| 20 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

সরস্বতী পূজা ও সনাতন ধর্মমত । ব্রততী সেন দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ছোটবেলায় আমাদের ভ্যালেন্টাইন দিবস ছিল নাসরস্বতী (saraswati)পুজোও ছিল না।ব্রাহ্ম স্কুলে পড়াশোনা করার দরুণ প্রেম প্রস্তাব পাওয়ার এমন অমোঘ দিনগুলো কেমন অবহেলায় হারিয়ে যেত।পরে যখন সন্তানরা পড়াশোনা শুরু করে তখন সরস্বতীবন্দনা আমার জীবনে এক অন্য মাত্রা পেল।তার আগে সম্বৎসর দেবী দুর্গতিনাশিনী দুর্গা যখন সন্তানাদি নিয়ে মর্ত্যভূমিতে দুষ্টের দমন ,শিষ্টের পালন করতে আসতেন তখন তাঁর সন্তানদের অন্যতমা হিসেবে দেখতাম হংসবাহনা দেবী সরস্বতীকে।সে সূত্রে মনে হত তিনি শিব –পার্বতীর সন্তান।

কিন্তু পুরাণ তাঁর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে অন্য কথা বলছে।বলা হয় হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ আসনের ত্রিমূর্তির অন্যতম ছিলেন ব্রহ্মা,বাকি দুজন হলেন বিষ্ণু ও মহেশ্বর।ব্রহ্মা হলেন স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ তাঁর পিতামাতা কেউ নেই,তিনি নিজেই নিজেকে জন্ম দিয়েছেন।বলা হয় সেই আশ্চর্য জন্মের পর ব্রহ্মা ধ্যানে বসে তাঁর নিজের সকল গুণগুলোকে একত্রীত করতে থাকেন দেখা যায় সকল ভাল গুণগুলো একত্রে এক নারীর অবয়ব ধারণ করে।এই ভাবে ব্রহ্মার মুখগহবর থেকে সৃষ্টি হয় দেবী সরস্বতীরআস্যাদ্বাক।ব্রহ্মার প্রথমে একটা মুখ ছিল কিন্তু সেই অপরূপা নারীকে দেখার জন্য তাঁর আরো তিনটে মুখের সৃষ্টি হয়।স্বকন্যা সরস্বতীর প্রতি ব্রহ্মা আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং ব্রহ্মার পুত্রদের এ বিষয়ে আপত্তি থাকায় ব্রহ্মা ক্ষোভে ও লজ্জায় দেহত্যাগ করেছিলেন।শিবপুরাণে আছে ব্রহ্মা কামপ্রবৃত্তির দ্বারা কন্যা সরস্বতীর পশ্চাদধাবন করেছিলেন।সরস্বতী (saraswati) ব্রহ্মার মুখ থেকে কুপ্রস্তাব শোনার পর ব্রহ্মার অশুভভাষী পঞ্চম মুন্ড ছিন্ন হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন।

পুরাণে আরো আছে ব্রহ্মা নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না,সরস্বতী (saraswati) তাঁকে এই বিশ্বকে আরো কীভাবে সুন্দর করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।পুরাণে কোথাও সরস্বতীর স্বামী হিসেবে বিষ্ণুর নাম লেখা আছে আবার কোথাও ব্রহ্মার নাম পাওয়া যায়।অথচ এই ব্রহ্মা মর্ত্যধামে সে ভাবে আরাধ্য নন বা তাঁর কোন মূর্তি পাওয়া যায় না কেন এর পেছনে যে কারণ শোনা যায় সেখানেও সরস্বতীর উল্লেখ আছে।শোনা যায় কোন এক অনুষ্ঠানে সরস্বতী সময় মত ব্রহ্মার পাশে উপস্থিত থাকতে পারেননি বলে ব্রহ্মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং আরও এক স্ত্রীর সৃষ্টি করেন এবং নাম দেন গায়ত্রী।সরস্বতী এসে স্বামীর পাশে গায়ত্রীকে দেখে প্রচন্ড রেগে ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন যে ত্রিমূর্তির অন্যতম হয়েও তিনি মর্ত্যে কোথাও পূজিত হবেন বা তাঁর নামে কোন মন্দির তৈরি হবে না।

বিদ্যাবুদ্ধি,সৃজনী প্রতিভা,চারুকলা ,বিজ্ঞান এবং ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির দেবী হলেন সরস্বতী (saraswati)।বেদ আর সরস্বতী অভিন্ন,বেদ– বেদাঙ্গবিদ্যার জননী সরস্বতী।ত্রিলোক ব্যাপিনী জ্ঞানময়ীর শুক্লজ্যোতিতে বিশ্ব চরাচর প্রকাশিত হয়েছে।তাই সরস্বতী হলেন তিমিরনাশিনীতমসো মা জ্যোতির্গময়ো।

সরস্বতী (saraswati) শব্দটির ব্যুতপত্তিগত অর্থ হল ‘সরস+বতু’ স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে হয় ‘সরস্বতী’সতত রসে সমৃদ্ধা।গঙ্গাযমুনার মত সরস্বতী আদিতে ছিল শুধু মাত্র এক নদীর নাম।সপ্তসিন্ধুর অন্যতম সরস্বতী প্রবাহমানা নদী,সরোবর নয়।

খৃষ্টপূর্ব তৃতীয়চতুর্থ সহস্রাব্দে উত্তর পশ্চিম ভারতের প্লক্ষ প্রস্রবণ থেকে সরস্বতী (saraswati) নদীর উৎপত্তি ঘটে,এর জল্প্রবাহ অত্যন্ত নির্মল এবং স্বচ্ছ ছিল,এই নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠে বৈদিক সভ্যতার প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র।নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হতো বৈদিক সারস্বত যজ্ঞ।এই নদীতে পিতৃতর্পণ করা ছিল অত্যন্ত পুণ্য কর্ম।ঋকবেদে সরস্বান নামে এক নদীদেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়তাঁর স্ত্রীলিঙ্গ কি সরস্বতীসারস্বত সমভূমি ছিল অতি উর্বরা,কৃষিজ সম্পদে পরিপূর্ণ।এই কারণে সরস্বতী একসময় কৃষিদেবী হিসেবে পূজিত হয়েছেন।নারীরা ‘সারস্বতব্রত’ পালন করতেন উচ্চমানের ফসলের আশায়।

আবার তিনি আরোগ্যা শুশ্রূষার দেবী,শুক্লাযজুর্বেদে তিনি দেববৈদ্য অশ্বিনীদ্বয়ের স্ত্রীরূপে পরিচিত।

বৈদিক সরস্বতী অভিন্ন হয়ে ওঠেন পৌরাণিক বাগদেবী বরদা বাগেশ্বরীর সঙ্গে।কালক্রমে সরস্বতী (saraswati) হয়ে ওঠেন ভাষার দেবী,বাক্য দিয়ে সজ্জিত হয়ে ওঠে ভাষা,সরস্বতী তাই বাক্যদেবী ,আজও তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাণীসরস্বতীরূপেই পূজিত।

মাঘ মাসে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শ্রীশ্রী সরস্বতী দেবীর পুজো হয়।সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই দিন শুদ্ধ চিত্তে দেবীর আরাধনা করেন

নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।

তিনি শুক্লবর্ণা,শুভ্র হংসবাহনাতাঁর এক হাতে বীণা আর অন্য হাতে পুস্তক।সরস্বতী (saraswati) জ্ঞানদায়িনী বিদ্যার দেবী,মানুষ স্বভাবতঃই জ্ঞান পিপাসু শ্রদ্ধাবান মানুষ জ্ঞান লাভ করেন দেবীকে পুজা করে।জ্ঞানের মত পবিত্র আর কিছুই নেই-‘নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’।

সত্ত্ব,রজঃ এবং তমোগুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অত্যন্ত পবিত্র,স্বচ্ছতার ও নির্মলতার প্রতীক।সত্ত্বগুণে জ্ঞান লাভ হয় এবং তার প্রতীক হল সাদা,তাই জ্ঞানের দেবী সরস্বতী শুক্লবর্ণা এবং শুক্লবস্ত্র পরিধান করেন।

দেবীর বাহনও শ্বেতহংস।হংস অসার ফেলে সারটুকু গ্রহণ করে।দেবীর সঙ্গে হংসও পূজিত হয় কেননা সে শিক্ষাদান করে যে যা কিছু অকল্যাণকর,অসার তাকে বাদ দিয়ে ভক্তরা যেন জীবনের সারসত্য,নিত্য পরমাত্মাকে গ্রহণ করে।তবে পুরাণতন্ত্রে হংসবাহনা সরস্বতীর উল্লেখ অপেক্ষাকৃত কম,সরস্বতী বারংবার বাহন পরিবর্তন করেছেনমেষ,সিংহ,ময়ূর ও হংস এই চারটি প্রাণী বারংবার সরস্বতীর বাহনরূপে কল্পিত হয়েছে।

দেবী সরস্বতীর (saraswati) একহাতে বীণা অন্য হাতে পুস্তক।বীণা্র ঝংকারে জীবনের ছন্দ বেজে ওঠে,বেজে ওঠে ধ্বনি বা নাদ।বাগদেবীর ভক্তরা সাধনার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করলে বীণার মধুর সুর শুনতে পান এবং তাদের মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন বীণার মত মধুর সঙ্গীতময় হয় তাই তিনি পাণিতে বীণা ধারণ করেন।

সরস্বতী জ্ঞানের ভাণ্ডার ‘বেদ’ ধারণ করেন আর এক হাতে,’বেদ’ হলো সকল জ্ঞানের ভাণ্ডার,বেদ থেকেই বিদ্যার উৎস।

বেদে পুরুষ দেবতার প্রাধান্য এবং সংখ্যাধিক্য,স্বল্প সংখ্যক নারী দেবতার মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রাধান্য লাভ করেছেন অদিতি,ঊষা এবং সরস্বতী।সরস্বতীর সঙ্গে ইড়া ও ভারতী নামের দুই দেবতার নাম অনেকবার সংশ্লিষ্ট হয়েছে।অনেক সময়ই এই তিন দেবতাকে একত্রে আহ্বান ও স্তুতি করে বলা হয়েছে

হে (অগ্নিরূপভারতী,সরস্বতী ও ইড়া!আমি তোমাদের সকলকে আহ্বান করছি,যা করলে সম্পত্তিশালী হতে পারি তাই কর।

এঁদের তিনজনকে বারবার একত্রে উল্লেখ করা হলেও এঁদের কোন গুণকর্মের পরিচয় মন্ত্র নেই।তবে যজ্ঞে এঁদের আগমন,অবস্থান এবং এঁদের দ্বারা যজ্ঞরক্ষার ক্ষেত্রে বারবার উল্লেখ দ্বারা এই তিনদেবী যে যজ্ঞাগ্নি এই বিশ্বাস জন্মায়।দেখা গেছে বৈদিক জ্যোতিরূপা সরস্বতী এবং নদী সরস্বতী একত্রে জ্ঞানের দেবতারূপে পুরাণ তন্ত্র ও সাহিত্যে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তির অধিকারী হয়েছেন।শুধু হিন্দু সংস্কৃতি নয়,হিন্দু ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে তিনি জৈন ও বৌদ্ধধর্মেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।কৌতূহলোদ্দীপক হল পুজার ক্রমবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রূপ কল্পনাও বহুবৈচিত্র্য লাভ করে।কোথাও তিনি দ্বিভুজা বা চতুর্ভুজা।কোথাও তিনি পদ্মাসনা বা শুক্লবর্ণা,শুভ্রবর্ণাত্রিলোচনা।তন্ত্রে ইনি বাগীশ্বরীবর্ণেশ্বরীসারদা ও শারদা।একটি মন্ত্রে বাগীশ্বরী মদোন্মত্তা– তাঁর হাতে পানপাত্র নরকপাল।বর্ণেশ্বরী সিন্দুরবর্ণা এবং বিদ্যা অক্ষরমালা ও মৃগশাবকধারিণী। কবিকংকন মুকুন্দরামের বর্ণনায় দেবী একহাতে শুকপাখী ধারণ করে আছেন।পুরাণতন্ত্রের বর্ণনায় যদিও সরস্বতীর হাতে বীণা কম দেখা যায়,আধুনিক যুগে সরস্বতীর হাতে বীণা অপরিহার্য।

সরস্বতী (saraswati) বিদ্যার এবং ললিতকলার অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে সমগ্র ভারতে পূজিতা হয়েছেন এবং হচ্ছেন।দেখা যায় ভারতের বাইরেও দেশ দেশান্তরে তাঁর পুজা প্রসারিত হয়েছে।যবদ্বীপে পাওয়া গেছে পদ্মাসীনাসপ্ততন্ত্রী বীণা হস্তা বীণাবাদিনী সরস্বতী দেবী।

তিব্বতে বজ্রধারিণীময়ূর বাহনা বজ্রসরস্বতীও বীণাপাণি সরস্বতী (saraswati)।

জাপানে বেনতেন নাম্নী সর্পাসনা দ্বিভুজা বীণাপাণি,অষ্টভুজা হপ্পিবেনতেন সরস্বতীর বহির্ভারতে পাড়ি দেওয়ার অভ্রান্ত সাক্ষ্য বহন করে।জাপানে সাতটি সৌভাগ্য দেবতার মধ্যে একমাত্র বেনতেন স্ত্রী ও সমুদ্রের দেবতা।তিনি সাহিত্যসঙ্গীতের প্রেরণাদাত্রী এবং সুখ ও ঐশ্বর্যদায়িনী।তিনি সমুদ্র থেকে জাত এবং সমুদ্রেই তাঁর বাস।ড্রাগন তাঁর বাহন আর সাপ তাঁর স্বামী।একটি শ্বেত সর্প তাঁর দূত।বেনতন অষ্টভুজাতাঁর দুই কর প্রার্থনার ভঙ্গীতে যুক্ত।বিউয়া নামক বাদ্যযন্ত্র তাঁর প্রিয়,ছবিতে তাঁকে সমুদ্রগর্ভে পদ্মের ওপরে বসে থাকতে দেখা যায় অথবা সাপের ওপর বিউয়া বাদনরতা অবস্থায় দ্বিভুজা ও চরুর্ভুজা বেনতনকে দেখা যায়।

সরস্বতীর (saraswati) আদল কিছু বহির্ভারতের দেবতার সঙ্গে মিল পাওয়া গেলেও সম্পূর্ণরূপে তাদেরকে সরস্বতীর বিকল্প বলা চলে না। এঁরা কখনও কখনও হয়ত বিদ্যাবুদ্ধি ও জ্ঞানদাত্রী কিন্তু পুরাণতন্ত্রে যে সরস্বতীর (saraswati) পরিচয় পাওয়া যায় তার থেকে অনেক দূরত্ব।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত