Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Saurabh Kumar Chaliha

অসমিয়া অনুবাদ গল্প: হেবিটেট । সৌরভ কুমার চলিহা

Reading Time: 11 minutes

লেখক পরিচিতি-১৯৩০ সনে অসমের মঙ্গলদৈ শহরে সৌরভ কুমার চলিহার জন্ম।এটা ছদ্মনাম।প্রকৃত নাম সুরেন্দ্রনাথ মেধি। অসমীয়া ছোটগল্পের নতুন রীতির প্রবর্তক সৌরভ কুমার চলিহা পঞ্চাশের দশকে অশান্ত ইলেকট্রন নামে একটি গল্প লিখে সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ গুলির যথাক্রমে অশান্ত ইলেকট্রনএহাত বাবা গোলাম নির্বাচিত সংকলন দুপুরিয়া ইত্যাদির জন্য গোলাম গ্রন্থের জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন ।২০১১ সনে মৃত্যু হয়।


রাতে শোবার জন্য গিয়ে দেখি তোষকের উপরে বিছানার চাদরটা নেই, বালিশগুলিতে ওয়ার নেই। আজ সকালবেলা চায়ের টেবিলে অবশ্যই ও একবার বলেছিল,’ তোমার বিছানার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, আজ সেগুলি ধোবির কাছে দেব, এত নোংরা বিছানায় মানুষ কি ঘুমোয়, রাম রাম, চায়ের দাগ, ঘামের গন্ধ, বালিশে সিগারেটের ছাইয়ের দাগ – তোমরাই পার এভাবে থাকতে- আজ ধোবির আগের কাপড়গুলি দেওয়ার কথা বিছানার চাদর বালিশের ওয়াড় বদলে দেব, তাহলে থাকবে আরও একটি দিন তোষকের ওপরে -‘

অর্থাৎ আজ বোধহয় ধোবি পুরোনো কাপড়গুলি দেয়নি। ইংরেজদের শোবার ঘরটা নাকি তাঁর দুর্গ (An Englishmans bedroom is his castle), আর আমার জন্য আমার বিছানাটা হল দৈনন্দিন জগত থেকে অন্তরিত আমার ব্যক্তিগত বিরামের দ্বীপ- ইউরোপ-আমেরিকার কোনো কোনো ধনকুবের টাইফুনের যেভাবে থাকে দূর সাগরের মধ্যে নিজ নিজ নিভৃত দ্বীপ- আমার একান্ত অন্তরঙ্গ আবাসস্থল, আমার নিজস্ব ‘হেবিটেট’ (habitat)-

আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি আর নির্লিপ্তভাবে বলছি, আচ্ছা হবে, এবং দ্বিতীয় পেয়ালার জন্য কাপটা এগিয়ে দিয়েছি, তখন চোখে পড়েছে যে কাপটা দেখছি আলাদা, আমার অভ্যস্ত কাপটা নয়-ওহো, এটা আবার কী কাপ বের করলে?’ ও চা ঢালতে ঢালতে বলছে,’ ‘কেন, কাল যে প্রীতি দিদির সঙ্গে মুকুল স্টোর থেকে নতুন সেটটা কিনেছি, গতকাল তো খুব সুন্দর হয়েছে বলেছিলে- হ্যাঁ ভালোই হয়েছে ডিজাইন টা সুন্দর কিন্তু এই সমস্ত ফেন্সি কাপ প্লেট সব সময় ইউজ না করাই ভালো নাকি, আমাদের যা ঘর, দুদিনেই ভেঙ্গে টেঙ্গে শেষ হবে- অতিথি এলে পরে বের করলেই ভালো- আমাকে আমার পুরোনো কাপেই দিও তাতে আমার পরিমাণটাও ঠিক হয়, খেয়েও তৃপ্তি পাই- ও মুখের মধ্যে একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলেছে এবং বলছে’ পুরোনো কান ভাঙ্গা কাপটায় না খেলে চা-কে চা বলে মনে হয় না তাই না, তোমার দেখছি ভালো রুচি -টুচি হারিয়ে বসেছ, রাম রাম-‘

ঠিক বুঝতে পারলাম না, আমার অভ্যস্ত কাপটা আর চায়ের টেবিলে দেখতে পাব কি পাব না- কানটা এক জায়গায় ভেঙেছে ঠিক (কাজ করা মহিলাটি বাসনপত্র যেভাবে রাখে), কিন্তু সেটা আর কী এমন বড় কথা, চা’টা ভালো বানালেই তো হল-

‘আচ্ছা ভেবে দেখ কী ভালো দেখায়’, কূটনৈতিকভাবে বলেছি এবং টেবিল থেকে উঠছি, তিনি বলছেন, আজ যেভাবেই হোক ব্লিচিং পাউডারটা আনতে ভুলে যেও না, প্রতিদিনই বলছি বাথরুমটা এত পিছল হয়ে গেছে, গতকাল রাতে তো আমি পড়েই যাচ্ছিলাম। কোনদিন আমার হাত পা ভাঙলে দেখছি তোমার হুঁস আসবে। আজ যেভাবেই হোক ব্লিচিং পাউডারটা আনবে, বাথরুমের মেঝেটা ভালো করে ঘষতে হবে– আর ‘নীল অডর’ একটা– বাথরুম থেকে যে কী গন্ধ বেরুচ্ছে, কোনো গন্ধ টন্ধ পাওনা নাকি, তোমাদের কি নাক কান কোনো কিছুই নেই, রাম রাম–’

‘ও, নিল-অডর? আচ্ছা, ঠিক আছে। বাথরুম প্রসঙ্গটা সেখানেই বন্ধ করলাম। না হলে হয়তো আবার একটা গীজার লাগিয়ে দেওয়ার কথা বলবে– প্রত‍্যেকেই আজকাল বাথরুমে একটা গীজার রাখেই, এইতো সেদিন মিসেস বরবরা তাদের বাথরুমে নতুন একটি লাগিয়ে নিয়েছেন বলেছেন– কিন্তু আমাদের যে ভাঙ্গাচুরা বাথরুম, পাকা খসে গিয়ে নতুন করে সিমেন্ট ঢেলে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে রাখা তেল সাবানের সেলফগুলিতেও আবর্জনার স্তূপ জমেছে, কাপড় গামছার রডগুলি ও ঢিলে হয়ে গেছে, বেসিনটাও প্রতিদিন ধুয়ে মুছে চকচকে করে রাখার দেখছি কারও সময় হয় না, আয়নার মধ্যে তো সব সময় মাকড়সার জাল বাসা বাঁধে ধুলোর স্তর তার মধ্যে আবার হাজার টাকা খরচ করে একটা মস্ত ঝকঝকে গীজার বসানোর কী আর এমন দরকার! (যাই হোক, ব্লিচিং পাউডারটা এনে দিয়েছি, ‘নিল-অডর’ একটাও এনে দিয়েছি, বিকেলে বাথরুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়টের পেয়েছি আগের সেই ভিজে ভিজে গন্ধটা দূর হয়ে একটা মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে। যাক তাহলে, আজ এভাবেই তোষকের  উপরে শুয়ে পড়লেই হবে– সচকিত হয়ে তাকালাম, মশারিটা আছে বা নেই– আছে , বোধহয় ভুলে গিয়ে খুলে ফেলে নি–

‘তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি? আজকের রাতটা এভাবেই পারবে তো? কাল লন্ডিরটা পেলে মেলে দেব, এটাও কাল ধুয়ে দেব’, ‘না না লাগবে না, নতুন গুলিতে নিচের দিকে পট্টি নেই, লম্বায় ঠিক হয় না, ঠিকমত গোঁজা যায় না, প্রস্থেও কম– আমার জন্য এটাই দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ঠিক আছে, এটাই থাকুক।’ ‘না সিগারেটের ধোঁয়া লেগে লেগে কী যে রং হয়েছে মশারিটার, মশারির ভেতরে সিগারেট খেতে এত নিষেধ করেও তোমার বদ অভ্যাসটা আর দূর করতে পারলাম না। এত যে নোংরা থাকতে ভালোবাস তুমি রাম রাম – যাক, আজকের রাতটা অন্তত আমার আরামের মশারিটা (অবশ্য মাথার দিকে বা হাতে একটা ফুটো বের হয়েছে, তারমধ্যে ওর কাপড় মেলা একটি ক্লিপ চুরি করে এনে লাগিয়ে ফুটোটা বন্ধ করে রেখেছি, কিন্তু কথাটা ওকে বলিনি, বললেই সেলাই করতে খুলে নিয়ে যাবে)।

দিনের বেলা বই- খবরের কাগজ পড়ার অবসর পাই না। রাতের বেলাও দশটা পর্যন্ত বাইরের যানবাহন ইত্যাদির গন্ডগোল বিরক্ত করে,নয়টা পর্যন্ত তো পাশাপাশি দুটো ক্যাসেটের দোকান যেন একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে প্রচন্ড জোরে লাউডস্পিকারে ক্যাসেট বাজাতে থাকে! আমার দ্বীপটার ভেতর প্রবেশ করলাম, আমার ‘হেবিটেট’, এখন গিয়ে এর ভেতর নির্ঝঞ্ঝাটে এক ঘন্টা পড়াশোনা করতে পারব… মনে পড়ল, গত কাল আমার বন্ধু শফিকুল জামালের সঙ্গে ‘হেবিটেট’র বিষয়ে কথা বলেছি— শফিক থাকে শহরের অন্যপ্রান্তে রেললাইনের ওপারে পাহাড়ের নীচে, মাঝেমধ্যে সন্ধেবেলা সেখানে গিয়ে (একটা উডপেকার হুইস্কির বোতল খুলে নিয়ে) কিছুটা সময় কাটানোর জন্য বসি (সঙ্গে জল বা সোডা, কখনও কোকা-কোলা! আর শফিকের স্ত্রী জেবিনভেজে দেওয়া গরম গরমপকোড়া)– আমরা দুজনেই সাধারণত শান্ত স্বরে কথা বলি, কিন্তু তার মধ্যে রেলগাড়ির ধক ধক এবং তীক্ষ্ণ হুইসেল কথাবার্তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য করে, আর ইদানিং আরম্ভ হয়েছে মাথার উপরে মাঝে মাঝে ধিংধাং শব্দ টিনের চালায়– সেটা হল বাঁদরের উৎপাত! পেছনের পাহাড়গুলোতে মানুষ যেখানে সেখানে ঘর বানিয়েছে, এমনকি দালান বানিয়েছে, পাহাড় গুলির পাথর ভেঙ্গে মাটি কেটে বাঁশ গাছ কলাগাছ সবকিছু কেটে ছিন্নভিন্ন করেছে– ফলে এতদিন পাহাড়ে নির্বিঘ্নে নিভৃতে থাকা বাঁদরগুলি ঝাঁকে ঝাঁকে নিচে নেমে এসেছে, বাড়ি ঘরে ঢুকে যেখানে যা পাচ্ছে খাবার জিনিস নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করছে, ছোট ছেলে মেয়ে বা মহিলাদের তো ভয় করেই না, বরং তেড়ে আসে–

‘বুঝেছ ভাই’, শফিক বলছে,’ এটা একটা রেসিপ্রোকেল এফেক্ট, মানে, আমরা বাঁদরদের হেবিটেট নষ্ট করেছি, বাঁদর আমাদের হেবিটেট ধ্বংস করছে। আমরা বন-জঙ্গল ধ্বংস করে হাতির হেবিটেট ধ্বংস করেছি, হাতি গ্রামগঞ্জ খেতি বাড়ি উৎখাত করে আমাদের হেবিটেট উচ্ছন্ন করেছে –’

‘ও, আমি বলছি,’ নিউটনের থার্ডলঃ প্রতিটি ক্রিয়ার আছে সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া।’

‘হ‍্যাঁ, কিন্তু নিউটনের ল তো ফিজিক্সে থাকার কথা ছিল,কিন্তু এখন দেখছি নিউটনের থার্ড ল আমাদের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে কি ডাইলেমায় ফেলেছে– জেবিন এখানে আর একদিন থাকতেও নারাজ। সারাদিন সারারাত রেলগাড়িরউৎপাত– সেটার সঙ্গেও মানিয়ে নিয়েছিলাম, কিন্তু তার উপরে যদি বাঁদরের উৎপাতে টেনছ হয়ে থাকতে হয়, সব সময় বাঁদর তাড়ানোর জন্য হুশিয়ার থাকতে হয়, বাকি কাজকর্মের কী হবে– এখানে আর থাকা যাবে না, এখান থেকে যেতে হবে, জেবিন আর এখানে কোনো মতেই থাকবে না– কিন্তু এখন আমরা যাবই বা কোথায়, নতুন করে বাড়ি ঘর করার শক্তি সামর্থ্যই বা কোথায়, আর দেখ ভাই– যাবেই বা কোথায়, শহরের সব জায়গাতেই তো সেই একই দুর্ভোগ, একই অশান্তি–’

খালি গ্লাস দুটিতে আরও কিছু উডপেকার ঢেলে একটা পকোড়া মুখে দিয়েছি আর বলছি,’ একজেক্টলি। শহরের কোনো জায়গাই আর আজকের মানুষের হেবিটেটের উপযোগী নয়। এয়ার পলিউশন, ওয়াটার পলিউশন, নয়েজ পলিউশন, ওভার ক্রাউডিং, ক্রাইম, করাপশন– ইনফ্যাক্ট, সমগ্র পৃথিবী আজ বসবাসের জন্য একেবারে আনফিট–’

শফিক হুইস্কিতে একটা চিন্তিত চুমুক দিয়েছে এবং বলছে,’ হ‍্যাঁ ভাই, আজ সারা দুনিয়ার নসিব ঝুলছে মাফিয়ার হাতে, টেররিস্টের হাতে– কোন মুহূর্তে কোন পাগল ফান্ডামেন্টালিস্ট নিউক্লিয়ার মিসাইলের বোতাম টিপে দেবে–বেং–বুম– সব খতম, কোন মাথা খারাপ ডিক্টেটর কখন উত্তেজিত হয়ে বিষাক্ত বীজাণুর চুঙা খুলে দেবে– ব‍্যস, শ্বাস প্রশ্বাস নিতে না পেরে সব মৃত্যুর কোলে একটু একটু করে ঢলে পড়বে, পচতে থাকবে সমগ্র বায়ুমন্ডলে কেবল রেডিও অ্যাকটিভ বিষ–মানে, সম্ভব হলে এই পৃথিবী ছেড়ে পালাতে হবে –’

আমাদের আবাসস্থল পৃথিবীর সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের কথা ভেবে গভীর আশঙ্কা এবং দুশ্চিন্তায় আমরা নীরবে হুইস্কিতে চুমুক দিচ্ছি পকোড়া চিবোচ্ছি, তারপর পরিবেশটা পরিবর্তন করার জন্য আমি বলেছি,’ ইনফ্যাক্ট, একদিন হয়তো মানুষকে সেটাই করতে হবে– জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, স্থানাভাব, খাদ্যাভাব, ইন্ধন তথা শক্তির অভাব,ওজোন হ’ল, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, এইসবের ফলে বরফ গলে পৃথিবী ডুবে যাবে, কোনোভাবে পরমাণু যুদ্ধ লাগলে তেজস্ক্রিয়তায় বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত হয়ে যাবে, কোনো উল্কাপিন্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পৃথিবী চূর্ণ হয়ে যাবে এবং আরও কত কি– তাই এই বিপদ সংকুল পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের কোনো গ্রহে উপগ্রহে উপনিবেশ পাতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই–

হুইস্কিটুকু শেষ করতে করতে আমরা কথাটা আরও কিছুটা আলোচনা করছি। 

‘বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের আবাসস্থল(Habitat -Today and Tomorrow) বলে একটি বিশ্বজোড়া সংস্থার পত্তনহয়েছে, নরওয়ে না ফিনল্যান্ডে তার মুখ্য কার্যালয়, কোথা থেকে জানি তারা অনেক বড় অঙ্কের টাকা অনুদান পায়, পুস্তিকা প্রচার করে, সেমিনারের আয়োজন করে, রেডিও-টিভিতে নিজেদের চ্যানেল আছে, ইন্টারনেটে একটা ওয়েবসাইট আছে, মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপদ আবাসস্থলের বিষয়ে বিশদ ভাবে বিশ্লেষণ করে, অধ‍্যয়ন চালায়, পরিকল্পনা গ্রহণ করে– তার ভেতরে মহাকাশের কোনো গ্রহ উপগ্রহে গিয়ে সংস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলে… কিন্তু কোন গ্রহে? সৌরজগতে মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী হয়তো কেবল মঙ্গল গ্রহ… কোন উপগ্রহে? বিভিন্ন গ্রহের নানান উপগ্রহের মধ্যে হয়তো মাত্র একটি বা দুটি বা হয়তো একেবারে সৌর জগতের বাইরের…

‘হ‍্যাঁ, কাগজে কিছু কিছু দেখেছি’, শফিক বলেছে,’ ইন্ডিয়াতেও নাকি সেদিন তারা একটি চ্যাপ্টার খুলেছে– আগামী সেপ্টেম্বর মাসে নাকি ত্রিবান্দম না লক্ষ্মৌতে তারা একটি সেমিনারের আয়োজন করবে।’

‘হ্যাঁ আগামী সেপ্টেম্বরে।’

বিছানার পাশের আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি।

  

… এভাবে আরও কয়েকটি সন্ধ্যা আমার ফুটো মশারির হেবিটেটটার ভেতরে ঢুকে কিছু পড়াশোনা করলাম (একটু কষ্ট করে দু-একটি বই ম্যাগাজিন জোগাড় করেছি ) মনে মনে কিছু পর্যালোচনা করলাম, দিনের বেলা কিছু সময় বের করে একটা ছক প্রস্তুত করলাম, সৌর জগতের কয়েকটি গ্রহ-উপগ্রহের বাস যোগ্যতার সূচক কিছু সংখ্যা – সূর্য থেকে দূরত্ব কত, আবর্তন কাল কত, কতটা উত্তাপ এবং আলো পায়, মাধ্যাকর্ষণ কত (দরকার হলে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে নাকি), আবহমন্ডলে কী কী আছে (মিথেইন অ্যামোনিয়া, অঙ্গার গ‍্যাস… হায়, অক্সিজেন দেখছি কোথাও নেই, কিন্তু হয়তো বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে।), জলের সম্ভাবনা কত, কী কী কাঁচামাল পাওয়া যেতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি– ঠিক একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা- পত্রিকা, কেবল বিদিত তথ্যের ভিত্তিতে একটি তুলনামূলক ছক সঙ্গে কয়েকটি গ্রাফ… পর্যালোচনা করলাম’ হেবিটেট– টুডে’ টুমরো কে কাগজটা পাঠিয়ে দিলে কেমন হয় (সেপ্টেম্বরের সেমিনার)… অবশেষে একদিন আলোটা নিভিয়ে শুতে যাচ্ছি, যখনই শুনতে পেলাম দরজার কাছ থেকে ও বলছে,’ ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?’ অর্ধেক ঘুমে আমি বলেছি, হ্যাঁ, কেন?’ ‘অটোর কথাটা বলে রেখেছে তো?’,হ‍্যাঁ, কাল সকাল পাঁচটায়  আসবে বলেছে।’ ‘ ঘুমিয়ে পড় তাহলে, ভোর চারটায় আমি জাগিয়ে দেব, এলার্ম দিয়ে রেখেছি’,’ আচ্ছা, আমি বলেছি আর শুয়ে পড়েছি। কাল খুব ভোরে উড়ান, বিমান অফিস এখান থেকে বেশ দূরে, এত সকালে বাসও নেই, এখন অটোটা ঠিক সময়ে এলেই হয়– সাড়ে পাঁচটায় এয়ার টার্মিনাল থেকে এয়ারপোর্টের কোচ, ছয়টার রিপোর্টিং টাইম… কলকাতায় বিমান বদলি… সেখান থেকে লক্ষ্মৌর উদ্দেশ্যে যাত্রা… সেমিনারের জন্য আমার গবেষণাপত্র গৃহীত হয়েছে …

 

… লক্ষ্মৌ– পুরোনো কালের সৌজন্যে খানদানির জন্য বিখ্যাত, কৃষ্টি- সংগীত- সুরুচি, প্রাচীন প্রাসাদ এবং হাভেলির জন্য বিখ্যাত ঐতিহ্যপূর্ণ শহর – কিন্তু আজ প্রথম দৃষ্টিতে দেখতে অন্য যেকোনো মহানগরের ব্যস্ত জনপ্রবাহ, যান- আকাশ রেখায় কেবল সুউচ্চ গগনচুম্বী অট্টালিকা…’ হোটেল হায়াত কনিষ্কের সামনে টাঙ্গা থেকে নামলাম, দুসারি বড় বড় চকচকে ধাতুর টাবগুলিতে সাজিয়ে রাখা ফুলের ঝোপ গুলির মধ্য দিয়ে লাল কার্পেট পাতা সিঁড়ি গুলি বেয়ে উঠলাম। কাছের প্রকাণ্ড প্রবেশদ্বারের বাইরে রাজস্থানি পাগড়ি এবং খয়েরি রঙের উর্দিপরা প্রহরী সেলাম ঠুকল এবং দরজাটা খুলে ধরল… রিসেপশন কাউন্টারে’ হেবিটেট’ এর প্রতিনিধি চিদানন্দ শ্রীধরণী আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে লিফটে তৃতীয় মহলের ২১৮ নংরুমে রেখে গেলেন– দুঃখিত, এখন তিনি আমাকে সঙ্গ দিতে পারবেন না, নিচে পার্টিসিপেন্টরা আসছে, সন্ধ‍্যে ছয়টার পরে ‘এম্ব্রজিয়া’ বারে দেখা হবে–’ প্লেইনেই আপনার লাঞ্চ হয়ে গেছে? ভালো কথা, এখন তাহলে আপনি মুখ মুখ হাত ধুয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিন। এটা রুম সার্ভিসের বোতাম, চা কফি কিছু খেতে চান যদি, রুমে এনে দেবে– আচ্ছা, সোলং।’

তিনি এবং বেল বয় যাওয়ার পরে ব্রিফকেস থেকে আমার পেপারটা বের করে জানালার কাছে রাইটিং টেবিলটাতে রাখলাম, তার শ্বেড দেওয়া রিডিং ল্যাম্পটা একবার জ্বালিয়ে দেখলাম– রাত্রির দিকে আরও একবার কাগজটা রিভাইজ করে পড়ে দেখতে হবে– তারপরে রুমের চারপাশে একবার চোখ বোলালাম, সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা অবিশ্বাস এবং অস্বস্তিতে যেন ছটফট করতে লাগলামঃ ওক কাঠের পেনেলিং দেওয়া বড় সড় ঘর, বাতানুকূল, দেওয়াল দরজা জানালার রং ফ্যাকাসে সাদা, মাঝখানে ঝুলছে একটা ছোট বৈদ্যুতিক ঝাড়- লন্ঠন, তার নিচে কাচের একটি ছোট কফি টেবিল, মখমলের কুশন পাতা চারটি সাদা রঙের বেতের চেয়ার, বেড়ার এপাশে-ওপাশে ভিক্টোরিয়ান মডেলের কয়েকটি আলো এবং দুটো টিউবলাইট, বিভিন্ন সুইচ, একটি অমৃতা-শ্বের-গীলের প্রিন্ট এবং একটি কোনো বিদেশি ল্যান্ডস্কেইপ, দুটো ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট, দুটো ছোট ছোট দেরাজের ওপরে স্লাইডিং প্যানেলে ঢাকা একটা ওয়ারড্রব, বাইরে একটি দর্পণ, এককোণে  একটি রঙিন টিভি এবং একটি হাউস টেলিফোন (সেটাও হালকা সাদা) আসবাবপত্র কৃত্রিম সিপেনডেইল ফার্নিচারের আদলে আখরোটের কারুকাজ করা, পশ্চিম কোণে একটি একজনের বিছানা এবং পাশের গোলটেবিলে ঢাকা দেওয়া একটি বেডল্যাম্প, সবকিছুই পরিপাটি, টিপ টপ, সাজানো-গোছানো, কোথাও এক ফোঁটা ধুলোবালি নেই, এক ইঞ্চি মাকড়সার জাল নেই… এই নিখুঁত সুবিন্যাস্ত ঘরে কীভাবে খুশিমতো হাত পা মেলে দিয়ে কীভাবে নাড়াচাড়া করব, শার্টটা বা সেন্ডেল জোড়া যেখানে মন চায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে কীভাবে যেখানে সেখানে ধপাস করে বসে পড়তে পারব… হাত মুখ ধোয়ার জন্য সংলগ্ন বাথরুমে প্রবেশ করলাম, টাইল খচিত দেওয়ালের রং সাদা কলাপাতার, জলের টেপ, বেশিন,শাওয়ার, বাথটাব, বিভিন্ন ফিটিংস ঝকঝক করছে, মেঝেতে টাইলস না কাচ মার্বেলের মোজাইক ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু দেখতে অত্যন্ত মসৃণ, যেন পা পিছলে যাবে, ভয়ে ভয়ে পা ফেললাম, আমার ঘরের বাথরুমের পরিচিত’ নিল-অডরের’ গন্ধ নয়, কিছু একটা যেন ল্যাভেন্ডার বা লাইলাকের সূক্ষ্ম সুবাস, মুখটা ধুতে না ধুতে মনে হল, না, এই ক্লিওপেট্রার বাথরুম আমাকে ব্যবহার করতে হলে দেখছি নির্ঘাত কিছু একটা অঘটন… ট্রে এবং ন্যাপকিনে HK মনোগ্রাম লেখা, একটা ছোট টি-পটে চা এবং বিস্কুট– পেস্ট্রি এল, চা টা সুন্দর সুগন্ধি দার্জিলিং লপচু কিন্তু কাপটাতে চুমুক দিয়ে পুনরায় যেন  বিপন্ন অনুভব করলাম। ওয়েজউড পোৰ্সিলিনেরমতো ঠুনকো বন-চায়নার কাপ, ধারনা হল এই বোধহয় আমার মোটা মোটা আঙুলের চাপে প্লেটে ঠক করে নামিয়ে রাখার সময় ঠুং করে ভেঙ্গে যাবে… সমস্ত জিনিস দেখছি অতি সাবধানে অতি সন্তর্পনে আলগোছে ধরতে হবে– যাই হোক, নির্র্বিঘ্নে চা টুকু শেষ করলাম কাপটার কানটান না ভেঙ্গে, তার পরে ভাবলাম, এখন কি করা যায়, শ্রীধরণীর সঙ্গে দেখা হবে ছয়টার পরে, এখনও তো হাতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় আছে– টেবিলের উপরে রাখা ব্রশিয়র থেকে জানতে পারলাম যে’ এম্ব্রজিয়া’ ছাড়া আরও কয়েকটি বার আছে হোটেলের বিভিন্ন মহলে – এই মহলে বাঁদিকে আছে ‘ মুঘল-এ- আজম’ ডাইনিংরুম( মোগলাই, দক্ষিণ ভারতীয়), চতুর্থ মহলে মাঃ জং (Mah-Jong) রিট্রিট'( বিলিয়ার্ডস, পিং- পং,ব্রীজ আর হুইষ্ট খেলার ব্যায়ামেআগ্রহীদের জন্য একটা জীম (gym), ডান্সফ্লোর ষষ্ঠ মহলে ‘ হানী বাইট(Honey Bite) কাফেটেরিয়া এবং কনফারেন্স হল যেখানে কাল আমাদের সেমিনার আরম্ভ হবে), দ্বিতীয় মহলে ‘আর্কেডিয়া’ ভোজন কক্ষ( কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ,…), আরও কত কি– পঞ্চম মহলের’ মন্দাকিনী’ বার পর্যন্ত সিঁড়িবেয়ে উঠে গেলাম, সিঁড়ির যেখানে যেখানে কার্পেট নেই সেখানে মিহি মোজাইক, তাড়াতাড়ি উঠতে ভয় লাগে,’ মন্দাকিনী’তে তখনও মানুষ জমতে শুরু করেনি, বড়সড়বারটিতেছড়িয়ে রয়েছে কেবল দুই চারটি স্ত্রী-পুরুষ, স্টিরিওতে মৃদু ভলিউমে’ রোলিংস্টোন’ এর একটি সুর বেজে চলেছে, ড্রিংকসকাউন্টারেরপেছনদিকেতিনজন বার এটেন্ডার যুবক কাপড়দিয়ে গ্লাস মুছছে, পেছনদিকে সারি সারি দেশি-বিদেশিসূরার বোতল– যাক, এখনই কিছু একটা নিয়েনির্ঝঞ্ঝাটে কিছু সময় বসা যাক। জানালা দিয়ে দেখা যায়অনতিদূরে প্রায় মহলটির সমান উঁচু একটা মসজিদের মিনার, সেখানে এ দিকে মুখ করে একটা লাউডস্পিকার লাগানো, বোধহয় আজানের ধ্বনি এই বারটিতেও মাঝে মধ্যে প্রবেশ করে, কখনও সূর্যের আলো আছে, অনেক নিচে’ হায়াতকনিষ্কের’ নীল সুইমিংপুল এবং বেশ কিছু দূরে সুন্দর করে সাজানো গোছানোলান্ডস্ক্যাপিং করা ইকোপার্ক, এখানে সেখানে দু’একটি বেঞ্চ আর চেয়ার টেবিল, তার ওপাশে কিছুটা দূরে একটা আঁকাবাঁকা সোনালী ফিতার মতোবয়ে গেছে গোমতী নদী –

– বীয়ার, স্যার?’ না, বীয়ার পরে হবে, প্রথমে একটা উডপেকার হুইস্কি–’, ‘উডপেকার স্যার? উডপেকার তো আজকাল চলে না–’ বার এটেণ্ডার বোধহয় গোয়ার। বুকের নাম ফলকে লেখা আছে ‘ আই ফার্নান্ডেজ’, মুখটা যেন নিরাশ হয়ে গেল, বোধহয় তার হিসেবে আমাদের মান কয়েক ধাপ নেমে গেল।’ কেন চলবে না? আমরা তো সবসময় ইউডপেকারই খেয়ে আসছি, তোমার এসবের চেয়ে (পেছনে রাখা জনি ওয়াকার, সিভাছরিগেল আদি স্কচ, হুইস্কির বোতল গুলির দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলাম)’ তো খুব একটা খারাপ নয়–’, ‘হ্যাঁ স্যার, কিছুটা কুণ্ঠিত ভাবে ফার্নান্ডেজ বলল,’ কিন্তু এখানে আমাদের গেস্টরা এসবই চায়–’, ‘হ্যাঁ, আমাদের এখানেও আজকাল অনেকে এইসব চায়, বিশেষ করে যাদের কালো টাকা আছে, নতুন করে ধনী হয়েছে, ইমপোর্টেড লেভেল না থাকলে আজকাল আর স্ট্যাটাস থাকে না তো! আমরা পুরোনো কালের মানুষ, আমরা ওল্ড রিলায়েবল স্টাফেই প্রেফার করি, ফার্নান্ডেজের মুখটা আরও কালো হয়ে গেল, আমি বললাম,’ তুমি বোধহয় গোয়ার, নয় কি? গোয়ার মানুষরা কি বলে না যে তাদের পুরোনো ফেনীর চেয়ে পৃথিবীতে আর কোনো ভালো পানীয় নেই?’ ফার্নান্ডেজ একটু হাসার চেষ্টা করল, তারপর বলল,’ ঠিক আছে স্যার, উডপেকার আনিয়ে দিতে পারব, একটু দেরি হবে– তারচেয়ে আমি বলছি কি স্যার আমার পরামর্শ যদি শোনেন, যদি আমাদের এই সপ্তাহের স্পেশিয়ালটা একটু খেয়ে দেখেন —’

তাই ফার্নান্ডেজের পরামর্শ মতো’ ডিমিট্টভ -ডাইকিরি’ একটা নিলাম (মানে রাম এবং লাইম জুসের ককটেল) আর সঙ্গে খাবার জন্য দুটো কানাপে’– চুমুক দিয়ে দেখলাম খারাপ নয়, সত্যিই ভালো– ভাবলাম জনি ওয়াকার এবং শিভাসরি গালোতো সত্যিই ভালো, মসৃণ মৃদু এবং আসলে শুধু কালো টাকাওয়ালারা কেন, আমরাও খাই কখনও কখনও– পারফরম্যান্স…। ছেলেটিও খারাপ নয়, মিছামিছি ওর মন খারাপ করে দিলাম– কিন্তু তার কারণটা অন্য কিছু নয়, কেবল এই হোটেলে প্রবেশ করার পর থেকেই যে অশান্তি এবং অস্বস্তি অনুভব করছি তার উষ্মাটা কিছুটা বের করে দেওয়া অন্য কিছু নয় –

ঘড়ি দেখলাম, আরও কিছু সময় আছে, কিন্তু মনের মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব আসতে লাগল শ্রীধরণীর সঙ্গে দেখা করতে যাব কিনা, গেলে নিশ্চয় আরও অনেক ডেলিগেটের সঙ্গে পরিচয় হবে, কিন্তু সকলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতোএখনওমানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারিনি, দীর্ঘ ভ্রমণের পরে ক্লান্ত লাগছে – এসবের পরে পুনরায় রাতে যেন তেন ভাবে আমার কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে নিতেই হবে, শ্রীধরণী বলেছেন যে এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল হেবিটেটের বিষয়ে দুটি পেপার এসেছে জাপান এবং পোল্যান্ড থেকে, তারা ১১ তারিখেই টেকনিক্যাল ডিরেক্টর গুস্তাভয়হানছেন এর কাছে আমার পেপারটা ফ্যাক্স করেছে। সেমিনারে সেই তিনটি পাঠ করার পরে প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য ডঃ হানছেন একটা আধঘণ্টার স্লটও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সকালে প্রাতঃরাশের পরে নয়টার সময় প্রতিনিধি- সাড়েদশটার সময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আরম্ভ। রাত সাড়ে আটটায়’ আর্কেডিয়া’ত ইতিমধ্যে এসে পৌঁছানো প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইনফর্মাল গেট- টুগেদার এবং ডিনার- এত নতুন পরিচিতের সঙ্গে সৌজন্য এবং কথাবার্তা ঠিক রাখতে হবে তাদের উইট এবং হিউমারের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারতে হবে… মনের এই অস্থির অসন্তুষ্ট অবস্থায় সেসব কি ঠিকমতো সামলাতে পারব– নিশ্চয়শ্যাম্পেনের সঙ্গে কেউ কোনো টোস্ট তুলে ধরবে, ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও খেতে হবে, আগেও এখানে সেখানে কখনও-কখনও শ্যাম্পেইন খেতে হয়েছে, খেয়ে কিছুই মনে হয় না। কেন যে তার এত কদর বুঝতে পারি না। মনে-মনে মুখ বিকট করেছি, হয়তো আমার খার খাওয়া জিহ্বা এই বহু বন্দিত বুদবুদের ফরাসি পানীয়ের আস্বাদ পেতে হলে আর ও অনেকবার খেতে হবে– 

…যাই হোক, সন্ধ্যাটা কোনোমতে টেনেটুনে পার করে দিলাম, তারপরে বিছানায় উঠে বসলাম, নিচের কোনো তলা থেকে নাচের বাজনা অষ্পষ্ট ভাবে ভেসে আসছে, বেড লাইটটা জ্বালিয়ে আমার পেপারটা হাতে নিলাম, আলোটা কাছে নিয়ে আসতে গিয়ে দেখলাম বিছানার চাদরটা সম্পূর্ণ সাদা নয়, তার উপরে জায়গায় জায়গায় নকশা কাঁটা আছে, বড় বড় পাতার এবং ছোট ছোটকাঁটায় একটি গোলাপ ফুল, প্রথম দৃষ্টিতে চোখে পড়ে না– বালিশের ওয়ার ধবধবে সাদা, উজ্জ্বল শুভ্র– একেই বোধহয় বলে ‘দুগ্ধ ফেননিভ’– গোলাপ ফুলের নকশা ওপরে শোওয়ার অভ্যাস নেই, অর্থাৎ মশারি নেই (এখানে মশা নেই), অর্থাৎ আমার অভ্যস্ত মশারিটিতে যা পেয়ে থাকি তার পরিচিত গন্ধ না কি সেটাও নেই– বড় ক্লান্ত লাগছে এখন শুয়ে পড়ি কাল সকালে উঠে এক কাপ বেড-টি খেয়ে কাগজটাতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেব… লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম, অনেক সময় এপাশ-ওপাশ করে কাটালাম, কিছুক্ষণ পরে বোধহয় চোখটা লেগে গেল … হঠাৎ জেগে গেলাম, মনে হল কী যেন শরীরের মধ্যে আঘাত করছে, মশার কামড় নয় –ও হো না। গোলাপের কাঁটা গুলি দেহে বিঁধতে শুরু করেছে– উপায় নেই– মনে হল, আরও দুটো রাত কীভাবে কাটাব–আর, পৃথিবীর বাইরের আবাসস্থলের বিষয়ে জল্পনা/কাগজ পাঠ করেই বা কী হবে এত লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের পড়ে আজ আমরা মানুষ জাতি ভালো খারাপ নিয়ে কোনো মতে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে শিখেছি মাত্র।

পৃথিবীর বাইরে কোথাও গিয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে আরও বা কত লক্ষ বছর লাগবে… আমার জীবনের ৬০ বছরের বিবর্তনের পরেও অভ্যস্ত বিছানাটা ছেড়ে’ হায়াত কনিষ্কের’ বিছানাতে এখন পর্যন্ত শুতে পারিনি…কী হবে মিছামিছি পেপার পড়ে– কিছু একটা অজুহাত বের করে, কিছু একটা জরুরী কারণ দেখিয়ে বাড়ি ফিরে যাব নাকি… কিছু সময় হাঁসফাঁস করে আবার শুয়ে পড়েছি, তারপরে আবার জেগে উঠেছি, আর কিছু একটা আঘাত করছে–না, গোলাপের কাঁটা নয়, মশার কামড়ও নয়, কানে মশার গুনগুন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, কোনোভাবে মশা ঢুকেছে, মশাটা মারতে গিয়ে আমার বিছানার মশারিতে হাতটা লাগল, কোনো ভাবে মশারির ফুটোতে লাগিয়ে রাখা ওর কাপড় মেলা ক্লিপটা খুলে গেছে…. রুমে ভোরের আলো প্রবেশ করেছে… যাক,রক্ষা !…

সকালে চায়ের টেবিলে বসে আমার পুরোনো কাপটিতে তৃপ্তির চুমুক দিয়েছি। এখন মনে পড়ছে লক্ষ্ণৌর হোটেলের কথা পড়েছিলাম সেখানে সেমিনার দিতে যাওয়া একজনের একটি নিবন্ধে-ইনি বলেছেন, ’তুমি ঠিকই বলেছ, নতুন কাপপ্লেট কয়েক জোড়া অতিথি এলে বের করা ভালো। কাল কাজের মেয়ে একটা নতুন কাপের হাতলটা ভেঙ্গে ফেলেছে-তোমাকে আবার তোমার আগের কাপটিতেই দিয়েছি-কান-ভাঙ্গা কাপে খেতে ভালোবাস, ওতেই খাও। আত্মা ঠাণ্ডা হোক-কিন্তু তোমার দেখছি সত্যিই ভালো রুচি টুচি লোপ পেয়েছে, রাম রাম-‘

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>