| 23 এপ্রিল 2024
Categories
শিশুতোষ

সিনেমা ও গল্প কথার অনন্য সত্যজিৎ রায় । মিলন কিবরিয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

সে এক মজার কাহিনী। গুপি গাইন আর বাঘা বাইনের গল্প। গুপি করেন গান আর বাঘা বাজান ঢোল। সেই গান আর বাজনার এমনই গুণ যারা শোনে তারা একদম নড়া-চড়া করতে পারে না। শুরুতে অবশ্য এমনটি ছিল না; গুপির বিকট গান আর বাঘার ভয়াবহ বাজনায় অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামের লোকজন তাদের দুই জনকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল। মনের দুঃখে তারা বনে গিয়ে ঠাঁই নিল। সেখানেই তাদের দেখা, তাদের বন্ধুত্ব। সেই বনে রাতের বেলায় ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা, তাদের গান-বাজনা শুনে খুশিতে নেমে এলো বনের সব ভূতেরা। গানের সুরে আর বাজনার তালে তালে নাচতে শুরু করলো সবাই। হরেক রকম ভূতের নানান কায়দার নাচ।
সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য!
‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’’ সিনেমায় আছে এই নাচের দৃশ্য। যারা দেখেছো তারা কোনদিন ভুলতে পারবে না সেই দৃশ্য! যেন চোখে লেগে আছে, বন্ধ করলেই ভেসে উঠে মজার সেই নাচ। আমাদের জন্য এই সিনেমা বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, কাহিনীটি নিয়েছিলেন দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প থেকে। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে আনন্দ আর হাসি। সেই হাসি আর আনন্দ আছে গুপি আর বাঘার পরের অভিযানেও, ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায়।
গুপি আর বাঘার কান্ড কীর্তি নিয়ে সত্যজিৎ রায় আমাদের জন্য ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ও ‘হীরক রাজার দেশে’ এই দুইটি সিনামা বানিয়েছেন। এমনভাবে চমৎকার ভাবে বানিয়েছেন যে তার রেশ সিনেমা দেখার পরেও থেকে যায়। কিছুতেই ভোলা যায় না। মনকাড়া সুর আর ছন্দে ভরা সংলাপ আমাদের মাথার ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। নিজের অজান্তেই মনের ভিতরে গুনগুনিয়ে ওঠে গান। গুপি আর বাঘার অভিনয় এতোই প্রাণবন্ত আর মজার যে চোখের উপরে ভাসতে থাকে। আর আমরা দুলতে থাকি আনন্দ আর খুশির দোলায়।
সিনেমার ভিতর দিয়ে সত্যজিৎ রায় আমাদের অনেক কিছু সহজ করে জানিয়ে দেন। আমাদের জানিয়ে দেন সুরের অনেক শক্তি, সঙ্গীতের অনেক ক্ষমতা। গান আমদের মুগ্ধ করে, বাজনা আমাদের ভিতর ছন্দ জাগায়। আমরা সুর আর তালের সুন্দর এক জগত দেখতে পাই এই সিনেমাগুলোয়।
যুদ্ধ ভালো নয়; যুদ্ধ মানেই মৃত্যু আর ধ্বংস। আমরা চাই শান্তি। মন্দ লোকেরা আমাদের যুদ্ধ আর অশান্তির দুনিয়ায় নিয়ে যেতে চায়। লোভ ভালো নয়, মন্দ লোকদের অনেক লোভ। হাল্লার মন্ত্রীর রাজ্যের লোভ, হীরকের রাজার হীরার লোভ। তারা মানুষের উপর অত্যাচার করে, তাদের কষ্ট দেয়। এই জন্য তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে; ঔষধ ব্যবহার করে, যন্ত্র ব্যবহার করে।
শিক্ষা আমাদের আলোকিত করে; সুন্দরের পথ দেখায়, জগতকে বুঝতে শেখায়। তাই মন্দ লোকেরা চায় না আমরা শিখি, আমরা জানি। মন্দ লোকেরা যতই চেষ্টা করুক শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হয়, ভালোর জিত হয়। গুপি আর বাঘার বুদ্ধিতে হাল্লা আর শুন্ডির মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয়। লোভী আর অত্যাচারী হীরক রাজার পরাজয় হয়। আমাদের চোখে ভাসতে থাকে রাজার পরাজয়ের দৃশ্য, কানে বাজতে থাকে –‘ দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’।
সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সিনেমা বানান। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের তিনি একজন। তার বানানো প্রথম সিনেমার নাম ‘পথের পাঁচালী’। প্রথম সিনেমায়ই তিনি তাক লাগিয়ে দেন পৃথিবীকে। বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় আছে ‘পথের পাঁচালী’র নাম। ছোট ভাই অপু আর তার দিদি দুর্গা এই সিনেমার প্রাণ। দুই ভাই-বোনের মধ্যে খুব ভাব। অভাবের সংসার তাদের। তার ভিতরেও তারা খুঁজে নেয় আনন্দের ছোট ছোট ক্ষণ। তেমনি এক আনন্দময় সময়ে দুই ভাই-বোনে মিলে বাড়িতে না জানিয়ে দূরে কাশবনের ভিতর দিয়ে ট্রেন দেখতে যায়। অপূর্ব সুন্দর সেই দৃশ্য।
আমাদের সেরা সাহিত্যিকদের কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’র কাহিনী কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস থেকে নেয়া। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প আর উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। নিজেও কাহিনী লিখেছেন অনেক সিনেমার। সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।
সিনেমা বানানোর পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় আমাদের অনেক গল্প শুনিয়েছেন, বিচিত্র সেই গল্পের ভান্ডার। রহস্য রোমাঞ্চ অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, গোয়েন্দা অভিযানের গল্প, কল্প-বিজ্ঞানের গল্প, ভূতের গল্প, ভয়ের গল্প। তার লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের নাম ফেলুদা। ফেলুদাকে আমরা সবাই চিনি, ডাকসাঁইটে গোয়েন্দা। তার পুরো নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্তির। খুড়তুতো ভাই তপেশ রঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। তোপসের বয়ানে আমরা ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারের গল্পগুলো পড়ি। গড়পড়তা বাঙ্গালির চেয়ে ফেলুদা লম্বা, তার দেহ সুঠাম। গল্পের সাথে মনকাড়া ছবিগুলো সত্যজিৎ রায়ই এঁকেছেন। সেই থেকে আমাদের মনে ছাপ পড়ে গেছে ফেলুদা দেখতে কেমন। ফেলুদা রহস্যের সমাধান করেন তার বুদ্ধি দিয়ে। চারপাশে তার কঠিন নজর, গভীর তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিশ্লেষণ করেন, বোঝার চেষ্টা করেন। এই দুইজনের সাথে আছেন এক মজার চরিত্র, তার নাম লালমোহন গাঙ্গুলী। লালমোহন গাঙ্গুলীর ছদ্মনাম জটায়ু, এই নামে তিনি রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখেন। মজার মজার কথা বলেন, মজার মজার কান্ড করেন। সত্যজিৎ রায় ফেলুদার কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন দুইটি, ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। পরে অন্য পরিচালকেরা ফেলুদার কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। এখনো ফেলুদার কাহিনী নিয়ে সিনেমা হচ্ছে, টিভি সিরিয়াল হচ্ছে। এ থেকে ফেলুদা যে কত জনপ্রিয়তা তা বোঝা যায়!
সত্যজিৎ রায়ের আরেকটি চমৎকার সৃষ্টি প্রোফেসর শঙ্কু। আমাদের খুব প্রিয় আরেকটি চরিত্র। ছোটখাট মানুষ; মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি-গোঁফ, মাথা জুড়ে টাক,চোখে গোল চশমা। চেহারায় ফুটে উঠেছে একটা বিজ্ঞ ভাব। থাকেন ভারতে, কিন্তু বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন, সাহসী ও বুদ্ধিমান। অনেকটা আত্মভোলা প্রকৃতির। পোষা বিড়ালটির নাম রেখেছেন একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নামে, নিউটন। অদ্ভুত সব আবিস্কার তার ঝুলিতে; বিচিত্র সেই সব যন্ত্র আর অস্ত্র, আছে ঔষধও। শুধু পৃথিবীর নানা জায়গায় নয়, ভিন গ্রহেও অভিযানে গিয়েছেন শঙ্কু। ভিন গ্রহের প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করেছেন পৃথিবীকে। বিচিত্র সব প্রাণীর দেখা পেয়েছেন বিভিন্ন অভিযানে। শঙ্কুর সেই সব অভিযান আমাদের শিহরিত করে, অবিশ্বাস্য সব কান্ড আমাদের অবাক করে।
গল্প কাহিনী লেখার পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় ছবি এঁকেছেন বিস্তর। নিজের সব বইয়ের প্রচ্ছদ ও ছবি নিজে এঁকেছেন, বেশির ভাগই স্কেচ। সিনেমার পোস্টার তৈরি করেছেন। সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার খাতায় স্কেচ করেছেন দৃশ্য আর সেট ডিজাইনের। ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে তিনি আমাদের তার ছোটবেলার গল্প শুনিয়েছেন। সিনেমায় শুটিং-এর মজার মজার গল্প শুনিয়েছেন ‘একেই বলে শুটিং’ বইয়ে। ছড়া-কবিতা লিখেছেন আমাদের জন্য। তার বেশির ভাগ লেখাই ছোটদের জন্য। আমাদের তিনি নিয়ে যান কল্পনার রঙিন জগতে। সেই জগতে শুধু আনন্দ আর বিস্ময়।
এই বছর সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শত বার্ষিকী। ১৯২১ সালের ২ মে তিনি কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সুকুমার রায় আর মায়ের নাম সুপ্রভা দেবী। বাবা সুকুমার রায়ও আমাদের সবার চেনা, আমাদের সবার প্রিয়। বাংলা শিশু সাহিত্যের একজন দিকপাল তিনি। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’, ‘হ য ব র ল’ আর ‘পাগলা দাশু’ পড়ে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। বাবা সুকুমার রায় যখন মারা যান সত্যজিৎ রায়ের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। পাঁচ বছর বয়সে মামার বাড়িতে চলে আসেন। এই সময়ের গল্প তিনি আমাদের বলেছেন তার ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে। সেই বই পড়ে জানা যায় তার শৈশব কেমন ছিল। তার স্কুল জীবনের গল্প, বন্ধুদের গল্প, শিক্ষকদের গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। সেই সময়ের মজার মজার ঘটনা আর হরেক রকম খেলনা আর যন্ত্রপাতির গল্প। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল এই সময়ে।
লেখা পড়া করেছেন বালিগঞ্জ সরকারী হাই স্কুল আর প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারপর মায়ের উৎসাহে পড়তে যান শান্তি নিকেতনে।
সত্যজিৎ রায় তার চাকুরি জীবন শুরু করেছিলেন এক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে। সেখান থেকে চলে আসেন ‘সিগনেট প্রেস’ নামে এক প্রকাশনী সংস্থায়। বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন আর অলঙ্করণে তিনি নতুনত্ব নিয়ে আসেন। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। এই ফিল্ম সোসাইটি তাকে বিশ্বের সেরা সিনেমা দেখার সুযোগ এনে দেয়। বিখ্যাত ফরাসী চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ রনোয়া কলকাতায় এলে সত্যজিৎ রায়ের সাথে তার দেখা হয়, আলাপ হয়। এ সময় তিনি রনোয়াকে শুটিং-এর জায়গা খুঁজতে সাহায্য করেন। ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে সিনেমা তৈরির পরিকল্পনার কথা রনোয়াকে জানান। রনোয়াকে তাকে উৎসাহ যোগান।
১৯৫০ সনে সত্যজিৎ রায় লন্ডনে যান। এই সময়ে তিনি সিনেমার স্বপ্নীল জগতে ডুব দেন, প্রচুর সিনেমা দেখেন। ইতালীয় চলচ্চিত্র পরিচালক ভিত্তরিও দে সিকার সিনেমা ‘দি বাইসাইকেল থিফ’ তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সিনেমা বানাবেন, চলচ্চিত্র পরিচালক হবেন। শুরু করেন তার প্রথম সিনেমা বানানোর অভিযান। সেটা ছিল এক কঠিন লড়াই। অর্থ কষ্টের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে থেমে থেমে শুটিং করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গ সরকারের অর্থ সাহায্যে কাজটি শেষ হয়।
১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ‘পথের পাঁচালী’। তারপর শুধু সামনে এগিয়ে যাবার পালা। সিনেমা বানিয়েছেন, দুই হাতে লেখালেখি করেছেন। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। সারা জী।বনের কীর্তির জন্য পেয়েছেন অস্কার পুরস্কার। পেয়েছেন ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান ভারত রত্ন পুরস্কার। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মারা যান এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ।
সত্যজির রায়ের ডাক নাম মানিক। মানিক অর্থ রত্ন। তিনি আমাদের রত্ন। আমাদের চলচ্চিত্র আর সাহিত্যের কিংবদন্তী।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত