বটবৃক্ষ আয় বসি
এক
পাঁচ বিঘে জায়গা জুড়ে জিতেনের ঘর গেরস্থালি, বাড়ি, উঠোন, মাঝে খামার, গোয়াল, ওপাশে একটা ছোট পুকুর ঘিরে নানা ফলের গাছ। সম্পন্ন চাষি। তিন পুত্র। শিক্ষিত ও চাকুরে। চার কন্যা। উপযুক্ত ব্যক্তিতে পাত্রস্থ।
বাপুতি ভিটে পাঁচশো মিটার দূরে। প্রায় পাশাপাশি সেখানে ভাই হিতেনের জমাট গেরস্থ। এবাকুল ওবাকুলের মাঝে কোনও কাঁটাগাছের বেড়া নেই। ভাই, ভাইপো-ভাইঝি, নাতি-নাতনি যে যখন খুশি আসা যাওয়া কর।
হিতেন প্রায় দিনই যখন হোক দাদার সঙ্গে একবার দেখাটা করে। চাষের নতুন প্রক্রিয়া প্রকরণ পদ্ধতি নিয়ে দু’ভাইয়ের আলোচনা হয়। ওদের আধুনিক চিন্তা ভাবনায় নবরূপে সাজে কৃষিক্ষেত্র। তার মাঝেই বড় বউমা বৈশালী চা নিয়ে আসে। শাশুড়িমা নাতনিকে নিয়ে শশব্যস্ত থাকে প্রায়ই।
হিতেনের খুবই ভাল লাগে বড় ভাইপো দেবুর স্ত্রী বৈশালীকে। জন্ম থেকেই কোয়ার্টারে ঘুরতে ঘুরতে বড় হয়েছে। বাবা রেলের বড় অফিসার ছিলেন। বিয়েটাই বেশ মজার। দেবু রাজ্য সরকারি অফিসে চাকরি করে কলকাতায়। বেয়াই মশাই ছেলে দেখলেন না। বেশ খানিকটা কৃষিজমির মালিক হিসেবে দাদাকেই পছন্দ করলেন। হিতেন ভাবগতিক দেখে থ। বলেছিল, ‘ আরে বেয়াই মশাই আপনি দেখছি ‘উল্টোপুরাণ’ পাঠ করে এসেছেন।’ হবু বেয়াই স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘বুঝতে পারছি আপনি কী বলবেন। আমরা তিন পুরুষ ধরে রেলের ঘরের লোক। টাকাপয়সা স্বাচ্ছন্দ্য কোনটারই অভাব নেই।’
জিতেন ব্যাপার বুঝতে পেরে বলল, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, আপনি আবেগের বশে কী বলবেন জানি। তবে ছেলে তো রাজ্য সরকারের লোক, বউমার মনঃপুত হবে তো?
দু’বেয়াই এর হাসিমুখ বিয়েটা দারুণভাবে উতরে দিয়েছিল।
‘উল্টোপুরাণ ডিগ্রি’প্রাপ্ত বাপের মেয়েটাকে হিতেন এবার রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, ‘এই সন্ধ্যেবেলায় তোমাকে খাটাচ্ছি আমরা। গাঁ ঘরের মেয়ে বউরা তো এখন টিভিতে মুখ গুঁজে বসে আছে?’
বৈশালী আজ চোদ্দো বছর ধরে চেনে ‘রগুড়ে’ খুড়শশুর মশাইকে। রগড় করতে ওস্তাদ। বৈশালী হই হই করে উঠল, ‘ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, বউ মেয়ে মাত্রই তো হিংসুটে আর কুচুটে। আপনারা তো সারা সন্ধ্যে জুড়ে এটাই প্রচার করছেন।’
হিতেন বুঝল হিতে বিপরীত। অবাক হয়ে বলল, ‘আমরা!’
বৈশালী নিজেকে সামলে নিল। হাসতে হাসতে বলল, তবে মজাটা কী জানেন। ওইসব সিরিয়াল দশদিন গ্যাপ দিয়ে দেখলেও মনে হবে কিছুই মিস করিনি। জিতেন এদের রগড়ে মজা পেল। বলল, ‘ওই ঢপ দিয়েই তো দেশটা চলছে বউমা। ঢপের চপ খাচ্ছি আমরা।’
বৈশালী হেসে ফেলল, না বাবা, ঢপের চপ আমরা খাই না।
২
বড় ছেলে চাকরি করে কলকাতায়। শুক্রবার বাড়ি আসে, সোমবার যায়। মেজো নেবু রিষড়ার বেসরকারি কারখানায় কাজ করে। মেজো বউমা একটু অন্য ধরনের। ছেলেকে মানুষ করার জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ছোটটা বেঙ্গালুরুতে। ট্রান্সফার নিয়ে এবার কলকাতায় আসবে বলেছে। তিন বউমা শিক্ষিত। প্রত্যেকেই গ্র্যাজুয়েট। তবে বড় বউমার গুনের তুলনা হয় না। নাতনি প্রাইমারী শেষ করার পর , জিতেন বলেছিল, ‘মেয়েটাকে মানুষ করার জন্য কলকাতায় থেকে পড়ানোর ব্যবস্থা করো।’
বৈশালী উত্তর দিয়েছিল, ‘কী দরকার বাবা। এখানে পড়েই তো আপনার তিন ছেলে মানুষ হয়েছে। ননদরাও পাশ-টাশ করেছে এখান থেকেই। তা হলে দাদু দিদিমার কাছ থেকেই মানুষ হোক না । ’
জিতেনের মনে পড়ে সে সব কথা। সত্যিই বড় বউমা ঢপের চপ খায় না। ছেলের ‘নবসম্বন্ধের’ দিন বেয়াই মশায় জিতেনকে বলেছিলেন, বেয়াই মশায়, তিন পুরুষ ধরে চাকরি করেছি। দাদু পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন। আমরা এখনও উদ্বাস্তু রয়ে গেছি।
জিতেন বিস্ময়ে তাকিয়েছিল। তা দেখে বিশ্বেশ্বরবাবু বলেছিলেন, শিলিগুড়ি এলাকায় বেশ খানিকটা চাষের জমি কিনেছিলেন দাদু। কিন্তু কী হল! চা বাগানের মালিককে বিক্রি করতে হল। বুঝলেন বেয়াই মশায়, জমি জায়গা হল মায়ের আঁচল। আমরা সেই মায়ের আঁচলটাই পেলাম না।
দুই
গজগজ করতে করতে জিতেন হাঁটা দেয় পুকুর পাড়ে আমগাছটার দিকে। মেজোটা একটু ‘নিনো’ (নিরীহ) ধরনের। ওর জন্যই কষ্ট । বছরে সে এক দু’বার আসে। ছেলেটার মুখ-চোখ দেখেই বোঝা যায়, এখানে এলে অনেকটা টেনশন মুক্ত হয়ে যায় । গজরাতে গজরাতে এগিয়ে চলে। গাছকে দুঃখের কথা শুনিয়ে মনটা হালকা করা।
জিতেন আমগাছের নীচে বসে ধমকাতে শুরু করে। ‘টাকা টাকা টাকা। খেয়ে পরে বাঁচার জন্য ওটা চায়। সেটা তো হল। তারপরেও এত আকাঙ্খা, এত টেনশন কেন?’
জিতেনের ধমক শুনে সামনের কলাগাছটা হেসে লুটোপুটি। জিতেন কটমট করে কলাগাছটার দিকে তাকাল, ‘এক ফসলেই তো শেষ। খুব গরব, না!’
কলাগাছ ফিকফিক হেসে বলল, ‘আমার মতো ওরাও সব একফসলি। তুই বটগাছ আমগাছের মতো কাকা জেঠা মাসি পিসি টুতো-টুতো নিয়ে জড়িয়ে থাকার কথা ভাবিস। ওসব ছাড়। বুঝতে চেষ্টা কর, গতিশীল প্রযুক্তির যুগে এদের আগেও কেউ নেই, পরেও কেও নেই।’
কলাগাছটার ফিক্ ফিকে হাসির মাঝেই জিতেন একটা অন্য স্বর শুনতে পেল। কত গম্ভীর সে স্বর- ‘বটবৃক্ষ, আয় বসি।’
৩
খামারবাড়ি থেকে বাষট্টি বছরের সরমার গম্ভীর স্বর বড় বউমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘অনেক বেলা হল, চান করতে হবে না? ডাকটা শুনে বটবৃক্ষের নীচে বসার আহ্বানটা মাথায় গেঁথে বলল, ‘হ্যাঁ, যাচ্ছি বউমা।’
পঁচাত্তর বছরের জিতেন শ্বেতপায়রা ঢাকা মাথা দুলিয়ে হাঁটতে থাকল। এসে দেখে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে শাদা চুলের মাঝে লাল সিন্দুর সরমা। সরমা উঠোনে জিতেনের কাছে এসে বলল, ‘এইমাত্র মাইতো বউ ফোন করেছিল।’
জিতেন হাসল, ‘দারুণ খবর তো। ঠিক আছে দেখছি, দেখছি। সেই কলার কান্দিটা পেকেছে? দু’খানা ছাড়িয়ে আনো দেখি, খিদেতে পেটটা চুঁই চুঁই করছ।’
সরমা দুটো হলুদ কলা জিতেনের হাতে দিয়ে বলল, ‘বউমা বলছিল নেবুদের কারখানাটা বন্ধ হয়ে যাবে।’
জিতেন কলার ডগায় কামড় বসিয়ে বলল, ‘এ আর নতুন কি! কারখানা বন্ধ হবে। যন্ত্রাংশ পাচার হবে। ওদের কারখানাটা পঁচিশ একর জমির উপর। মালিক পঁচিশটা ফাণ্ডে ডোনেশন দেবে। শ্রমিকদের পি এফ গ্র্যাচুইটি চুলোয় যাক। রাতারাতি ফ্ল্যাট উঠবে। আবাসন ব্যবসা লাভজনক শিল্প।’
সরমা এতসব কথা ঠিক বুঝতে পারে না। হাঁ করে তাকিয়ে কলা খাওয়া দেখছে লোকটার। জিতেন কলার ছালগুলো খড়পালুইয়ের পাশে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘নেবুকে বল, ছেলে বউমাকে পাঠিয়ে দে এখানে। তারপর তুই কারখানা চষে খোঁজ!’
দাদুর কলা খাওয়া দেখতে নাতনি হাজির। দাদুর সামনের ন্যাড়া আমড়া গাছে বসে আছে সেই পাখিটা। কী সুন্দর হলুদ ডানা, লেজের অংশ ও মুণ্ডুটি কালো। নাতনি ঋ আঙুল তুলে দেখাল উলঙ্গ আমড়া ডালে বসা পাখিটাকে। জিতেন একচোখ দেখে নিয়েই বলল, ‘ওহো ওই পাখিটা। আমরা ছেলেবেলায় হলদে বোনা জানতাম, পরে জানলাম ওটা বসন্তবৌরি। খুব সুন্দর কথা বলে।’
নাতনিকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, পাখিদের ডাকের সঙ্গে তুই মনে মনে যা উচ্চারন করবি সেটাই মিলে যাবে।
ঋ অবাক হয়ে দাদুকে দেখছে, ‘ধুর! তাই আবার হয় নাক? টিয়া ময়নার থেকেও ভাল কথা বলে?’
ওদের কথার মাঝে, ভরদুপুরের উঠোনে গোলা পায়রাগুলো কোথা থেকে ত্বরিৎ উড়ে এসে নামল, নেমেই মরাইটার নীচে পাটাতনের ফাঁকে লুকোতে শুরু করল। জিতেন পায়রাগুলোর আতঙ্ক দেখে আকাশে নজর চালাল। হ্যাঁ ঠিক তাই। তীক্ষ্ণ নখ বের করে শিকারি বাজ আকাশে চক্কর মারছে। প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে পড়ছে গোলা পায়রা। সরমাও এতসব জানত না। বৈশালীও অবাক হয়ে দেখল কৌশলী বাজপাখির কাণ্ডকারখানা। বৈশালী একটু ঝুঁকে মরাইয়ের পাটাতনের নীচে তাকাল। ভয়ে ঝাঁক বেঁধে আছে পায়রাগুলো। বিপদের দিনে ওরা নিরাপদ আশ্রয় পেল।
পায়রারা এখন নিরাপদ আশ্রয়ে সুস্থির। জিতেন বড়বৌমাকে বলল, ‘তেলের ভাঁড়টা আন তো বৌমা। চপচপে করে মেখে পুকুরের জলে দামাড়ে আসি।’
ঋ এইসময় চেঁচিয়ে উঠল, দাদু ওই দেখ বাজপাখিটা! জিতেন চোখ তুলে দেখল মাথার ওপর উড়ছেন মহারাজ।
৪
নাতনি বলল, ‘দাদু ওই পাখিটা তো কথা বলছে না?’
জিতেন তেল ঘষতে ঘষতে বলল, ‘শোন মন দিয়ে শোন।’
ঋ কান খাড়া করেও কিছু শুনতে পেল না। ‘ধুর! এটা বোবা পাখি।’
জিতেন বলল, ‘না রে বোবা নয়। বোবা সেজে আছে। কী বলছে শুনতে পাচ্ছিস না? আর একটু খেয়াল কর।’
ঋ আরও একটু মনোযোগ দিল- ‘হ্যাঁ খুব মিহি স্বরে কী যেন বলছে।’
জিতেন হাসল। হ্যাঁ, শোন মন দিয়ে, তোকেই বলছে, ‘পড়াটা করলি কবে?
ঋ হেসে গড়িয়ে পড়ল, ‘দেখি তবে! ‘পড়াটা করলি কবে’ কথাটা আমিও, ঠিক মিলে যাচ্ছে। ঋ দাদুর তেল মাখা গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘বেশ আমারটা তো হল। এবার তোমাকে কী বলছে বল তো?’
জিতেন সজাগ হয়ে বলল, ‘আমাকে বলছে, শিল্পটা আকাশে হবে?’ ঋ পদ্যের লাইনদুটো মিলিয়ে নিয়ে হাততালি দিয়ে নেচে উঠল, পড়াটা করলি কবে?
শিল্পটা আকাশে হবে?