প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী “শরৎ কুঠির” । পলাশ পোড়েল
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের তৈরি বাড়ি শরৎ কুঠির। এটি আছে বাগনানের অন্তর্গত সামতাবেড় এ, এটি হাওড়া জেলার একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। যেখানে বাংলার স্বনামধন্য কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর মধ্যজীবনে এক স্থায়ী আস্তানা গড়ে বসবাস করতে শুরু করেন। শরৎচন্দ্র সমতা গ্রামে এই বাড়িটিতে থাকতেন। তিনি স্থানীয় জেলে ও ধোপাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন বলে, সমাজে তাকে একঘরে করা হয়। তারা এই এলাকাটিকে গ্রাম থেকে আলাদা করে নিয়ে সমতাবেড় নাম দিয়েছিল।
মানুষের জন্য শরৎচন্দ্রের ভালোবাসার প্রতীক হলো তাঁর হোমিওপ্যাথি চর্চা। এই বাড়িতে থাকাকালীন তিনি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের বাক্স নিয়ে রূপনারায়ণের তীরে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে দুলে বাগদীদের নিখরচায় চিকিৎসা করে বেড়াতেন। এখনও একটি ঘরে আলমারি ভর্তি হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি বোতল লক্ষ্যনীয়।
রূপনারায়ণ নদের পূর্ব কূলে এই সামতাবেড় গ্রামেই শরৎচন্দ্রের বসতবাড়ি আছে। অনেকটা জমির ওপর ইঁটের ভিত দেওয়া দোতলা দক্ষিণ দুয়ারী মাটির দেওয়ালের বাড়ি। কাঠের কাঠামোর ওপর টিনের ছাউনি। পুরো বাড়িটা বাগান দিয়ে ঘেরা। সামনের দিকে আম, পেয়ারা, ডালিম ইত্যাদি ফলের গাছ; আর পিছনে বাঁশ বাগান। বাড়ির লাগোয়া দক্ষিণ দিকে দু-দুটো বড়ো আকারের ঘেরা পুকুর। তাতে খিলখিল করে ছোটোবড়ো নানারকম মাছ; আবার জলতলের ওপরে সারি বাঁধা হাঁস এবং পানকৌড়ির অবাধ যাতায়াত। একটা পুকুর চান করার জন্যে; অন্যটা পানীয় জলের পুকুর। তাতে নামা নিষেধ! একেবারে আদর্শ গ্রাম বলতে যা বোঝায়, তার সব উপাদানই সামতাবেড়ে মজুত। ঠিক এই অবস্থাটা অনেক যুগ বজায় ছিল।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাওড়ার বাড়ি নিঃসন্দেহে প্রকৃত অর্থেই জাতীয় শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের একটি। হাওড়ার দেউলটি স্টেশন সংলগ্ন সামতাবেড় গ্রামে প্রায় এক বিঘা জায়গার ওপর বাড়িটি অবস্থিত। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্র এসেছিলেন পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামে তাঁর দিদির বাড়িতে। দিদির নাম ছিল অনিলাদেবী। দিদি ওনার খুবই প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। উনি নিজের ছদ্মনামও রেখেছিলেন অনিলাদেবী। দিদির বাড়ির পরিবেশ ভালো লাগার কারণে উনি পরবর্তীতে মনস্থির করেন, ওখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস করার। সেইমতো তিনি সামতাবেড় গ্রামে বাড়ি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ঝাড়গ্রামের স্থপতি ‘ইয়াকুবু’র তত্ত্বাবধানে প্রায় ১১,১৫১ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় শরৎকুঠি। সম্পুর্ণ বার্মিজ সৌষ্ঠবে নির্মিত এই বাড়িটি দেখতে অসাধারণ। যার উত্তর দিকে ছিল তাঁতী ও জেলেপাড়া, পশ্চিম দিকে রূপনারায়ণ ও ধান জমি, পূর্বে কাঁচা বড়ো বাঁধ এবং দক্ষিণে সামতা গ্রাম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত প্রায় বারো বছর এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন।
আগে রূপনারায়ণ নদ এই বাড়িটির ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে যেত। শরৎচন্দ্রের পড়ার ঘর থেকে নদী দেখা যেত। এখন নদী খাত পরিবর্তন করে দূরে সরে গেছে। এই পড়ার ঘরে বসেই শরৎচন্দ্র অভাগীর স্বর্গ, কমললতা, শেষপ্রশ্ন, পল্লীসমাজ, রামের সুমতি, পথের দাবী ও মহেশ-এর মতো গল্প-উপন্যাসগুলি লেখেন। বাড়িটি দোতলা। শরৎচন্দ্র ও তার ভাই স্বামী বেদানন্দ এখানে থাকতেন। বেদানন্দ বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী ছিলেন। উভয়ের সমাধিই এই বাড়িতে আছে। শরৎচন্দ্রের স্বহস্তে পোঁতা গুলঞ্চ, পেয়ারা ইত্যাদি গাছ এই বাড়িতে এখনও রয়েছে।
বাড়িটির সর্বত্রই তাঁর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ধানের গোলা, কাঠের বারান্দা, নীচের উঠোন সব জায়গাগুলোই ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবেন পর্যটকরা। সংরক্ষণ করা হয়েছে লেখকের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। যে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি চিত্তরঞ্জন দাশ উপহার দিয়েছিলেন লেখককে তা রাখা আছে ঠাকুরঘরে। রাধা কৃষ্ণ এখনও প্রত্যেকদিন নিত্য পূজিত হন। যারা ‘রামের সুমতি’ পড়েছে তাদের সবার লেখকের বাড়ির সামনের পুকুরটা দেখেই ‘কার্তিক’, ‘গণেশে’র কথা মনে পড়বেই।
এই বাড়িতে অনেক গুণি মানুষের পায়ের ধুলো পড়েছে। এ বাড়িতেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে মিটিং করতেন। কিন্তু ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঘরভাঙানি বন্যা এই অঞ্চলের প্রায় সব মাটির বাড়িই ভেঙে মাঠ করে দিলেও শরৎচন্দ্রের দোতলা মাটির বাড়িটার অস্তিত্ব মুছে যায়নি! তবে খানিকটা বন্যাবিধ্যস্ত করে দিয়েছিল। বন্যার পর তৎকালীন রাজ্য সরকার শরৎচন্দ্রের মাটির বাড়িটা সন্তর্পণে মেরামত করে সংরক্ষণ করেছিল। বর্তমানে রাজ্য সরকারের সহায়তায় স্থানীয় প্রশাসন শরৎচন্দ্রের বাড়িটাকে ভ্রমণপিপাসুদের জন্যে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। একসময় বাড়ির আঙিনায় একজোড়া ময়ূর ছিল। এছাড়া ছোটো রং বেরংয়ের বাহারি গাছ দিয়ে বাগানের মাঝখানে লেখা থাকত ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’।
২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন অ্যাক্ট অনুসারে এটিকে ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্থলের স্বীকৃতি দেয়।২০০৯ সালে পুরো বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছে।
শিক্ষক, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ক্যুইজমাস্টার, ও সম্পাদক।জন্ম – পিয়ারাপুর, উদয়নারায়ণপুর, হাওড়া। পিতা ও মাতার নাম- ৺নিমাই ,৺ আল্পনা। শিক্ষাগত যোগ্যতা- ডবল এম এ( ভূগোল, এডুকেশন) , বি এড। পেশা- সহ শিক্ষক, বড়দা গঙ্গাধর হাইস্কুল। *সম্পাদক- হাওড়া জেলার কথা ও আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক পলাশ সাহিত্য পত্রিকা।* সাহিত্য চর্চা- পাঁচারুল শ্রীহরি বিদ্যামন্দিরে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তে পড়তে লেখালেখি শুরু। বিভিন্ন ছোট পত্রিকা( মেটেফুল, অভিযান, পাঞ্চজন্য, শম্পা,সারঙ্গ আলো ভূমিজ ইত্যাদি), রং বেরং, দৌড়, আমি অনন্যা, তথ্যকেন্দ্র, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান এর মতো কয়েকটি বড় বাণিজ্যিক পত্রিকায় লেখা প্রকাশ পায়।সারা ভারতবর্ষ এবং আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। রেডিও তে নিয়মিত কবিতা পড়া হয়। * FM Rainbow থেকে সেরা পলেসুর সম্মান লাভ। হাওড়া জেলা বইমেলা কমিটির সম্মান, হাওড়ার বঙ্কিম মেলার সম্মান, হাওড়ার সত্যজিৎ রায় জন্মোৎসব কমিটির সম্মান, এই সময় পত্রিকা সম্মান ছাড়াও অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকা থেকে সম্মান লাভ। *প্রকাশিত বই- গৌর দাসের আখড়ার বোষ্টমি,একতারার সুর, উদয়নারায়ণপুর জনপদ কথা ( ব্যক্তিগত ভাবে) , ভূমি (একটি আবাদের গল্প),বোষ্টমী ও বাউল কথা। হাওড়া জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে নিরন্তর কাজ চলছে। *ওয়েবসাইটে হাওড়া জেলার কথা গ্রুপ ও পেজ নিয়ত জনপ্রিয় হচ্ছে।
বর্তমান ঠিকানা : কুলডাঙা, পাঁচলা, হাওড়া