| 16 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ গল্প: মরুদ‍্যান । সৌরভ কুমার  চলিহা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Saurabh_Kumar_Chaliha

লেখক পরিচিতি-১৯৩০ সনে অসমের মঙ্গলদৈ শহরে সৌরভ কুমার চলিহার জন্ম। এটা ছদ্মনাম। প্রকৃত নাম সুরেন্দ্রনাথ মেধি। অসমিয়া ছোটগল্পের নতুন রীতির প্রবর্তক সৌরভ কুমার চলিহা পঞ্চাশের দশকে ‘অশান্ত ইলেকট্রন’ নামে একটি গল্প লিখে সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ গুলি যথাক্রমে ‘অশান্ত ইলেকট্রন’, ‘এহাত দাবা’, ‘গোলাম’, ‘জন্মদিন’ ‘নির্বাচিত সংকলন’দুপুরিয়া ইত্যাদি। গোলাম গ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন ।২০১১ সনে মৃত্যু হয়।


অবশেষে এসে পৌছালাম একটি শান্ত সবুজ সমতল, জানিনা কোথায়, জানিনা কীভাবে, জানিনা কেন। সংঘাত জৰ্জর পার্থিব জীবন থেকে যে আকুল অব্যাহতি এতদিন ধরে চাইছিলাম, তাই যেন এখন স্বচ্ছন্দভাবে চোখের সামনে বাস্তবায়িত। ভূমিতে পা রেখেই অনুভব করলাম যে এই বিস্তীর্ণ কোমল ঘাসের কার্পেট কিন্তু ঘাস নয়, ঘাসের মতো কৃত্রিম কিছু (খেলার মাঠে যেমন থাকে কৃত্রিম টার্ফ) এবং মুক্ত জায়গাগুলির মাঝে মধ্যে এই যে ছোট বড় ঝোপ এবং দেবদারু গাছ, সেইসব কিন্তু দেবদারু নয়, দেবদারুর মতো দেখতে অন্য কিছু। জায়গাটিতে উপনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সমস্ত দেহ মনে এসে গেল এক অভূতপূর্ব স্বস্তি, জীবন সংগ্রামের ক্লান্তি যেন বিস্মৃত হয়ে গেলাম, তার জায়গায় কোথাকার  ঝিরঝির মলয় বাতাস যেন যেন সমস্ত সত্তাকে শীতল করে গেল। কতক্ষণ সমাহিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলতে পারিনা, অনুভব করলাম যে একটু বসার ইচ্ছা করছে, সঙ্গে সঙ্গে যেন পাশের একটি ঘন ঝোপ সাবলীল ভাবে আমার কাছে যেন বাতাসে ভর করে এগিয়ে এল, কিন্তু আসলে একটুও বাতাস নেই, গাছ পাতা নিস্পন্দ! ঝোপটাতে হাত দিয়ে দেখলাম, আমার ওজন বহন করতে পারবে- বসলাম। নিস্তব্ধ, কোনো পাখপাখালির বা পোকা পতঙ্গের কিচিরমিচির নেই, মনে হল যেন আমার সামনের দেবদারু গাছটা সামনের দিকে হেলে কিছু একটা বলল,অস্ফূট কিন্তু বাঙ্ময়, আর এবারও বুঝলাম না এটা দৃষ্টিবিভ্রম না অন্য কিছু, কারণ তার শাখা-প্রশাখা গুলি আন্দোলিত করার মতো আবহমন্ডলের কোনো বায়ু প্রবাহ নেই। হয়তো এখানে এটাই স্বাভাবিক, এখানে গতিহীনতা থেকেই আসে গতিময়তা, হয়তো এটাই এখানকার প্রাকৃতিক বিধান। অনুভব করলাম যেন ক্ষীণ একটা ক্ষুধার ভাব জেগেছে, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা , দেখলাম আমি বসে থাকা ঝোপটার দুপাশ থেকে দুটো দেবদারুর ডাল এবং পাতা হেলে এসে আমার সামনে দাঁড়াল, ডাল পাতাগুলি একটি একটি করে সরে গিয়ে যেন ভেতরে ছোট গোল এক টুকরো জায়গা করে দিল, নাকে এল একটা অপরিচিত গন্ধ, অনির্ণেয় এবং অবর্ণনীয়। কিন্তু যেন রসনা উদ্রেককারী পরম সুস্বাদু, অজান্তেই আমার মুখ খুলে গেল, যেন পরম পরিতৃপ্তিতে সেই গন্ধ আমার ভেতরে টেনে নিলাম, অপেক্ষা করলাম, বুঝতে পারলাম এই  পরিপুষ্টিতে প্রশমিত হয়েছে আমার ক্ষুধা, আমার তৃষ্ণা, মুখ বন্ধ করলাম- একপাশে হয়ে যাওয়া ডাল পাতাগুলি আবার এসে নিজ নিজ স্থানে বসল, গাছ দুটি যেন সামনের দিকে সামান্য হেলে অভিবাদন জানাল, তারপর যেন পুনরায় বাতাসে আগের আগের জায়গায় গিয়ে রইল, সেই নিশ্চল দৃশ্যপট।

মনে কোনো সচেতন ভাব খেলল না, কিন্তু কোথাও হৃদয়ঙ্গম করলাম যে আমি এখানে একজন সমাদৃত অতিথি, আমি এখানে স্বাগত, আমার উপস্থিতি উৎপন্ন করেনি কোনো সন্দেহ, কোনো শত্রুতা, কোনো সর্তকতা,বরং এখানে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির এক সুশীল পরিমণ্ডল। এটা সম্ভব কেবল কোনো সুসভ্য সমাজে, যেখানে সমস্ত প্রাণীর জন্যই’বসুধৈব কুটুম্বকম’, কোনো সুউচ্চ সভ্যতায়। এবং সত্যিই এই সভ্যতা হতে হবে অত্যুচ্চ কেননা এই দৃশ্যপট, এই গতিহীন গতিবিধি হতে পারে অলীক, হতে পারে ভুয়ো,হতে পারে ভেলকি, হতে পারে কেবল সুচতুর সম্মোহন, কিন্তু এইসব সৃষ্টি করেছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে নিশ্চয় কোনো উৎকৃষ্ট বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীর মানুষের চেয়েও বহু বহু উন্নত কোনো সভ্যতার প্রাণী,যার বিবর্তন ঘটেছে হয়তো আমাদের লক্ষ লক্ষ বছর আগে থেকে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী এত সুদীর্ঘ সময় যে এই সভ্যতা চলমান রয়েছে তাই প্রমাণ করে যে এই সভ্যতা কেবল বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নয়, নৈতিকতার ক্ষেত্রেও আমাদের চেয়ে অনেক ওপরে। কোনো সভ্যতায় প্রযুক্তি এবং ও অনৈতিকতা একসঙ্গে থাকতে পারেনা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সেই ধরনের সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে, যেভাবে বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়ন পৃথিবীর মানুষকে পারমাণবিক যুদ্ধ এবং বিষক্রিয়ার ব্যাপ্তিতে ধ্বংসের মুখে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অহরহ। সুসভ্য,সুস্থির সভ্যতা হতে হবে লোভ দ্বেষ এবং হিংস্রতা থেকে মুক্ত, কিন্তু আমাদের ভীতিবিহ্বল পৃথিবী এখনও একটি আদিম অসভ্য বর্বর বধ্যভূমি-

বলা হয় যে এই ধরনের অকৃত্রিম,উচ্চতর সভ্যতার সম্মুখীন হলে আমরা একটি সাংস্কৃতিক শ্বক পাব,যা আমরা সহ্য করতে পারব না,আমরা লুপ্ত হয়ে যাব। কিন্তু এখন যেখানে আমি বসে আছি, তাতে তো আমার মনে হচ্ছে না কোনো বিলুপ্তির বিপৎসংকেত, বরং আমার মনে ভেসে আসছে সেক্সপিয়ারের দুটো সারি-

After life’s fitful fever

He sleeps well,

কেবল এই sleep বা নিদ্রা চির নিদ্রার সুষুপ্তি নয়, বরং ক্লান্তি দূর করার জন্য গভীর ঘুম, সতেজ হয়ে জেগে উঠার জন্য এই নিদ্রা- জানিনা, কোথায় কোথায় আছে এই ধরনের একটি সুশীল সমতল, সবুজ গাছপালায় সুশোভন ? আমাদের এই পৃথিবীতে ? কিন্তু আমাদের পৃথিবীতে তো এই ধরনের একটি সমভূমি থাকার কথা আমরা শুনিনি আর আজতো পৃথিবীতে অনাবিষ্কৃত অঞ্চল খুব কমই রয়েছে- হয়তো এখনও কোনোভাবে মানুষের চোখে না পড়ে থেকে গেছে কোনো দুর্ভেদ্য ঘন অরণ্যের মধ্যে এক টুকরো বিস্তীর্ণ সমভূমি? কিন্তু দূর সন্ধানী উপগ্রহের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে থাকতে পারে এই ধরনের একটুকরো ভূমি? আমাদের নিকটতম  উপগ্রহটিতে, চন্দ্রেতো নেই কোনো আবহ,তার মাধ্যাকর্ষণও আমাদের পৃথিবীর মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ,সেখানে নেই কোনো উদ্ভিদ। তাহলে সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে? উপগ্রহে? কিন্তু কোথায় আছে এই ধরনের গ্রহ? কিছু গ্রহ হল অধিক উষ্ণ, যেমন বুধ বা অতি শীতল যেমন ইউরেনাস এবং নেপচুন, এগুলোতে অক্সিজেন নেই অর্থাৎ আমাদের জন্য মোটেই বাসোপযোগী নয়। এই সব গ্রহের মাধ্যাকর্ষণও আমাদের জন্য উপযোগী নয়। একমাত্র মঙ্গলগ্রহেই হয়তো প্রাণী থাকার কথা ভাবা যেতে পারে। হয়তো মানুষের মতোই প্রাণী, কেননা মঙ্গল হল যেন পৃথিবীর ছোট ভাই, পৃথিবীর চেয়ে শীতল কিন্তু খুব বেশি শীতল নয়। এখনও দিনগুলি প্রায় 24 ঘন্টা, দুই মেরুতে বরফ আছে, এখানে সেখানে জল আছে, যা হল জীবনের জন্য মূল দ্রব্য- কিন্তু এর আবহাওয়ায় রয়েছে অঙ্গার গ্যাস,অক্সিজেন নেই,যা  নাহলে আমরা বেঁচে থাকতে পারব না- তাহলে কি বৃহস্পতি বা শনির কোনো উপগ্রহে? কিন্তু হায়, সৌরজগতের কোনো উপগ্রহেই তো অক্সিজেনের সন্ধান পাওয়া যায়নি…

তাহলে আমাদের সৌরজগতের বাইরে কোনো গ্রহ উপগ্রহে?

  • *                             *                             *                           *

জানিনা, কীভাবে? জানিনা কীভাবে গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের সৌর প্রণালীর বাইরের এই শান্তি সমতলে? আমরা জানি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তারা আছে অগনন, আমরা জানি-মানে,আমরা জানি না, কিন্তু আমরা নিশ্চিত যে এই অসংখ্য তারা বা নক্ষত্রের চারপাশে আবর্তন করছে বিভিন্ন ছোট বড় গ্রহ উপগ্রহ অর্থাৎ অন্তরীক্ষে রয়েছে কোটি কোটি সৌরজগৎ,তার কোনো কোনো গ্রহ উপগ্রহে প্রাণ আছে,জল আছে, অক্সিজেন আছে, আছে কোটি কোটি প্রজাতির উদ্ভিদ এবং জীব রূপ, যেখানে হয়তো লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের পরে উদ্ভব হয়েছে প্রাণী, হয়তো কালের অনন্ত স্রোতে সেইসব বিলুপ্ত হয়ে গেছে যেভাবে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ডাইনোসরাস এবং টাইরানস এবং বন মানুষ, হয়তো উদ্ভূত হয়ে চলেছে বা উদ্ভব হয়েছে বুদ্ধিমান প্রাণী, মানুষের চেয়ে উন্নত চিন্তাশীল প্রাণী, উন্নীত হয়েছে সভ্যতার উচ্চ শিখরে- বিশ্বে নাকি ‘গ্যালাক্সি’ বা  নক্ষত্র মহানগরী আছে দশ হাজার কোটি, মোট নক্ষত্র রয়েছে নয় কোটি কোটি নিযুত (অর্থাৎ একের পিঠে কুড়িটা শূন্য বসালে যা হবে তা )আমরা বসবাস করা গ্যালাক্সিটা হল ছায়াপথ, আর ছায়াপথেই রয়েছে দশ হাজার কোটি তারা বা সূর্য। আর এই ছায়াপথেই নাকি রয়েছে এক লক্ষ থেকে এক নিযুত সংখ্যক উন্নত সভ্যতা,এইসব কয়েকশো আলোকবর্ষ দূরে দূরে অবস্থিত, আর তারা অনাতাঁর সংকেত প্রেরণ করতে সক্ষম।

এক আলোকবর্ষ মানে আলো এক বছরে যত দূর যায় সেই দূরত্ব। আলোর বেগ হল সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল এবং এটা অনাতাঁর তরঙ্গেরও বেগ(কেন না আলো হল অনাতাঁর তরঙ্গের মতো এক ধরনের বিদ্যুৎ চুম্বক তরঙ্গ)। কিন্তু সূর্যের পরে আমাদের নিকটতম নক্ষত্রটি হল প্রক্সিমা সেন্টরাই,( খালি চোখে দেখা যায় না) পৃথিবী থেকে ৪.২২আলোকবর্ষ দূরে, অর্থাৎ পৃথিবী থেকে আলোর (তথা বেতার তরঙ্গ) সেখানে যাবার জন্য সময় লাগবে ৪.২২ বছর। তারপরের নিকটতম নক্ষত্র হল আলফা সেন্টোরি যার দূরত্ব আমাদের থেকে ৪.৩৫  আলোকবর্ষ অর্থাৎ রেডিও সংকেত বা আলো যাবার জন্য সময় লাগবে ৪.৩৫ বছর অর্থাৎ প্রায় ৪ বছর ৪ মাস। একটি মহাকাশযানে উঠে যদি আমরা পাড়ি দেই আমরা গিয়ে পৌছাবো না কেননা সেকেন্ডে ৫ মাইল গতিবেগে (আজকাল হয়তো নয়মাইল বেগে) গেলেও আমাদের সময় লাগবে প্রায় ৮০ হাজার বছর। অন্য গ্রহে যেতে হলে লাগবে আরও কত লক্ষ বছর।

না আমরা নিশ্চয়ই আমাদের সৌর জগত ছেড়ে কোথাও আসিনি, নিশ্চয় আমাদের পৃথিবী ছেড়ে কোথাও আসিনি কেননা বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। তাহলে হয়তো কল্পনাতে এসেছি এই সুশীল সমতলে? হ্যাঁ, সেটা সম্ভব। শংকরদেব বলেছেন ‘মনেসেতে আছে ইটো চৈধ‍্যই ভুবন’, গ্রহ গ্রহান্তরের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর আবশ্যক নেই। এবং মনসেতে স্থির হয়ে আছে আমাতের কাম্য ভুবন, আমাদের তীর্থযাত্রার লক্ষ্য স্থান সেটি হল হাজার সমস্যা অসুবিধায় আকীর্ণ আমাদের নিজের পৃথিবী, আমাদের মাতৃ, আমাদের ধরিত্রী। ছাত্র ছাত্রী যেভাবে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বলে alma mater, প্রিয় জননী, সেভাবে মানুষের জন্য পৃথিবীই চাই আদরের মা, এখানেই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য, জীবন সংগ্রামে পরভৃত না হয়ে নিজের অস্তিত্ব অটুট রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধাপে ধাপে শিক্ষা দিয়েছে, ধরিত্রী শিক্ষা দিয়েছে, শিক্ষা দিয়েছে,শাস্তি দিয়েছে, মাঝেমধ্যে হয়তো ধারণা হয়েছে ধরিত্রী একজন অতি কঠোর শিক্ষয়িত্রী, অতি নির্মম, অতি কঠিন হৃদয়, কিন্তু এসবের মাধ্যমে যেন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করিয়ে নিয়েছে পৃথিবী। দূরদূরান্তে পাড়ি দেয় মহাকাশচারীরা,কিন্তু তাদের মহাকাশযানের এন্টিনা অর্থাৎ আকাশীতাঁরের   সব সময় লক্ষ্য থাকে পৃথিবীর দিকে, আলোকীয় দূরবীন এবং রেডিও দূরবীন সবসময় পৃথিবীর দিকে থাকে অভিযাত্রী এবং পৃথিবীর মধ্যে ক্রমশ বেড়ে যায় ব্যবধান কিন্তু অবিচল থাকে অনাতাঁর সংকেত এবং দূরবীনের দিক, মাতৃ এবং সন্তানের মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য সংযোগ রেখা। অন্তরীক্ষে বহু দিন কাটিয়ে মাধ্যাকর্ষণের বাইরের মহাকাশ কেন্দ্রে সুদীর্ঘকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে অবশেষে নিজের ধরনের বায়ুমণ্ডল এবং মাধ্যাকর্ষণে প্রত্যাবর্তন করে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নভোচারী, যেন ছিন্নমূল প্রবাসী ফিরে আসে নিজের বাড়িতে। যতই কষ্ট হোক না কেন মানব জীবন যতই অসহনীয় সংঘাতপূর্ণ হোক না কেন মানুষের স্থিতি, নিজের বাড়ি মানে নিজের বাড়ি। বিশাল নভোমন্ডলে নক্ষত্র নীহারিকার গান মানুষ শুনেছে, কিন্তু তাতে পায়নি তাদের প্রাণের স্পন্দন। মানুষ নিজের দ্বন্দ্ব এবং আকুলতার ছন্দে নিজেই রচনা করে নিয়েছে তাদের জীবন সঙ্গীত। বিবর্তনের স্রোতে এসছে ‘চেতনা’ এবং ‘বুদ্ধি’, এসেছে দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক, এসেছে কবি এবং শিল্পী, এসেছে বিটোফেন- ‘প্রধানত দুঃখ আছে’ বিঠোফেন  প্রসঙ্গে এক জায়গায় পড়েছি, ‘কিন্তু সেই দুঃখ ভেদ করে আনন্দের ইঙ্গিতও রয়েছে… এটা জীবনের সার্বজনীন পরিস্থিতি, এটা তার সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি। তিনি সঙ্গীতে রূপায়িত করলেন তোমার আমার হৃদয় জ্বালা এবং তোমার আমার হাসি। অন্যায় আছে,অবিচার আছে, অকারণ দুর্ভাগ্য, যুক্তিহীন কষ্ট কিন্তু ও, জীবন আছে, যৌবন আছে, অবিচল কঠোর প্রচেষ্টা আছে , উঠতে হবে, উঠতে হবে, অদৃষ্টকে উলঙ্ঘন করে বীরত্বের মর্যাদায় উঠতে হবে…সমালোচক বলেছেন, হাইডেন এবং মোজার্ট সঙ্গীতকে যে উচ্চ বেদীতে স্থাপন করে গিয়েছিল, তিনি সঙ্গীতকে সেখান থেকে নামিয়ে আনলেন। সঙ্গীতের মসৃণতা কোমলতা তিনি খন্ড-বিখন্ড করে তাকে জীবনের কর্কশ রুক্ষ কঠিনতার   ছাঁচে গড়ে তুললেন, সঙ্গীতকে তিনি জীবনের ঘূর্ণিপাকের নিমজ্জিত  করে দিলেন-‘

স্নেহময়ী মা কি আমাদের পৃথিবীর দিকে টানছেন, বিঠোফেন কি আমাদের পৃথিবীর দিকে টানছে?

  • *                            *                                   *                          *

জানিনা, কেন। জানিনা কেন আমাদের কল্পলোকে এল দেবদারু গাছের এই স্বহৃদয় সমতল। হয়তো এখানে সেখানে পড়তে পাওয়া কিছু বাক্য জন্ম দিয়েছে এই ধরনের কল্প সম্ভাবনার, এই ধরনের অভীপ্সার।স্কটল্যান্ডের একজন লেখক ডক্টর পল ব্রুন্টন (Dr Paul Brunton) হিমালয় গিয়েছেন, তেহরি গাড়ওয়াল অঞ্চলের হিমালয়ের উপরে পেয়েছেন ব্রিটিশের দিনের বন বিভাগের একটি ছোট অব্যবহৃত পরিদর্শন বাংলো, সেখানে গিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন, হিমালয়ের বিস্তৃত বরফ এবং নির্জনতায়,শীত এবং দেবদারু বনানীর মধ্যে তিনি ভারতীয় ঋষি মুনির মতো ধ‍্যান অভ্যাস করবেন- সেই দিন গুলি বর্ণনা করে তিনি একটি বই লিখেছেন (A Hermit in the Himalayas), তিনি লিখেছেন যে তিনি যে পাথরের উপর বসে বসে ধ্যান করেন এবং রাতে আকাশের তারা দেখেন তার সামনে একটা দেবদারু যেন তাকে নিরীক্ষণ করে থাকে মাঝেমধ্যে তিনি গাছটির সঙ্গে কথা বলেন হয়তো জিজ্ঞেস করেন কথাটা এরকম এরকম, নয় কি, আর দেবদারু গাছটি তখন তার দিকে সামান্য হেলে যেন মাথা নাড়িয়ে  হ‍্যাঁ বলে উত্তর  দেয়, না হলে হয়তো এদিক থেকে ওদিকে আন্দোলিত হয়ে যেন মাথা নাড়ায়, যেন বলে, না, তিনি সেখানে আরও দেখতে পেয়েছেন গিরিশৃঙ্গ আবৃত এক জায়গায় একজন ধ্যানস্থ তপস্বী দিনের পর দিন একই জায়গায় বসে আছেন দিনের রোদে, রাতের অন্ধকারে, তুফান বৃষ্টি এবং প্রবল তুষারপাতের মধ্যে, অবিচল নিলিপ্ত যেন এই সমস্ত তাকে স্পর্শ করে না লেখোকের মনে এসেছে গীতায় বর্ণিত স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির কথা যে উঠেছেন বিপরীত লিঙ্গের উপরে অর্থাৎ সুখ-দুঃখ হর্ষ বিষাদ যাকে প্রভাবিত করে না,শীততাপ তাকে বিচলিত করে না, সমস্ত পরিস্থিতিতে অটল এবং নিস্পৃহ… হয়তো সেই সমস্ত বর্ণনায় আমার কল্পনায় এনেছে দেবদারুর ছবি, দেবদারু সদৃশ্য কোনো সচেতন উদ্ভিদের ধারণা, যার ‘প্রাণ’ আছে ‘বুদ্ধি’ আছে, যা আমাদের অভিজ্ঞতার অগোচর কোনো প্রচ্ছন্ন জীবন রূপ… বৈজ্ঞানিকও নাকি কল্পনা করেছেন এই ধরনের জীবন রূপ, যার ‘মন’ দেহ থেকে মুক্ত, যে ‘মন’ক্ষয়িষ্ণু এবং ভঙ্গুর দেহের ক্রিয়া প্রক্রিয়ার ওপরে নির্ভরশীল নয়, হিমালয়ের এই তপস্বীটির মতো …  একজায়গায় পড়েছি যে ‘…ভাইকিং, ভয়েজার ইত্যাদির স্বয়ংক্রিয় অন্বেষকগুলি, ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযাত্রীরা হয়তো কোনোদিন খুঁজে পাবে না পৃথিবীর মতো মানুষ অথবা পৃথিবীর মতো ৩০ কোটি জীবন রূপের কোনো একটি। তারা যা পাবে তা হয়তো হতে পারে এই রকম ধরনের জীবন যা সম্পূর্ণ অপার্থিব (অর্থাৎ পদার্থবিহীন,অ বস্তু), হয়তো যা সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়াতীত। হয়তো এই ধরনের জীবন রূপ( এটা আর্থার সি ক্লার্ক এর আকাশচুম্বী ভবিষ্যকল্পনা) যে জীবন রূপে কোনো অত‍্যুচ্চ  সভ্যতাই সমস্ত ধর্মের চরম লক্ষ্য বাস্তবায়িত করেছেঃ দেহের কারা থেকে ‘আত্মা’কে মুক্ত করেছে, বস্তুর পিঞ্জর থেকে মনকে বিমুক্ত করেছে- অর্থাৎ যে জীবন রূপে ‘মন’বা ‘বুদ্ধি’ দুর্ঘটনা প্রবণ, জরা ব্যাধি  মৃত্যুর বশীভূত কোনো শরীরের উপরে নির্ভরশীল নয় (এমনকি আমাদের পৃথিবীতে এই দিক দিয়ে ইতস্তত ছোটখাটো পদক্ষেপ আমরা করতে শুরু করেছিঃ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-রক্তমাংস বিচ্যুত করতে শুরু করেছে কৃত্রিম  দেহাংশ- প্লাস্টিকের হৃদয়,  নাইলনের স্নায়ু, রবারের ফুসফুস, ইলেকট্রনিক চোখ, বায়নিক কান, কৃত্রিম ত্বক, কৃত্রিম রক্ত- কাল ক্রমে এইসবের স্থান নেবে হয়তো বিদ্যুৎপ্রবাহ, চৌম্বক ক্ষেত্র, লেজার তরঙ্গ অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে পদার্থ বস্তুর থেকে তরঙ্গ, শক্তিক্ষেত্র…

জানি না, এখন কি, এখন কোথায়। জানিনা কত সময় পার হয়ে গেছে,মনে হয় যেন দিন শেষ হয়ে এসেছে। হয়তো এখন অন্ধকার হবে, আকাশে তারা ফুটবে, নক্ষত্রপুঞ্জের রাশিচক্র গুলি থেকে বুঝতে পারব এখন কোথায় আছি- কিন্তু আকাশ সেরকমই আছে কোনো জ্যোতিষ্ক দেখা যায় না, বোঝার উপায় নেই আকাশে আছে আমাদেরই সূর্য না অন্য কোনো নক্ষত্র। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি, স্থির করতে পারছি না এই নিশ্চিন্ত নিরুদ্দেশ নশ্বর নৈসর্গের পরিপূর্ণ প্রশান্তিতে এখানে থেকে যাব না এখানে থেকে যাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই, এই পুরস্কার আমি অর্জন করিনি। ধীরে ধীরে যেন কিছু একটা সংশয় চিত্ত চঞ্চল করে এনেছে, যেন অন্তর থেকে কিছু একটা বলছে যে এখনও সময় হয়নি, তোমাকে একটা পূর্বাভাস দেখানো হয়েছে মাত্র। তার জন্য তুমি নিজেকে প্রস্তুত কর, ফিরে যাও, ফিরে যাও- কিন্তু কোথায় ফিরে যাব ? যদি এটা আমাদের এই পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত এবং অজ্ঞাত দৃশ্যপট, তাহলে তো -কিন্তু না, এটা আমাদের পৃথিবী যদিও, বাস্তবে এটা আমাদের পৃথিবী নয়, আমাদের আকাশীতাঁর যেদিকে অবিচলভাবে ঝুঁকে আছে, সেদিকেই আমাদের পৃথিবী,সামনের দেবদারু গাছ গুলোর দিকে তাকালাম তার পাতাগুলি আমার দিকে হেলে এসে যেন স্মিতহাস্যে মাথা নিচু করল, যেন বলল, হা এটাই উচিত সিদ্ধান্ত- তোমার মঙ্গল হোক- বিদায়- বিদায়-’ তারপর শাখা প্রশাখা গুলি পুনরায় যথাস্থানে ফিরে গিয়ে স্থির হয়ে রইল।

আমিও একদিন তাকিয়ে রইলাম রেডিও দূরবীনের দিকদর্শক রেখা স্থির করে দেওয়া আমাদের সংঘাত সংকুল গোলোকটার দিকে, যেন পরম পুলকের প্লাবনে স্পর্শ করে গেল প্রাণ-মন, বুঝতে পারলাম যে আমরা ফিরে যাব আমাদের প্রিয় ধরিত্রী মায়ের কোলে, আমরা শুনব গিয়ে বিঠোফেন-

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত