সরদার ফারুকের গুচ্ছ কবিতা
আজ ০৯ নভেম্বর কবি সরদার ফারুকের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
সঙিন
জঙ্গলের বুট পায়ে জনারণ্যে হাঁটো
মৃগয়ার অনুমতি পেয়ে
সবখানে তোমার স্বরাজ
দুমড়ে মুচড়ে দাও স্বর…
সঙিনের ফলা কচি ডালপালা ছিঁড়ে
বিঁধে আছে গাছের গ্রীবায়
ধূসর অধ্যায়
ধূসর অধ্যায় আসে, ঘেয়ো কুকুরের
চামড়ার বিছানায় শুয়ে আছো–
ভালুকের কাছে নাচ শিখে
ভেবেছিলে আসর মাতাবে?
ঝুপড়ির মেয়েটির গায়ে আনাজের ঘ্রাণ, হাঁড়িতে ফুটছে
আশা ও স্বপ্নের দানা
‘খাঁচা খুলে কবুতর দেখা’ বড়ো বেদনার মতো বাজে
কখনো একান্ত সেতু ছিলো, লুকিয়ে থাকার তাঁবু
আর এক রঙ-জ্বলা হারমোনিকায় ভুলভাল সুর —
‘ মেরা জুতা হ্যায় জাপানি…’
বুটের আওয়াজ শোনা যায়
পাহারাওয়ালার হাঁক , বাতাসের ফিসফাস…
কামারশালায়
গ্রীষ্মের দুপুরে কেন কামারশালায় ?
হাঁপরের ফুঁসে ওঠা দেখে মনে পড়েছিলো শ্বাসের অসুখ,
পালের উচ্ছ্বাস?
দিনগুলো পুড়ে গেছে, রাতের দখল নিয়ে মাতামাতি করে
ভাড়া-করা পরী, অভিনেতা শয়তান
একটু নরম হলে লোহা , চলুক হাতুড়ি
রাত
এখনো গলছে রাত, টের পাই
নীল আলো কাঁপে
ভাইয়ের কবরে যেতে অন্ধকার
ঝোঁপঝাড়, বটের শেকড়
হ্যাজাকের আলো জ্বেলে একবার
মাঠভরা নাচ
জিংক অক্সাইড মেখে
অনেকেই পরী সেজেছিলো
আধখানা মোম, কাছে গেলে
চুলপোড়া গন্ধ পাওয়া যাবে
বয়সের বাধা নেই
বয়সের বাধা নেই
প্রমাণ হিসাবে তবে কররেখা দেখা যেতে পারে—
তটভূমি ভেসে গেছে জোয়ারের স্রোতে
ব্রিজের পিলারে জলচিহ্ন দেখা যায়
সেও তো স্মারক!
আনন্দস্নানের দিন এখনও কি আছে?
হাতের মুঠোয় পাবে কোমলতা, নিশাদল,
অঙ্গারের গুঁড়ো?
সন্ধ্যা হয়
অধীত বিদ্যার দিন ম্লান
মক্ষিকার গুঞ্জরণ চুপ
কেবল স্পন্দনটুকু— কোথা থেকে আসে?
সন্ধ্যা হয়, রঙগুলো নেভে
কাগজের দুই পিঠে কে এঁকেছে রাত্রিচর পাখি!
পড়ালেখা
গাছের বাকলে পড়ি কাঠঠোকরার
ভাষা, কালো মেঘেদের দিন
পুকুরের ঘাটে পড়ি
তোমার পায়ের ছাপ, নতুন শাড়ির
ভেজা দাগ, ভুল করে ফেলে যাওয়া
চিরুণির অপার আহ্লাদ
ঘুঘুচরা ভিটে জুড়ে লিখি
ভালোবাসা, চিনিগুড়া ধান
মিলিত হয়েছি
মিলিত হয়েছি ক্রুশকাঠে
লোহার শলাকা ছাড়া কী করে এমন
নিবিড়তা হবে?
জড়িত রয়েছি এক গভীর পতনে
প্রপাতের শব্দ শোনা যায়
দুধসাদা জল ঘন বাষ্পের আকারে
ব্যাপ্ত হয়ে আছে
অচেনা প্রবাসে
শবাধারে প্রজাপতি ওড়ে
অভিশাপ
মোহর পাওনা যার
তাকে কেউ দিওনা জহর
নাপাক জবানে
পড়ে যেন কঠিন কহর
কাকে এই তাম্রমূদ্রা দাও,
ঘৃণার নহর?
অভিশাপে পুড়ে যাবে বোকার শহর
রাখাল
কখনো গভীর রাতে পাশের বাড়িটা
আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে, অশ্রাব্য চিৎকার
অনুচ্চ বিলাপ, বোতল ভাঙার শব্দ
রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে ঘুমন্ত শহর দেখি, অনাথ শিশুর
মুখে বিলবোর্ড থেকে গলে পড়া আলো
পাহারাদারের হাতে লাঠি
একা একা বলি
এই অসুখী শহর, দুঃস্থ লালসার
আমি কেউ নই
পথভ্রষ্ট দরিদ্র রাখাল
হারানো ভেড়ার পাল খুঁজতে এসেছি
দৈবের ঘোড়া
এখনো দৈবের ঘোড়া লোকালয়ে আসে
পাঁচমাত্রার খুরের শব্দ জেগে থাকে সারারাত।
এখনো নিয়ম ভেঙে নিভৃত মন্দিরে
অগোচরে ঢুকে যায় রূপের ভিখিরি
বলে, ‘বর দাও, আমিও নৃপতি হবো’
দেবীর চোখের রত্ন কারা যেন খুলে নিয়ে গেছে
অক্ষিকোটরের দিকে ফিরে তাকালেই হাহাকার
সাপের জিভের মতো চেরা অন্ধকার।
মায়ার দোকান
শিশু সাপ কার কাছে ফণা তোলা শেখে
পিঁপড়েরা বিষাক্ত কামড়?
কোথা থেকে আসে এতো ধারালো পাথর?
যেখানেই যাই
কাঁটার মুকুটে ভরা মায়ার দোকান
খালের ওধারে
কারা থাকে খালের ওধারে ,
ডুরে শাড়ি দড়িতে শুকায়?
এদিকে সেদিকে ঘোরে তালের ডোঙায়
কলহ-বিবাদে
অবিকল আমাদের মতো
কাদা ছুঁড়ে দেয় ?
কালিগঙ্গা ব্রীজ
গরুর গাড়ির থেকে এক আঁটি
ধান পড়ে গেছে
পথ জুড়ে পাখিদের পিকনিক
গাড়োয়ান পেছনে দেখেনি
সামনেই কালীগঙ্গা ব্রীজ
যোগাযোগ
এ কেমন দগ্ধদোষ ,বাগব্যবহার
ভাষাতরু ছেয়ে আছে বিবর্ণ পাতায়
বার বার ক্ষমা চেয়ে শুনে নিতে হয়
যোগাযোগ এখনো সম্ভব?
এই পাণ্ডুলিপি,পরাআখ্যানের ফেণা
তুকতাক ,শব্দের সার্কাস !
কফিন
কিনে দেব কারুকার্যময়
দেবদারু কাঠের কফিন
চোখ খোলো ,গান গেয়ে ওঠো
ইউক্যারিস্টের রাতে রুটির বদলে
নরমাংস ভোজন করেছি
মদ নয় ,পান করে গেছি
রক্তের ফোয়ারা
চুল থেকে এখনো ঝরেনি শেষস্নান?
রূপ
‘ভাইজান ,কতাডা হোনেন…’
আকন্দের পাতা ছিঁড়ে নিলে
যেভাবে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা কষ
অসভ্য আলোতে দেখা যায়
লাবণ্যের চিহ্ন নেই
সারা হাতে ব্লেড-চেরা দাগ
‘জনম অবধি হাম রূপ নেহারিনু
নয়ন না তিরপিত ভেল’
কম্পমান কঙ্কালের সারি
চোয়াল খুলেছে
‘ক্যামুন চেহেরা কও , ভালো লাগে নাই?’
ঝড়-জলে গাছের আশ্রয়
প্রেতযোনি নেমে আসে কনকনে হাওয়ার বাহনে
অনুরোধের আসর
এখনো চলছে অনুরোধের আসর, আর কাকে মুগ্ধ করে
লাটিম বানাবে?
ঠোঁটের কোণায় ছাপো বাঁকানো অক্ষর
ঢেউগুলো প্রাকৃতিক নয়
এবারে ছুটিতে কুয়াকাটা যাবো। নারকেলপাতা জানে নোনা স্বাদ,
স্যাক্সোফোনে বেজে-ওঠা অনন্ত আক্ষেপ
