সত্যজিৎ রায়ের রবীন্দ্রনাথ

Reading Time: 4 minutes

শাকুর মজিদ

কলকাতার মহাসড়ক দিয়ে যেতে সড়ক দ্বীপের মধ্যে যে কতগুলো নাম লিখে এই শহরটি তাদের শহর বলে মনে করিয়ে দেয়া হয়, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি সত্যজিতের নামটি একাধিক জায়গায়ই দেখেছি। সত্যজিৎ এর পূর্বপুরুষের বাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। সেখান থেকে কলকাতা যান তাঁর পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায়, থাকতেন উত্তর কলকাতার কর্নওয়ালিশ রোডে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপেন্দ্র কিশোর রায়ের সখ্য ছিল।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ৬০, সত্যজিতের তখন জন্ম। সত্যজিতের যখন ১০ বছর বয়স, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায়। সত্যজিতের মাতা সুপ্রভা রায় ১০ বছর বয়েসি পুত্র সত্যজিৎ কে নিয়ে গিয়েছিলেন গুরুর আশীর্বাদ নেবার জন্য। সত্যজিৎ রবি ঠাকুরের সামনে একটা অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খাতার উপর তাৎক্ষণিক সই না করে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়িতে। পরদিন সকালবেলা সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের উত্তরায়ণে গিয়ে হাজির হলে ফেরত পান খাতা। সে খাতার ভেতর লেখা ছিল—‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।।’
রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ সম্পর্ক এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। মূলত শুরু এখান থেকে। ১৯৩৭ সালে সত্যজিতের মা রবীন্দ্রনাথের হাতে নিজ পুত্রকে তুলে দেয়ার জন্য ভর্তি করান শান্তিনিকেতনে। সত্যজিতের বয়স তখন ১৬। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু অবধি তিনি শান্তি নিকেতনেই কবিগুরুর স্ব-স্নেহে বেড়ে ওঠেন এবং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অনেক অনেক পর সত্যজিত্ রায় যখন চলচ্চিত্রকার হিসেবে আবির্ভূত হন, তিনি একে একে বেছে নেন রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস।
রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে কলকাতার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী পুরুষ হিসেবে সত্যজিতের নামই সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয়। আমার বারবার মনে হতো রবীন্দ্রনাথ কেন চলচ্চিত্রে এলেন না? তাঁর মতো প্রতিভাবানেরই তো জায়গা চলচ্চিত্র। যেখানে শিল্পের ৬টি শাখাকে এক করে বাঁধা হয়, অমন বাধ যদি সত্যজিত্ যথাযথভাবেই বাঁধতে পারেন, তবে রবীন্দ্রনাথ নয় কেন? বার বার মনে হয়েছে, শব্দসহ চলমান চিত্র দেখানোর সুযোগটা যদি ২০ বছর আগে এসে যেত বাঙালি পেত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালকও। কিন্তু বাস্তবিকতা হচ্ছে যে, কলকাতায় যখন সবাক চলচ্চিত্র বানানো হয়, তখন কবির যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র পরিচালনা যথেষ্ট শারীরিক পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ। সত্যজিৎ কে ও আমরা দেখেছি পঞ্চাশে এসেই তিনি ইনডোরমুখো হয়ে গিয়েছিলেন শুটিং-এ। রবীন্দ্রনাথকে সচল অবস্থায় দেখেছি কয়েকটা চলচ্চিত্রে। ইউটিউব থেকে পাওয়া তাঁর নিজের পরিচালনায় বানানো  ‘নটীর পূজা’ আর সত্যজিতের বানানো ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে শান্তিনেকেতনে ধারণ করা কয়েকটা শট মাত্র। রবীন্দ্রনাথ সরাসরি চলচ্চিত্র নির্মাণে না এলেও চলচ্চিত্র কি তাঁকে বাদ দিতে পেরেছিল? বাংলা চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগে ১৯২০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ  করেছিলেন, কিন্তু কাজটা হয়নি। ১৯২৩ সালে নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায়  রবীন্দ্রনাথের কাহিনির চিত্ররূপ পায় ‘মান ভঞ্জন’-এ। ১৯২৯ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘তপতী’ ছবিটি নির্মাণ শুরু করলেও চার রিল পর্যন্ত শুটিং হয়। এ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথ রাজি হলেও বিদেশ ভ্রমণের কারণে ছবির কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। শিশিরকুমার ভাদুড়ী ১৯২৯ সালেই রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ নিয়ে বানিয়েছিলেন নির্বাক চলচ্চিত্র। ১৯৩১ সালে সবাক চলচ্চিত্রের যুগ শুরু হয় শরত্চন্দ্রের কাহিনি নিয়ে, পরের বছরই রবীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্র নির্মাণে নেমেছিলেন। মাত্র চার দিনে ‘নটীর পূজা’র শুটিং শেষ হয়। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের অভিনীত এ চলচ্চিত্রে উপালির চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এরপর ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত তাঁর জীবদ্দশায় চিরকুমার সভা, নৌকাডুবি , গোরা, চোখের বালি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নজরুল ইসলাম তখন সচল যুবক। তিনিও চলচ্চিত্র নির্মাণে আসেন । ১৯৩৮ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিসংবলিত কাহিনি, গান ও সুরে মুখর ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার চলচ্চিত্রজগত্। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তখন অশীতিপর। তাঁর শারীরিক দুর্বলতাজনিত কারণেই বোধহয় আমরা চলচ্চিত্রকার রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার সুযোগ পাইনি।
১৯৬০ সালের আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের শোধবোধ, শেষরক্ষা, অজন্তা, নৌকাডুবি, দৃষ্টিদান, বিচারক, গোরা, বউঠাকুরাণীর হাট, চিত্রাঙ্গদা, চিরকুমার সভা, কাবুলিওয়ালা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ক্ষুধিত পাষাণ নিয়ে প্রথিতযশা নির্মাতারা ছবি বানান। এঁদের মধ্যে তপন সিংহ পরিচালিত ‘কাবুলীওয়ালা’ ভারতের রাষ্ট্রপতির পদক, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে পুরস্কার ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ভারতের ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথ টালিউডে সীমাবদ্ধ থাকার কথা নয়, ছিলেনও না। কলকাতার আরেক প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষ ২০০৩ সালে বলিউডি সুপারস্টার ঐশ্বরিয়াকে নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘চোখের বালি’, ২০০৮-এ সুমন মুখোপাধ্যায় বানিয়েছেন ‘চতুরঙ্গ’, ২০১২-তে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বানান ‘চার অধ্যায়’। শুধু বাংলাতেই নয়, হিন্দিতেও তাঁর কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে ‘বলিদান’ (১৯২৭), ‘নৌকাডুবি’ নিয়ে ‘মিলন’ (১৯৪৭), ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৬১), ‘সমাপ্তি’ নিয়ে ‘উপহার’ (১৯৭১), ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ নিয়ে ‘লেকিন’ (১৯৯১), চার অধ্যায় (১৯৯৭), ‘নৌকাডুবি’ নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘কাসমাকাস’ (২০১১)। রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে চাষি নজরুল ইসলাম ২০০৪ সালে ‘শাস্তি’, ২০০৬ সালে ‘শুভা’ নামে দুটো চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ১১৯টি ছোটগল্পের মধ্যে এমন কোনো গল্প পাওয়া কঠিনই হবে যাকে নিয়ে একাধিক নাটক বানানো না-হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশনে।
১৯৬০ সালে ভারত সরকার দায়িত্ব দিলেন সত্যজিত্ রায়কে। তিনি বানালেন প্রামাণ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’। সত্যজিত্ রায় ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের তপন সিংহ, মৃণাল সেন, পূর্ণেন্দু পত্রীসহ বিখ্যাত প্রায় সকল চিত্রপরিচালকই ছবি বানানোর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা বানিয়েছিলেন—নিশীথে, অর্ঘ্য, সুভা ও দেবতার গ্রাস, অতিথি, শাস্তি, ইচ্ছাপূরণ, মেঘ ও রৌদ্র, মাল্যদান, স্ত্রীর পত্র, বিসর্জন, শেষরক্ষা, নৌকাডুবি, মালঞ্চ প্রমুখ চলচ্চিত্র। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে হিট হয়েছিল নৌকাডুবি, এটি একাধিক নির্মাতা বানিয়েছিলেন, এমনকি উর্দুতেও এটা বানানো হয়। বাংলাদেশে এবং পাকিস্তানে একাধিক চলচ্চিত্রকার এর কাহিনি নিয়ে ছবি বানালেও কাহিনিকার হিসেবে অনেক জায়গায়ই রবীন্দ্রনাথের নাম ব্যবহার করেননি।
সত্যজিতের পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমপর্ক এবং শান্তিনিকেতনে কয়েক মাস রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাত্ তদারকিতে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তাঁর হাতে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসগুলো সচল ও জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোটগল্প সমাপ্তি, পোস্টমাস্টার ও মনিহারা নিয়ে ‘তিনকন্যা’ বানিয়েছিলেন সত্যজিত্ রায় ১৯৬১ সালে। রবীন্দ্রনাথের বড় গল্প ‘নষ্টনীড়’ দিয়ে ১৯৬৪-তে বানালেন ‘চারুলতা’। বলা হয়ে থাকে যে সত্যজিতের সবচেয়ে নিখুঁত চলচ্চিত্রের নাম চারুলতা। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পদক, বার্লিন ও মেক্সিকো চলচ্চিত্র উত্সবে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়। সত্যজিত্ এরপর বড় পুরস্কার পান ‘ঘরে বাইরে’র জন্য, এটি ১৯৮৪-তে ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে পুরস্কার পায়। সত্যজিত্ তাঁর সারাজীবনের কাজের জন্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার অস্কার পেয়েছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর দিয়ে সূচনা, তারপর সুকুমার-সত্যজিত্ শেষে সন্দ্বীপ রায় হাত দিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। বাবার কাহিনি থেকে ‘বোম্বের বম্বেটে’ বানাতে প্রডিউসার পেলেন বালাজিকে। তারাও অবাঙালি মাড়োয়ারি। যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন তিনি খরচ করার, কাজেও লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণে এসেছে পরিবর্তন। ফিল্মের কারবার শেষ হয়ে ডিজিটাল ফরমেট যখন চলে এল তখন ভেঙ্কটশ প্রায় ২০০টি ডিজিটাল হল বসালো পশ্চিম বাংলায়, বেশি করে লগ্নি করতে লাগল অপেক্ষাকৃত কম বাজেটের ডিজিটাল ছবিতে। যার ফলে বেশ কিছু তরুণ প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার এলেন কলকাতার সিনেমায়। এদের একজনের নাম সৃজিত। ‘বাইশে শ্রাবণ’ নামক একটি ছবি দেখে আমি চলচ্চিত্রের ভিন্ন ভাষা খুঁজে পাই এবং আন্দাজ করি, এদের সবার ভেতরেই রবীন্দ্রনাথ। তা না হলে ছবির নাম যে ‘তারিখ’ নিয়ে সেটা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন হবে কেন? ছবিটার সূচনাতে ছিলেন জীবনানন্দ, শেষে এসে রবীন্দ্রনাথ হাজির হন। একপর্যায়ে কবিতা ও কাব্য নিয়ে আলোচনার পর প্রবীর ও পাকড়াশী অনুমান করে যে, খুনি নামকরা বাঙালি কবিদের মৃত্যুবার্ষিকীতেই খুন করে এবং তারা বুঝতে পারে যে, এর পরের খুনের তারিখ হলো ২৯ শে জুন। কারণ সেদিন মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যুবার্ষিকী। এর একমাস পর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী (বাইশে শ্রাবণ) চলে আসে। প্রবীর পাকড়াশীকে  রবীন্দ্রনাথ নামের একজনের সাথে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
কলকাতার সিনেমার নৌকার পালে এখন নতুন হাওয়া লেগেছে। এ নৌকা যারা এখন বাইছেন তাঁরা সবাই সত্যজিেকই তাঁদের আদর্শ মেনে হাল ধরে আছেন, আর সত্যজিতের আদর্শের অনুপ্রেরণা তো রবীন্দ্রনাথ থেকেই।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>