Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

রিগর মরটিস

Reading Time: 5 minutes

 

ধীমান ফোন করে এইমাত্র খবরটা জানাল। ওর বাবা মারা গেছে। থ্রোট ক্যান্সার। রেডিও কেমো সময় সময়েই নেওয়া হয়েছিল। সাগ্নিক এসবই জানত। তাই কাকুর মৃত্যুর খবরে মোটেই বেসামাল হল না আর এই বেসামাল না হওয়ার কারণটাও খুবই সহজ। মানুষের মৃত্যুর খবর কানে এলে প্রথম যে প্রতিক্রিয়াটা হয় তা মূলত স্বচ্ছ। ভোরের শিশিরের মতোই খাঁটি আবার একই সঙ্গে এলোমেলো অথচ পরিচ্ছন্ন কতগুলি দমকা ভাবের মিশেল—এক ধাক্কায় বুঝিয়ে দেয় সেই মৃত মানুষটির উপর আমাদের টান কতটুকু। এই ভাবের আবেশে সাগ্নিকও কিছুক্ষন থমকে থাকল।তার বেশি কিছু নয়।

কাকুর বডি এখনও হসপিটালে। বিল মেটানো এবং অন্যান্য ফর্মালিটিস চলছে যেমন চলে।কয়েকজন বন্ধু অফিস ফেরত সোজা পৌঁছে গেছে হসপিটালে। দু’একজন পুরো অফিস না করেই। তারা সবাই এখন ধীমানের পাশে। বন্ধুদের পাশে থাকার একটা প্রক্রিয়া ক্রমশ গড়ে উঠছে। আবছা ছবির মতো সবকিছুই এমনি এমনিই টের পেল সাগ্নিক। চোখের পলক না ফেলে কঠিন মুখে ভাবল অফিস থেকে কীভাবে দুম করে বেরিয়ে যাকে বলে একেবারে ঝড়ের মতো হসপিটালে পৌঁছে যাওয়া যায়। কোনও কথা না বলে চুপিসারে এক কোণায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে ধীমানকে কীভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, আমরা সবাই তোর পাশে আছি। সাগ্নিকের কলিগ অফিসের বাইরে গিয়েছিলো ঝালমুড়ি খেতে। ফিরে এসে বলল , কিরে আর কত কাজ করবি। কাজ করে তো একেবারে ফাটিয়ে দিচ্ছিস। কলিগের কথায় পেঁয়াজের গন্ধ।

এবার বসের ডাক। সাগ্নিক একবার এদিকে আয় তো। সাগ্নিক পৌঁছে গেল বসের ডেস্কে। এই ডকুমেন্টটা একটু প্রেপেয়ার করে দে । কাল যেরকম বলেছিলাম। রাতের ক্লায়েন্ট কলটা অ্যাটেন্ড করিস কিন্তু। আমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।ওকে?

সিদ্ধার্থদা, তোমার কাকা জ্যাঠা পিসো ক্যান্সারে মারা গেছে কখনও? ধরা যাক এমন একটা সময় যখন তুমি অফিসে একটা ডকুমেন্ট তৈরী করার কথা ভাবছ। ডকুমেন্টটা খুললে , সবে টাইপ করতে যাবে আর অমনি তোমার কাকা একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে মারা গেলো। মুখটা হাঁ। চোখ দুটো খোলা। ঠিক তারপর তোমার ওই ডকুমেন্ট অ্যালফাবেটে যত সেজে উঠছে ততই তোমার কাকা জ্যাঠা পিসোর শরীর আস্তে আস্তে ঠান্ডা কাঠের মত হয়ে যাচ্ছে।রিগর মর্টিস।
—কী হলো? কী ভাবছিস? সাগ্নিক? এই সাগ্নিক?
—হ্যা, না। কী বলছো?
—কী হলো তোর? কী ভাবছিস? এনিথিং রঙ?
—না না, কিছু না। আমি ডকুমেন্ট আর ক্লায়েন্ট কল ম্যানেজ করে নেব। তুমি যাও।

সাগ্নিকের কিউবিকলে ওর হ্যাপি ফ্যামিলির একটা ছবি বাঁধানো। উঠতে বসতে চোখে পড়ে। দিনে রাতে অফিসের প্রচণ্ড কাজের চাপে বৌ মেয়ের সমুদ্রতীরে রোদমাখা হাসিমুখ মনে শান্তি আনে। আজও চোখে পড়ল। হসপিটালে ধীমান এখন কী করছে? কী ভাবছে? ও তো কাকুকে ভীষণ ভালবাসত। সব ছেলেরাই বাবাকে ভালবাসে কিন্তু ধীমানের ব্যাপারটা…। আমি আসব একথা নিশ্চয়ই আশা করেছে। আমার তো যাওয়া উচিত। হ্যাঁ, ঠিকই তো। যাওয়া উচিৎ। কাকু বলতেন, সাগ্নিক রাতে আমাদের সাথে খেয়ে নিও। অনেকদিন তোমার গল্প শোনা হয়নি। কাকুর গলা শুনে কী যে ভালো লাগতো! রোজ ওই মনোজ কেবিনের একঘেয়ে খাবার! উফফ। আশা করতাম কাকু ডাকবেন, একসঙ্গে রাতে খাওয়ার কথা বলবেন। আর কী আশ্চর্য! কাকু কীভাবে যে ঠিক বুঝে ফেলতেন। রাতে ডিম তরকা আর রুটির খরচ বেঁচে যাওয়া মানে তো পরের দিন হিসেবের বাইরের আমার পকেটে ফিল্টার উইলস।
না কাকু। আবার শুধু শুধু আমার জন্যে…। আমি মনোজ কেবিনে খেয়ে নেব।
কেন? মাসে মাসে ভাড়া নি বলে কি একসঙ্গে দুটো খেতে নেই? তুমিও আমার কাছে বুবাইয়ের মত। এসো এসো তাড়াতাড়ি খাবে এসো। খুব খিদে পেয়েছে।
সাড়ে আটটা। যদি দশটায় বেরোতে পারি তাহলেও হসপিটালে যাওয়া যেতে পারে। অতক্ষণ কি থাকবে ওরা? একটা ফোন করেনি।কিন্তু ধীমানকে ফোন করা কি ঠিক হবে? ওর এখন যা মানসিক অবস্থা!তাও, ফোন তো একটা করা উচিৎ।
— হ্যালো ধীমান ?
— সাগ্নিক? বল।
— এখন মানে। … তোরা কি সবাই হসপিটালেই আছিস?
— হ্যা। বিল নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। বাবাকে… ছাড়তে চাইছে না। তুই কি অফিসে?
— আর বলিস না। অফিসে এই ফালতু কাজের চাপ। কিছুতেই বেরোতে পারছি না।
— না না ঠিক আছে। পরে আসিস না হয়। রাখছি বুঝলি। আমাকে আবার একটু …
— ঠিকাছে। ঠিকাছে। পরে নয় কথা বলব।
ডকুমেন্ট সুন্দর সেজে উঠছে। ক্লায়েন্ট কলও শুরু হয়েছে সঠিক সময়ে। অফিস মোটামুটি ফাঁকা। এই সময়ে বাড়িতে থাকলে পাড়ার কুকুরের ঝগড়ার শব্দ পাওয়া যায়। পাশের ফ্ল্যাটের পূর্ণেন্দু মুখারজি মদ খেয়ে বৌকে পিটিয়ে ইংরেজিতে খিস্তি করে। অফিসে থাকলে এসব কিছুই বোঝা যায় না। এসির হাওয়ায় আর নিউ জার্সির স্টিভ উইলিয়ামসের চমৎকার কথায় ঝগড়া ফগড়া খিস্তি মিস্তি কোথায় যে হারিয়ে যায়!
সাগ্নিকের কলিগ কমলালেবু খাচ্ছে। ওর কদিন আগে পেটে কীসব ধরা পড়েছে। তার পর থেকেই আপেল কমলা গুণে গুণে।
নটা সতেরো। বিপ্লবের ফোন।
— হ্যা বিপ্লব। বল।
— কিরে তুই আসবি না?
— আমি অফিসে ফেঁসে গেছি রে।
— এলে ভালো হতো। শোন, আমরা এই বেরোব। ধীমানের বাড়ি হয়ে কালীতলা মহাশ্মশান। তুই ওখানে ডিরেক্ট চলে আয় না।
— দেখছি। কিন্তু নট সিওর।
— কী আবার দেখবি? তোদের ওই অফিসে রোজ সবাই কাজে ফেঁসে যায়। নতুন কিছু না। একমাস হলো কাকু হসপিটালে ভর্তি। একদিনও শালা এলি না। কাকু তোর কথা কালও জিজ্ঞেস করছিলেন।মাইরি আমিও যে কীসব—ছাড়। মাইন্ড করিস না। মন টন একদম ভালো নেই। জালি একখানা হসপিটাল। কাকুকে শালারা মেরে ফেলল জানিস।এখন বিল নিয়ে ঝামেলা করছে। মটকা গরম হয়ে আছে। তুই দ্যাখ ম্যানেজ করতে পারিস কিনা। দু মাস আগেই তো ম্যানেজার হয়েছিস। বারবিকিউ চিলিসে পার্টি দিলি। হেবি খাইয়েছিলিস। এখনও শালা ঢেঁকুর ওঠে। চল রাখছি। আসার ইচ্ছে হলে ফোন করিস। শ্মশানের ডিরেকশনটা দিয়ে দেব।
— তোরা কে কে আছিস ওখানে?
— সবাই। তুই বাদে। রাখলাম।

ক্লায়েন্টের সঙ্গে সাগ্নিকের কল একটু আগেই শুরু হয়েছে।জনা দুয়েক আমেরিকান, তিনজন সাউথ ইন্দিয়ান এবং কলকাতা থেকে সাগ্নিক একাই। শুনতে জমপেশ লাগলেও আখেরে সেই ভুঁড়িওয়ালা ব্যবসায়ীর লাভ লোকসানের সস্তা কথা।টানা চল্লিশ মিনিট এইসব সস্তা কথার দাপটে সাগ্নিকের মাথার ডানদিকটা বেশ টনটন করছে।

অঙ্কিতাকে নিয়ে কাকুর কাছে আর যাওয়া হল না। কাকু কতবার বলেছিলেন, সাগ্নিক বউমাকে নিয়ে একবার এসো। চাকরি পাওয়ার পর আমাদের কি ভুলে গেলে নাকি?
যাওয়া আর হল কই।
বসের আবদার করা ডকুমেন্টের কাজ শেষ হল সাড়ে দশটায়। পারকিং স্পেস খাঁ খাঁ। একটা পলিথিন ব্যাগ হওয়ায় উড়ছে। সাগ্নিকের গাড়িটা যেন শাস্তি পাওয়া সেই দুষ্টু ছেলেটা। কাল সার্ভিসিং ছিল। এখন আবার ফিট। ঘ্যাসঘ্যাসে আওয়াজটাও নেই। ব্রেক ক্লাচ সবই নতুনের মতো সাড়া দিচ্ছে।
মোবাইলটা পাশের সিটে ছুঁড়ে ফেলতেই সিটের গদিতে হাল্কা লাফিয়ে সেটা এখন চুপচাপ। বড় রাস্তায় নামতেই জেগে উঠল। মোবাইল স্ক্রিনে অঙ্কিতা।
— হ্যাঁ বল।
— বেরিয়েছ?
— হুমম।
— ফেরার সময় একটু সেরেল্যাক নিয়ে এসো না। শেষ হয়ে গেছে। একদম খেয়াল করি নি।
— এতো রাতে?
— প্লিজ। পাঁচ মিনিট তো লাগবে। এখনও খোলা পাবে। যেখান থেকে কিনি।
নিজের ছানার জন্য সেরেল্যাক কেনা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ যা না করলে অঙ্কিতা— একটা ফুটফুটে শিশুর মা সঙ্গত কারণেই সাগ্নিকের ওপর রাগ করতে পারে। একটা দায়িত্বহীন কাজ পাগল মানুষের তকমা লাগার সম্ভাবনাও খানিক রয়েছে বৈকি। তাছাড়া কর্পোরেট লাইফের এই চোদ্দ বছরের অভ্যাসে গড়ে ওঠা একটা ম্যাড়ম্যাড়ে নির্বোধ জীবনের ওজন আজ এই মুহূর্তে সাগ্নিকের ঘাড়ের ওপর হঠাৎ কেমন জাঁকিয়ে বসল। মনের হাত পা গুটিয়ে সাগ্নিক বসে থাকল ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধির মতো। যা ঘটছে ঘটুক। একজন সচেতন চালাক মানুষ পরিস্থিতিকে ঠেকাতে মনের ভেতর সরু মোটা নানান ভাবনাগুলোর ভেতর থেকে ছিপ ফেলে সঠিক ভাবনাটাকে কব্জা করে মনের ভেতর ছড়িয়ে দেয়। পরিস্থিতির সামাল দেয়। গাড়ি চালাতে চালাতে এফএমে গান শুনতে শুনতে কী অদ্ভুত পারদর্শিতায় সাগ্নিক আসলে ঠিক সেই কাজটাই করল। বুঝতে পারল যে এই প্রায় গভীর রাতে সেরেল্যাকের প্যাকেট কিনে সবে সার্ভিসিং হওয়া জাপানি গাড়িটা নিয়ে হুট করে কালীতলা মহাশ্মশানে ঢুকে পড়াটা আসলে একটা এলিয়েন ব্যাপার হবে।
ঠিক এই মুহূর্তে সাগ্নিক ধীমানকে ফোন করল।
— হ্যালো।
—বল বিপ্লব বলছি।
—ধীমান কোথায়?
— আছে তবে কথা বলার অবস্থায় নেই। বাবাকে ঘি মাখিয়ে বসে আছে। আরও অনেকের কাকা দাদু জ্যাঠারা চুল্লীতে পুড়ছে কিনা। লাইন আছে ভাই লাইন। সত্যি মাইরি শ্মশানে না এলে বোঝাই যায় না রোজ এত লোক মরে।

