| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

ইরাবতী পুনর্পাঠ গল্প : গণনায়ক । সতীনাথ ভাদুড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 20 মিনিট

পূর্ণিয়া জেলার গোপালপুর থানা, আর দিনাজপুর জেলার শ্রীপুর থানার মধ্যের সীমারেখা ‘নাগর’ নদী। পার্বত্য ‘নাগর’ এখানে খুব খামখেয়ালি নয়। তাই তার সোহাগের অজস্রতার ওপর রূঢ় ঔদাসীনা দেখিয়ে আজও দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছে, কাঠের নড়বড়ে পুলটি।

আগেকার যুগে উত্তর বাংলা থেকে উত্তর বিহারে ফৌজ পাঠাবার যে পথ ছিল, তারই ওপর ছিল এই সেতু। সেই রাস্তা এখনও পুলের দু’দিকেই আছে; কিন্তু তার সে জলুস আর নেই। কেবল গত বছরকয়েক থেকে গোপালপুর থানার আরুয়াখোয়ার হাট জমে উঠেছে যুদ্ধ আর যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির দৌলতে_বিহার আর বাংলার মধ্যের বেআইনি জিনিসের কেনাবেচায়। পুলের পশ্চিমেই আরুয়াখোয়ার হাট। এই হাটের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে আর একটা রাস্তা, মালদা জেলা থেকে আরম্ভ করে পূর্ণিয়া, জলপাইগুড়ি জেলা হয়ে একেবারে শিলিগুড়ি পর্যন্ত। অগণিত মালবোঝাই গরুর গাড়ি মালদা, দিনাজপুর আর জলপাইগুড়ি তিন দিক থেকে পুলের সম্মুখে এসে মিলিত হয়। গত বছর হাটের ইজারাদারের কাছ থেকে, বকরিদের আগে শান্তিরক্ষার মুচলেকা নেওয়ার জন্য এসে এসডিও সাহেবের মোটরকার যায় পথে আটকে। তারপর থেকে পথের গর্তগুলো বুজেছে।বাইরের জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ ষোলো মাইল দূরের সুধানী স্টেশন থেকে। চোরাকারবারের কেন্দ্র আরুয়াখোয়া বাজার থেকে পুল পার হয়ে যায় গরু, মোষ, চিনি, ঘি; আর বাংলাদেশ থেকে আসে চাল আর ধান।
হিন্দু মুসলমানের মিশ্রিত জনসংখ্যা। হিন্দুদের মধ্যে অধিকাংশই রাজবংশী। গত বছরের কলকাতা, নোয়াখালী আর বিহারের নানা প্রকার বিকৃত খবর, তাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল ঠিকই; কিন্তু এর চিড়খাওয়া মনও কয়েক দিনের মধ্যে জোড়া লেগে গিয়েছিল। গতানুগতিকতার তাগিদে, পেটের ধান্দায় জোড়াতালি দেওয়া জীবন একরকম কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই পুরনো ফাটল দিয়ে ভাঙন ধরল হঠাৎ।
সুধানী-গোলার জহুরমল ডোকানিয়ার ‘মুনীম’ (গোমস্তা) এক শনিবারের রাতে আরুয়াখোয়া হাটে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। চিনির বস্তাগুলির ওপর ত্রিপল বিছানো। রাতে খেয়েদেয়ে গাড়ি চড়লে আরুয়াখোয়ায় গাড়ি পেঁৗছুবে কাল সকালে। বিড়িটায় শেষ টান মেরে ছোট অবশিষ্টটুকু গাড়োয়ানকে দেন। বিলট্ গাড়োয়ান খুশি হয়ে ওঠে।
‘গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ুন মুনীমজি। একেবারে আরুয়াখোয়ায় উঠবেন। ঘণ্টায় কোশ যায় গরুর গাড়ি, দূরের সফরে। আর ধরুন, রাতবিরাতের জন্য এক ঘণ্টা ফাজিল রাখলাম। সকাল এক প্রহরের সময়, আরুয়াখোয়ায় গিয়ে দাঁতন করবেন।’
মুনীমজি আজকে খুব খুশি আছেন। তিনি যাওয়ামাত্র সকলেই তাঁর কাছে দেশের ‘হালচাল’ জিজ্ঞাসা করে। পথে যার সঙ্গে দেখা হয়, এমনকি কন্সী এলপি স্কুলের গুরুজি পর্যন্ত তাঁর কাছে খবর জিজ্ঞাসা করে। একে অত বড় গোলার লেখাপড়া জানা মুনীম; তার ওপর তাঁর মালিকের বাড়িতে ‘বিজলী’তে খবর আনাবার কল আছে! সেই কলে লাটসাহেব পর্যন্ত ডোকানিয়াজীর সঙ্গে কথা বলেন, কত লোক কত খবর সেখানে দেয়, কত আওরত তাঁকে খুশি করবার জন্য গানবাজনা শোনায়। কাজেই মুনীমজির কথার গুরুত্ব স্থানীয় লোকদের কাছে অনেকখানি।
‘দেখিস রাতে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে কী নিয়ে যাচ্ছিস, তাহলে বলিস, আলু; আলুর বোরাটা সম্মুখে আছে তো?’
‘জি।’
‘আমি পিছনেই শুই চিনির বস্তাগুলোর ওপর। সম্মুখের দিকে চিনির বস্তাগুলো রাখতে পারলে একটু আরামে শোয়া যেত, ঝাঁকানি কম লাগত।’
‘জি।’
‘মীরপুরে একটু সাবধান থাকিস। ওখানকার গ্রাম অ্যাডভাইজরি কমিটির সেক্রেটারি ভারি বজ্জাত। তার ওপর আজকাল দুনিয়াসুদ্ধ সকলে সেক্রেটারি হয়ে উঠেছে, দেখিস না? ওখানে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে আমাকে ডেকে দিবি। ও’ গাঁখানা দিয়ে যাবার সময় চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে যাস্; চুপচাপ গেলেই সন্দেহ করবে। অনর্থক কতকগুলো টাকা খরচ। গাঁয়ের সেক্রেটারির দাম গড়ে টাকা দশেক। মীরপুরেরটাকে কিনতে টাকা পঞ্চাশের কম লাগবে না। সাবধান।’
‘সে আর আমায় বলতে হবে না হুজুর। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি খুব হেপাজাৎ করে চালাব; খানা গর্ত বাঁচিয়ে!’
মুনীমজির ঘুম আর আসে না। যে খবর তিনি নিয়ে যাচ্ছেন, তা শুনলে হাটসুদ্ধ লোক চমকে যাবে। এমন জবর খবর বহুকাল এ মুল্লুকের লেক শোনেনি।… না, চিনির বস্তার পিঁপড়েগুলো আর ঘুমোতে দেবে না। ঐ হাঁদা-গঙ্গারাম বিলট্টা কি বস্তাগুলো তুলবার সময় ঝেড়েও তোলেনি!
‘এই বিলট্ ঢুলছিস নাকি?’
‘না, এই একটু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল হুজুর।’ মুনীমজি জানেন যে এইবার বিলট্ আমতা আমতা করে বিড়ি চাইবে ঘুম ভাঙানোর জন্য।… আর করেই বা কী বেচারি_সারা রাত জাগতে হবে তো?… বিলট্ আবার ঐ ভাসাভাসা শোনা খবরটা পথের লোকদের দিতে দিতে না যায়।
‘এই বিলট্। এই নে, বিড়ি দেশলাই রাখ্। আর আজকের সুধানীতে শোনা খবরটা কাউকে বলিস না যেন।’ বিলট্ এতক্ষণ খবরটি সম্বন্ধে কিছুই ভাবেনি। মুনীমজির কথার পর খবরটা মনে করবার চেষ্টা করে।…
‘না, না, মুনীম সাহেব, সে আর আমায় বলতে হবে না। এতকাল আপনাদের নুন খাচ্ছি, কোনো দিন খবর বলতে শুনেছেন? গরিব মানুষ, আমাদের খবর দিয়ে দরকার কী?’
প্রসন্ন মনে সে বিড়ি আর দেশলাই নেয়। তারপর বাঁয়ের বলদের লেজ মুড়তে মুড়তে তার নিকট আত্মীয়ার উদ্দেশে গালি দিতে আরম্ভ করে।


আরো পড়ুন: সথীনাথ ভাদুড়ীর ছোটগল্পে স্বদেশ বীক্ষণ

মুসহর সাওয়ের দোকানের সম্মুখে গাড়ি পেঁৗছায় প্রায় বেলা দশটার সময়।
‘রাম রাম মুনীমজি!’
‘জয়গোপাল! জয়গোপাল।’
মুসহর সাও আর তার ছেলে, গাড়ি থামবার সঙ্গে সঙ্গে চিনির বস্তাগুলি বাড়ির আঙিনার ভিতর নিয়ে রাখে,_এখনি আবার অন্য লোকেরা এসে পড়বে।…
‘চার বোরা মোটে?’
‘কত ধানে কত চাল, তার তো হিসাব রাখো না। ঐ আনতেই হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। যা দিনকাল পড়েছে, মিলের ছাপমারা বোরার ওপর অন্য বোরা ঢুকিয়ে, ডবল বস্তার মধ্যে কোনা রকমে আনা।’
আলুর বোরাটা দোকানের সম্মুখেই নামিয়ে রেখে, সাওজি বলে, ‘এবার বলুন হালচাল।’
মুনীমজি গম্ভীর হয়ে যায়; প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দাঁতন আনতে বলেন। সাওজি বোঝে, আজ কিছু জবর খবর আছে। একে একে লোক জমতে আরম্ভ করে। বেশির ভাগই দোকানদার; দু-চারজন দূর গাঁয়ের লোক, যারা চালের গাড়ি নিয়ে এসেছে হাটে। অজস্র ‘রাম রাম মুনীমজি’র প্রত্যভিবাদন ইঙ্গিতে সেরে মুনীমজি একমনে দাঁতন করতে থাকেন; ভাবে মনে হয়, সংসারে তাঁর দিকদারি ধরে গিয়েছে! সকলে উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে,_কতক্ষণে তাঁর মুখ ধোয়া শেষ হবে, কতক্ষণে তাঁর মুখের দুটো কথা শুনতে পাবে।… এইবার গামছা দিয়ে মুখ মুছছেন; আবার স্নানের জন্য তেল চাইবেন না তো…।
অন্যদিন হলে সাওজি নিজেই স্নানের কথা তুলত; এখন ইচ্ছা করেই খবর শোনবার লোভে সে কথা ওঠায় না। মুনীমজি বিলট্ গাড়োয়ানকে দুইজনের জন্য দই-চিঁড়ে কিনবার পয়সা দেন।
‘ভাল দেখে গুড়ও কিছু আনিস; চিনি তো আর পাওয়ার জো নেই এক চিমটি, এই যবে থেকে কংগ্রেস মিনিস্ট্রি হয়েছে।’
তারপর মুনীমজি সমবেত লোকদের দিকে না তাকিয়ে, ট্যাঁকে কয়েকটি অবশিষ্ট খুচরো পয়সা গুঁজতে গুঁজতে বলেন, ‘আর কি, দিনাজপুর জেলা তো পাকিস্তান হয়ে গেল।’ কথার সুরে মনে হয় এ একটা সাধারণ খবর, হামেশাই এ রকম বহু জেলা পাকিস্তান হয়ে থাকে। এতক্ষণে তাঁর সম্মুখের লোকদের দিকে তাকাবার অবকাশ হয়। ভঙ্গিতে আত্মপ্রত্যয় ফুটে বেরোচ্ছে; কোনো বিশ্ববিশ্রুত দেশনায়ক সাংবাদিকদের বৈঠক ডেকেছেন যেন।
মুহূর্তের জন্য সকলে নীরব হয়ে যায়। শ্রীপুরের রাজবংশী দর্পণ সিংয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আর সকলের বুক ঢিপ ঢিপ করে_না জানি তার জেলার কী হয়েছে; এইবার বুঝি মুনীমজি তাঁর গাঁয়ের কথা বলবে। সাওজির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে ভয়ে;_তার দোকান, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার! সে সাহসে বুক বেঁধে জিজ্ঞাসা করে_’আর আমাদের আরুয়াখোয়া?’
‘আরুয়াখোয়া তো পূর্ণিয়া জেলা, হিন্দুস্থানে। এ তো আর বাংলামুলুক নয়,_এ হচ্ছে বিহার। এখানে আর কারো টু ফ্যাঁ চলবে না।’
হাটের দোকানদাররা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে। মুনীমজি একসঙ্গে সব খবর বলে ফেলেন না,_আস্তে আস্তে টিপে টিপে খবর ছাড়েন। এতগুলো লোক উদগ্র উৎকণ্ঠায় তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছে, লাটসাহেবের বেতার বক্তৃতার মতো তাঁর কথার দাম আছে এখানে। এই সময়টুকুকে যত টেনে বড় করা যায়,_এই মানসিক বিলাসের মোহ কম নয়।
দূরের হাটুরেরা চালের গাড়ি নিয়ে সকলের চেয়ে আগে আসে। তাদের মধ্যে থেকেও অনেকে এসে জমেছে এখানে।
অছিমদ্দী জিজ্ঞাসা করে, ‘মীরপুর কোথায় পড়ল হুজুর?’
‘মীরপুর কোন জেলায়?’
কাঁদো কাঁদো হয়ে অছিমদ্দী বলে, ‘হরিশ্চন্দ্রপুর থানা।’
সাওজি বলে দেয়_’ও হলো মালদা জেলা।’
‘মালদা জেলা পড়েছে পাকিস্তানে।’
আল্লার এই অসীম করুণায় অছিমদ্দী এত অভিভূত হয়ে পড়ে যে সে আর কোনো কথা বলবার ভাষা খুঁজে পায় না।
বজরগাঁও পোড়াগোঁসাই ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন।… ইনি রাজবংশীদের পুরোহিত। এই এলাকায় এঁর অনেক যজমান আছে। সাওজি উঠে এঁকে খাটিয়ায় বসতে দেন। তাঁর কিন্তু সেদিক খেয়াল নেই। একেবারে মুনীমজির সম্মুখে যেতে যেতে প্রশ্ন করে_’আর বজরগাঁ? তিতলিয়া থানা, জলপাইগুড়ি জেলা?’
‘বাবাজি, আপনি জলপাইগুড়ি জেলার জন্য চিন্তা করবেন না। রামজির আশীর্বাদে ওটা হিন্দুস্থানেই পড়েছে।’
‘পড়বে না? বাপ-পিতাম’র আমল থেকে আমরা রয়েছি বজরগাঁয়। পাকিস্তানে চলে গেলেই হলো! জল্পেশ্বরের এলাকা, মহাকালের রাজ্য, চলে যাবে পাকিস্তানে? বড়লাট ভারি সমঝদার লোক। নারায়ণ! নারায়ণ!
নারায়ণকে প্রণাম করবার সময় অছিমদ্দীর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।
কৌতূহল ও উদ্বেগের মধ্যে এতক্ষণ সকলে তার অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়েছিল। এখন সকলেই তার দিকে তাকানোয় সে সংকুচিত হয়ে পড়ে।… এক কাসেম ছাড়া আর সকলেই তাকে অপরাধী মনে করছে। তার গাঁয়ের আসগর আলী পত্তনিদারই নিশ্চয় চেষ্টা করে তার গাঁ’কে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছে!…
খবরটায় তার আনন্দ হয়েছে এইটুকু তার অপরাধ। তবুও সে বোঝে যে সে এখানে অবাঞ্ছিত। সে কাসেমকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। দূরে তাদের গাড়ির কাছে গিয়ে অছিমদ্দী একগাল হেসে বলে, ‘বাপকা বেটা আসগর আলী পত্তনিদার; কথা রেখেছে। চল্, তাড়াতাড়ি ধান বেচে_যা দাম পাওয়া যায়। গাঁয়ে গিয়ে পত্তনিদারের সঙ্গে দেখা করে শোক্রিয়া জানাতে হবে।’
কাসেম বলে, ‘এখনই ফিরে চল; ভয় করে হাটে আজ এদের মধ্যে।’
‘ধান না বেচলে ওষুধ কিনবি কী দিয়ে? একবার খরচ করে দু’জেলার চাল ধরার পুলিশদের মণ পিছু দুটাকা করে দিয়েছিস। ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হলে আবার ঐ খরচ করতে হবে। এদিকে রোজগারের নামে খোঁজ নেই। এখানে হাজি সাহেব হাটের ইজারাদার। ভয়টা কিসের শুনি? গোলমাল হলে লেঠেল দিয়ে ঠাণ্ডা করে দেবে না!’
কাসেম সাহসে ভর করে ইজারাদারের কাছারিতে যায়_হাজার হোক মুসলমান তো ইজারাদার সাহেব! আগে হলে কাসেমের এ সাহস হতো না; কিন্তু গত বছর বিহারের কাণ্ডের পর মুসলমান আর মুসলমানের কাছে যেতে ভয় পায় না। কাসেম দেখে যে সেখানে আরও অনেকে বসে রয়েছে। সকলেই ইজারাদারকে শাসাচ্ছে। ইজারাদার সাহেব সকলকে শান্ত করেন। দূরের লোকদের তখনই বাড়ি ফিরতে বলেন। চারদিকে হিন্দু বস্তি। সকলে খুব সাবধানে থাকবে। রাতে পালা করে জাগবে। কিষাণগঞ্জ সাবডিভিশন হিন্দুস্থানে গেলেই হলো। এর আমি বিহিত করছি। খবর এখনও সঠিক পাওয়া যায়নি। ঐ মুনীমটার কথায় বিশ্বাস কী?’
কাসেম আর অছিমদ্দীর মনে শেষের কথাটা ছাঁৎ করে লাগে। দুজনেই একসঙ্গে কথাটার প্রতিবাদ করে ওঠে। উপস্থিত সকলে কটমট করে তাদের দিকে তাকায়। তারা তাড়াতাড়ি ইজারাদার সাহেবকে তাদের ধানটা কিনে নিতে বলে_যে কোনো দামে হোক। নিজের ‘মঝবে’র লোকের জন্য ইজারাদার সাহেব নিজের দরকার না থাকলেও তাদের ধানটা কিনে নিতে কর্মচারীকে আদেশ দেন। ‘দরটা ঠিক করে নিও, মাসুম, বুঝলে।’ মাসুম পুরনো কর্মচারী_সে মনিবের ইঙ্গিত ঠিক বোঝে।
ইজারাদার সাহেব সকলকে বোঝান। ‘আরে মিয়া, লাট সাহেবের কথাও বদলায়_ঠেলায় ফেলতে পারলে। আমি আজ রাতেই যাচ্ছি সদরে। পঁচিশ টাকা চাঁদা নিয়ে গেল জেলা পাকিস্তান কনফারেন্সে_সদর সাহেব কত রকমের কথা বললেন, আর চলে গেলেই হলো এ জেলা হিন্দুস্থানে। কেবল কতগুলো টাকা অনর্থক খরচ হবে এই যা।’
হাট আর আজ জমল না। লোকের মুখে মুখে মুনীমজির খবর হাটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সাওজির দোকান লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সকলেই মুনীমজির নিজের মুখ থেকে খবর শুনতে চায়। নানা প্রশ্নে সকলে তাকে উদ্ব্যস্ত করে তোলে। দিনাজপুর আর মালদার হিন্দু হাটুরেরা দলবেঁধে আসে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে। মুনীমজি বাইরের অন্য লোকদের সরিয়ে দিতে বলেন সাওজিকে_কী জানি কোনো মুসলমান যদি থেকে যায় ভিড়ের মধ্যে। মালদা, দিনাজপুরের হিন্দুদের সঙ্গে তিনি অনেকক্ষণ একান্তে কথাবার্তা বলেন। এই বিপত্তির সময় মুনীমজির স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতিতে তারা মনে বল পায়। ও দেশে থাকা আর নিরাপদ নয়; আত্মীয় পরিজনদের বাড়ি থেকে সরাতে হবে। তারা আর অপেক্ষা না করে হাট ভালভাবে বসবার আগেই ফিরে যেতে চায়। আর্দ্রস্বরে মুনীমজি তাদের বলেন যে তাদের এক মুহূর্ত দেরি করা উচিত নয়। তাদের সনির্বন্ধ অুনুরোধে তিনি তাদের সব চাল কিনে নেন_ষোলো টাকা দরে। গত হাটের চালের দাম ছিল উনিশ, কাল সুধানীর বাজারে ছিল বাইশ।
খানিক পরে ইজারাদার সাহেবের সেপাই খবর দেয় যে, তিনি মুনীমজিকে ডেকেছেন। তিনি যেতেই তাঁকে এক আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসান ইজারাদার সাহেব। বেতারের খবর সম্বন্ধে কথাবার্তা হওয়ার পর ইজারাদার সাহেব বলেন, ‘আমার এ হাট এবার গেল। যাক, সে তো বরাতে যা আছে হবেই। এসব তো এখনো অনেক কাল চলবে, এখন কাজের কথা হোক। আজ ক’ বোরা চিনি এনেছ?’
‘এনেছি চার বোরা। এক বোরা সাওজিকে দিতে হবে। তোমার তিন বোরা। এবার কিন্তু সত্তর টাকা মণ।’
‘তাজ্জব কথা! এত দিন ছিল ষাট টাকা, আজ হঠাৎ দাম বাড়ালে চলবে কেন? আর সাওজিকে আধ বস্তা দাও_আমাকে সাড়ে তিন বস্তা। গতবারে যে চিনি দিয়েছিলে, তা ছিল একেবারে ভিজে।’
‘সাওজির তো মোটে এক বস্তা_তার মধ্যেও তোমার পাকিস্তানের দাবি! সে হয় না; ওকে এক বস্তা পুরো দিতেই হবে; কথার খেলাপ যেতে পারে না। আর চিনি ভিজবে কী করে। ত্রিপল দিয়ে ঢেকে আনা। হ্যাঁ, আর দুটো করে পাটের বস্তা যে বিনা পয়সায় পাচ্ছ, তার দাম কি আমি ঘর থেকে দেব নাকি? বললেই হলো ভিজে! তার ওপর মালদা আর দিনাজপুর এখন তো পাকিস্তান হলো। সেখানে এখন তো খুব ক’দিন মোফিল চলবে। ঈদের জন্য চিনিও লোকে এখন থেকেই জোগাড় করবে; আড়াই টাকা সের অনায়াসে তুমি পাবে।’… মুনীম সাহেবের কথার বন্যায় ইজারাদার সাহেবের যুক্তিস্রোত ঘুলিয়ে যায়; থই না পেয়ে মৃদু প্রতিবাদ জানায়। ‘কী যে বলো মুনীমজি; মুসলমানের হাতে পয়সা কোথায়?’
‘আচ্ছা যাও, দু টাকা কম দিও। হ্যাঁ, তবে আর একটা কাজ করতে হবে ইজারাদার সাহেব, আমাকে খানকয়েক গরুর গাড়ি ঠিক করে দিতে হবে। সুধানীর গোলায় চাল নিয়ে যাবে। এখানে অত রাখবার জায়গা নেই। বর্ষার দিন, বাইরে পড়ে রয়েছে। তোমার হাতে আছে অনেক গাড়োয়ান।’
‘আচ্ছা সে হয়ে যাবে সব ঠিক। ভোর রাত্রে গেলেই হবে তো?’
মাসুম এসে খবর দেয় যে হাটের লোকেরা খেপে গিয়েছে। তারা দলবেঁধে কাছারি বাড়ির মাঠে ঢুকছে। তারা মুনীমজিকে ফেরত চায়_আপনি নাকি তাঁকে আর জিন্দা ফিরতে দেবেন না।
বাইরে তুমুল কোলাহল শোনা যায়।
‘লোকগুলো পাগল হলো নাকি’, ভয়ে ইজারাদার সাহেবের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়।
দুজনে একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বাজারের স্থায়ী দোকানদাররা ইজারাদার সাহেবকে দেখে হাটুরেদের সম্মুখে আগিয়ে দেয়, হাজার হোক তাদের জমিদার তো। মুনীম সাহেব এসে ক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করেন। স্বর নামিয়ে সম্মুখের লোকদের বলেন, ‘ওর সাধ্যি কি আমাকে কিছু করার। তোমরা এখনও বাড়ি ফেরনি? আজকালকার দিনে বাড়ি-ঘর ছেড়ে যত কম থাকা যায় ততই ভাল। তোমরা তো সব বুঝি। আমি আর কি শলা দেব! নিজের নিজের গাঁয়ের মোড়লদের সঙ্গে পরামর্শ করে, যা ভাল হয় করো।… মেয়ে-ছেলেদের নিয়েই বিপদ। একটু হুঁশিয়ার থাকবে। আমরা তো সুধানী বাজারেও জানানাদের রাখতে সাহস পাইনি_সব রাজপুতানায় রেখে এসেছি এই মাসে। যন্ত্রপাতির কর্ম, বলা তো যায় না, কী বলতে কী বলে। শালা লাটসাহেবের মুখ ফসকে পূর্ণিয়াটা বেরোলেই তো সব চৌপট হয়েছিল_সাবধানের মার নেই।’…
রাজবংশীদের সরু সরু চোখগুলো ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। ‘পোলিয়া’ মেয়েরা কান্নাকাটি আরম্ভ করে।
‘আর এখন নুন কিনতে হবে না’; ‘ওরে বাচ্চিদাই, কোন দিকে গেলি শিগ্গিরি আয় না’, ‘ওঠ নবাবপুত্তুর, এখনও জাবর কাটছে!’ ‘আজ দাম চাই না, খালি তুমি ওজন করে নিয়ে রাখ’…’এই টাকাটা মুনীমজি আমানত রাখবেন গোলায়, কাছে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না’…
আতঙ্কমুখর পরিবেশ সুস্থ মনকেও দুর্বল করে তোলে। অল্পক্ষণের অস্বাভাবিক কর্মতৎপরতার পরই হাট নীরব হয়ে আসে।
পরের দিন থেকেই আরুয়াখোয়ার রূপ যায় বদলে। আগে সপ্তাহে একদিন হাট বসত_এখন অহোরাত্র ভয়ার্ত নর-নারীর নিরানন্দ মেলা। গাড়ির পর গাড়ি আসছে পুল পার হয়ে শ্রীপুরের দিক থেকে। হেঁটে চলে আসছে দলে দলে মেয়ে, ছেলে, গরু, ছাগল। ছোট ছেলেটির মাথায় পর্যন্ত হাঁড়িকুড়ির বোঝা চাপানো। ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে হাড়জিলজিলে কালাজ্বরের রোগী, একটা বিড়াল কোলে নিয়ে। কাশতে কাশতে চলেছে হেপো বুড়ী_পাকিস্তান থেকে বাঁচতে গিয়ে প্রাণটা বেরোয় বুঝি! এতদিন ছোট্টো ছিল এদের জগৎ। আজ হাটে বিশ্রাম করে কতক যাবে এগিয়ে, শিকারের খেদানো হরিণের মতো অনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। কতক যাবে থেকে; যদি ক্ষেতের কাজ পায়, এই আশায়। পথে খাওয়ার অভাব কি,_এখন তাল পাকার সময়।
পূর্ণিয়া আর দিনাজপুর, দুটো ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মধ্যে কোনোটাই ‘নাগরে’র ওপরের পুলের জন্য খরচের দায়িত্ব স্বীকার করে না। নড়বড়ে পুলটার ওপর খুব ধকল চলেছে আজ কদিন থেকে। পুলের দুদিকে ক্যাম্প পড়েছে। মুনীমজি কলকাতার এক রিলিফ সোসাইটিকে বলে-কয়ে শরণার্থীদের সুখ-সুবিধা দেওয়ার জন্য আরুয়াখোয়ায় একটি ক্যাম্প খুলিয়েছেন। লোকাল বোর্ডে খবর দিয়ে ডাক্তার আনিয়েছেন। সব কাজ হচ্ছে মুনীমজির সহযোগিতায়।
কত লোক মুনীম সাহেবের ক্যাম্পে সুখ-দুঃখের কথা বলতে আসে। তিনি কাউকে আশ্বাস দেন, কাউকে রামজির শরণ নিতে অনুরোধ করেন, কাউকে ধৈর্য ধরতে বলেন; কারও কাছে বা কংগ্রেস সরকারের দুর্বলনীতির নিন্দা করেন। তারপর রিলিফ কমিটির চিঁড়ে-দইয়ের স্লিপ কাটতে কাটতে বলেন, ‘কজন? পাঁচ; এক বাচ্চা? আচ্ছা ঐ ঝাণ্ডাওয়ালা তাঁবুতে মোহর করিয়ে সাওজির দোকানে নিয়ে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কৃতজ্ঞতায় শরণার্থীর মন ভরে ওঠে_এই বিপদের সময় মিষ্টি কথাই বা কজন লোক বলে!
পুলের ওপারে রেলিংয়ের ওপর লাগানো হয়েছে সবুজের ওপর চাঁদতারা দেওয়া লীগের ঝাণ্ডা; পুলের এদিকে দেওয়া হয়েছে কংগ্রেসি তিনরঙা পতাকা। ওদিকে একদল চিৎকার করে, ‘লে লিয়া হ্যায় পাকিস্তান’, ‘বাঁটগেয়া হ্যায় হিন্দুস্থান’; এদিকের দল চ্যাঁচায় ‘বন্দে মাতরম্’, ‘জয়হিন্দ্’।
তিক্ত উত্তেজনাময় আবহাওয়া সৃষ্টি হতে দেরি লাগে না। এই বুঝি কোনো কাণ্ড হয়, হয়! এদিকে গুজব ওঠে যে ওরা পুলে আগুন লাগিয়ে দেবে_যাতে জিনিসপত্র নিয়ে ওদিক থেকে আর কেউ না আসতে পারে। অমনি এদিককার লোক গর্জে ওঠে, ‘এদিকের গরু-মোষ আর যেতে দেব? আমরাই আগে পুলে আগুন ধরাব।’ এপারের লোকদের মুনীমজি ঠাণ্ডা করে; ওপারের লোকদের করে ইজারাদার সাহেব_পুল গেলে হাট থাকবে কোথায়_
মুনীমজি তাদের বোঝায়, ‘দুদিন সবুর করো তো। দেখো না কি হয়। মহাত্মাজি কী আর চুপ করে বসে আছেন? লাটসাহেবকে দিয়ে ‘কমিশন’ বসিয়েছেন। হেঁজিপেঁজি লাট নয়, খানদানি লোক, রাজার বাড়ির ছেলে।’
সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে যাও সকলের মুখেই ঐ একই কথা, ‘কমিশন’, ‘কমিশন’।
শ্রীপুরের চুয়ালাল রাজবংশীর বুদ্ধিমান বলে খ্যাতি আছে। মুনীমজি সব খবর বলে না নাকি; তাই তাকে সকলে চালের গাড়ির ওপর বসিয়ে সুধানী ইস্টিশনে পাঠায় ‘কমিশনে’র খবর আনতে। চুয়ালাল ভয় পাবার ছেলে নয়; সে সোজা পয়েন্টসম্যান সাহেবকে ‘কমিশনে’র খবর জিজ্ঞাসা করে। পয়েন্টসম্যান বলেছিল যে কমিশনের খবর তো বেরিয়েছে। তাদের মাইনে আর ভাতা বাড়বে! শ্রীপুরের লোকেরা এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারেনি।
কমিশন! ইজারাদার সাহেবের পুরনো সেপাই ইসরাইল লাঠি ঠুকে বলে, ‘কমিশন নেওয়া হয় গোলাতে, পাট খরিদের ওপর ‘ধর্মদায়’ বলে। কোনো মুসলমান আজ থেকে আর এ দিচ্ছে না। বের করাচ্ছি কমিশন। আরুয়াখোয়া হাটিয়া হিন্দুস্থানে এলেই হলো!’
দর্পণ সিংয়ের বুড়ো বাবা শুকনো ঊরুতে তাল ঠুকে বলে, ‘এই হাটের তোলা মুসলমান ইজারাদারকে কোনো লোক দিও না। ঘরদোর ও জমিজিরেত ছেড়ে হিন্দুস্থানে এসেছি কি এমনি। সেখানে হিন্দুকে মেয়ে-বেটী নিয়ে থাকতে দেবে না শুনেছি। এখানেও আবার মুসলমানকে তোলা দিতে হবে?’… সে আরও কত কী বলতে যাচ্ছিল, দর্পণের মা তার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যায়… বদলোকদের চটিয়ে লাভ কী?
হাটের তোলা দেওয়া সেইদিন থেকে বন্ধ হয়ে যায়।
মুনীমজি সাওজিকে বলে, ‘দেখছ, ইজারাদার সাহেব আর রাতে এপারে থাকে না। ওদিককার ক্যাম্পের খরচ কি ওই চালাচ্ছে নাকি?’
‘না, চাঁদা তুলে চালাচ্ছে ইজারাদার সাহেব। গোপালপুর থানাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য কলকাতায় কমিশনকে টাকা খাওয়াতে হবে বলে ও আরও অনেক টাকা চাঁদা তুলছে।’
মুনীমজির চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে ওঠে; ইজারাদার সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধায় না ঈর্ষায়, ঠিক বোঝা যায় না।
সাওজি আবার বলে, ‘তা মুনীমজি, আমরাও হাট থেকে কিছু চাঁদা আদায় করে দিতে পারি, গোপালপুর থানাকে পাকিস্তান থেকে বাঁচানোর জন্য। ইজারাদার ভারি ফন্দিবাজ লোক_কমিশনকে আবার টাকা দিয়ে হাত না করে নেয়। আপনি একটু চেষ্টা করলেই আমাদের প্রাণটা বাঁচে, পূর্ণিয়া জেলাটাও বাঁচে।’
মুনীমজি এই হিসাবই এতক্ষণ মনে মনে খতিয়ে দেখছিলেন। তাঁর হিসাবে ভুল না হয়। এখন চাঁদা তুলে যা লাভের সম্ভাবনা, তার অনুপাতে বিপদের আশঙ্কা অনেক বেশি। এক করলে হয় একটি জিনিস, চাঁদা তুলে চুপচাপ থাকা, যদি পাকিস্তানে যায় জায়গাটা তাহলে টাকা ফেরত দেওয়া যাবে, বলা যাবে যে হাকিমদের ঘুষ খাওয়ানো গেল না; আর যদি পাকিস্তানে না যায়, তাহলে টাকাটা নিয়ে বললেই হবে যে কমিশনকে খাইয়েছিলাম।…না, দরকার কি ঝঞ্ঝাটে। যা রয় সয় তাই ভাল।…
‘না না সাওজি, ওসব হাঙ্গামায় আমি পড়তে চাই না। ওর জন্য কংগ্রেস সরকার রয়েছে, মহাত্মাজি রয়েছেন, আমার মালিক রয়েছেন। কিন্তু পুলের দুদিকেই যে মাল আটকাচ্ছে, তার কি উপায় করা যায় বলো। বর্ষার নদী। অন্য সময় হলেও না হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করা যেত।’
‘দুদিককার ধান-চালের পুলিশও দেখছি, আজ কদিন থেকে যুধিষ্ঠিরের বাচ্চা হয়ে উঠেছে। আজ দেড়শো টাকার লোভ ছেড়েছে_দেড়শো মোষ যাচ্ছিল মজফরপুর থেকে মৈমনসিং। ওপারের চালের অফিসারও কদিন থেকে টাকা নিচ্ছে না, এ হাট তো উঠে যাবে দেখছি। সাধে কি আর ইজারাদার হাটে থাকার অভ্যাস কাটাচ্ছে!’
‘হাকিম-টাকিম আসতে পারে, এই ভয়ে নিচ্ছে না বোধ হয়। দু’চারদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। ঘাবড়ো না। এত ভাবনা কিসের? রিলিফের কাজ তো তোমার দোকান থেকে চলছেই। এত এখন ভাববার দরকার কী তোমার? কারবারি লোক আমরা, কোনোরকমে দু’পয়সা রোজগার করবই।’
সাওজি এ কথায় সায় দেয় বটে, কিন্তু মুখ দেখে বোঝা যায় যে সে বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না…রিলিফের জিনিসের লাভের থেকে টাকায় চার আনা দিতে হবে মুনীমজিকে…কত আর থাকবে।…
‘এক মানুষ হয়েছিল পাটের গাছগুলো’, ‘গোঁয়ার গোবিন্দ জামাই এলো না, মেয়েটার কপালে অনেক খোয়ার আছে’, ‘ওলাওঠায় গাঁ যখন উজাড় হয়ে গিয়েছিল তখনও গাঁ ছাড়িনি’…নিত্যনূতন স্বরে, নূতন ভাষায় শোনা যায়,…একই দুঃখগীতির পুনরাবৃত্তি।
দর্পণ সিং বাবাকে সান্ত্বনা দেয়, যাক্, মেয়েদের ইজ্জত বেঁচেছে। বৃদ্ধ কেঁদে ফেলে, ‘আমার চাকর এরফান আমার ষাট বিঘা জমি পেয়ে যাবে। এই হলো ভগবানের বিচার!’
ইজারাদার সাহেব দিনের বেলায় কাছারি ঘর থেকে দেখে তিনরঙা ঝাণ্ডাটি…হাওয়ায় উড়ছে আর ঐ সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছে নৈরাশ্য, বিদ্বেষ, আর আতঙ্কের বিষ_যার প্রতীক ঐ তিনটি রং…ইচ্ছা হয় এই মুহূর্তে ওপারের সবুজ পতাকার কাছের ক্যাম্পে চলে যাই। এতটুকুর মাত্র ব্যবধান; কিন্তু এরই মধ্যে কত পার্থক্য। একটি তার নিজের। এর নিচে আছে শান্তি, সুখ, অনাবিল আনন্দ, ‘আল হিলালে’র ছায়ার তলের নিরাপত্তা।_কিন্তু এই রাজবংশীগুলোর ভয়ে, নিজের জমিদারি ছেড়ে পালালে আর কখনও ভবিষ্যতে এ হাট থেকে, এক পয়সাও তোলা উসুল করা যাবে? কমিশনের রায় কি হবে বলা যায় না_সবই খোদার মর্জি।_
দর্পণ সিংয়ের স্ত্রীকে সাওজির মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে_’তোমরা তো পুলের ওপারে পাকিস্তান হওয়ার পর একদিন ছিলে। হাওয়াতে কি রসুন ফোড়নের দুর্গন্ধ নাকি? লোকগুলো শাক ডাঁটা সে রাতে কাউকে খেতে দিয়েছিল? বজ্জাতি আরম্ভ করেছিল বুঝি?’
প্রশ্নের বাণে জর্জরিত হয়ে সে কোনো প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে না। আপন মনে বকে চলে_’লক্লকে কুমড়ো গাছটা থেকে প্রাণে ধরে একদিন একটা ডগা, ডাঁটা খাওয়ার জন্য কাটতে পারিনি! সেটাকে দিয়ে এলাম গোড়া থেকে কেটে বঁটি দিয়ে। বলদ জোড়াও ভয় পেয়েছিল নাকি, কুমড়োর ডগা এগিয়ে দিতে শুঁকে মুখ ফিরিয়ে নিল।_চ্যালাকাঠ দিয়ে আসবার সময়, উনুনটা ভেঙে দিয়ে এলাম,_কী সুন্দর করে ঝকঝকে তকতকে উনুনটা তুলেছিলাম,_তাতে রাঁধবে কি না এরফানের চাচী,_আর যে জিনিস রাঁধবার নয় সেই সব জিনিস!…বিপদ হয়েছে ঠাকুরের মূর্তিটিকে নিয়ে। ঐ জন্যই ছিল ভয়। ঠাকুরের অসীম কৃপা।_আমরা বোকা মূর্খ মানুষ, তাই তাঁর ভাবনা ভেবে মরি। দেখি আবার পুরুত মশাই ও সম্বন্ধে কী বিধান দেন। এখানে ছত্রিশ জাতের মধ্যে ভাল করে যে দুটো ভোগ দেব সে উপায়ও রাখলে না ঠাকুর,_’
দর্পণের স্ত্রী ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করবার জন্য হাত তুলতে গিয়ে বোঝে যে দুজনেরই অজ্ঞাতে কখন সাওজির স্ত্রী তার বেনে-সুলভ হিসাব-নিকাশের মন ভুলে গিয়ে তার হাত চেপে ধরেছে। দরদী হাতের স্পর্শ ছাড়িয়ে ঠাকুরকে যুক্ত করে প্রণাম করতেও মন চায় না।…মাত্র তিন দিনের পরিচয়_কোন দূরদেশ সেই বালিয়া_সেখানকার বেনে বৌ;_তার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে দর্পণের স্ত্রী নিজের মনের গুরুভার লাঘব করার চেষ্টা করে।…
দূরদৃষ্টের আকস্মিকতা লোকদের এ কয়দিন অভিভূত করে ফেলেছিল। দিন কয়েকের মধ্যে বিপদ গা-সওয়া হয়ে যায়, আতঙ্কের তীক্ষ্ন অনুভূতি আসে ভোঁতা হয়ে। গরুর গাড়ির ভাড়া আর খাবারের দাম যা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল, আবার কমে আসে। চালের পুলিশদের ন্যায়নিষ্ঠ হওয়ার তিন দিনের বাতিক সেরে যায়। গাড়ি গাড়ি চাল পুল পার হয়ে আসতে আরম্ভ করে, হাজারে হাজারে গরু-মোষ ওপারে যায়।
সব কাজের মধ্যেও লোক কমিশনের খবরের জন্য ব্যস্ত। মুনীমজি প্রথম হিড়িকেই যত চাল কিনেছেন, সব পাঠাচ্ছেন সুধানীতে; প্রত্যহ অজস্র গাড়িতে বোঝাই করে। মুনীমজির কথা স্বতন্ত্র, তাই তার ভাড়া কম লাগে। লোক তাঁর কাছে এত কৃতজ্ঞ যে তিনি যদি বিনা পয়সায়ও গাড়ি নিয়ে যেতে বলেন,_তাহলেও গাড়োয়ানরা নিজেদের কৃতার্থ মনে করত হয়তো।…
‘কিন্তু মুনীমজি সাচ্চা আদমী;_হিঁদুর ছেলে, আর এদিককার মছলী খাওয়া হিঁদু নয়। রাজপুতানা, বীরের দেশ,_রাজা আর শেঠের দেশ,_তারা মুসলমানদের কাছে এক দিনের জন্যও মাথা নিচু করেনি। তিনি মাগনা তোমাদের গাড়ি নেবেন না; বেগার গাড়ি নিতে পারে মুসলমান ইজারাদার। মুনীমজি ওয়াজিব ভাড়া দেবেন তোমাদের।’
‘সে কথা আর বলতে হবে না সাওজি। কমিশনের খবর কবে বেরোবে?’
‘কে জানে। শুনছি তো দু’একদিনের মধ্যে। মুনীমজি বলছিল যে মুসলমানরা আবার এতেও বখেরা লাগিয়েছে।’
‘সাওজি, মুনীম সাহেবের চিঠি আজ আমার হাতে দিয়ো।’
‘তুই তো পরশু নিয়েছিলি শুকদেব। আজ আমাকে দিয়ো।’
‘আমাকে’ ‘আমাকে’_কমিশনের খবরের জন্য মুনীম সাহেব প্রত্যহ সুধানী গোলাতে যে চিঠি দেন, সব চালের গাড়ির গাড়োয়ানই, তা নিয়ে যাবার সৌভাগ্য পেতে চায়।
সিরিলাল সাওজিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘সুধানী গোলায় যে লাটসাহেবের খবর দেওয়ার কল আছে, তাতে যত খবর আসে সব কি দোকানের লম্বা খাতায় লেখা হয় নাকি? সেদিন মুনীমজির চিঠি গোলায় দেওয়ার পর সেটা তারা খাতায় লিখে নিল; আর খাতা থেকে দেখেই জবাবের চিঠি দিল।’
‘হবে! ওসব বড় বড় গোলার কাণ্ডকারখানা। আমরা আদার ব্যাপারী_ওসব খোঁজও রাখি না। রামজির কৃপায় আর তোমাদের সেবা করে বালবাচ্চাকে দুটো খেতে দিই! মিশ্রিলাল আজ চিঠি নিয়ে যাবে। আর সিরিলাল, কাল মুনীমজি নিজেই যাবে সুধানীতে। তোর গাড়িতে একটা টপর দিয়ে নিতে পারবি না? আচ্ছা, আমি জোগাড় করে দেব। ইজারাদার সাহেব তো তার টপর দেওয়া গাড়ি মুনীম সাহেবকে দিতে পারলে বর্তে যায়। কিন্তু মুনীমজি সে বান্দাই নয়। ও মরদ কা বেটা। ইজারাদারের কাছ থেকে এক কানাকড়ির উপকার নিতেও রাজী নয়। কাল চাই একজন বিশ্বাসী গাড়োয়ান। লোকের আমানতী টাকা চাল কেনার পরেও কিছু বেচেছে মুনীমজির কাছে। সেই সব পাবলিকের টাকা গোলায় রাখতে হবে। চোর-ছ্যাঁচড় ভরা হাটের মধ্যে কি অত টাকা রাখা যায়? গোলা থেকে পরে, গোলমাল মিটলে এই পুরো টাকা ফেরত দেবে সকলকে;_এক পয়সাও কেটে নেবে না। তেমন চোর গোলাই নয়; ডোকানিয়াজির গোলা_লাটসাহেব পর্যন্ত জানে।’
‘মুনীমজি!’ ‘মুনীমজি!’ যেখানে যাও কেবল মুনীমজির গল্প।
তাঁর স্নানাহারের পর্যন্ত সময় নেই। দিন-রাত কাজ করছেন, কী করলে শরণার্থীদের একটু সুখ-সুবিধা হয় কেবল তারই চেষ্টা!
দর্পণ সিংয়ের বাবাকে তিনি আগাম টাকা দেবেন বলেছেন। বুড়ো চেয়েছিল এরফানকে ঠাণ্ডা করতে_সে কি না রাজবংশীর মেয়েকে বিয়ে করবে বলে। সব বিপদ তুচ্ছ করেও মুনীম সাহেব এরফানকে শায়েস্তা করবার জন্য, দর্পণের ষাট বিঘা জমি কিনে নেবেন কথা দিয়েছেন। আর গোলার জোতের অধীনে পনের বিঘা বন্দোবস্ত দেবেন বলেছেন দর্পণকে_অবিশ্যি কমিশনের রায়ের পর।
মুনীম সাহেবের কর্মক্ষমতায় বিহার বাংলা দুই দিককার সরকারি কর্মচারীরাই সন্তুষ্ট, কলকাতার রিলিফ সোসাইটি তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ; হিন্দুরা সকলেই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, মুসলমানরা তাঁর ওপর একেবারে বীতশ্রদ্ধ নয়।
‘পনেরই আগস্ট, হিন্দুস্থান আজাদ হবে’_মুনীমজি সব দোকানদারকে খবর দেন।
‘আর পাকিস্তান?’
‘হ্যাঁ, পাকিস্তানকেও আজাদী দিতে হবে ঐ দিন।’
সমবেত শত শত লোক প্রশ্ন করতে চায়_’ওটা কি আর কিছুতেই আটকানো যায় না?’ যেন এই নীরব প্রশ্নেরই উত্তর দিতে বাধ্য হয়ে মুনীমজি জবাব দেন, ‘এই নিয়েই যদি খুশী হস তো নে।’ মুসলমানদের প্রতি একটা দমকা উদারতার ঝাপটায়_’দিন কয়েক পরেই ঠেলা বুঝবি’_কথা কয়টা জিভে আটকে যায়।
দিনাজপুর আর মালদার শরণার্থীদের ভীতবিহ্বল মুখে উৎকণ্ঠার ছায়া ঘনিয়ে আসে। একসঙ্গে সকলেই প্রশ্ন করে_’কমিশন’ ‘আর কমিশনের রায়?’
‘ও বেরোবে দিন কয়েক পর। তবে পূর্ণিয়া জেলা, মানে এই আরুয়াখোয়া পাকিস্তানে যাবে না এ কথা ঠিক হয়ে গিয়েছে।’ পূর্ণিয়া জেলার লোকরা, বিশেষ করে আরুয়াখোয়া বাজারের দোকানদাররা চিৎকার করে ওঠে ‘গান্ধীজি কি জয়!’ ছাতা, খড়ম, গামছা ওপরে উৎক্ষিপ্ত হয়। যদু পানওয়ালা আনন্দে নাচতে নাচতে, তার সমস্ত পানের খিলি হরির লুট দিয়ে দেয়।
মালদা, দিনাজপুরের অনেক লোক পূর্ণিয়া জেলায় মুনীমজির কাছ থেকে জমি নেওয়ার কথাটা আবার তোলে।
পূর্ণিয়া জেলার এদিকটা ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের এলাকা। পড়তি জমি পড়ে আছে কোশের পর কোশ_অভাব পয়সার, অভাব চাষ করবার লোকের।
…এত সিকমীদার পাওয়া যাবে।_তার ওপর প্রচুর সেলামী। অধিকাংশই জোত আর রায়তী জমি। ভাগ্য ভাল_না হলে আবার মিনিস্ট্রি জমিদার উঠাচ্ছে, কী হতো বলা যায় না।_ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির ছবি মুনীমজির চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সকলের অনুনয়ের কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতে চান_নেওয়া না নেওয়া তোমাদের ইচ্ছে, আমার ওতে কোনো আগ্রহ নেই।
‘তবে একটা কথা! জমি বিলি ব্যবস্থার কথা আসবে পরে। এখন যে এই সব শরণার্থীরা এত যে গরু-মোষ নিয়ে এসেছে, এ তো যেখানে সেখানে চিরকাল চরতে পারে না। গেরস্তরা তা চরতে দেবেই বা কেন? এদের চরবার জন্য আমি মাসিক হারে জমি ব্যবস্থা করিয়ে দিতে পারি_সস্তায়; কিন্তু দেওয়া চাই নগদ।’
সকলেই একটা সমস্যার সুরাহা পেয়ে তাঁর চারদিকে ভিড় করে দাঁড়ায়। কার কাজ আগে হবে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
এদিককার এই জয়ধ্বনি পুলের ওপারেও চাঞ্চল্য জাগায়! ‘কী! কী ব্যাপার! নিশ্চয়ই কিছু ঘটে থাকবে। ঘাবড়াস্ না।’
টিনের চোঙটা হাতে নিয়ে এক্বাল চিৎকার করে ‘নারে তকদীর।’ অপর সকলে বলে ‘আল্লাহু আকবর’_’মুর্দা নাকি? জোরে বলতে পারিস না? ওপারের আওয়াজকে ডুবিয়ে দিতে হবে।’_হানিফ, এক্বাল, আরও কয়েকজন জয়ধ্বনির কারণ জানতে বেরোয়।_
‘তোরা ততক্ষণ থামিস না যেন বুঝলি।’
‘কে যায় গাড়িতে?’
‘শ্রীপুরের দর্পণ সিংয়ের জামাই আর মেয়ে।’
সার্চ কর গাড়ি, পাকিস্তান থেকে আবার কিছু মাল নিয়ে যাচ্ছে না তো।’
সঙ্গে সঙ্গে এরফান এসে পড়ে।_কে, দিদিমণি? জামাইবাবু?_যেতে দাও গাড়ি। পালিয়ে যাচ্ছ কেন? আমরা থাকতে তোমাদের ভয় কী দিদিমণি? খোকাবাবু কত বড়টা হয়েছে দেখি। ভয় পাচ্ছে আমাকে দেখে। কিছু ভয় নেই দিদিমণি। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে আবার এসো। তোমাকে তো, জামাইবাবু, ভেবেছিলাম মরদ। তুমি আবার পালাও কেন?’
জামাইবাবু আমতা আমতা করে। এরফান খোকার হাতে একখানা কাগজের তৈরি লীগের ঝাণ্ডা দেয়_’কেমন সুন্দর দেখতে, না খোকাবাবু?’
তারপর সঙ্গে গিয়ে গাড়িখানা পুল পার করে দিয়ে আসে। বিদায় নেওয়ার আগে জামাইবাবুর সঙ্গে রসিকতা করে_’রাজা হেঁটে, আর পেরজা (প্রজা) গাড়িতে।’
খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণিয়া জেলার যেসব মুসলমান এক্বালের সঙ্গে ছিল, তারা ইজারাদারের ওপর চটে আগুন হয়ে ওঠে।_ওটা চাঁদার টাকা নিশ্চয় খেয়েছে। আজকে ওটাকে ঠাণ্ডা করতে হবে_এখন আরুয়াখোয়া কাছারিতেই আছে বোধ হয়। হিঁদুদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে, ওদের দিকে রায় করে দিল না তো? আজ রাত্রে এদিকে আসতে দে না।_
মুনীম সাহেবের খবরে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয় দুই পারের লোকের মধ্যে। দর্পণ সিংয়ের বুড়ো বাবাও জোর করে মুখে হাসি আনবার চেষ্টা করে_শ্রীপুর হিন্দুস্থানে আসবে এ দুরাশা যে কদিন জিইয়ে রাখা যায়। তার পরই তো সম্মুখে পড়ে আছে দুঃখ-বেদনাময় জীবন_যার সূচনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে সেই পুল পার হওয়ার দিন থেকেই। দীর্ঘ জীবনের সুখ-সমৃদ্ধির স্মৃতি, সব সেই দিন ওপারে রেখে এসেছে। এই বুড়ো বয়সে আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করা কি সম্ভব? আর, এই দেশে? এতটা বয়স হলো_’নাগর’ নদীর পশ্চিমের দেশকে তারা জ্বরের দেশ বলেই জেনে এসেছে। আজ একে সোনার হিন্দুস্থান বলে জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ করে নাচার অসঙ্গতি বৃদ্ধের সংসারাভিজ্ঞ মনে খচখচ করে বেঁধে। কেন এমন হলো তা সে ভেবে কূলকিনারা পায় না।
সেবার ‘নাগর’ যখন ঘরদোর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তখনও মাচা বেঁধে বাঁধের রাস্তার ওপর কত দিন কাটাতে হয়েছে; এপারে আসবার কথা কল্পনাতেও আনতে পারেনি।_কিছুক্ষণ ভাববার পর যেই এরফানের কথা মনে পড়ে, অমনি ব্যর্থ আক্রোশের বেড়াজালে, সকল যুক্তিতর্কের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়।
এই উত্তেজনার মধ্যে মুনীমজি ছ’খানা গাড়ি বোঝাই করে কী সব জিনিস এনেছে, সে কথা সকলে জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যায়।
মুনীমজির হুকুম, আর পুলের এপার-ওপারের লোকের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি নয়। পনেরই আগস্ট দুই দিকেই প্রাণখোলা উৎসব করতে হবে, যা হওয়ার হয়েছে।
নিজে এগিয়ে ওপারের লোকের সঙ্গে মুনীমজি যেচে আলাপ করতে যান। এত দিন তিনি যেতেন পুলের মধ্যখানের ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ পর্যন্ত। এখন যান একেবারে ওপারের ক্যাম্পে। সকলে বলাবলি করে_আলবত হিম্মতদার লোক।
মুনীমজির মধ্যস্থতায় দুদিককার লোকের মধ্যে প্যাক্ট হয়, কোনো দলই কারও সম্বন্ধে ‘মুর্দাবাদ’ বলতে পারবে না_’আর পাকিস্তানের নতুন ঝাণ্ডা পেয়েছ তোমরা? না না, এ নয়। এ তো পুরনো, লীগের ঝাণ্ডা। নতুন ফ্ল্যাগের খবর রাখো না বুঝি? দরকার থাকে তো আমাকে বলো যত লাগে। সব রকম দামের আছে।’
এপারের লোকদেরও মুনীমজি হিন্দুস্থানের নতুন ঝাণ্ডার কথা এত দিনে বলেন।
‘সে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?’
‘সেকি আর আমি ব্যবস্থা করিনি? সব রকম দামের পাবে।’
সাধে কি আর লোকে ‘মুনীমজি’ করে অস্থির হয়! যখন যেখানে যে জিনিসটার দরকার, মুনীমজির তা নখদর্পণে।
উৎসব লেগে গিয়েছে রিলিফ ক্যাম্পের কাছে। কলকাতায় বিলট্ গাড়োয়ানের ভাই কাজ করত পাটের কলে। সেখানে নাকি পনেরই আগস্ট খুব দাঙ্গা লাগবে, তাই সে বছর দশেকের ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। বাপ-বেটায় দুদিন থেকে রিলিফ সোসাইটির ক্যাম্পে কাজ করে। কলকাতা-ফেরত ছোকরা_অজপাড়াগাঁয়ের নিরীহ ছেলেদের ওপর খুব মোড়লি করছে। ছেলেদের সে নূতন ভূত-ভূত খেলা শিখিয়েছে_অবশ্যি আসলে খেলাটা শিখিয়েছে রিলিফের বাবুরা।_একদল হয়েছে বেহ্মদত্যি, একদল হয়েছে মামদো ভূত। একদিককার নাম বেলগাছের দিক, আর একটা কবরের দিক; মধ্যেখান দিয়ে একটা কঞ্চির দাগের লাইন টানা। নোয়াখালীতে মরলে হবে বেহ্মদত্যি, বিহারে মরলে হবে মামদো! কবরের দিকে নূতন কোনো খেলোয়াড় এলেই মামদোরা উল্লাসে নাকিসুরে চিৎকার করে ‘বিহার থেকে এসেছে রে’; আর বেলগাছের দিকে কেউ এলেই সকলে জিজ্ঞাসা করে ‘নোয়াখালী নাকি’? জবাব দিতে হবে, ‘না, চিৎপুর’_
ছেলেরা বিকৃত উচ্চারণে জায়গাগুলোর নাম নেয়। বড়রা সকলেই এই তামাশা দেখে, আর ছেলেদের এই কাণ্ড দেখে হেসে আকুল হয়।
মুনীমজি এসে সকলকে তাড়া দেয়, ‘এসব কী হচ্ছে? আবার একটা গোলমাল পাকাবে নাকি? পালাও সব ছোকরারা, ফের যদি আমি এই দেখি, তাহলে তোমাদের সব কটাকে পুলের থেকে ‘নাগরে’র মধ্যে ফেলে দেব।’
তারপর রিলিফের বাবুদের বলেন, ‘আপনাদের কাছ থেকে আর একটু দায়িত্বশীলতার আশা রেখেছিলাম।’ তারা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
দুদিনের মধ্যে সব ঝাণ্ডা চড়া দামে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। স্বজাতির লোকের ভয়ে ইজারাদার কোথায় যেন গিয়েছে_তার সেপাই বলে পাটনায়।
নিরবচ্ছিন্ন উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে পনেরই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হয়। পুলের এপারে হিন্দুস্থানের পতাকা, ওপারে পাকিস্তানের ঝাণ্ডা। আতর গোলাপের ছড়াছড়ির মধ্যে পুলটি কেমন যেন অবাস্তব মনে হয়_খানিকটা পাকিস্তানে, খানিকটা হিন্দুস্থানে, খানিকটা শূন্যে_। উৎসবের মধ্যেও এই পুলটির কথাই দর্পণ সিংয়ের মনে হয়।_সে-ও থাকে আরুয়াখোয়ায়, মন পড়ে থাকে শ্রীপুরের জমির ওপর। এই পুলটিই তার দেহ ও মনের সংযোগের সূত্র। এরই জন্য সময়মতো এদিকে পালিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে; ভগবান যদি সুদিন দেন, তাহলে এই দিয়েই আবার নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবে। না ভগবান কেন, কমিশন। কমিশন কি ভগবানের চাইতেও বড়?…
দুই দিকের লোকের সম্মতি নিয়ে রিলিফের বাবুরা পুলের মধ্যেখানে ঝাণ্ডা-ভূতের খেলা দেখায়। ইংরাজের মড়াঝাণ্ডা জড়ানো ছেলের দল প্রথমে চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় তারপর লীগ আর কংগ্রেসের পতাকা জড়ানো ছেলের দলও চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। মাতুমের গান গেয়ে। তারপর হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের নতুন জিন্দা ঝাণ্ডা নিয়ে দুদল ছেলে কোলাকুলি করে,_দর্পণ সিংয়ের বাবার মন একটু যেন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।…
শরণার্থীর দল ছাড়া আর সকলে বোধ হয় যখন কমিশনের কথা ভুলেছে, তখন হঠাৎ মুনীমজি খবর দেন, ‘কমিশনের রায় বেরিয়েছে।’ সকলে মুনীম সাহেবের কাছে ছোটে।
‘শ্রীপুর এসেছে হিন্দুস্থানে।’
দর্পণ সিং মুনীম সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। তার মা কি বোঝে না বোঝে, হাউ মাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে। তার বাবা ভগবানকে আর কমিশনকে প্রণাম করে।
_কমিশন তাহলে তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন।_
‘হরিপুর থানা পড়েছে পাকিস্তানে।’
‘আর মালদা?’
তোমাদের দিকটা এসেছে হিন্দুস্থানে, শুকদেব। আর কি, মেরে দিয়েছ।’
কপালে তিলক কাটা পোড়াগোঁসাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। এসেই প্রথমে রসিকতা করেন, ‘এই আসছি। গরুর গাড়ি থেকে নামবার সময় দেখি সিরি সাওয়ের দোকানের দেওয়ালে রং দিয়ে ‘কাপস্টান’ লেখা। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল। ছাঁৎ করে মনে হলো লিখেছে পাকিস্তান,_উর্দুর উচ্চারণে উলটে। ভাবলাম তাহলে আরুয়াখোয়া নিশ্চয়ই গিয়েছে পাকিস্তানে। তারপর শুনলাম ওটা এক রকম সিগারেট।_এখন আমার খবর বলুন মুনীমজি।’
মুনীমজি তার কথার জবাব ইচ্ছা করেই দেন না। রাজবংশীরা তাদের গুরুদেবের ওপর মুনীমজির এই ইচ্ছাকৃত তাচ্ছিল্যে আশ্চর্য হয়।
শেষ পর্যন্ত তাঁকে কুসংবাদ জানাতেই হয়। ‘জলপাইগুড়ি জেলার তিতলিয়া থানা চলে গিয়েছে পাকিস্তানে।’
‘বললেই হলো? চলে গেলেই হলো আর কি।’
পরে তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে খাটিয়ার ওপরে বসে পড়েন।_ভগবান এ তুমি আমার কী করলে_শেষকালে মরলে কবরে যেতে হবে।…মন্দিরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এও কি আমার কপালে ছিল।…
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার স্বস্তি পায় অধিকাংশ শরণার্থী। আবার সেই পুরাতন দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। এক দিনের মধ্যে শরণার্থীদের ক্যাম্প ভেঙে যায়। দূর দূর থেকে ফিরে আসে গাড়ি, মানুষ, গরু, মোষের মিছিল। গাড়িগুলির ওপর তিনরঙা ঝাণ্ডা লাগানো। মিছিলের লোকদের মধ্যে কারও কারও হাতে হিন্দুস্থানের পতাকা, মুখে রাজ্য জয় করে ফিরবার দীপ্তি। বাঘের মুখ থেকে বাঁচবার আনন্দে মেয়েরা মশগুল।…
_দ্রুতগতিতে চলছে দুনিয়া। এতকাল যাঁরা সৃষ্টি সংসার চালিয়েছেন, তাঁরা এত দ্রুত তালের কল্পনাও করতে পারেননি। এত লোকের মন নিয়ে এমনভাবে ছিনিমিনি খেলতে সাহসও করেননি।_সেই কথাই ভাবছে এক্বাল পুলের ওপর থেকে পাকিস্তান ঝাণ্ডাটা নামাবার সময়।…দরকার কি ছিল কদিনের এই রাজত্বের? খাবার দিয়ে কেড়ে নেওয়ার প্রয়োজন কী ছিল? দুশো বছর লেগে গেল ইংরেজের পতাকা সরাতে, আর তার ঝাণ্ডা সরাতে তিন দিনও সময় লাগল না! মানসিক দুঃখ-বেদনা তো এতে আছেই; কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে যে এ অপমান রাখবার জায়গা নেই। পুলের ওপর, পথের ওপর শরণার্থীর সারি, ওপারে হাটসুদ্ধ লোক দেখছে।_মাথা কাটা যায় অপমানে, নদীতীরের বালির মধ্যে মিশে যেতে ইচ্ছে করে, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কত উৎসাহের সঙ্গে এই ঝাণ্ডা সে তুলেছিল। ‘তিন দিনের ভিস্তির বাদশাগিরি শেষ হলো’_রামজি সাওয়ের এ টিপ্পনী তার প্রাণের মধ্যে গিয়ে বেঁধে। এখানেই এখনই ওরা ওড়াবে হিন্দুস্থানের ঝাণ্ডা। কিন্তু ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে যে এই ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছিলাম সেকি এইজন্য? কালই হয়তো শ্রীপুরের ছেলেরা এই ঝাণ্ডা নিয়ে এই পুলের ওপর মড়াঝাণ্ডার ভূতের খেলা করবে। কার ওপর অভিমান করবে_দুনিয়া যখন তার পিছনে লেগেছে…
কোনো দিকে না তাকিয়ে এক্বাল ঝাণ্ডাটি নামিয়ে কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যায়_উত্তরের দিকে_যেখানে এ ঝাণ্ডা এখনও মরেনি।
হানিফ নিজের নির্লিপ্ততা দেখানোর জন্যে বিড়ি ধরিয়েছিল। সে খাওয়ার আগে আধ খাওয়া বিড়িটা পুলের ওপর ফেলে যায় আর ভাবে, এটা দিয়ে পুলটায় আগুন লেগে গেলে বেশ হয়।…আরুয়াখোয়া আর শ্রীপুর আলাদা হয়ে যাবে তাহলে।…সে জানে যে এ থেকে ঐ কাঠে আগুন লাগা সম্ভব নয়, তবু এটুকু ভেবেও আনন্দ পায়।
মুনীম সাহেব ওপারে ইজারাদার সাহেবের ক্যাম্প দখল করেন।
ছেলেরা পাটের ক্ষেত থেকে একটি পরিবারকে ধরে নিয়ে আসে,_কী মতলবে লুকিয়েছিল,_আগুন লাগাবে বলে মনে হয়_
‘আরে অছিমদ্দী যে।’
অছিমদ্দী কেঁদে পড়ে।_’গাঁ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলাম হরিপুরের দিকে। মীরপুর হিন্দুস্থান হয়ে গিয়েছে পরশু থেকে। শুনছি পূর্বদিকে মুখ করিয়ে নামাজ পড়াবে। মুরগি জবাই করতে দেবে না। তাই এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছি। ভাবলাম দিনমানটা পাটের ক্ষেতে থেকে, সাঁঝ হতে চলতে শুরু করব’_সে কাঁদতে কাঁদতে মুনীম সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে।
‘ছেড়ে দাও একে। এরা আমার চেনা লোক।’
‘দয়ার শরীর হুজুরের।’
‘মুনীম সাহেব কী, জয়!’ ‘মহাত্মা গান্ধীজি কী, জয়!’_জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে।
মুনীমজি ওপারের সকল লোককে বলেন যে ‘সকালে পাকিস্তান ফ্ল্যাগ আর রেখো না। আমার কাছে দিয়ে দিও। আমি গভর্নর্মেন্টের কাছে জমা করে দেব। হিন্দুস্থানে পাকিস্তান ফ্ল্যাগ রাখা বারণ।’
তাঁরই দেওয়া পাকিস্তান নিশানগুলি আবার তাঁর কাছে ফিরে আসে।
তিনি মনে মনে ভাবেন_এগুলি নিয়ে কাল যেতে হবে তিতলিয়ার দিকে। পোড়াগোঁসাইয়ের খালিবাড়িতে উঠবেন, তাঁর জমিটমিগুলো একবার দেখেও আসবেন, সেখানে বেচতে হবে এই পাকিস্তান ঝাণ্ডাগুলো। আর সেখানে জোগাড় করতে হবে সেখানকার অপ্রয়োজনীয় হিন্দুস্থান পতাকাগুলি। একই জিনিস দু’দুবার করে বেচবেন। তিনি হিসাব করেন সব মিলিয়ে তাঁর কত হলো। ‘কমিশন’ অনেককে অনেক কিছু দিয়েছে, আবার অনেক কিছু নিয়েছে। কিন্তু এই কমিশনের রায়ের, কমিশন বাবদ তাঁর প্রাপ্য তিনি পেয়ে গিয়েছেন। হিসাবে কোথাও ভুল হয়নি।…
ক্যাম্পের বাইরে থেকে ভেসে আসছে ‘মুনীম সাহেব কী, জয়!’…একটু সন্দেহ মনের মধ্যে খচ্ খচ্ করে…একটি খদ্দরের টুপি আগেই কিনে রাখলে বোধ হয় আর একটু সুবিধে হতো…হয়তো হিসাবে একটু সুবিধে হতো…হয়তো হিসাবে একটু ভুল হয়ে গিয়েছে। যাকগে, রামজি যাকে যা দেন তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত।…
মুনীমজি কুঠিয়ালি ভাষায় পকেটবুকে হিসাব লিখতে বসেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত