বহুড়াঘাটের কিসসা
বহুড়াঘাট ঘুমায় না। কবে থেকে তার চোখে ঘুম নেই না সেখতিয়ান ঘাটের নিজেরও অজানা। যদিও খাতায় কলমে ঘাটের আদি নাম বয়ারাঘাট, সে নামে কশ্চিৎ কেউ ডাকে। ঘাট জানে পদ্মার বুকে চরটা জেগে ওঠাতক বহুড়াঘাটের চোখের পাতা পড়ে না। দেশভাগে মুছে গিয়েছে আদি ঘাটের বৃত্তান্ত। কিন্তু বিরাট কচ্ছপ পিঠের মতো চরটা যেই পদ্মার বুকে ভুস করে ভেসে উঠল নতুন করে বাড়ল বহুড়াঘাটের কদর। চর জাগার বছর দুইয়ের মধ্যে আজান সেখের আব্বা কাঁদু সেখ বাল বাচ্চা নিয়ে প্রথমে চরে এসে খুঁটি গেড়ে বসেছিল। আজানের বয়স তখন সাতকি আট। সেই থেকে চরে রক্ত জল গড়াতে দেখা আজান সেখ এখন বহুড়াঘাটের ইজারাদার। রাত গভীর হলে তার ভাবনার কপাটগুলো লকগেটের মতো খুলে যায়।
তার ভাবনার সুতো কেটে গেল ক্যাচর ম্যাচর করে আসা একটি মোটর ভ্যানের হঠাৎ ব্রেক কষা শব্দে। আগন্তুক ভ্যান থেকে নেমে দ্বিধা পায়ে সেন্ট্রিপোস্টের দিকে এগোতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাঁধের উপর জমে থাকা নিঃস্তব্ধতা টুকরো টুকরো করে একটি বাজখাই গলা হাঁক দিল-কৌন হ্যয়?
-ছার, মুই খাদিম। বাজিতপুরের খাদিম মোল্লা।
-ইধার আও।
ঘুমটি ঘর থেকে আজান বুঝল খাদিমের কপালে দুঃখ আছে, পান্ডের পাল্লায় পড়েছে। রাতপাহারার ডিউটি পড়েছে তার। যতই চেনা লোক আসুক না কেন আগাপাছতলা বাজিয়ে নেবে পান্ডে। লোকটার ধান্দাপানি কম। কিন্তু সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে ডিউটি অফিসার, তার কিছু করার থাকবে না। বিএসএফ ক্যাম্প থেকে খাদিমকে অনেকক্ষণ না বেরুতে দেখে আজান ধরে নিল, পান্ডে তাকে নিয়ে গেছে ডিউটি অফিসারের কাছে। ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড দেখিয়েই লাভ হয়নি আজ। তবে কি গরুর কার্ড বা হিসেব নিকেশ নিয়ে গণ্ডগোল? অনেক পরে বেরুল খাদিম, পিছন পান্ডে সঙ্গে ডিউটি অফিসার। মোটর ভ্যান থেকে নামল এক যুবতি। আজান চমকে উঠল, এত গভীর রাতে পিরোজপুর-বাজিতপুরমুখি যুবতি? বরঞ্চ উল্টোতা ঘটে মাঝে সাঁঝে। ওপার থেকে মেয়ে আসে, কারা পাঠায় কোথায় যায় আজান কিছু জানে না। পারের কড়ি নিয়ে বোবা হয়ে যায়। সে জানে বোবার শত্রু নেই, না হলে ঘাটে এক দিনও টিকতে পারবে না। পরক্ষণেই তার হুঁশ ফিরল, এত রাতে বহুড়াঘাটে তো কোনোদিন ছই দেওয়া ভ্যান আসে না। ভ্যান, লড়ি আসে ঠিকই, তাদের পেটে ডাই করা থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পিছমোড়া করে বাঁধা গরু। বস্তার মতো একটার উপর আর একটা প্রাণ। সবাই জানে বর্ডারে গরুর মুখ পুব দিকে। গরুরা কেবল পুব দিকেই হাঁটতে পারে। সাব-অ্যাসিস্টান্ট ইন্সপেক্টর মর্যাদার ডিউটি অফিসার চিবিয়ে চিবিয়ে বলল-এই ব্যাটা ধর, যদি কোনো আভিযোগ আসে মেয়ে ভাগিয়েছিস, তবে কিন্তু তোর ঘরদোর গুঁড়িয়ে দেব। ইয়াবা কেস দিয়ে দেব, কোনো বাপ ছাড়াতে পারবে না। আর শোন প্রতিদিন বাজিতপুর বিওপিতে মেয়েটাকে দেখিয়ে হাজিরা দিয়ে আসবি। পান্ডে-
-স্যার।
-বাজিতপুর ক্যাম্প মে ওয়ারলেস সে ই মেসেজ ভেজ দো।
-জি স্যার। বাঁধ থেকে ঘাটের দিকে নেমে আসছে খাদিম আর সঙ্গে থাকা যুবতিটি। খাদিমের চেহারা বিদ্ধস্ত। ঘুমটির কাছে এসে সে বলল-চাচা, আইজ পয়সা দিতে পারম না। পরে দিব, ক্যাম্পে রফা করতে সব গ্যাছে গো।
-থাউক রে, তুরে আজ রাতে পারের পয়সা দিতে হবে না। ঘুমটি ঘরের সামনে মাচায় বসেছিল আজান সেখ, সেখান থেকে উত্তর দিল। এটা তার ক্যাশ কাউন্টারও বটে।ভিতরে একটা কম পাওয়ারের চাইনিজ চার্জার লাইট টিমটিম করে জ্বলছে। ওপারে জ্যোৎস্নায় ভাসছে নদী চর। মোম জ্যোৎসায় মেখে আছে যুবতীর চোখ দু’টি। যুবতির চোখে চোখ পড়তে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে গেল আজান। তার মনে হল সাক্ষাৎ জিন নেমে এসেছে বহুড়াঘাটে। তার ঘোর আর কাটে না, তবে কি সে ঠিক দেখল? ছোটবেলায় আব্বা কাঁন্দু সেখ বলত, জোছন রাতে চরে দলে দলে জিন আসে পদ্মার টলটলে পানিতে নাইতে। নাওয়ার আগে তারা ন্যাংটা শরীরে চরের বালিতে গড়াগড়ি খায় আর নিঝুম রাতে খিলখিল করে হাসে। জিনের ছোঁয়াবে চরের মাটি উর্বর হয়ে যায়। চর মাঠের জল নেমে গেলে শুধু কলাই ছিটিয়ে দিলেই হল, লকলক করে ওঠে সবুজ ডগা। চাষের খরচপাতি প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। একবার কলাই তুলতে পারলে পাক্কা দুই তিন বছরের খোরাকি ছিল নিশ্চিত। আর এই কলাই ক্ষেত নিয়েই যত ঝামেলা। গ্রাম থেকে ঝেটিয়ে আসত মানুষ, ঘোষেরাও আসে রানিকুঠি থেকে। আগে চরের সবুজ ঘাসে পাল পাল গরু চড়িয়ে খুশি থাকত তারা। তারাও চরের হিস্সা চায়। দখল যার চাষ তার। সে এক যুদ্ধ বটে, দখলের জন্য সারা বছর ঘরের চালায় ওত পেতে থাকত তলোয়ার, রামদা।বা মুঙ্গেরের দোনালা পাইপগান। কত যে লাশ শুয়ে আছে চরের মাটিতে। আজানের বুকের মধ্যে ধপাস করে উঠল। সেজ ভাই কাইজার শুয়ে আছে ঘাসের নিচে। হয়তো কিলবিলে পোকা মাংসশূন্য করে হাড় খশিয়ে দিয়েছে দেহের। আজকাল খুন খারাবি কমে গেছে, বিডিও অফিস একটা অলিখিত ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছে চাষের চর। অনেক দখলদার। আয়ের পরিমান কমে এসেছে। আজানের মাথায় ফিরে এল জিন, জিন তো অদৃশ্য জীব। জিন অগ্নিদেহী, খোদ আল্লা নির্ধূম অগুনশিখা থেকে সৃষ্টি করেছে তাদের। কিছু ভাল, কিছু খারাপ। শয়তান ইবলিসও জিনদের একজন কিন্তু আগুনে গড়া ইবলিসের প্রচন্ড দেমাক, সে মাটির গড়া আদমের প্রতি সিজদা করবে কেন? কিসের বশ্যতা স্বীকার? সে তো আল্লার প্রতিদ্বন্দি। লুকিয়ে লুকিয়ে বেহেস্তে প্রবেশ করে আর প্রতিবার উল্কাপাতের মতো নিক্ষিপ্ত হয়।ইবলিস জানে তার ক্ষমতার কথা। কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে আদমের বংশধরের সঙ্গে সর্বাত্মক শত্রুতা। কিছু জিনের পুণ্য করে স্বর্গে যাওয়ার বাসনা আছে। প্রতিবার চরের মাটি উর্বর করে যায় তারা। তবে কি তাদের কেউ নেমে এল খাদিমের ঘরে? না ঘাড়ে চেপেছে কালা শক্তি? আজান তাকিয়ে দেখল যুবক যুবতি পদ্মার শাখা নদী পার হয়ে গেছে। নদীতে পাশাপাশি বসানো নৌকার উপর বাঁশের চালি পথটুকু পেরুতে বেশি সময় লাগেনি। চরের পথ উজিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার যেতে হবে বাজিতপুরে, তাদের পায়ে তাড়া। আজানের চোখের সামনে তারা আস্তে আস্তে চরজ্যোৎনায় মিলিয়ে গেল।
-ও আজানভাই, ছুন্যা মাঠের দিকি হা করিং তাকাই আছু ক্যানে। জিনে ধরছে নাকি? ভাব গতিক তো ভালা দেকি লাই।
ধরা খাওয়া মানুষের মতো সে থতমত খেয়ে বলে উঠল-কে-এ-ডা, কেডা?
-কান্ড দেখছু, চিনতেও পারছ না?
-ও নাজু, তা ক’ডা গ্যালো?
-লে হালুয়া, ঔন্য দিন যে ন্যাজ মাথা গুনং গরু পারের পয়সা লও।
-সব দিন কি মন মেজাজ এক থাকে নাজুভাই? রাইতে ঘাট বাও বাতাসে পোহরে পোহরে রূপ পাল্টায়। এক একজন ধুরের রাত কিসসা ছুনলে তুমার চুল খাঁড়া হয়া যাবে মিয়াঁভাই। আজ রাইতে চরে জিন নামছে গো। জিন!
-হা হা। যা তা ক্যুহ্যারা দেকছি, জিনের পিছা ছুইট্যা কাম নাই। এই ধরো তুমার পারের কড়ি। বলেই সে আজান সেখের হাতে তিনশো টাকা গুঁজে দিয়ে ফেয়ার ওয়েদার ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটা লাগাল। ক’টা গরু গেল তার হিসেব তার মাথায় এল না। অন্য রাতে গরু প্রতি পঞ্চাশ ষাট টাকা করে ভাড়া নেয় সে। সবই অলিখিত। রাতে ঘাটে লেখা আইনের বালাইনেই। পঞ্চায়েত সমিতির নির্ধারিত মানুষ, মোটর সাইকেল পারাপারের মূল্য তালিকা আছে। কিন্তু রাতের রহস্য পারাপারের কোনো নির্ধারিত মূল্য নেই, অলীক মূল্যে বিকোয় ঘাটের রাত। ধারে কাছের কোনো বাড়িতে গরুর চটি। ফরিয়ারা গরু কিনে এনে জমায় চটিতে। আর অদৃশ্য মালিক আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ে, থানা পুলিশ বর্ডার বশ মেনে যায়। বর্ডারে সিগনাল হলে সবার চোখে লেগে যায় ঠুলি। প্রতীক যুক্ত গরু-কার্ড চলে যায় ধুরদের হাতে। আসমান সেখের প্রতীক যদি কচ্ছপ হয় তো জগা ঘোষের কার্ডে আঁকা সোনার হরিণ। ধরতে গেলে যায় না তাদের ধরা। ছিটকে ছিটকে যায়। থানা পুলিশ বিএসএফের হিস্সা না মিটিয়ে গরু পাচার হল চোরাই মাল। গরু তো আর চুরি করা না, চাষি দাম পায়, কিন্তু লাইন ক্লিয়ারের পয়সা ফাঁকি দিয়ে নদীর ওপারে নিতে পারলেই অনেক লাভ। ধুরের পকেটে চলে আসবে জোড়ায় দশ বারো হাজার টাকা আর ওপারের মালিকেরও পুষিয়ে যাবে। ওপারের মালিকের লুকোচুরি নেই, মাল নিয়ে দেশে ফেলতে পারলেই বৈধ। খাদিম যাওয়াতক তার ভাবনাটা এলোমেলো বইছে, সে ভাবল ছেলেকে ডাকবে এবার। বাকি রাতটুকু ছেলে জাগবে। ঘাটে কাঁচা পয়সার কারবার, বিশ্বাস করে লোক রাখতে পারে না। দিনে প্রয়োজনে কখনও সখনও বিবিকে ডাকে ঠেকা দিতে। দিনে তেমন চাপ কোথায়, সবে তো দু’টো গ্রেমের বাসিন্দাদের পারাপার। আজান উঠে নদী পাড়ে গিয়ে সবে পেচ্ছাপে বসেছে তখনই গুমগুম করে হাড় কাঁপানো চার পাঁচটা তেজি বাইক বাঁধে এসে থামল। পান্ডে হাঁক দিল-সাবধান। কৌন হ্যয়?
-আওলাদ গাজি আউর উনকা আদমি। দলের একজন উত্তর দিল।
-সব লোগ পহেলে ইধার আও।
আওলাদ গাজির নাম শুনেই আজানের পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি ফিরে ছেলেকে ডাকল-শুকুল, এই শুকুল, উট্। উট্ শিগ্গর।
শুকুল ধড়ফড়িয়ে উঠে বাইরে এল-কি হছে আব্বাজান?
-কারা যনি আইছে।
ছেলে একটু বিরক্ত হল-বোশাখথাকি ঘাট পাওয়ার পর থাইক্যা নোজ রাইতে তো দেখি কত ধরণের নোক আসে আব্বা। লতুন কী হল?
-লতুন কিছু না, তবি আওলাদ গাজি নিজে তো এতো রাইতে ঘাটে আসে না। তার কারবারের নোকেরা আসে। কারবার করে, পারের পয়সা দেয় কখনও?
ছেলের মাথায়ও চিন্তা ঢুকে গেল। লোকটা ইবলিসের চেয়েও বড় শয়তান, সবাই জানে। লোকটাও বেহস্ত, দোযখের সব খবর জানে। আগে ছিল ঘাটের ইজারাদার। ঘাটের জোরে প্রসার প্রতিপত্তি। থানা নেতা বিএসএফের সঙ্গে চাম উকুনের মতো লেপ্টালেপ্টি।
আওলাদ তার ফোর মাস্কেটিয়ার্স কালু, ন্যাপা, কুদ্দুস, জলুকে নিয়ে নেমে এল ঘাটে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দলটা বাপ ছেলেকে ঘিরে ধরে ঠেলতে ঠেলতে ঘুমটির মধ্যে ঢুকিয়ে আওলাদ চাপা গলায় বলল-এই চোদনা, কোন সাহসে ঘাটের ডাক দিতে গেছিলি?
আজান তোতলাতে তোতলাতে বলল-ক্যান, ঘাটে তো যে কেউ ডাক দিতে পারত। চৈত মাসে তো পঞ্চাইত সমিতি লুটিস দিছিনু।
কুদ্দুস অতর্কিতে তার কান চাপাটি জুড়ে সজোরে থাপ্পর লাগিয়ে ধমকে উঠল-গান্ডু, গাজির মুখে মুখে আবার চ্যাটাং চ্যাটাং করং। গাজিভাই বাদে আগে কেউ ঘাটের ডাক দিছে শালা? পোঁদে মেসিন ঢুকাই সোজা টিপি দিম। পুঁটকি ফাঁড়তে ফাঁড়তে ঘিলুতে আগুনে নাল টোটা গাঁথি থাকবে, কয়া দিনু।
-আব্বে কুদ্দুস, মেসিন নামা শালা। ছুঁচা মারিং একটা টোটা নষ্ট করবি নাকি রে? আমি কী বুলছি ছুন আজান, যদি ঝাড়ে বংশে নির্বংশ না হতে চাস এই মাসের মধ্যে ঘাট ছাড়ি দিবি। বিডিও অফিসে গেয়ি ইজারা ছাড়্যা দিয়া আসবি। তিন চাইর মাসে যা কামাই করার করিং নিছু। ঘাটের পয়সায় মোর পুষা ছাগলেরও দানাপানির খরচ ওঠে না, কিন্তু ঘাট আমার চাই। ঘাটে খোঁচড় রাখতে চাই না, শুদা মোর নোকই থাকবে বহুড়াঘাটে।
আজান কাঁপা গলায় বলল-আমি বাল বাচ্চা লিয়া কী খায়।
-তুই কী খাবি সিডাও মোর কয়া দিতে হবে! আগে তো ধুরের কাম করতি, এর মধ্যে বাবু বুনে গেছ? তউ যখন কছু, তুর গরু মাল পারাপারে মুই পয়সা নিমু না।
ন্যাপা বলে উঠল-দ্যাখ, দ্যাখ, আওলাদ ভাই কেমন দিল দরিয়া সাচ্চা মানুষ। এক কথায় তোর পারাপারে হগল পয়সা মকুব করে দিল। সারা জীবন কতটাকা খারিজ হয়া যাবে ভাবতে পারছস? পাপ করলি তুই তউ নসিব খুলং গেল। এই ব্যাটা, আর চুদুরবুদুর করিস না।
আওলাদ তাগাদা লাগাল-কইরে চল তুরা, ও শালা ভাবুক অর নসিব নিয়া। বলেই সে হাঁটা লাগাল বাঁধের দিকে। পিছন পিছন সাগরেদরা। হঠাৎ জলু উল্টো দিকে ঘুরে বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে ফিরে এসে ক্যাশ বাক্সটি থাবা মেরে তুলে নিল। চোখের সামনে দিন রাতের আয় চলে গেল কিন্তু বাপ বেটার বুকের মধ্যে আওয়াজ করার জোশ নেই। বাঁধ থেকে গুমগুম শব্দ করতে করতে বাইকগুলি রঘুনাথগঞ্জ-লালগোলা যাওয়া রাস্তা বাদশাহী রোডের দিকে চলে গেল।
পিছনে ঘাট পুরোপুরি অরক্ষিত পড়ে রইল। পারাপারের ভাড়া নেওয়ার কেউ নেই। শুক্ল পক্ষের জ্যোৎস্না ডোবা অন্ধকারে লোক দু’টি হেঁটে যাচ্ছে নীরবে। কিন্তু চর তত নীরব নয়, শিয়ালদের নিশাচর শিকার শেষ হয়েছে। হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। সমবেত ডাকে জড়ো করছে অন্যদের। এবার আশ্রয়ে ফিরবে। নিজের আশ্রয় পিরোজপুরে ফিরতে বাপ বেটার বুকের মধ্য শোঁ শোঁ করছে বাতাস। বাজিতপুর পিরোজপুর দুই সহদর ভাইয়ের মতো পাশাপাশি গ্রাম। চর গ্রামও বলে লোকে। রঘুনাথগঞ্জ দুই নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির বড়শিমুল দয়ারামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে চরে দুই দু’টি স্কুল আছে ঠিকই কিন্তু মাস্টার কী ছাত্র কেউ-ই স্কুলমুখি হতে চায় না। মাস্টাররা পালা করে আসে, খাতাপত্র ঠিক রাখাটাই তাদের দস্তুর। অভিভাবকদের তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। এখানে বইয়ের বিদ্যা শেখার চেয়ে গুপ্তবিদ্যা শিখলে সহজ আয়ের রাস্তা খুলে যায়।আজান আর শুকুল ফিরছে উলটো যন্ত্রণা নিয়ে, তারা একটা চেষ্টা করেছিল চরের চেনা বৃত্তের বাইরে জীবনে ফেরার। রাতের ইবলিস এসে ভাঙ্গনের মখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তাদের স্বপ্ন। মাটির মানুষের বুক ভেঙেই যে তার আনন্দ। বাপ বেটার মুখে রা নেই।বাজিতপুর বিওপির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেন্ট্রি বুথ থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল-কেয়া হুয়া, বাপ বেটা এক সাথ ইতনা শুভা শুভা গাও মে নিকাল আয়া?
আজান সেখ উত্তর দিল-তবিয়াত ঠিক নেহি।
-দো আদমি কোএক সাথ তবিয়াত বিগড় গয়া?
– হ্ ছার। সেন্ট্রির কেমন অবিশ্বাস্য মনে হল, সে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখনই দুই গ্রামের মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে এল, আসসলাতুখাইরুমমিনাননাউম…ভোর বেলার প্রার্থনা বেশি কার্যকারি। ওঠ সবাই।মুয়াজ্জিনদের গলার সুরেলা আওয়াজ শান্ত চরকে আদুরে স্পর্শ দিতে দিতে জল ছুঁয়ে দিল ছুট। সেন্ট্রি দমে গেল, নামাজের সময় ঘাটানো ঠিক হবে না।
যুবেদা বিবি নিয়ম মেনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ঘরেই পড়ে নেয় নামাজ। পুরুষের সঙ্গে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার বহুদিনে ইচ্ছা, ইচ্ছা পূরণ হয় না বলে তার মেজাজ খাপ্পা। ঘরের মিয়াঁকে বহুবার বলেছে অনুযোগের কথা। মিয়াঁর এক কথা, ডাঙ্গার নিয়ম কানুন চরে চলে? মেয়াছালে মসজিদে যাবে ক্যামনে। ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে বাপ বেটাকে এক সঙ্গে দেখে ভূত দেখার মতো আঁতঁকে উঠল- হায় আল্লা-আ, ঘাট ছাড়্যা দুই জনই এ্যাক সাথি চলিং আলা?
শুকুল নিজের মুখে আঙুল চাপা দিয়ে মা’কে চিল্লাতে বারণ করল-আম্মা, আগে ঘরে লও সকল কুথা বুলছি।
শোনাতক যুবেদা বিবিকে যেন কালা হাওয়া চেপে ধরেছে, আতঙ্ক ছাড়ছে না। মিয়াঁ ঘাটের ইজারা পাওয়ার পর থেকে তার মধ্যে এক ধরণের নিরাপত্তা বোধ এসেছিল। এখন কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে ফিসফিসে গলায় বলল-বিয়ার পর থাকি ভয়ে ভয়ে ঘুমাতি যাতাম, কাম থাকি নির্বাদে মিঁয়া বাড়ি ফিরবে তো? কুত রাইত ঘুমাতি পারি লাই গো। নোজ ভাবিনু পোলা যনি আজান মিয়াঁর মতন ধুর না হয়। আগির দুই তিন মাস পেরাণ ভরি ঘুমানু, সব থাকি ভালা নাগে, পাড়া পোতিবেশি বাজিতপুর পিরোজপুরের মানসি মুরে যখুন ইজারাদারের বিবি বুলে ডাকে। ভেতরি ভেতরি গব্ব হইত গো।
বাপ বেটা বেহুঁশ মানুষের মতো শুনছে।যুবেদা বিবিএকটু দম নিয়ে মরিয়া হয়ে বলল-আওলাদ গাজি শাসাইল আর বাপ ব্যাটা ঘাট ছাড়ি সুড়সুড় করিং চল্যা আলা? দ্যাশে আইন কানুন কিছু লাই নাকি?
-গাজির সঙ্গে-ই পাঙ্গা দিবার ক্ষমতা আমাগে আছে? কোট কাচারিতে যাবার আগিই তো আমাগে বালিতে পুঁত্যা দেবে। বিবি, অফিস আদালত সব অর কেনা।
-তালে ওই চালানের কাম আবার করবা? তুমারি পদ্মা-ই খাবে গো। পদ্মা মা’র পানিতে বেশি দিন ওনাচার করলি কাল সইন্দ্যার মতন পানির তলে টানি নিয়া যায়। পদ্মা তো জিন পরির মতন জাগ্রইত দেবী।
আজানের বুকের মধ্যে ছলাত করে উঠল। পদ্মার পানিযেন কুহক অতলের নিশি ডাক।চরের মাটির উর্বরতা কমেনি। কিন্তু চর এখন বহু মালিকের সরাইখানা। মাথাপিছু জমির পরিমান কমে এসেছে, যত কলাই চাষের থেকে আয় কমছে ততই বেড়ছে পাচার নির্ভরতা। আজান জানে পাচার মালিক হওয়ার টাকা বা ক্ষমতা কোনোটাই তার ছিল না। তার কাজ ছিল নদীর আশেপাশের চটিতে রাখা অদৃশ্য মালিকের গরু পারাপার।ভিতরে ভিতরে পাপ বোধ কাজ করে কিন্তু যাবে কোথায়? চরের রহস্য ঘিরেই তো শ্বাস। বাহুড়াঘাট দিয়ে বয়ে গেছে শাখাপদ্মা, আবার গিয়ে মিশেছে মূল পদ্মায়। পুব দিকে নদীর মূল ধারা। চরটার মালিক দুই দেশ, ভারত বাংলাদেশ। বাংলাদেশি গ্রাম বেলতার পশ্চিমে বাজিতপুর-পিরোজপুর। মাঝে কাঁটাতারের বেড়া নেই। শুধু পিলারের এপাশ ওপাশ, দুই পাশে দুই দেশ। বাজিতপুর, বেলতলায় কার্বাইন হাতে অষ্টপ্রহর পাহারা দেয় বিএসএফ, বিজেবি। বেলতলার গা বেয়ে গেছে যুবতি পদ্মা। যেমনি তেজ তেমনি তার ভুবন মোহিনী রূপ। বেলতলার মানুষের জীবন বাঁচে ভারতের চাল তেল নুন কাপড়ে, বাকি রসদ আসে ওপার থেকে। পদ্মার বুক উজিয়ে চর বাসিন্দাদের যেতে হয় ওপারে বাংলাদেশের বাখরালিতে। নবাবগঞ্জের বাখরপুর, জহরপুর বা বাঘডাঙ্গায় হাট বাজার। দেশভাগের আগে বাহুরাঘাট থেকে খেয়া গিয়ে থামত বাখরালির ঘাটে। এখন আজানরা পাশাপাশি বাঁধা গরুর লেজ ধরে সাঁতার লাগায়, পা ধরে টানে ফরাক্কা থেকে নেমে আসা পাগলা স্রোত। লেজ ধরে খোদার কাছে নির্বিচ্ছিন্নভাবে মোনাজাত করে, আল্লা পার করয়্যা দাও।আল্লা পার করয়্যা দাও।ওপারে পৌঁছাতে পারেলেই ভাবে,আল্লা মেহেরবান। পিছনে হয়তো টুক করে খশেযায়কারো হাত,অতলতলে কেবলই ঘুল্লি খায়, আর ঘুল্লি খায়। জলের পির খোয়াজ খিজিরের পোষা মাছেরা মেতে ওঠে খাদ্য উৎসবে। জলের নিশি গভীরে সাঁতার কাটে রূপচাঁদা মাছের ঝিলিক। খাদ্য উৎসবে তারা মাতোয়ারা।আজানের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল জলের ঘুল্লি।
আজান বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল- মনের আনন্দের কুনোদিন গরু পার করছি বিবি? পরাণডা গামছায় বাঁন্দি কাম করতাম।ধুররা হয় বুলেটে যায়, নলি পদ্মা খায়। সরকার বুঝেও বুঝে না, গরু ও দ্যাশে না গেলে চাষিরা জলের দামেও দামড়া ব্যাচার বাজার পারবে না। চালান বৈধ করিং দিলা এ্যাতো জীবন যাইতই না। মোরা কাম পাতাম না ঠিক কিন্তু নোভও হইত না। নিশুত রাইতের কালা নোভ সারাখন ডাকে আয়, আয়।
-মুই কিন্তু গরুর ন্যাজ ধর্যা লদী পারাতে পারম না আব্বা, কয়ে দিলাম।
-না রে বা’জান না, পালা। যেদিগে পারস পালা।এই কাছিম পিঠ থাক্যা পালা। রাজমিস্ত্রির জোগালদার হয়ে ছহুরে যা। মুই তো একটা চেষ্টা করিং গাজির গিরায় ফাঁসি গ্যালাম।
-আল্লায় সুখ দিলা না, সবাই মোরে ইজারাদারের বিবি বলি ডাকত। আবার সবাই কবে ধুরের বউ। হাসবে সবাই। এক ধমকানিতেই তুমরা বাপ ব্যাটা ক্যামনেই সিঁধায়ে গ্যালা। ঘাট তো বিএসএসের জাগায়, তাগো নাকের ডগায়। হ্যাগো কোনো জোর নাই?
-দ্যাখো বিবি, সব ঘটনাটা তো অগো চুখের সামনেই হইল, এ্যট্টা দাবরি দিলেই গাজি বুঝত গরীবনোকের পেছনেও বাপ আছে।
যুবেদা বিবি হঠাৎ করে উচ্ছসিত হয়ে উঠল-ছুনো, ছুনো মোর এট্টা কথা মাথায় আলো, ওই যে কমাউন্ডান্ট সাব দলবীর সিং আছে না, আরে যার ভয়ে বিএসএফ বাবুরা পেরায় মুত্যা ফেলায়। তারি কলে ক্যামন হয় গো। নোকটা নাকি ভালা মানুষ। উপুকার করতে চালি জান দিয়া করে।
যুবেদার কথায় যেন একটি আশার গোল্লা ছুটে এল। সত্যি অ্যাসিস্টান্ট কমান্ডান্ট দলবীর সিং অন্য ধাতের মানুষ। বাদশাহী রোডের পাশে খান্দোয়া ক্যাম্পে তার অফিস, মাঝে সাঁঝে আসে বাহুড়াঘাট, বাজিতপুর বিওপি পরিদর্শনে। এলে সেদিন মাল পারাপারের সব রাস্তা বন্ধ। এমনকি বেলতলা ঘাটেও ভিড়বে না লুকিয়ে আনা ইয়াবা বা সোনার বাট ভরা নৌকা। এপার থেকে যাবে না পোস্ত, পাতা বিড়ির খোলে ভরা গাঁজা, ফেন্সিড্রিল। হ্যালোর যুগে সতর্কবার্তা পৌঁছে যাবে এপার ওপার।
আজান বলল- জানো বিবি, নোকে তারিকয় জলভেলা। রাত লাই দিন লাই সময় পালেই পদ্মার বুকে ভাসি থাকে, সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটতে কাটতে খান্দোয়া ক্যাম্প থাকি পদ্মা পারায়ে ভুস করি ভাসি উঠে নাড়ুখাকির কান্দায়। নাড়ুখাকি, জ্যোতবিশ্বনাথ, হাতাপাড়ার মতো তিন তিনটা ইন্ডিয়ার গেরাম বাংলাদেশের গায়ে মৌচাকের মতো ঝুলি আছে না, ওইখানে।নাড়ুখাকি বিএসএফ ক্যাম্পে যখন তখন হাজির হয়ে যায় সাঁতারি, ভিজা জামা কাপুড় পরি। সিপাইরা সারাবেলা তটস্থ থাকে। নোকটা নাকি ভাসতি ভাসতি দুঃখ ভাসায় পানিতে। অর বাড়ি নাগাল্যান্ডে, সিখানে খরাসোতা নদী ডোয়াং না কী য্যেন নাম, তাতি ভাসি গ্যাছে তার ছোট বুন। তারি খুঁজতি খুঁজতি কখন যে সে সাঁতারু বনি গ্যাছে। সাঁতারি দিল্লীর পুরুস্কার পাইছে। গাঁয়ের সব নোক জানে তার কাহিনি। তারা ভাবে, পদ্মার পানিতে এ্যাখনও বুনরে খোঁজে দলবীর।
-মুই তো অত কতা জানি না, পাচারকারিরা ভয় পায় আবার সুনামও করে আড়ালে আবডালে। যুবেদা বলল।
-তুমি কতাডা তো ভালোই ক’ছ, কিন্তু কমাউন্ডান্টের ধারে কাছে কেডা যাবে, যা মেজাঝি সায়েব। ঘাটে আলিই তো মুই জামা কাপড়ে ছেউরায়া ফেলি আর কী। তবে লোকটার দিল সাচ্ছা, বাজিতপুর ক্যাম্পে আসার সময় ঘাটে নামিই জিগাত, ক্যায়সে হ্যয় আজান?
-তবে এ্যাকবার খান্দোয়া ক্যাম্পে যাও না ক্যেনে মিঁয়া।
-তুমি আমার সঙ্গে যাবা? মুর মুখ দিয়া কিছু বারাবে না গো। সব ভুল্যা যাম।
-হায় হায় আল্লা! নামাজ পড়াতে বিবিরে মসজিদে নিতি পারো না তারি লিয়া যাবা ক্যাম্পে! বাড়ির মেয়াছেলারে ক্যাম্পে কেউ নেয়? মোর জন্ম এই চরে, চারি দিকে লদী ঘেরা এই দ্বীপের বাইরে মুই কিছু চিনি না, মরমুও এই চরে। হাঁস মুরগি পালা ছাড়া মুই কোনো কতা শিকছি, গুছাই কতা কওয়া তো দূরের কতা।
-মানসে কয়, সিং সাব নাকি একমাত্র মেয়া গো কতা মুন দিয়া ছুনে। সব মেয়া গো মা বুনের চুখে দেখে। কম বয়সী মেয়েরা গেলে চুখ নামাই রাখে, চুখের থাকি পানি গড়ায়। হ্যের তখন বুনডার কতা মুনে পড়ে পরাণডা খাক হয়ে যায় গো।
-মুই কই কী, তুমি ঔন্য অল্প বসী মেয়া খুঁজই নেও।
যুবেদার কথায় আজানের মাথায় এল রাতের ঘটনা। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো তার অবস্থা। এক চিলকে আশা উঁকি দিল। রাতেই দেখেছে তাকে, সে যে নয়জিন পরি। ভাল কাজ করে নিঃসন্দেহে বেহেস্তে ফিরে যেতে চাইবে। পরক্ষণে তার মাথায় প্রশ্ন এল, আগ্নিদেহী জিন এখন চরের মানষের ঘরে আছে তো? রাতে দেখা মেয়েটা আলেয়া নয় তো? চরে বার মাস জিনেরা ঘুরে বেড়ায়, অদৃশ্য তাদের বিচরণ। চোখে দেখা মেয়ে মানুষই বা কি করে জিন হবে? না না, তবু সে যাবে।
বেলতলা ফুঁড়ে সূর্য খানিকটা উঠেছে। খাদিমের বাড়ির মাথায় সৌর প্যানেলে বসে এক জোড়া পায়রা মাথা নাচিয়ে নাচিয়ে ডাকছে, বক বকুম্ বক বকুম্। খাদিমের দরজা তখনও খোলেনি। আজান সেখ ইতস্তত করছিল, দরজায় কড়া নাড়া ঠিক হবে কিনা। যুবেদা বিবির সবুর সইছিল না, সে বলল-প্যাটে খিদা মোগো, ডাকো না ক্যেনে, যা ভাবে ভাবুক গো। একাধিক বার কড়া নাড়ার পর ঘুম চোখে বিরক্ত মুখে লুঙ্গি গুছাতে গুছাতে খাদিম দরজা খুলে হতবাক-ও চাচা! আসি ভালই করছু। গেরামের নোকেরা কলো, মুইও ভাবলাম ঘরে পরের ঘরের মেয়া থাকলে সবাই কী কবে? আব্বা কাজি ডাকি আনল, রাইতেই কলমা পড়াই দিছে, আমাগো সাদি হয়ে গ্যাল। তুমি চরের গইন্য মাইন্য নোক, তুমারে রাইতে খবর দিতে পারিনু। ভারি অন্যায় হয়ি গেছে গো ইজারাদার চাচা।
-খুব ভাল কাম হইছে আব্বাজান। মোরা আইনু বড় বেপদে পড়ি।
খাদিম উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল-কী হইছে গো চাচা?
-আওলাদ গাজি…। সব শুনে খাদিম বউকে ডাকল-পরি, পরি এ্যাকবার বারান্দায় আসো, ইজারাদার চাচা কী কয় ছুনো।
পরি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওড়নার আলুথালু হিজাব মাথায়নত মুখে সে বলল, আমি ঘর থেকে সব শুনেছি চাচা। খাদিম মিয়াঁ আমার জীবন বাঁচিয়েছে। না হলে কোথায় ঠাঁই হত আল্লা জানে। আর রাতে আপনি আমাদের বিনা পয়সায় নদী পাড় করেছেন। আমি খান্দোয়ায় যাব। দলবীর সাহেব কোনো কারণে রাজি না হলেও ঘাট মোরা ছাড়ব না চাচা। আপনার ঘাট মানে পুরো দ্বীপের মানুষের ঘাট, তাদের ইজ্জতের প্রশ্ন। দ্বীপের মানুষ অন্য পেশায় বাঁচার স্বপ্ন দেখবে আপনাকে দেখে। প্রয়োজনে আমরা চরের সবার ঘরে গিয়ে বুঝাব, ঘাট আমাগো।আমরাই পাহারা দেব।
আজানের কানে আর কোনো কথাই যাচ্ছে না। সামান্য হিজাবের আড়ালে নববধূকে দেখেই তার আবার মনে হল, সাক্ষাৎ জিন পরি। বনদেবী চরে এসে রক্ত মাংসের রূপ ধারণ করেছে, সে অসীম ক্ষমতাময়ী। তার ছোঁয়াবে চরের মাটি সোনা হয়ে উঠবে।আজান মিয়াঁ ছেলেকে দাবড়ি দিল-হাঁদার মতন খাঁড়াইয়া কী দ্যাখছস রে বেটা, দৌড় লাগা। যা, গিয়া ঘাট সামলা।
পিতা: নারায়ণ চন্দ্র বাড়ৈ,
শিক্ষা: গণ-প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী।
পেশা: বিশেষ সচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ভারত।
লেখালেখি: লিখেছেন ৭০টিরও বেশি ছোটগল্প, ৫টি উপন্যাস, একটি কাব্যগ্রন্থ, মোট গ্রন্থ সংখ্যা-৮টি। উল্লেখযগ্য গ্রন্থ- দেড়শো গজে জীবন, খোয়াজ খিজিরের গপ্প, ক্ষয়িষ্ণু পুরুষ, মহাল কইন্যা, গাঙ্গুরের নিঃশব্দ জলে ইত্যাদি।
পুরস্কার: শ্রুতিনাটক “কাঁকড়া’র জন্য লেখক হিসেবে পেয়েছেন “আকাশবাণী জাতীয় পুরস্কার” এবং ‘খোয়াজ খিজিরের গপ্প’ গল্পগ্রন্থের জন্য “ কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার”।
থাইল্যান্ড সরকারের আমন্ত্রণে অংশ গ্রহণ করেছেন ‘আসিয়ান ও এশিয়ান দেশের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন ২০১৫”-এ।