| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইতিহাস তবু ইতিহাস নয়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 

ইতিহাসে এম. এ টা পাশ করার কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের চাকরিটা জুটে গেলো! হোক না মেদিনীপুরের অখ্যাত গাঁয়ের অখ্যাত স্কুল! চাকরির এই বাজারে ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করে আর কীই বা পাওয়া যাবে! তাছাড়া হিয়ার এসব নিয়ে ভাবার সম্বল বা সঙ্গতি কোনোটাই ছিল না! ছোটবেলা থেকে মামারবাড়িতে বড়ো হয়ে ওঠা হিয়া অনেক তাড়াতাড়ি বুঝতে শিখেছিল তাকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে! তাই এই গন্ডগ্রামে এসেও মন খারাপ করেনি হিয়া! বরং স্বস্তি পেয়েছে একথা ভেবে যে এখন থেকে মায়ের খরচখরচার জন্য মামাদের কাছে আর হাত পাতার প্রয়োজন হবেনা!

টেবিল এ রাখা ফাইল এর দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলো হিয়া! ক্লাস নাইন এর মার্কশীট , রাখা ফাইলের মধ্যে কিন্তু এ কি ভয়াবহ অবস্থা! ইতিহাসে ক্লাস এর সর্বোচ্চ প্রাপ্ত নম্বর ১৫! পাশে বসে থাকা স্কুল সেক্রেটারি বিমল প্রধানের দিকে তাকালো হিয়া! পানের ছোপ লাগা দাঁত বের করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসলেন বিমল বাবু তারপর বিড়িতে একটু সুখটান দিয়ে বললেন,” বোঝলেন কিনা , ইতিহাসে সব পাতিহাঁস, দ্যাখেন কি করতে পারেন! “ রাগে গা জ্বলছিল হিয়ার! বলে কি লোকটা ? এইরকম ছেলেমেয়েদের কি পড়াবে সে?

সাদা আর হলুদ ডোরাকাটা শাড়িটা পরে আয়নার দিকে তাকালো হিয়া! চুলে চিরুনি বোলালো আলতো করে! হালকা প্রসাধন শেষ করে পাশের ঘরে গিয়ে খাবার নিয়ে অপেক্ষারত সুমেধাকে দেখেই আতঁকে উঠেছে! হেসে ফেললো হিয়া! মাথা নাড়িয়ে বললো, “ মনে হচ্ছে এটা আমার নয় , লঙ্কাধিপতি রাবনের প্রাতরাশ! এটা খেতে মিনিমাম দশখানা মুখের দরকার! আমার একার দ্বারা হবে না, বুঝলে জননী, ভেরি সরি! হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো হিয়া! সুমেধাও হাসছিলো! এখানে আসার পরে তিনটে মাস কেটে গেলো! সুমেধাও এসেছিলো হিয়ার সঙ্গে, ভেবেছিলো কিছুদিন পরে ফিরে যাবে কলকাতায়! কিন্তু কি মনে করে যায়নি এখনো! প্রথমে এসে বেশ দমে গিয়েছিলো সুমেধা! শেষকালে এই গন্ডগ্রামে জীবন কাটাবে মেয়েটা? এখন অবশ্য মন বসে গেছে! বসে গেছে বললে ভুল হবে! মনটাকে বশে এনেছে সে! কলকাতায় ফিরে গেলে একা হয়ে যাবে মেয়েটা! আর তাছাড়া কী বা আছে ওখানে? ভাইদের সংসারে ? তার থেকে এই বেশ! মা মেয়ের স্বাধীন জীবন!

একটু খেয়েই উঠে দাঁড়ালো হিয়া! মৃদু ধমক দিলেন সুমেধা “সুস্থির হয়ে খাওয়াও যায় না? এতো তাড়া কিসের?” মাথা ঝাঁকালো হিয়া! “আজ একটু তাড়া আছে মা, হেডমিস্ট্রেস ডেকে পাঠিয়েছেন ! স্কুলে অ্যানুয়াল ফাংশন এর দায়িত্বটা এবার নিতে হবে আমাকে! ভাবছি মহাভারতের উরুভি কে নিয়ে একটা নাটক করবো এবার!“ উরুভি? কে? ভাঁজ ঘনিয়েছে সুমেধার দুই ভ্রুর মাঝখানে ! বহুবার পড়া মহাভারতটা মনে মনে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো সে! কিছু ভাবার আগেই অবশ্য জবাব দিলো হিয়া!” মহাভারতের অন্যতম উপেক্ষিত চরিত্র উরুভি, কর্ণের স্ত্রী !স্বয়ম্বর সভায় অর্জুনকে প্রত্যাখ্যান করে বরমাল্য পরালেন কর্ণের গলায়! সুমেধা তাকালো হিয়ার দিকে! মেয়েটাকে বড়ো খুশি লাগছে আজ! নতুন পরিবেশে গত কয়েকটা মাস বড়ো ঝড় গেলো মেয়েটার ওপর দিয়ে ! হিয়াকে দেখে মন ভালো হয়ে গেলো সুমেধার!

আজ প্রথমবার কেন জানিনা সুমেধার হঠাৎ মনে হলো হিয়ার ইতিহাস পড়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিলোনা মোটেই! অথচ এই ইতিহাস পড়া নিয়ে কিযে অশান্তি হয়েছে বাড়িতে! সুমেধা নিজেও কেমন কুন্ঠিত হয়ে থাকতো হিয়ার পড়াশুনো নিয়ে! ফুলদির মেয়ে ফিজিক্স, ছোড়দার ছেলে ম্যাথমেটিক্স, দাদার ছেলে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি করলো, শুধু হিয়াটাই কেমন একটা পড়াশুনা করলো যেন! সারা বাড়িতে বেশ চাপা অসন্তোষ ছিল হিয়ার বিষয় নির্বাচন নিয়ে! তার থেকেও বড়ো কথা সবাই পরোক্ষে সুমেধাকেই দোষ দিতো! যেন হিয়ার এই ইতিহাস প্রেমের জন্য সুমেধাই দায়ী ! হিয়াকে বেশ কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছে সুমেধা! কিন্তু হিয়া সেসব শোনেই নি !উল্টে বলেছে, “বাঙালি একটা ম্যাথস অবসেসড কমিউনিটি! আমি আম বাঙালির মতন নই মোটেও ! লোকের কথায় আমাকে ওই ছাঁচে ফেলতে গেলে ঝামেলায় পড়বে তুমি! ইতিহাস নিয়ে পড়বো আমি, দেশকে চিনতে হবে, জানতে হবে! এখনো অনেক জানার বাকি! তুমি শুধু দে খতে থাকো মাতা! পরিবেশ লঘু করার জন্য মজা করতো হিয়া!

আজ অফুরন্ত অবসরে পুরোনো কথা ভিড় করছিলো সুমেধার চোখের সামনে! উঠে দাঁড়ালো সুমেধা! আর ভাববে না পুরোনো দিনের কথা! বিস্মৃতির অতলে যাক সেসব।

নির্ঘুম রাত কাটলো মেহেরুন্নিসার! যমুনার জলে তিরতির করা আলোর কাঁপন দেখছিলো আনমনে! হঠাৎ ভোরের আজান শুনতেই চমকে উঠলো! আজ প্রথমবার জাহাঙ্গীরের শিকার-অভিযানের সফরসঙ্গিনী মেহেরুন্নিসা! গোলাপজলে স্নান সারা হলে আয়নার সামনে দাঁড়ালো মেহেরুন্নিসা! দুধ, চন্দন আর গোলাপ পাপড়ি দিয়ে ত্বক পরিচর্যা পর্ব চলছে এখন! প্রসাধন শেষে ধীর পায়ে এগোলো মেহেরুন্নিসা! ধীর কিন্তু শান্ত পদক্ষেপ !সুসজ্জিত হাতির ওপরে অপেক্ষারত শাহাজাদা সেলিম! হাওদার চারদিকে সোনার থাম, টুকটুকে লাল গদির ওপরে পান্না ও চুনির কারুকাজ! হাওদার ঠিক ওপরে মুক্তো খচিত রুপার ছাতা! পাশে দাঁড়ানো জগৎ গোসাঁই এর দিকে ফিরে তাকালো না মেহেরুন্নিসা! সোজা গিয়ে উঠে বসলো হাতির পিঠে, শাহজাদার পাশে! স্তব্ধ হয়ে গেলো জগৎ গোসাই! কি ঔদ্ধত্য , কি স্পর্ধা মেয়েটার? খানদানি নিয়মের তোয়াক্কা করেনা এতটুকু? পাদশাহ বেগম জগৎগোঁ?সাই কে কুর্নিশ পর্যন্ত করার প্রয়োজন বোধ করলো না।

ভয়াবহ আক্রোশে তাকিয়ে রইলো জাহাঙ্গীরের বড়ি বেগম জগৎ গোসাঁই! এই প্রথম নিয়মের অন্যথা হলো! শাহজাদার পাশে আজ বড়ি বেগম নয়, বসে আছে মেহেরুন্নিসা! এগিয়ে গেলো জগৎ গোসাঁই! শিকারে যেতেই হবে তাকে! বড়ো অসহায় লাগছে আজ! দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের আত্মনিবেদন, ভালোবাসা , আকণ্ঠ নির্ভরতা সব নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো যেন! ক্ষোভে , হতাশায় বুকে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে এখন!

জঙ্গলের পথে চলতে চলতে হঠাৎ কেঁপে উঠেছে শাহজাদার হাতি! জঙ্গলের বুক চিরে শোনা যাচ্ছে ভয়াবহ গর্জন ! ভয়ার্ত মেহেরুন্নিসা মুখ লুকালো! হঠাৎ সশব্দ আওয়াজে চমক ভেঙেছে তার! হাতির পদতলে লুটিয়ে পড়ে আছে বিশালাকৃতি সিংহ! আকাশ বাতাস মুখরিত হলো জয়োধ্বনিতে “জয় পাদশাহ বেগমের জয়” “ কেয়া বাত বড়ি বেগম”, ঠোঁটের কোণায় গর্বের হাসি জাহাঙ্গীরের! জগৎ হাসলো, বড়ো ম্লান অনুজ্জ্বল সেই হাসি! তারপরে তাকালেন মেহেরুন্নিসার দিকে! অবজ্ঞার দৃষ্টি, উপেক্ষার দৃষ্টি, তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি! মনেমনে বললেন, “তুই বড়ো সাধারণ মেহেরুন্নিসা! কি আছে তোর? রূপ? বড়ো রূপের দেমাক তোর! শুধু রূপ থাকলে হয় না রে ! জাত থাকতে হয়, অভিজ্যত্য থাকতে হয়!

আজ বড়ি বেগমের উৎসবমুখর প্রাসাদে রাত্রিযাপন করবেন শিকার প্রত্যাগত শাহাজাদা! আজ প্রধান বাবুর্চি মীর বাকলাওয়াল খুব ব্যস্ত! নদীর জলে চারবার ধোয়া হবে চাল! তারপরে দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ মিশবে তাতে! জাফরান আর মিঠা আতরের সুগন্ধযুক্ত পোলাও রাখা হবে সোনার পাত্রে, রুপোর পাত্রে থাকবে তুলতুলে নরম ভেড়ার মাংস! ডোরাকাটা সাটিনের কাপড়ে ঢাকা হবে পাত্র! তার ওপরে বিছিয়ে দেওয়া হবে সোনার কারুকাজ করা জালিকাটা ওড়না!

ছুটির ঘন্টা বাজতেই চুপ করে যায় হিয়া! হৈহৈ করে অন্য ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে মেয়ের দল! শুধু চুপ করে বসে থাকে ইতিহাসের গল্প শুনতে থাকা মেয়েগুলো ! এভাবেই পড়ায় হিয়া! ইতিহাসের গল্প বলে ক্লাসে ! মোঘল সাম্রাজ্যের গল্প , স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প, মহাকাব্যের গল্প! গল্পের মধ্যে দিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাস! মন্ত্রমুগ্ধের মতন শোনে একদা অমনোযোগী, নিরুৎসাহী মেয়েগুলো! আরো জানতে চায় ওরা, আরো শুনতে চায়! “ইতিহাস না জানলে দেশকে জানা যায়না, দেশবাসীকে জানা যায় না! ইতিহাস মানে বইয়ের পাতায় লেখা সাল, তারিখ আর ঘটনার বিবরণ নয়! গভীরে যেতে হয়, অনেক গভীরে! “ থেমে থেমে কথা বলছিলো হিয়া! সারা শ্রেণীকক্ষে এখন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য, পিনপতনের আওয়াজ পাওয়া যাবে যেন! ক্লাস থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো হিয়া! এখন রং বদলের খেলা চলছে আকাশ জুড়ে ! অস্ত যাচ্ছে সূর্য! ঘরে ফিরছে পাখীর দল! মেঠো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে কর্মক্লান্ত মানুষ! বাড়ি ফিরছে হিয়া! বুকের ভেতরটা কোনো এক জাদুকাঠির স্পর্শে নির্ভার লাগছে।

কলেজ সার্ভিস কমিশন এর লিস্টটা বেরিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই! পোস্টিং হতে অবশ্য বছর ঘুরে গেলো! খবরটা পেয়ে যতটা আনন্দ হয়েছিল এখন আর হচ্ছে না তেমন ! এই একটা বছরে অনেক বদলে গেছে হিয়ার জীবন! কিছুই নেই এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে! গ্রামজুড়ে বড়োবড়ো দীঘি , তাল , সুপারি আর নারকেল গাছের সারি , দুখানা হাইস্কুল আর রাধামাধবের মন্দির! ওই মন্দির চত্বরেই বিকেলে ক্ৰিকেট খেলে বাচ্চারা! তবু ভালো লাগে হিয়ার! শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে এক নিশ্চিন্ত ঠিকানা , নিরাপদ আশ্রয়! “কি খুঁজছিস?“ সুমেধার গলা পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো হিয়া!“ আমার সবুজ রঙের জামদানিটা কোথায় মা? কাল ভাবছি স্কুল ফেয়ারওয়েল এ পড়ে যাবো!” মেয়ের দিকে তাকালো সুমেধা! কেমন একটা ফ্যাকাসে হাসির ছোঁয়া মুখে ! গলার স্বরে কেমন একটা বিষন্নতার আভাস যেন! অপ্রসন্ন মুখে সরে গেলো সুমেধা! এই গন্ডগ্রামে থেকে জীবন নষ্ট করার মধ্যে কি মহত্ব কে জানে!

জানালা দিয়ে তাকালো হিয়া! ঘরের পাশে আমগাছটায় দুটো শালিক বাসা বেঁধেছে! কাঠিকুটো জোগাড় করছে রোজ ! পলকের জন্য উদাস হলো হিয়া! ফোন বাজছে ! দৌড়ে গিয়ে ধরলো ফোন! “ হ্যাঁ, ছোটমামা, পরশু ভোরের ট্রেনে যাচ্ছি ! তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাবো! হ্যাঁ হ্যাঁ, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরছি! জোর করে হাসার চেষ্টা করলো হিয়া! কথা শেষ হয়ে গেলে বিছানায় এসে বসলো! ঝিরঝির করে মিঠে হাওয়া বইছে বাইরে! হঠাৎ হাওয়ায় ভাসছে বকুল ফুলের সুগন্ধ! বড়ো ঘুম পাচ্ছে এখন! বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলো হিয়া!

মহালক্ষ্মী মন্দিরের পাশে যে বড়ো দীঘি তার লাগোয়া শ্মশানে মানুষের ঢল নেমেছে আজ! অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছে রাজপুত্র দামোদর! আর কিছুক্ষনের মধ্যেই দাহকার্য্য সম্পন্ন হবে ঝাঁসির সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারীর ! পুত্রশোকে উন্মাদপ্রায় রাণী লক্ষীবাঈ আর রাজা গঙ্গাধর রাও!

কপালের ঘাম মুছলো হিয়া! বাইরে আজ বেশ গুমোট! বিনবিন করে ঘাম জমছে কপালে! আজ ক্লাসে ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈয়ের গল্প বলছিলো হিয়া! রানীর বীরত্বের কাহিনী, তাঁর ব্যক্তিগত সেনা দুর্গাদল এর কাহিনী, রাজ পরিবারের কাহিনী! উন্মুখ হয়ে শুনছিলো মেয়েগুলো! ঢংঢং করে ঘন্টা বাজতেই অভ্যেসমতন ক্লাসের বাইরে পা বাড়িয়েছে হিয়া! হঠাৎগলারআওয়াজে তাকিয়েছে ঘাড় ঘুরিয়ে! ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছে মেয়েগুলো! হিসেবমতন আজই স্কুলে শেষ দিন! কাল সকালের ট্রেনেই ফিরছে কলকাতায়! সেখানে আবার নতুন করে শুরু, নতুন কর্মজীবন!

এগিয়ে এলো হিয়া! তার সবথেকে প্রিয় ছাত্রী কাঞ্চনা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে! ভারী মেধাবী মেয়েটি! চিবুকে হাত রাখতেই সজল হলো চোখদুটো! বড়ো বিষণ্ণ কিন্তু বড়ো সুন্দর এক মুহূর্ত! এক ঝটকায় হিয়ার চোখের সামনে ফিরে এলো সেই প্রথম দিনের ছবি! অনাগ্রহী, বিবর্ণ মুখে বসে থাকা মেয়েগুলো অনেক বদলে গেছে! কোথাও একটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে হিয়া এই একটা বছরে! স্টাফরুমে যাওয়ার পথে বাইরে এসে দাঁড়ালো হিয়া! নিশ্বাস নিলো প্রাণ ভরে! গন্ধ নিলো আলো, বাতাস রোদের! ক্ষণপূর্বের মলিনতা, বিষন্নতা উধাও এখন!

সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হলো হিয়ার! আজ বেলা দুটো পঁয়তাল্লিশএ ক্লাস, বারোটা নাগাদ বেরোলেই চলবে! কলকাতায় আসার পর কলেজের কাছেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে হিয়া, মামাদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ! সাতশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে মা মেয়ের দিব্বি হয়ে যায়! এদিকটায় এখনো বাড়িঘর হয়নি তেমন! দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকদূর অবধি দেখা যায়! ফ্লাস্কে রাখা চা কাপ এ ঢেলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো হিয়া! ছোট্ট বারান্দায় বেতের চেয়ার এ এলিয়ে দিলো শরীর ! চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই পাশে রাখা খবরের কাগজটা টেনে নিলো! কাগজে চোখ বুলিয়েই অবশ্য লাফিয়ে উঠেছে! আনন্দে হাঁকডাঁক শুরু করেছে!সুমেধা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার পাশে! “ কিরে, কি হলো? এতো খুশি যে? “ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিলো সে! “ একবার এটা দেখো মা, আমাদের পাঁচপোতা স্কুলের কাঞ্চনা গড়াই মাধ্যমিকে তৃতীয় হয়েছে এবার! “ আনন্দে হাসছিলো হিয়া! “ কই দেখি , হাত থেকে খবরের কাগজটা কেড়ে নিয়েছেন সুমেধা খুঁটিয়ে পড়ছেন খবরটা! মেয়েটার হাসি হাসি মুখের একটা ছবিও দিয়েছে কাগজে! হিয়া টেবিল এর ওপরে রাখা মোবাইল টার বোতাম
টিপলো ! এখুনি একবার স্কুলে ফোন করতে হবে!

ক্লাস সেরে তাড়াহুড়ো করে বেরোলেও ট্যাক্সি পেতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেলো! ঘড়ির দিকে তাকালো হিয়া! নাহ, সময়মতো পৌঁছনো যাবেনা আজ! গাড়িটাও আটকে রয়েছে জ্যামে! ঝকঝকে দিনটা বিস্বাদ হয়ে গেলো! ভিড়ভাট্টা সামলে হিয়া যখন পৌঁছলো তখন মূল অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে! আজ মাধ্যমিকের কৃতি ছাত্রদের সংবর্ধনা দিচ্ছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ! তাই প্রেস , মিডিয়ার গাড়িতে ছয়লাপ চারদিক ! হল এ ঢুকেই কাঞ্চনাকে দেখতে পেলো হিয়া! ভীরু পায়ে নেমে আসছে স্টেজ থেকে! কেমন যেন কাঁটা হয়ে আছে মেয়েটা! বড়ো মলিন , বড়ো বিবর্ণ দেখাচ্ছে আজ কাঞ্চনাকে! হাত নেড়ে ডাকলো হিয়া! ডাক শুনে মুখ তুলে তাকিয়েছে মেয়েটা! নিমেষে উধাও অপ্রতিভতা , উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ! হিয়া ভিড় ঠেলে আবার এগোবার চেষ্টা করলো! কিন্তু তার আগেই সহস্র ক্যামেরার আলো ঠিকরে পড়েছে মেয়েটার মুখের ওপরে! “ কি হতে চাও তুমি? কি নিয়ে পড়াশুনা করার ইচ্ছে তোমার? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? “ প্রেস মিডিয়ার লোকজনের বৃত্তে এই মুহূর্তে একা দাঁড়িয়ে কাঞ্চনা!

”ইতিহাস নিয়ে পড়বো আমি! গবেষণা করতে চাই ইতিহাস নিয়ে! ইতিহাস না জানলে দেশকে জানা যায়না , দেশকে ভালোবাসা যায়না!;; দূর থেকে দেখছিলো হিয়া! বিবর্ণতা , মলিনতা ভেদ করে বেড়িয়ে আসছে প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বের বিভা ! কি অপূর্ব সুন্দর, কি কাঙ্খিত এই মুহূর্ত! অবরুদ্ধ আবেগে কেঁপে উঠছিলো হিয়া!

বৃষ্টি নেমেছে হঠাৎই! বাড়ি ফেরার পথে ট্যাক্সিতে বসে চোখ বুজলো হিয়া! অপার্থিব এক সুখ জাগছে প্রাণে ! সার্থকতার এক অনির্বচনীয় আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে ! গাড়ির কাঁচের ওপরে বৃষ্টি পড়ছে অবিশ্রান্ত ! আজ বুকের ভেতরেও অবিরাম অশ্রুপ্রপাতের শব্দ পাচ্ছিলো হিয়া! কান পেতে শুনছিলো সেই অশ্রুধারার শব্দ!

 

 

 

 

 

 

তথ্যসূত্র ও অনুপ্রেরণা –

The Last Queen Of India- Michelle Moran
Feast Of Roses- Indu Sunderasan
Marva Collins’ Way- Marva Collins and Civia Tamarkin

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত