| 29 নভেম্বর 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

বৌদ্ধধর্মেও পূজিত হন দেবী সরস্বতী । পার্থসারথি পাণ্ডা

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
 
সুপ্রাচীন ভারতে বিশেষ কোন ধর্ম ছিল না। প্রকৃতি উপাসনা ছিল। কয়েক শো বছরের পরিক্রমায় আচার ও উপাসনার মতভেদে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন–এই তিন ভারত-সম্ভূত ধর্মের উদ্ভব। একই ভূখণ্ডের একই জলহাওয়ার মানুষ হওয়ায় এইসব ভিন্নমতের ধর্মের মধ্যে খুব স্থূল মিল আছে মূর্তি উপাসনা ও দেব-দেবীভাবনার মধ্যে। প্রাচীন হিন্দুধর্মের অনেক দেবতাই পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্যে সেই মিলের পথ ধরে ঢুকে পড়েছেন। দেবী সরস্বতী তাঁদেরই একজন।
 
হিন্দু তন্ত্রশাস্ত্রে, শিবের ‘শক্তি’ যেমন দুর্গা, তেমনি ব্রহ্মার ‘শক্তি’ সরস্বতী। এখান থেকেই বৌদ্ধতান্ত্রিকেরা তাঁদের বজ্রযান গ্রন্থে সরস্বতীকে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। সেখানে সবার ওপরে বোধিসত্ত্ব, তাঁর নীচেই মঞ্জুশ্রীর স্থান। মঞ্জুশ্রী দেবী নন, তাঁর পুরো নাম মঞ্জুনাথ বা মঞ্জুঘোষ—ইনি বাগ-দেবতা বা বিদ্যার অধিপতি, বাগীশ্বরী সরস্বতী তাঁর ‘শক্তি’। বৌদ্ধদের সাধনমালায় রূপভেদে সরস্বতীর পাঁচটি নাম পাওয়া যায়—মহাসরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী, বজ্রসারদা, আর্য সরস্বতী ও আর্যবজ্র সরস্বতী। তন্ত্রে এঁরা সবাই মাতৃকামূর্তি।
 
 
দেবী মহাসরস্বতীর রূপকল্পনায় ভাবা হয়েছে যে, তাঁর আকার-প্রকার বারো বছর বয়সী মেয়েটির মতো, তাঁর গায়ের রঙ সাদা, বসন সাদা এবং তাঁর পদ্মের আসনও সাদা। গলায় মুক্তার হার। ডান হাতে বরাভয়, বাঁ হাতে সাদা পদ্ম।
 
বজ্রবীণা সরস্বতী রূপ মহাসরস্বতীর মতোই, তবে এঁর দুই হাতে বীণা আছে।
 
বজ্রসারদার মুকুটে অর্ধচন্দ্র, ত্রিনয়ন, ডান হাতে পদ্ম, বাঁ হাতে পুস্তক। শ্বেতবর্ণা এই দেবী সাদাপদ্মের ওপর অধিষ্ঠিতা।
 
আর্য সরস্বতী সাদা বসনে শোভিতা, শ্বেতবর্ণা। এঁর আকার যেন ষোল বছরের যুবতী মেয়েটির মতো। এঁর ডান হাতে লালপদ্ম, বাঁ-হাতে প্রজ্ঞাপারমিতা পুস্তক।
 
আর্যবজ্র সরস্বতীর তিনটি মুখ। বাঁ মুখ সাদা, মধ্যিখানের মুখে লাল আভা, ডান দিকের মুখটি নীল রঙের। এঁর ছয় হাত। তিন ডান হাতে পদ্ম, তরোয়াল ও কর্ত্রী। তিন বাঁ হাতে ব্রহ্মকপাল, রত্ন ও চক্র। তিনি বাঁ পা সামনে মেলে ডান পা মুড়ে বসে অধিষ্ঠান করেন।
 
 
বৌদ্ধধর্ম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতীর উপাসনা ভারত থেকে চীন, জাপান, জাভা, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়। গড়ে ওঠে মন্দির। জাপানের সাতটি সৌভাগ্য দেবী ও দেবতার মধ্যে একজনের নাম ‘বেন-তেন’, ইনিই ভারতের সরস্বতী।
 
জাপানের একমাত্র সৌভাগ্যদেবী বেন-তেন বিরাট ড্রাগনের ওপর অবস্থান করেন, এঁর দুই হাত, দুই হাতে ধরে থাকেন বীণা। ড্রাগনের মুখ মানুষের মতো। জাপানের বিখ্যাত বেন-তেন মন্দির উয়েনো-তে সিনোবাজু লেকের ধারে অবস্থিত। কোন জলাশয় বা পুকুরের ধারেই জাপানে বেন-তেনের মন্দির বানানোর নিয়ম, এর অন্যথা করা যায় না।
 
দ্বিভুজা, ষড়ভুজা, অষ্টভুজা—রূপভেদে বেন-তেনের অনেক নাম—হম্পি বেন-তেন, কোঙ্গো সিও, বেন-জাই-তেন প্রভৃতি।
 
জাপানিদের কাছে বেন-তেন যেমন সৌভাগ্যের দেবী, তেমনি প্রেমেরও দেবী। তাঁর নামে অনেক লোককাহিনি জাপানে প্রচলিত।
 
 
বুনশো নামের এক বন্ধ্যা নারীর কিছুতেই যখন সন্তান হচ্ছিল না, তখন সে বেন-তেনের কাছে গিয়ে মানত করল। ফলে, সে গর্ভবতী হল। কিন্তু সন্তানের পরিবর্তে সে পাঁচশো ডিম প্রসব করল। বুনশো ভয় পেল, এই ডিম থেকে পাছে কোন ড্রাগনের জন্ম হয়—তাই সে ডিমগুলো ঝুড়ি ভরে রিনজু-গাওয়া নদীতে ভাসিয়ে দিল। গরীব এক জেলে সেই ডিম নদীতে ভেসে যেতে দেখে তুলে আনল পাড়ে। বালির মধ্যে সে সেই ডিম লুকিয়ে রাখল। সে যখন দেখল, বালির উত্তাপে ডিমগুলো ফুটে তা থেকে পাঁচশো ছেলেমেয়েকে বেরিয়ে আসতে। সে ছুটে গিয়ে গাঁয়ের মোড়লকে আশ্চর্য এই খবরটা দিল। মোড়ল সব দেখে শুনে জেলেকে উপদেশ দিল ছেলেমেয়ের মাকে খুঁজে তার কাছে রেখে আসতে। বেন-তেনের কৃপায় জেলে বুনশোর কাছে তার ছেলেমেয়েদের পৌঁছে দিল। ছেলেমেয়েদের পেয়ে বুনশোর মনে দারুণ আনন্দ হল। দেবীর কৃপায় সে তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করল।
 
এভাবেই বৌদ্ধধর্ম, তন্ত্র ও বাংলার ব্রতকথাধর্মী লোকগাথার মধ্য দিয়ে জাপান ও ভারতের বাইরে বৌদ্ধ দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল দেবী সরস্বতীর পূজা। অবশ্য ভিন্ন নামে। সেখানে তিনি বিদ্যা ও কলাশিল্পের আঙিনা ছুঁয়ে সৌভাগ্যের দেবী।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত