| 9 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
সময়ের ডায়েরি

স্মরণ: বহুরৈখিক শান্তনু বিশ্বাসের সৃজনবলয়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

সেলিনা শেলী

সৃজনশীল মানুষ বহুতর সফরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বকনিষ্ঠ কণ্ঠযোদ্ধা শান্তনু বিশ্বাস কীভাবে নিরীক্ষাধর্মী সঙ্গীত সাধনায় বাংলার গানের একটি স্বাদু রুচিবোধ নির্মাণ করেছেন সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে বহুরৈখিক শান্তনু বিশ্বাসের সৃজনবলয়ের সামান্য আঁতুরকথন প্রয়োজন।
শান্তনু বিশ্বাস (জ. ১৯৫৪ সাল) মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাটক লেখা, অভিনয় ও নির্দেশনা শুরু করেন- সে সময়টায় বাংলা মৌলিক নাটকের আকাল চলছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নাটকই সবচেয়ে জনলগ্ন- মাটিলগ্ন- দায়বদ্ধ শক্তিশালী শিল্প হিসেবে বিকশিত হতে থাকে। ১৯৭৬ এর দিকে চট্টগ্রামে সান্তনু আরও ক’জন নাট্যকর্মী সহ অঙ্গন থিয়েটার গড়ে তোলেন। ‘কালো গোলাপের দেশ’ তাঁর লেখা প্রথম নাটক, ‘দপ্তরে রাজ দপ্তরী’। এ দুটো অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট নিয়মিত প্রদর্শন করেছে। এর আগেই তিনি ‘অঙ্গন’ এবং ‘গণায়ন’-এ অভিনয় করে সারা দেশে একজন শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। এর পর তিনি কেবল নাটকই লিখলেন না, নির্দেশনা আবহও তৈরি করলেন তৃতীয় নাটক- ‘নবজন্ম’-তে। বহু অভিনীত এ নাটক। দর্শকের স্মৃতিতে আমৃত্যু অমলিন থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা নাটক ‘ইনফরমার’ যা রচনা, নির্দেশনা এবং অভিনয়ের সকল কৃতিত্বে তিনি সারা দেশে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পান। এর পরের নাটক ‘ভবঘুরে’ মিউসিকাল আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে- এটি কলকাতার শূদ্রক নাট্য পত্রে প্রকাশিত হয় এবং পরে থিয়েটার আরামবাগ ও অরিন্দম নাট্যসমপ্রদায় মঞ্চস্থ করেন। বিপুল দর্শকনন্দিত নাটক এটিও। নির্ভার (২০১৩) নাটকটি থিয়েটার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং সে বছরই বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও শান্তনু বিশ্বাস বিশ্ব নাট্যের বহু নাটক অনুবাদ করেছেন, রূপান্তরও করেছেন, কিশোর নাট্য রচনা করেছেন। নাটক করতে এসে মৌলিক বাংলা নাটকের অভাব তাঁকে মর্মাহত করে। সে সময় অনুবাদ নাটকের মঞ্চায়নের বদলে নতুন বাংলা নাটক লিখে সময়েরস্বরে কথা বলতে চেয়েছেন শান্তনু। আত্ম পরিচয় খোঁজার অদম্য আগ্রহেই এই নাটকগুলোর জন্ম হয়েছে। দেশ জুরে চলছিল এই সৃষ্টিশীলতা। বাংলাদেশের ঘটে যাওয়া ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত শান্তনুর নাটকে তাই প্রতিফলিত হয়েছে সময়ের সংকট ও উত্তরণের তীব্র দাহ, কল্যাণমুখী ইতিবাচকতা, ছিলো সেই লক্ষ্যের কমিটমেন্ট। পাশাপাশি তিনি নাট্য পত্র সম্পাদনার কাজেও নিয়োজিত থাকেন। একটি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও কতটা শিল্পঅন্তপ্রাণ হলে এমন কঠিন ভূমিতে কঠিন সময়ে তিনি নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলেন আজ তা ভাবতে হবে।
এবারে শান্তনু বিশ্বাসের গানের কথায় আসা যাক। কে না জানে মানবজীবন সুর প্রধান। তার আনন্দ বেদনায় নিজের অজান্তেই খেলা করে সুর। সেই সুর তাল লয় আদি অন্তে বাঁধা- দূরগামী নক্ষত্র হতে মর্ত্যের মৃত্তিকালগ্ন। কেননা তা প্রকৃতির স্বরেই বেজে ওঠে। কবিতায় যাকে আমরা ছন্দ বলি গানে তাকেই বলি লয়। আমাদের পঞ্চকবি- রবিন্দ্র, নজরুল, দিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুল প্রাসাদ থেকে শুরু করে বহু কবির গানের বই নিয়মিত বের হয়েছে। স্বাধীনতার পর কবি মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল-এ খোদাসহ অনেকেরই গানের বই বেরিয়েছে। বিগত পাঁচ এবং ছয়ের দশকটিও ছিল বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ। কথা ও সুর সে সময় পাল্লা দিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছে। সুরকারদের মধ্যে ছিলেন সলিল চৌধুরী, সুধীন্দ্র দাশ গুপ্ত, শ্যামল গুপ্ত, সতী নাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র প্রমুখ।
ইদানিং কবিরা গান থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। গান শুধু শোনার বিষয় নয়- পাঠেরও, এটা আজ আর তেমন উপলব্ধিতে আসে না। বরং মনে হয়, ইদানিংকার গান যেন দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ দিন পরে কবি মনিরুল মনিরের খড়িমাটি থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে প্রকাশিত হলো শান্তনু বিশ্বাসের গানের বই- ‘গানের কবিতা- খোলাপিঠ’। নান্দনিক একটি প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।
একজন মানুষ জন্ম থেকেই অনেকগুলো সফরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায়। খোলাপিঠের শুরুতে শান্তনুর অসাধারণ গদ্যবিভার একটি প্রবন্ধ বা মুখবন্ধ অথবা আতুরকথন সংযোজিত হয়েছে যা গ্রন্থটির সমকাল ও আগামীর পাঠকের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কেননা পুরো প্রবন্ধটি জুড়ে প্রাচ্য পাশ্চাত্য সঙ্গীতের নানান দিক, একটি জীবন ব্যাপে শুদ্ধ সঙ্গীতের সাধনা কীভাবে লোকগান, ধ্রুপদী, প্রাচ্য পাশ্চাত্য মিউসিকের রকমারি একটা মানুষের জীবনানুভূতি পালটে দিয়েছে- কীভাবে সেটা তার অসংখ্য চোখজোড়া খুলে দিয়েছে, তার দিব্যকর্ণ তৈরি করেছে, তাঁকে দেশলগ্ন মুক্তিযুদ্ধ মগ্ন সমাজের অগ্রচিন্তক করে একটি সুরুচির পরিমণ্ডল তৈরি করেছে- তা জানবেন পাঠক। এখানে শান্তনুকেই উদ্ধৃত করি- “গান আমার ভাবনার, চেতনা প্রবাহের প্রতিচ্ছবি। আমার ভেতর বাহিরকে অর্থাৎ আমাকে চেনার ছোট্ট একটা জানালা খুলে দেয় আমার গান। নির্মাণ ও সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় আমার গানের হয়ে ওঠা। সুর ও ধ্বনির বা ছন্দের কি সীমারেখা আছে? সীমাহীন বলে আমাদের গান ওদের আর ওদেরটা খুব সহজে হয়ে ওঠে আমাদের। তাই দেশিও উপকরণের সঙ্গে মেশে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সুর ও ছন্দ, তাদের প্রকাশভিন্নতাও মিশে অভিন্ন মোকাম তৈরি করে। বাংলা গানে এই প্রচেষ্টা বহু দিনের, কবিতাকে গানের কাছাকাছি আর গানকে কবিতার। এক কথায় গানকে কবিতাময় আর কবিতাকে গানময় করে তোলা। উদ্ভাবনের স্বকীয়তায় গানগুলো একটা পরিচয়চিহ্ন খুঁজে পেলেও পেতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, রবিন্দ্রনাথের গান তাঁর জন্মশতবর্ষে, সেই ১৯৬১ সালে মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার ফলে ব্যাপক জনপ্রিয়তয়া পায়। তাঁকে সাধারণ্যে পৌঁছুতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।” শান্তনু আরও বলেন, “গান নির্মাণ করে যদি একটা স্বতন্ত্র পরিচয়চিহ্ন রাখা না যায় তাহলে অকারণ কাজটি করে কী হবে?”
“ছোটবেলা থেকে ঘটেছিল নানা ধরণের গান শোনার সুযোগ। আমার প্যাশন এমনই তীব্র ছিল যে শুধু গান নয়, কে লিখেছেন, সুর দিয়েছেন কে, গানের অর্কেস্ট্রেশন সবটাতেই আগ্রহ ছিল প্রবল। অর্থাৎ পুরো গানটির নির্মাণ ও প্রয়োগ ভাবনা আমায় ভাবাত।”
তাঁর পারিবারিক গানের আবহ, ওস্তাদ, বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষক ব্রাদার হ্যামেল, যিনি তাঁর গান শোনার কান ও ওভ্যেস তৈরি করে দিয়েছিলেন- তাঁর কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন। অসংখ্য পাশ্চাত্য লোকসঙ্গীত ও ধ্রুপদী সঙ্গীত তিনি হ্যামেলের প্লেয়িং রেকর্ডে শুনেছেন। সেজন্যেই তাঁর গান ‘বাজনা গান’ নয়। অপ্রয়োজনের কোনও বাদ্য বেজে সেখানে বাণীকে আকীর্ণ করে তোলে না। শ্রোতাকে চিন্তার খোরাক যোগায় ও নবায়ন করে তোলে। ফলে তাঁর গানগুলো কোনও একটি বিশেষ পরিস্থিতির খণ্ডচিত্র হয়েও ছড়িয়ে পড়ে বহু অখণ্ডে। দম আটকানো গুমোট মেঘ কেটে গিয়ে সময়ের উত্তাপ শুভবোধে প্রশমিত হয়। তাঁর কথায় বিষয়টি আরও ভালো করে বোঝা যাবে- “যে গান জীবনযাপনের গায়ে গায়ে লেগে থাকে, যে গান প্রাত্যহিকতাকে আমাদের দৈনন্দিনতাকে ছুঁয়ে প্রকাশমান, আর এর ভেতর গানের আধুনিকতাকে খোঁজার অবিরাম চেষ্টা, কথায়, সুরে ও গায়ন রীতিতে। বর্তমান সময়ে ‘বাজনাগান’ থেকে গানকে আলাদা করে গানের সঙ্গে যে টুকু বাদন সংগত, তাই দিয়ে গানকে খোলামেলা রাখার ইচ্ছেটুকু প্রবল।”
শান্তনু বিশ্বাস সঙ্গীতের সংগঠকও বটে। কেননা এ বিষয়ে তিনি গবেষণা করেন, প্রবন্ধও লেখেন। গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠকার শান্তনু রবিন্দ্রনাথের মতন নিজের লেখা নাটকের কোনও একটি সিকোয়েন্সকে সহজবোধ্য অথবা আরও কমিউনিকেটিভ করার জন্য নিজের গানের ব্যবহার করেছেন। তিনি শিল্পের দায়ে বিশ্বাসী। আর সেজন্যেই গানের বাণী, সুর আর গায়কীতে তাঁর গভীর মনোযোগ। আজকের শিল্পীদের মধ্যে তা বিরল বললেই চলে। গানের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙে নিত্য দিনের অতি সাধারণকে, খণ্ডচিত্র, বিষয় ও মেজাজকে যা আপাত আড়াল ও দূরান্বয়ী হলেও যার প্রভাব সমাজকে শুভমুখী করে তোলে তা-ই তিনি পথ থেকে কুড়িয়ে গানে বেঁধেছেন। কবীর সুমনের কাছেও ঋণ শিকার করতে তিনি ভুলে যাননি। ফলে তাঁর গান শ্রোতাকে এক অখণ্ড প্রণোদনায় পৌঁছে দেয়।
জীবনের ধর্ম প্রকাশ আর মৃত্যুর ধর্ম রহস্যাবৃত অপ্রকাশের মধ্যে। জীবনের অণ্বেষায় মানুষ যে কীর্তীর কোলাজ প্রতিষ্ঠিত করে, সেখানেই তাঁর অমরতার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত। জীবনের ধারা কত যে বিচিত্র আর কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে তারও কোনও সুরাহা নেই। সেজন্যে তাঁকে বলতে শুনি ‘জীবনমুখী গান’ বলে কোনও কথায় তিনি বিশ্বাস করেন না। কারণ তাহলে তো ‘মরণমুখী’ একটা কিছুও থাকতে হবে। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে রবিন্দ্রনাথ বলেন- “সংসারে ক্ষুদ্র কালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয়…… চিরকালটা থাকে আড়ালে; গানে চিরকালটাই আসে সামনে, ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে, তাতেই মন মুক্তি পায়।” সেই চিরকেলে গান নিয়ে শান্তনু বিশ্বাসের বোঝাপড়া। স্বাধীনতা উত্তরকালে তাঁর বেশ কটি মিশ্র এ্যালবাম বের হয়। ২০০৬ সালে এটিএন মিউজিক থেকে তাঁর কথা ও সুরে সুবীর নন্দী ও ইন্দ্রাণী সেনের দ্বৈত এ্যালবাম বের হয়। ২০০৭ সালে ইমেপ্রস অডিও ভিশন থেকে বের হয় ‘ঝিনুক ঝিনুক মন’- এটি অরুণিমা ও শান্তনু বিশ্বাসের যৌথ সংকলন। ২০০৮ সালে অগ্নিবীণার ব্যানারে বের হয় বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে যৌথ এ্যালবাম ‘বহমান’। ২০০৯ সালে বেরোয় তাঁর প্রথম একক এ্যালবাম ‘চিরকুট’। ২০১১ তে বেরোয় দ্বিতীয় একক এ্যালবাম ‘পোস্টম্যান’ এবং ২০১৪-র মার্চে বেরোয় ‘খড়কুটো’ ৩য় একক এ্যালবাম। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে পূর্বে উল্লিখিত নাট্যগ্রন্থগুলো। এ বছরই ‘গানের কবিতা খোলাপিঠ’র সঙ্গে নাট্যগ্রন্থ ‘নির্ভার’-ও প্রকাশিত হয়। লিখে চলেছেন আরও বেশ কটি একাঙ্কিকা ও গান। তাঁর খোলাপিঠের গানগুলো সময়ের দলিল অথবা কোনও দীর্ঘ প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত প্রমিত রূপ। প্রতিটি গানের নিচে তিনি টীকাভাষ্যে আতুরকথন বর্ণনা করেছেন। খুব ভালো হতো যদি গানগুলোর স্বরলিপিও সংযুক্ত থাকতো। যদিও ইউটিউবে তাঁর সবগুলো গান আলাদা আলাদা এ্যালবামে পাওয়া যায় এবং অতিসমপ্রতি সবগুলো এ্যালবামের সংকলনও প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। গানের কবিতা গ্রন্থে মোট ৩৮টি গান রয়েছে। শান্তনু বলেন- “ঐতিহ্যবাহী বাংলা গানের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে আমি চেয়েছি তাকে সমকালীন করে তুলতে। আমার দেখা ও অদেখা জীবন এবং আমার চার পাশের দুঃখ সুখে দোল দোলানো মানুষকে নিয়েই রচিত হয়েছে ‘পোস্টম্যান’ এ্যালবামের যত গান।” ‘খড়কুটো’ নিয়ে বলেন- “এ্যালবাম করার ক্ষেত্রে আমার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে আমি যেন নিজের পাশাপাশি শ্রোতাদের ফাঁকি না দিই। শ্রোতা হচ্ছেন পূজনীয়।” বাংলা গানকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় ২০১৪-এ প্রকাশিত ‘খড়কুটো’-র ‘প্রবঞ্চনা’ নামের গানটি খুব সাড়া ফেলেছিল। একটি ফরাসি চার্চ সঙ্গীতের অনুপ্রেরণায় রচিত হয়েছে এই গান। বিখ্যাত এই গানের মডেল হয়েছিলেন ইশরাত আখন্দ। মৃত্যুর বছর দুই আগে শখ করে জেড এঙ ওয়াই ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক এবং চিত্রশিল্পী ইশরাত সাদা কালো শাড়ি পরে এই গানের মডেল হন। ইশরাত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই গানের মিউজিক ভিডিওর চিত্রনাট্য লিখতে চেয়েছিলেন।
“আঘ্রাণে কোনও গানের টানে
যেও না আছে প্রবঞ্চনা” কে জানত হোলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ১ জুলাই তিনি এমনই এক প্রবঞ্চনার শিকার হবেন! শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রত্যয়দীপ্ত অসামপ্রদায়িক তরুণদের উৎসর্গ করা গীতিকবিতা ‘সব তোমাদের জন্য’ এবং ‘অগ্নিকোণের তল্লাটে’। কবি বলেন- ২০১৩, ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ, যুদ্ধ অপরাধীর ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে জড়ো হতে থাকে প্রতিবাদী মানুষ যার সিংহভাগ বয়সে তরুণ। ১৯৭১ এর পর আমার কাছে এই শাহবাগ আন্দোলন এক মহত্তর সুঘটন। আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনুরোধে এই গান নির্মিত। এবং নানা টিভি চ্যানেলে সেই সময় প্রচারিত হয়েছিল এই গান। তারপর ‘শাহবাগের গান’ নামে যে গানের সংকলন প্রকাশিত হয় সেখানে এই গানটি সংকলিত করা হয়।
“ঘুম ভেঙে দাঁড়িয়েছে সবাই
অগ্নিকোণের তল্লাটে
তোলপাড় দুরন্ত ঝড়ে
শাহবাগ মোড়ে
দিনরাত বিনিদ্র কাটে

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন আজ নয়
খামছে ধরেছে ওরা পতাকা
হও প্রতিবাদ প্রতিরোধে নির্ভয়
ঘুরে যাক সময়ের চাকা। …”
এরকম আরেকটি গান-
“এ দেশ অনন্য
সব তোমাদের জন্য।”
প্রতিদিন এ দেশে নারী নির্যাতিত হচ্ছে ধর্ষিত হচ্ছে। একটি মেয়ের জীবন তছনছ করে দিচ্ছে এই ভয়াবহতা। কবি নিজে পুরুষ বলে লজ্জায়, বেথায় কুঁকড়ে যান, কেননা তিনি তো তারই স্বজন অথবা বাবা। কী অসাধারণ এই গানটির বুনন।
“তার রোদ্দুর ধোয়া গালে
জমতে দেখেছি বিন্দু বিন্দু ঘাম
সন্ধ্যার প্রাক্কালে মেয়েটির কপালে
ঘটতে দেখেছি কুৎসিত পরিণাম
সে এ পাড়ার মেয়ে ও পাড়ার মেয়ে
এ বাড়ির মেয়ে ও বাড়ির মেয়ে
আমাদের মেয়ে তোমাদের মেয়ে
রাধা কিংবা মেরি বা ফাতেমা তার নাম…”

সাধারণ মানুষের জীবনযুদ্ধের এক ক্ষত বিক্ষত লড়াইয়ের চিত্র উঠে আসে ‘আবুল কালাম’ গানটিতে। যে লড়াই করে, নৈতিকতা মেনে চলে, কখনও অর্ধ মানবে পরিণত হয়ে হেরে যায়- হেরে যেতে যেতে জিতে উঠতে চায়। সে হারে সে জেতে- তবু কখনও থামে না। কেননা ইতোমধ্যেই সে জেনে যায় থেমে যাওয়া জীবনের কোনও মানে নেই।
“মাস শেষ হলে মাথার ভেতর
সাইরেনের শব্দ
পাইকারি আর খুচরো জীবন
করছে তাকে জব্দ
প্রতিদিন তাই ভাবতে ভাবতে
আবুল কালাম দাঁড়ায় বাসের লাইনে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন ভাবে
আর সামান্য বাড়তো যদি মাইনে…”
দেশ নিয়ে বহু গান তিনি লিখেছেন, তাঁর কথায়- “দেশ দুঃখী হলে মানুষ ভালো থাকে কী করে, যদি মাটি সরে যায় তাহলে অনেক দূরে সরে যায় আকাশও।” প্রিয়তম স্বদেশের গান- “তুমি ছুঁয়ে দিলে হবে রূপান্তর।” সুসম বণ্টন নেই এই অসম দেশে পৃথিবীতে। সেই বেদনার হাহাকার শুনি এখানে ওখানে কবিতায়। চট্টগ্রামের বহু ঐতিহ্য, সাধুর দোকান, লাল দীঘি, জব্বারের বলি খেলা, একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের দুঃখ বিভাজিত বহুমুখী গানের সমাহার এই গ্রন্থ। ফরাসি চার্চ সঙ্গীত কি স্প্যানিশ লোকগান অথবা আফ্রিকান ক্যালিপ্সো সঙ্গীতের আঙ্গিক অথবা মাধুর্যে ভরিয়ে তুলেছেন তিনি কতক গান। আবার তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রাম নিয়ে লিখেছেন ‘স্মৃতির শহরে’। গীতিকবিতা যখন কবির নিজের কণ্ঠভঙ্গিতে সুরের ব্যঞ্জনায় বেজে ওঠে- তখন বোদ্ধা শ্রোতার চৈতন্যের ঘরকুঠরিতে বাংলা গানের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়, উত্তর প্রজন্ম নবায়নমুখী হয়ে ওঠে।
এই ডামাডোলের বাজারে শিল্পের নিভৃত কারিগরদের কথা আমরা মনেই রাখি না। কেবলই চাকচিক্য- অসুস্থ বিনোদন বাহানায় ভরে গেছে দেশ। যোগ্যের হাতে প্রায়শই আমরা কোনও অর্ঘ্য তুলে দিতে পারি না। পুরস্কার যদি অযোগ্যের হাতে যায় তবে সুবিচার যেমন হয় না, তেমনি শ্রোতা পাঠক আর দর্শকের রুচিও পতিত হয়। যা একটি দেশের জন্যে ভয়াবহই বটে। পুরস্কার দিতে হবে, দেয়াই উচিত সরকারি বেসরকারিভাবে। কিন্তু তা যেন যোগ্যের হাতে যায়। তা নয় যে ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারেন না। তিনি ঐ পুরস্কৃত অযোগ্যের যাবতীয় ‘কলা’-কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে শুরু করেন। এই নেতির প্রভাব জাতিকে অগ্রসরমান হতে বাধাগ্রস্ত করে। অন্য দিকে ভালো শিল্পী, লেখক, কবি তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন, অপমানিত হন, দমে যান। এই শিল্পীরা শামুকের জামা গায়ে দিয়ে চলেন নীরবে। যেমন শান্তনু বিশ্বাস। কী কী বৈশিষ্ট্য বিচারে এ দেশে পুরস্কার বা পদক দেয়া হয়, কারা নির্ধারণ করেন আমি জানি না, জানতেও চাই না। শুধু বলবো এই মানুষটিকে যদি পুরস্কৃত করা হয়, এ দেশ ঠকবে না, বরং উপকৃত হবে- ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে।
এইসব প্রিজমের মতো আলোখচিত ভুবনজোড়া গান আমাদের সমাজকে বিন্যস্ত করে তুলুক, বহুরৈখিক আড়ালচারী শিল্পী শান্তনু বিশ্বাস- আপনার জয় হোক।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত