া হয় গাইনের গীতে। গানের মাধ্যমে গাইনরা জগত্ সংসারে নারীদের ইতিবাচক ভূমিকার কথা যেমন তুলে ধরেন, তেমনি তুলে ধরেন তাদের নেতিবাচক দিকগুলোকেও। গ্রামীণ নারীরা চুপ করে বসে মুগ্ধ হয়ে গাইনদের গান শোনেন এবং তা থেকে জ্ঞান আহরণ করেন। ‘লক্ষ্মীর বন্দনা’ বিষয়ক গীতে গাইনরা প্রায় পরিবেশন করেন এ ধরনের গান : ‘আক্কলে ছাগল বন্দী জলে বন্দী মাছ/ নারীর কাছে পুরুষ বন্দী ঘোরায় বারমাস / নারী অইছে ধরার লক্ষ্মী এরার কামাই খাই/ নারী জাতি বিনে আমার পুষ্যের গতি নাই / অমলা মজা কমলা মজা ঘৃত মজা লুনে/ অল্প বয়নে পিরিত মজা পান মজা হয় চুনে / পান খাইতে সুপারি লাগে আরও লাগে চুন/ ঘুষিয়া ঘুষিয়া জ্বলে পিরিতের আগুন / শুন বাবা রঙ্গের কথা তোমরারে জানাই/ দুই চাইরডা নারীর কথা কইয়া যাওন চাই / এক জাতের নারীর আছে আঞ্জা ভরা চুল/ ভাত কাপড়ে কম হইলে গলাত বান্ধে ঢোল / আরেক জাতের নারীর আছে পায়ের গোছা মোডা/ এই নারীরে করলে বিয়া বংশে থাকে খোডা / আরেক জাতের নারী আছে হাতের গোছা মোডা/ এই নারীডা মরিচ বাটলে ভাইঙ্গা যায় গা পাডা / উচ কপালী চিরল দাঁতি পিঙ্গল মাথার কেশ/ এই নারীরে বিয়া করলে ঘুরে বাংলাদেশ / উগারে উইঠ্যা নারী যদি করে রাও/ লক্ষ্মীর বুকেতে দিলে আশি ছেলের যাও / দুপুরিয়া কালে নারী জুইড়্যা দেয় গা বাড়া/ লক্ষ্মী মায়ে উইঠা বলে ছাড়ছি তরার পাড়া / সন্ধ্যাকালে যে বা নারী বাতি দেয় না ঘরে/ লক্ষ্মী মায়ে উইঠ্যা বলে ছাইড়া গেলাম তরে / উঠান ফুইরা যে বা নারী বাও আতে লয় ঝাডা/ এই গিরস্থের গোয়ইল গরুর চউক্ষে পড়ে ঝাডা / ঘুমের শিশু কোলে লইয়া যে বা নারী খায়/ দিনে দিনে এই শিশুডা হাল্কা অইয়া যায় / এই পর্যন্ত বইলা আমি ইতি দিয়া যাই/ সবার চরণে আমি সালামও জানাই ’
শুরুতেই বলা হয়েছে, এখন আর আগের মতো গাইনের গীত দেখা যায় না। লোকসঙ্গীতের এই ধারাটি অত্যন্ত ক্ষয়িষ্ণুভাবে টিকে আছে। কমে গেছে গাইনদের সংখ্যাও। কিছুকাল আগেও আব্দুল হেলিম বয়াতী, আব্দুল হেকিম বয়াতী, জসীম গাইন, বাবুল মিয়া, আব্দুল জব্বার, সাইফুল ইসলাম, মজনু গাইন, মিলন গাইন, ফেরদৌসসহ অনেকে গাইনের গীত গেয়ে নেত্রকোনার গ্রাম-জনপদ মাতিয়ে রাখতেন। এখন খুব কমই গাইনের গীত অনুষ্ঠিত হয়। আগের মতো মহিলারা গাজীর গীতের মানতও করেন না। এসব কারণে গান গেয়ে গাইনদের আর পোষায়না। সর্বোপরি সংসার চলে না। তবুও হাতে গোনা কয়েকজন বয়াতী এখনো গাইনের গীতের ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছেন। লোকসংস্কৃতি উত্সব বা মেলার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে এখনো তাঁরা গাইনের গীত গেয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে থাকেন।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. ময়মনসিংহের লোকগীতি ও লোকসঙ্গীত (প্রবন্ধ)— মোহাম্মদ আজিজুল হক চৌধুরী, ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সম্পাদক : শাকির উদ্দিন আহমদ, প্রকাশক : জেলা বোর্ড, ময়মনসিংহ, ১৯৭৮।
২. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : নেত্রকোনা, প্রধান সম্পাদক : শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০১৩।
৩. নেত্রকোণার লোকগীতি পরিচয়— গোলাম এরশাদুর রহমান, প্রকাশক : হাসিনা রৌণক ১৯৯৮।
৪. বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি— মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার, প্রকাশক : আহমেদ কাওসার, বইপত্র, ২০০৪।
৫. হাওর জনপদের গীতরঙ্গ : অন্তরঙ্গ আলোয়— কামাল উদ্দিন কবির, আইইডি, ঢাকা ২০০৭
৬. বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোক সংস্কৃতি সন্ধান— ফরিদ আহমদ দুলাল, আবিষ্কার, ২০১৩।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>