Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,saraswati pooja

সরস্বতী পুজোর অতীত বর্তমান ।  শকুন্তলা চৌধুরী

Reading Time: 5 minutes

সরস্বতী পুজোর (saraswati pooja) অতীত বর্তমান স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে স্কুল, কলেজ জীবনের সরস্বতী পুজোর দিন ও প্রবাস জীবনে দেখা পুজোর কথা ও পুরনো দিনের হারিয়ে যাওয়া সময়ের নস্টালজিয়া।


খ্রীষ্টমাসের ছুটির পর, জানুয়ারী মাসে, স্কুল খুললেই শুরু হয়ে যেতো তোড়জোড়। সরস্বতী পুজো আসছে। হাওড়ায় গঙ্গার ধারে, রেসিডেন্শিয়াল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে ছিলো আমাদের সেই ছোট্ট স্কুলটা। বেশীরভাগই ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়ে, বাইরেরও কিছু আছ। প্রতিটি ক্লাসে কুল্যে ৩০-৩৫ জন ছাত্রছাত্রী। শিক্ষক-শিক্ষিকার আকস্মিক অভাব পূর্ণ করতে প্রায়ই এগিয়ে আসতেন মা-মাসীরা।

স্কুলটির অভিভাবকত্বে ছিলেন বাবা-কাকু-জ্যেঠুরা। তাতে পড়াশোনার কাজটা আরোই ভালো হতো। মোটের ওপর ছোট হলেও স্কুলটির যথেষ্ট সুনাম ছিলো, রেজাল্টও বেশ ভালো হতো। আর সবকিছুতেই ছিলো একটা ঘরোয়া ভাব। স্কুলের সরস্বতী পুজো ছিলো আমাদের ঘরের পূজো। দুর্গাপুজোর মতো ধূমধাম হতো না বটে, কিন্তু এই পূজোটা ছিলো আমাদের মনের খুব কাছাকাছি। এটা আমাদের পুজো, ছাত্রছাত্রীদের পুজো। আমরা সেই পুজোর যোগাড় করছি….বাচ্চা বলে কেউ হেলাফেলা করে সরিয়ে দিচ্ছে না….মা সরস্বতী আমাদের পুজো নিতে আসছেন। কম কথা?

সবচেয়ে উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিরা করতো পুজোর আসল কাজ। তার পরের ক্লাসের দাদা-দিদিরা বানাতো স্কুলের সামনে সরস্বতীপূজোর তোরণ। শিক্ষক-শিক্ষিকারা করতেন পূজোর জোগাড়-গাঁদাফুলে গাঁথা হতো মালা। নিতান্ত বালখিল্যরা ক্যাম্পাসের সব বাগান হাতড়ে তুলে আনতো অঞ্জলির ফুল, ধুতো শালপাতা আর ভাঁড়। বাকীরা তাদের ক্লাসের উচ্চতা অনুযায়ী পূজোর অন্যান্য জোগাড়ে হাত লাগাতো। ছেলেরা যেতো বাজার করতে, প্রতিমা আনতে। মেয়েরা কাটতো আলু, বাঁধাকপি।

এই লিঙ্গবৈষম্যটা আমার একেবারেই ভালো লাগতো না। আমরা যখন সর্ব্বোচ্চ ক্লাসে এবং পুজোর দায়িত্বে, তখন এই নিয়ম ভেঙে কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে কলেজের বাস নিয়ে আমরা মেয়েরা প্রতিমা আনতে গিয়েছিলাম। বাধা পড়েছিলো অনেক, কিন্তু তাও যে যেতে পেরেছিলাম তাতেই মনে হয়েছিলো যে ঐ পুরোনো নিয়মটা অন্তত মা সরস্বতী নিজে তৈরী করেননি! তিনি নিজেই তো মেয়ে! তাই তিনি সেবারে আমাদের মেয়েদের সাগ্রহ আপ্যায়ন গ্রহণ করে পূজোপ্রাঙ্গণে অধিষ্ঠিতা হলেন। তৈরী হলো নতুন ঐতিহ্য।


আরো পড়ুন:সরস্বতী উপাসনা ও বৌদ্ধ ধর্মমত । সুকন্যা দত্ত


পুজোর দিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকা-কর্মচারীরা ছাড়াও আসতো অসংখ্য প্রাক্তনী। সবার জন্যে ছিলো স্কুলের বারান্দায় দু’সারি মুখোমুখি বসে ঢালা খাওয়ার ব্যবস্থা। দুপুর বারোটা থেকে ব্যাচ বসতো, চলতো বিকেল তিনটে-চারটে অবধি। সবচেয়ে উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিরা করতো পরিবেশন। কাঠি-দিয়ে-আটকানো শালপাতার ওপর দ্রুতহাতে ছুঁড়ে দেওয়া আটার লুচি, ছোলার ডাল, আলু-বাঁধাকপির তরকারী, টম্যাটোর চাটনি আর পান্তুয়া। মাটির ভাঁড়ে জল – তাতে একটা অন্য গন্ধ মিশে থাকতো, আর তলার ফুটো দিয়ে প্রায়ই আর্দ্ধেক জল গড়িয়ে পড়ে যেতো। তবে খাওয়ার স্বাদ তাতে কমতো না। হলপ করে বলতে পারি যে রাজভোগও তার চেয়ে সুস্বাদু ছিলো না। …

পুজোর আগেরদিন থেকে শুরু হয়ে যেতো তোড়জোড় – সেদিন আর ক্লাস হতো না। তার পরের দিন পূজো – সুতরাং সেদিন ছুটি তো বটেই, কোনো পড়াশোনা করাই নিষিদ্ধ। ভোরবেলা উঠে, চান করে, বাসন্তী রঙের শাড়ী পরে, আমরা তৈরী। শীতের সকালের আবছা ঠাণ্ডা গায়েই লাগতো না। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকতাম পুজো ও তারপরের নানা আয়োজনে। সন্ধ্যেবেলা হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – সেও আরেক মজার পর্ব।


আরো পড়ুন:সরস্বতী পুজো নয়ের দশক আর এক ‘অবাস্তব’ পৃথিবী


তারও পরের দিন দধিকর্মা হওয়ার পর, গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে শেষ হতো পূজা। চতুর্থদিনে আবার শুরু হতো ক্লাস। মনে বেশ জোর নিয়ে তৈরী হতাম ফার্স্ট টার্মের পরীক্ষার জন্যে। মা সরস্বতীর পূজোর যোগাড় করেছি, অঞ্জলি দিয়েছি, বিদ্যাদেবীর পায়ে বই আর পেন ঠেকিয়ে এনেছি, পূজো দেওয়ার আগে কুল খাইনি – ভয় কিসের?…..

ছোটবেলায় স্কুল-কলেজ-বাড়ীতেই বেশীরভাগ সরস্বতী পুজো (saraswati pooja) দেখেছি। বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে অবশ্য দেখেছিলাম কলকাতার বারোয়ারী সরস্বতী পুজোর (saraswati pooja)  জাঁকজমক। কেউ বানাচ্ছে মুসুরীর ডালের সরস্বতী প্রতিমা…..কেউ বা বানাচ্ছে বেতের প্রতিমা। প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে চলতো নতুনত্বের কারিকুরি আর তার সঙ্গে সারাদিন ধরে মাইকে গান।….

তবে আমরা থাকতাম এ’সবের চেয়ে দূরে। একটা নিশ্চিন্ততার ঘেরাটোপে। গঙ্গাপাড়ের সেই সবুজ ক্যাম্পাস ছিলো যেন একটা অচঞ্চল সুরক্ষিত দ্বীপ। বাইরের ঢেউ তট পেরিয়ে সেখানে সহজে ঢুকতে পারতো না। সাতদিনের চব্বিশ ঘন্টাই আমাদের কাটতো সেখানে। বাইরে বেরোলে মনটা ছটফট করতো ফেরার জন্যে। হাওড়ার জনবহুল ধোঁওয়া-ধুলো মাখা রাস্তা পেরিয়ে যেই ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে ঢুকতাম, একটা ঠাণ্ডা হাওয়া আপ্যায়ন করে ভেতরে টেনে নিতো। নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচতাম। মনেই হতো না যে এটা আমাদের অস্থায়ী আবাসন, মনে হতো এটা যেন আমাদের চিরকালের জায়গা।

আমাদের পূজোয় প্রতিবারই কুমোরটুলি থেকে আসতো একইরকমের মাঝারি মাপের মাটির প্রতিমা। ধবধবে সাদা প্রতিমার গায়ে জড়ানো হলুদ শাড়ী, চোখে স্মিত জ্ঞানের আলো। বৈদিক পূজোর যে ঐতিহ্য উনিশ শতক অবধি অব্যাহত ছিলো, তার স্মারক হিসাবে প্রতিমার পাশে রাখা থাকতো দোয়াত আর কলম। পুজোয় জাঁকজমকের চেয়ে বেশী ছিলো মনের আকুলতা—পরীক্ষার রেজাল্টের চাপ সামলাতে অঞ্জলি দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত শীতের কুল দেখেও চোখ সরিয়ে নেওয়া….পূজোর দিন ঠেলাঠেলি করে নিজের বই-খাতা-কলম মা সরস্বতীর পায়ের যত কাছে পারা যায় রেখে দেওয়া….আর বাসন্তী রঙের শাড়ী পরে একমনে বলে যাওয়া “সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে….”। মনে আছে যে কলেজে ঢোকার পরেও কলেজের সরস্বতী পূজো কোনদিন দেখিনি—পূজোর দিন প্রাক্তনী হিসাবে ফিরে যেতাম স্কুল চত্বরে।…

বহু বছর হলো আমার দেশ পাল্টে গেছে। সেই সুরক্ষিত সবুজ দ্বীপটি ছেড়ে আমি চলে এসেছি বিশ্বের এক বিরাট ‘মেল্টিং পট’-এ। সব দেশের সব জাতির লোক এখানে আছে— তারা নিজেদের মতো করে নিজেদের অনুষ্ঠানগুলো পালন করে। আবার সবাই একসাথে মিলে গিয়ে, জুলাইয়ের চার তারিখে স্বাধীনতাদিবস পালন করে।

আমেরিকায় বাঙালী ক্লাবের সরস্বতী পুজো (saraswati pooja) হয় আর যে কোনো অনুষ্ঠানের মতই— সপ্তাহান্তে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষ সেটা যদি বা হয়, পঞ্চমী প্রায় কখনোই হয়না। ষষ্ঠী থেকে দশমীর মধ্যে যে দিনটি শনিবার, সেই দিন পুজো হয়। এখানকার বেশীরভাগ মন্দিরই দক্ষিণ ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত— দক্ষিণ ভারতীয়রা সরস্বতী পুজো (saraswati pooja) করেন নবরাত্রির অঙ্গ হিসাবে, শরৎকালে। সুতরাং সেইসব মন্দিরে আলাদা করে শীতকালে সরস্বতী পুজো (saraswati pooja) হয়না। মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজো (saraswati pooja) করার রীতিটা উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ। আমাদের শহরে দুয়েকটি বাঙালী মন্দির আছে যেখানে মাঘ মাসে যথাযথ তিথি মেনে শুক্লা পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজো (saraswati pooja) হয়, কিন্তু ছুটি না থাকলে সেই পুজোয় গিয়ে উঠতে পারিনা।

সুতরাং সপ্তাহান্তে, হাড়-জমানো শীতে, শাড়ীর ওপর ভারী কোট চাপিয়ে, যাই বাঙালী ক্লাবের পুজোয়। শাড়ীটা এখনও হলুদ রঙেরই পরার চেষ্টা করি। গাঁদাফুল বিরল, তাই মালা গাঁথা হয় অন্যফুলে। কুল এখানে দুষ্প্রাপ্য, তাই আগে খেয়ে ফেলার ভয় নেই। মনে ইচ্ছে থাকলেও, বাচ্চাদের ভিড় ঠেলে নিজের আইপ্যাডটা আর মা সরস্বতীর পায়ের কাছে রেখে উঠতে পারিনা।…এখানে সরস্বতী পুজোর (saraswati pooja) দিন ছোট বাচ্চাদের হাতে খড়িটাই প্রধান অনুষ্ঠান। প্রথমে হয় পুজো, তারপর অঞ্জলি। সবশেষে হাতেখড়ি।

প্রসাদ বিতরণের পরে, দ্বিপ্রাহরিক খিচুড়ি ভোগ। সঙ্গে পাঁচমিশালী তরকারী, চাটনি আর হরেকরকম মিষ্টি।আমার মনটা আনচান করে ওঠে শালপাতা থেকে গড়িয়ে যাওয়া ছোলার ডাল দিয়ে আটার লুচি খাওয়ার জন্যে। তলা-ফুটো জলপূর্ণ মাটির ভাঁড়ের বদলে, ডিজপোজেবল্ থার্মোকলের গ্লাস তুলে নিই হাতে। দিনটা গড়িয়ে যায় গল্পগুজব, দুপুরের স্ন্যাকস্ আর নিরামিষ সান্ধ্যভোজনের মধ্যে দিয়ে। আর থাকে বাচ্চাদের কবিতা-গান-নাচের প্রদর্শনী।

বহুযত্নে আমার মেয়েদের শিখেয়েছিলাম সেখানে সরস্বতী স্তোত্র পাঠ করতে, সুকুমার রায়ের কবিতা আবৃত্তি করতে, গান করতে, নাচ করতে। সেও তো একরকম বাগদেবীরই পূজো। অন্যভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত সেই বাচ্চারা যখন আপ্রাণ নিষ্ঠায় বলে উঠতো – “বিনা পুশ্টক রন্জিটো হশ্টে বগোবোটি বারোটি ডেবি নমশ্টে”, মনে হতো মা সরস্বতী যেন হাত পেতে নিয়ে নিলেন সেই প্রাণের অঞ্জলি…..হোক্ না অশুদ্ধ উচ্চারণ আর অ-তিথিতে পূজন! ভক্তিতে তো কোথাও কমতি নেই! তারা তো জন্মাবধি এই পুজোই দেখে আসছে!

এদেশে আসার পর আর কোনদিন স্কুলের পুজোয় গিয়ে উঠতে পারিনি। জানিনা সেখানে আজও সবাই ঠেলাঠেলি করে বই-কলম রাখছে, নাকি তার জায়গা নিয়ে নিয়েছে আইপ্যাড-কিবোর্ড। জানিনা বাসন্তী রঙের শাড়ী পরে সেখানে এখনও কেউ অঞ্জলি দিতে যায় কিনা। জানিনা আমার সেই সবুজ দ্বীপটা বাস্তবে এখনও সেইরকমই মায়াবী আছে কিনা।….

মনে মনে প্রতি শুক্লা পঞ্চমীর ভোরে আমি আজও ফিরে যাই সেই দ্বীপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ছোট্ট স্কুলের প্রাঙ্গনে, যেখানে চার বছর বয়সে প্রথম শুরু করেছিলাম মা সরস্বতীর বন্দনা। যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে করি আমার পূজো। একাই অঞ্জলি দিই, একাই প্রসাদ নিই। আমাকেও কেউ দেখতে পায়না, আমিও কাউকে দেখতে পাইনা।

শুধু মনে হয় পুজোর শেষে মা সরস্বতীর বীণাখানি যেন সপ্তসুরে বেজে উঠলো বুকের ভেতর….বুঝতে পারি সাতসমুদ্র তেরোনদী পেরিয়ে আমার পুজো পৌঁছে গেছে বাগদেবীর চরণতলে ।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>