তাছাড়া—
— শোন আমি আসতে পারব না। ভীষণ টায়ার্ড। আমি কাল পরশু গিয়ে ধীমানের সাথে দেখা করে আসব। ওকে সময় বুঝে বলিস সেকথা।
— শর্ট কাটে কত্তব্ব সারবি?
— কী ব্যাপারটা কী বলতো? তখন থেকে আজেবাজে কথা বলছিস। এত রাগ কীসের তোর আমার ওপর? কী হয়েছেটা কী? হসপিটালে আসতে পারি নি বলে? শ্মশানে এখন নেই বলে? কী? ঝেড়ে কাশ তো এবার।
— বাব্বা। হঠাৎ গলায় এত কনফিডেন্স। এতক্ষণ তো মিন মিন করছিলিস। না আসার কোনও ব্রিলিয়ান্ট এক্সকিউস ছঁকেছিস মনে হচ্ছে?
বিপ্লবের এই প্রশ্নের উত্তরে ‘ইডিয়েট’ বলেই ফোনটা কেটে দিল সাগ্নিক।
বাড়িতে ফিরেই প্রথম যে কাজটা সে করল তা হল সেরেল্যাকের প্যাকেটটা ডাইনিং টেবিলে রেখেই ঘুমকাদা মেয়েকে কোলে তুলে নেওয়া। কোলে তুলে খামোখা খুব করে চুমু খেল দু গালেই। তারপর মন ভরলে শুইয়ে দিল বিছানায়। ফুটফুটে শিশুটি সামান্য কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে আবার ঘুমে কাদা। এমনই তার ঘুমোবার কায়দা যেন এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে চলেছে তা সবই ঠিকঠাক।

—খিদে পেয়েছে। যাও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।
মাইক্রো ওভেনের ভেতর আলো জ্বলে উঠল। দুপেট ফ্রায়েড রাইস ভরা থালাটা ঘুরতে থাকল। পৃথিবী যেদিকে ঘুরছে সেই দিকেই।
সাগ্নিক সোফায় গা এলিয়ে টিভিটা চালাল। টিভিটা মিউট।
—কী হল? খিদে পেয়েছে বাবিন। অনেক রাত হয়েছে। রিমোট নিয়ে ঢং করো না। খাবে এসো।
সাগ্নিক নড়ল না। চোখ টিভির দিকে। টিভিতে রাজনীতি।
—খাবার কিন্তু ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমি আবার গরম করতে পারব না। বারোটা বাজে। আর ভাল্লাগছেনা। আমি শুরু করলাম।
সাগ্নিক চুপচাপ। টিভিটা এখনও মিউট। টিভির পেছনে দেওয়াল। সাগ্নিকের চোখ এখন সেই দেওয়ালে। দেওয়ালে গোলাপি রঙ। এক ধরনের আর্টিস্টিক টেক্সচার ওই রঙে। টেক্সচারে ঝাপসা কাকুর বডি। চুল্লীর আঁচে পুড়ছে।
সাগ্নিক খাবে এসো।
কে? চেনা পরিচিত কাকু! না। তার চেয়ে আরও অনেক অনেক বেশি কাছের। অনেকটা বাবার মতন। বাবারা যেমন হয়। সাগ্নিকের কিন্তু তেমন কষ্ট হচ্ছে না। বিশ্বাস করুন। সত্যিই হচ্ছে না অথচ তার সারা শরীর কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। হাত পা গুলো ভীষণ ভারী। কাঠের মত শক্ত। কেন কে জানে!

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>