আজ ০৯ নভেম্বর কবি সরদার ফারুকের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
শ্মশানের পাশে
শ্মশানের পাশে থাকি, গোরস্তান বেশি দূরে নয়
অচেনা লাশের সাথে দেখা হয়, ইশারায় আমাকেও
মৌন হতে বলে
গুলমোহরের ডালে এক হলুদ-লেজের পাখি দোল খায়
বৃষ্টিভেজা কাঠে চাপা আগুনের ধোঁয়া
বিধবার জানালায় আলকাতরার রঙ
গলে গলে পড়ে
আনন্দ, কোথায় তুমি
আনন্দ, কোথায় তুমি? দরোজায় তালা
কিছুই না বলে কেন অন্তর্ধানে গেলে?
পাতা ঝরা দিনে
ভাল লাগবে না উচ্চ নিনাদের গান
আনন্দ আমার
তোমার পায়ের শব্দে সবখানে নাচঘর ছিল
মাঝে মধ্যে ঘুঙুরের ধ্বনি শোনা যায়।
স্টেশন রোড
স্টেশনের দিকে কিছুদূর এগুলেই
চোখে পড়ে যশুরে লতায়
ঢাকা পরিত্যক্ত ঘরদোর
হেলেসাপ খেলা করে ইটের পাঁজায়।
‘অনন্ত কেবিনে’ সবুজ দেয়াল জুড়ে
ছোপ লাগা কালো কালো দাগ
কারা যেন বিস্বাদ চায়ের
সাথে কড়া তামাকের ঘ্রাণ বাতাসে ছড়ায়।
শিরিষের তোরণ পেরিয়ে
শর্ষেক্ষেত, তারপর ছন্নছাড়া রেলের জংশন।
ইতিহাস
বিকেলের দুঃখ আলো ফিরিয়ে দিয়েছে
পুরোনো বিষাদ, ভাঙা প্রাসাদের ঝরোকা খিলান
প্রেতের পৃথিবী হাতছানি দিয়ে ডাকে।
সাদা হাড়ে খনিজের দাগ
রক্ত-মাংস-মজ্জা মিশে গেছে
কত দিন আগে!
মরকুটে নেড়ি কুকুরের
লোম ওঠা বাদামি ত্বকের প্যাপিরাসে
পাঠ করি তোমদের ভ্রষ্ট ইতিহাস।
নীল জামা
রেলপথ ধরে হেঁটে গেলে
ছোট কালভার্ট
অগভীর জলে খেলা করে
ডানকানা মাছ
তারপর তোমাদের বাড়ি
তুমি থাকো ভিতরের ঘরে
নীল জামা বাইরে শুকায়।
অ্যাক্রোফোবিয়া
অতল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থেকো না
দেবদারু পাইনের অবাধ বিস্তার
যতোই টানুক!
ক্যামেলিয়া এখনো ফোটেনি
প্রস্তুতিতে কেটে যাবে আরো কিছু দিন।
মেঘের ভ্রমণে কোন অস্থিরতা নেই
পতনের ভয় নেই বলে?
উচ্চতার দারুন ম্যাজিকে
অজগর পাক খায় অ্যামিগডালায়।
নৃত্য
আমাকে নাচালে কেন?
আমি নাচিয়েছি? নেচেছো স্বেচ্ছায়।
আমাকে কাঁদালে কেন?
এ ক্রন্দন বিশ্বময়, আমিও কেঁদেছি।
এ-ও তো যুগল নৃত্য, দুজনের ভুল
কে যে কবে খুলেছিল নাচের ইস্কুল!
বন্দনা
দোহাই তোমার কালু রায়
দোহাই মা বনবিবি, বনে আসি
ভাতের জোগাড়ে
দোহাই মনসা দেবী,
এঁকে-বেঁকে ঘোরে ফেরে, রাতে বলি লতা
ভয়ে ভয়ে গোলপাতা কাটি
হরিণ শিশুর পায়ে জোঁক
কাদা জলে রক্ত মিশে যায়
ভালোবাসা
‘যৌনতার সঙ্গে যদি সংস্কৃতি মেশাও, তবে তাকে
ভালোবাসা বলা যেতে পারে’–এভাবেই বিষয়টা দেখেছেন
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন
তোমাদের কেউ প্লেটোনিক, কেউ কেউ অকথ্য বর্বর
কেউ শুধু উসকানি দিতে জানো, কেউ বা শিখেছো বিনিময়
হাতে ফুল নেই, ঠোঁটে কবিতাও নেই
বাৎসায়ন পড়োনি কখনো
পশুরও প্রস্তুতি থাকে,তোমাদের নেই
একহাতে চেকবই, অন্যহাতে জন্মরোধী টুপি
নৃত্যঘর
দূর থেকে ‘মৃত্যুঘর’ মনে হলো। কাছে গিয়ে দেখি
বড় করে লেখা আছে ‘নৃত্যঘর’– এখানে কত্থক, ভরতনাট্যম,
সিনেমার ড্যান্স অতি যত্ন সহকারে…
‘মৃত্যুর নিকুচি করি, আমি নৃত্য ভালোবাসি’– এই কথা ভেবে
এগিয়ে যেতেই দেখি একদল রক্তবর্ণ নারী প্রণামের ভঙ্গি করে
কিশোরীরা হলুদ ফুলের পাপড়ি ছিটায়
বাঁশের কুলোয় আলপনা, ঠোঁটে উলুধ্বনি
জ্ঞান হারানোর আগে শেষবার ‘ভালোবাসি’– বলে উঠি
সাহস
‘ভদ্র ছেলেদের দিয়ে কিছুই হবে না, সবখানে তারা
বেকুব দর্শক…’– ছোটকাকা বলতেন
আমিও দেখেছি রাজহংসী বসে আছে
বখাটের নতুন বাইকে
ধর্মষাঁড় বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়ে মটরশুটির ক্ষেতে
জিমনেসিয়াম থেকে বেরোতে দেখেই গীতাদি বলেন-
‘মাসল বানিয়ে লাভ নেই, সাহসই আসল।’
রজ্জু
এ এক বিস্ময়-রজ্জু, যতোবার বাঁধি, একা একা
খুলে যায় গেরো, যেন ধুতি-প্রান্ত খসে গিয়ে
লেজ হয়ে ঝোলে
কৃতী সেজে কেউ দূরদেশে যায়–সবুজ-রূপালী ফিতে
স্মৃতিভ্রষ্ট চোখ নিয়ে দেখে
এ-ও কি আরাধ্য সন্ধ্যা, দীপশিখাহীন, বিধবার ব্রত–
উপবাস, কাঁটালতা, রোদন-বিলাস!
মানুষ
‘শয়তান আর ঈশ্বরের মাঝামাঝি বলে
মানুষকে সহ্য করা যায়।’—পুরোটা বোতল শেষ হলে
ফণিদা’র মুখে নানাবিধ বাণী ভর করে
যিশুর ক্ষমায় তিনি যাকে তাকে জড়িয়ে ধরেন
‘ভেবে দ্যাখ, ধার্মিকের পাশাপাশি বেড়ে চলে বদমাশ
প্রায়শ তাদের মুখ একাকার, পাপ ও পুণ্যের ফুল
ফুটে আছে একই ডালে— অভিন্ন চেহারা!’
‘মানুষকে ভালোবাসি, তারা দু’পথেই হাঁটে,
বেশিক্ষণ কোথাও থাকে না।’