| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

চন্দ্রপুলিওলার রূপো রঙের বাক্স ভরা থাকত চন্দ্রপুলি,মুগের বরফি,মুগের লাড্ডু ,এইসব নানাবিধ লোভনীয় উপকরণে। সাধারণতঃ ক্ষীর অথবা নারকেল দিয়ে চন্দ্রপুলি বানানো হত। দাম অনুযায়ী ছিল তার আকৃতি,আয়তন।বড়সড়গুলো কেনা হত বিজয়া দশমীর আগে। অন্যসময় পাতলা ছেলেভুলোন চন্দ্রপুলি গোটাকতক কিনেই উঠে পড়তেন মায়েরা।আমরা মায়েদের অর্থনৈতিক অসহায়তা বুঝতাম না।তখনও হয়ত মুগের লাড্ডুর দিকে তাকিয়ে আছি। সেসব গ্রাহ্য না করেই বিক্রেতা তার বাক্সের ঢাকনা ঘটাং আওয়াজে বন্ধ করে মাথায় তুলে এগিয়ে যেত।বুঝিয়ে দিত , সেদিনের মত বেচাকেনার পালা শেষ।Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Sarbani Banerjee

বিকেলে আসত ঘুঘনিওলা।একজন সাদা ধুতি আর সাদা ফতুয়া পরা সাদা চুলের মানুষ। কালচে হলুদ রঙের ঘন সেই ঘুঘনিতে সে যে কী মশলা দিত কে জানে?আজও সেরকম ঘুঘনি আর কোথাও খুঁজে পাইনি।তার গলায় সেই “চাই ঘুঘনি…ই….ই”র গম্ভীর ডাক কোন এক নৈঃশব্দে মিশে গিয়েছে।আর কোনদিন ফিরে আসবে না। রেখে গিয়েছে একটি ছবি।শালপাতা হাতে সে তার লাল শালু দিয়ে বানানো গলায় ঝোলানো কাপড়ের বন্ধনী ফাঁক করে এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি থেকে ঘুঘনি দিচ্ছে।আর আমরা তার হাঁড়িতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছি কোন ফাউএর গল্প আছে না নেই। অথবা শালপাতায় চেটে চেটে আমরা সেই মহা অমৃতের শেষ বিন্দুটুকু নিঃশব্দে নিঃশেষ করছি।


আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


গরমের দুপুরে বাবারা থাকতেন অফিসে।মায়েদের সুখনিদ্রা ভাঙিয়ে আমরা বলতাম “ফেরিওয়ালা এসেছে।”

“ওকে বসতে বলেছিস তো?”

“হ্যাঁ।”

সদর দরজা পেরিয়ে ,গলিপথের শেষে,বাড়ির দিকে আসার পথের মাঝেই চওড়া উঠোন। সেখানেই আসতেন বাজারউলি, ঘুঁটেউলি।আবার চন্দ্রপুলিওলা বা ফেরি ওয়ালাদের মত পুরুষমানুষেরাও সেখানে এসে তাদের পশরা নামাতেন।Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Sarbani Banerjee

স্কুলের বইএ তখন সেরিবা, সেরিবান ফেরিওয়ালাদের অমর গল্প।সৎ ও অসৎ ফেরিওয়ালা আর সোনার থালা বিকিকিনির সেই গল্পটি খুব প্রিয় ছিল,কতবার করে যে পড়তুম। বইএর পাতায় ফেরিওয়ালাদের ছবি ছিল অস্পষ্ট।অনেক চেষ্টাতেও তাকে চেনা যেত না।বাড়িতে আসা জলজ্যান্ত ফেরিওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে সেরিবা অথবা সেরিবান কল্পনা করে বড় তৃপ্তি হত।মায়েদের হাতের চুড়িতে যে সেফটিপিন ঝোলে সেই সেফটিপিন, মেয়েদের লম্বা বিনুনির খোঁপার গোড়া বাঁধার কার, আমাদের মাথার লাল সবুজ ফিতে, প্লাস্টিকের রঙচঙে ‘ইভনিং ইন প্যারিস’ লেখা হেয়ার ব্যান্ড, লাল বেগুনী সবুজ নীল রঙের রকমারি কাঁচ বা প্লাস্টিকের চুড়ি, আলতা ,সিঁদুর ,হিমানী বা অন্য স্নো এর কৌটো,অগুরু বা কান্তা সেন্টের শিশি, ন্যাপথলিন, আরো কত বিচিত্র জিনিস থাকত তার ওই ত্রিপলের ঢাকনা দেওয়া চৌকো বিশাল বাক্সে।এমন কী উকুনের ওষুধও পাওয়া যেত তার কাছে। আর আমরা তো একমাস বা তারও কিছু কম দিনের মধ্যে উকুন আক্রান্ত হতাম।স্কুলে যাওয়া মানেই মাথায় উকুনের আবির্ভাব।রবিবার বা ছুটির দিনে নারকেল তেলের সঙ্গে ওই ওষুধ মেখে আমরা বসে থাকতাম।তারপরের সাবান দিয়ে মাথা ধোয়ার পর্বটি খুব আকর্ষণীয় ছিল।হাওয়ায় ওড়া ফুরফুরে চুলে বাহার খুলত মাথার।আর আমাদের মনে হত বেশ ফ্যাশানদুরস্ত  হওয়া গিয়েছে।যদিও ওই ফুরফুরে চুলের পিছনের উকুনের অধ্যায়টি সকলে আন্দাজ করে একটু তাচ্ছিল্য মিশ্রিত দৃষ্টি দিয়ে আমাদের দিকে তাকাত।বলাবাহুল্য সেসব চাহনি আমরা একেবারেই গায়ে মাখতাম না।Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Sarbani Banerjee

সে যাই হোক ফেরিওয়ালার মাথায় বাক্স তোলার সময় স্বাস্থ্যবতী মনাকাকীমার ডাক পড়ত।আমাদের রোগাসোগা মা কাকিমাদের জন্য পাশের বাড়ির জানলায় তার হাসিমুখের ছবিটিও মনে আঁকা আছে।বড় হয়ে বুঝেছি ,তার বোধহয় তেমন আর্থিক সামর্থ্য ছিলনা। তিনি কিছু কিনতেন না,কিন্তু সদালাপী মানুষটির সাহায়্য থেকে মা বা কাকিমারা বঞ্চিত হননি কখনও।আশপাশের বাড়ির মহিলারাও আমাদের উঠোনে জড়ো হতেন।মা,কাকিমা, জ্যেঠিমাদের সামর্থ্য ছিল সীমিত। কাপড়ের আঁচলে বাঁধা গুটিকয়েক পয়সা বা কালো হয়ে যাওয়া কয়েকটা এক টাকার নোট । তবু তারা কখনও সখনও মনাকাকিমার হাতে তুলে দিতেন আলতার শিশি বা চুলের গোড়া বাঁধার কালো কার। সেফটিপিনের পাতা অথবা মাথার বাঁকা কাঁটার পাতা । নেবার সময় “না না” বলে আপত্তি জানালেও তার চোখে হাসি ফুটে উঠত।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত