| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী সাহিত্য গল্প: বসন্তবৌরি । সায়মা আরজু

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

শীতকাল, বাংলাদেশে এটাকে বিয়ের মৌসুমই বলা চলে। ফেসবুক খুললে রোজই কোনও না কোনও বিয়ের ছবি নাাচতে নাচতে সামনে উপস্থিত হয়। এই ছবিগুলোও হাড় বজ্জাত, কেমন করে যেন মনোযোগ কেড়ে নেয়! তবে যাই বলা হোক না কেন, কে কি পরলো, কার পাশে কাকে মানালো, কে একটু মোটা হয়েছে, কার চোখের নীচে কালি পড়েছে, কে কোন পার্লারে সেজেছে এরকম হরেক প্রাসঙ্গিক ,অপ্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা এক একটি ছবির নীচে সারি বেঁধে সাধারন জ্ঞানের যে প্রশ্নমালা তৈরী করে, সেগুলোও কম রসালো না। কেউ কেউ তো আবার খাবারের ছবি দিয়ে কোন বাবুর্চি রেঁধেছে তার কয়েক প্রজন্মের বায়োগ্রাফি বিশদে বর্ননা করে।

বন্ধুর জন্মদিন, শুভেচ্ছা জানাবো। সকালের নাস্তা শেষ করে এক কাপ ব্লাক কফি হাতে নিয়ে বারান্দায় রোদে পীঠ দিয়ে বসলাম। রাস্তার উল্টোদিকে একটু এগুলেই ঢাকেশ্বরী মন্দির।আমি পাঁচতলায় থাকি, কাছেধারে এখনও কোনও বড় বিল্ডিং নেই বলে মন্দিরের ভিতরের চাতাল, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, মন্দিরের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা লাজুক শ্বেতকরবি গাছটা পর্যন্ত দেখা যায়। সনাতন ধর্মালম্বীদের বড় বাৎসরিক উৎসব শেষ হয়েছে মাস দুই আগে। তবে মন্দিরে কিছু না কিছু আয়োজন লেগে থাকে হররোজ যদিও আজ তেমন কিছু ভীড় ভাট্টা নেই। আমি একবার গোটা মন্দিরটাতে চোখ বুলাই, চন্দন ঘট হাতে বুড়ো মাসি শান বাঁধানো পুকুরঘাটে বসে কিছু একটা করছে, একটু থেকে থেকে পূজারী, দর্শনার্থীরা ঘন্টা বাজাচ্ছে কালী মন্দীরে, মূল ভবনের সামনে কিছু অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে জটলা করছে, মন্দির কেন্দ্রিক গজিয়ে ওঠা মিষ্টি আর পূজার সামগ্রীর দোকানগুলো রাতের ঘুম ভেঙ্গে কেবল সাজতে শুরু করেছে…. । আমি অদুরে সরকারী কলোনীর উঁচু উঁচু রেইনট্রি গুলোর দিকে চেয়ে থাকি, আয়েশে কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়াই । হঠাৎই একটা বসন্তবৌরি কোথা থেকে উড়ে এসে আমার বারান্দার মেহেন্দির ডালে বসে। নীচেই কয়েকটা কসমস ফুলের টব। টবের আশেপাশে কতগুলো চড়ুই ঘাস থেকে পোকা খাচ্ছিল, রোজই এরা আসে, নিজেরা কি কি সব গল্প করে, হয়তো আমাকে ও খোঁজে। কথাটি বললাম কারন বেশ কয়েকদিন খেয়াল করেছি ওরা আমার দিকে তাকিয়েও কথা বলে, আমি বারান্দায় না বসলে ঠিক শোওয়ার ঘরের জানালার গ্রীলে বসে ওটওটটোটোটো…. ডাক দেয়।আদর এক একটা! কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আমার এসব বাস্তুু চড়ুইদের সাথে বসন্তবৌরির বুনলো না তেমন,তেমন কোনও কথাবার্তা ছাড়াই কিছুক্ষন উদাস চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল বসন্তবৌরি, তারপর মন্দিরের দিকে উড়াল দিল। আমি তার উড়ে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকি, অপেক্ষা করি তার ফিরে আসার, মনে মনে খুঁজি, কফি শেষ হয়, তাকে আর দেখা যায় না।

ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে আজ সকালে একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গিয়েছিল। সেই থেকে নিজের অজান্তেই বারবার মনে পড়ছে বিষয়টা। স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছি যাতে হারিয়ে না ফেলি, কিন্তু কেন রেখেছি জানিনা। বিজ্ঞাপনটি ওল্ড গুডস নামে একটা গ্রুপ পেইজের। এখানে পুরানো কিন্তু তেমন ব্যবহার হয়নি এমন সব জিনিস ক্রয় বিক্রয় হয়। অনেক ভালো ভালো জিনিস অনেকটা সস্তাদামেই অনেক সময় বিক্রি হয়। আমি কখনও কিছু কিনিনি এখান থেকে, ইচ্ছেও হয়নি তবে সামনে পড়লে বিজ্ঞাপনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। ওহ্ যে বিজ্ঞাপনটার কথা বলছিলাম সেটা এমন: একটা বিয়ের লেহেঙ্গা বিক্রি হবে যেটা একেবারেই ব্যবহার হয় নি। কনে তার পরিবারের লোকদের সাথে মার্কেটে গিয়ে পছন্দ করে কিনেছিল। বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়েছিল, হল বুক করা হয়েছিল কিন্তু বিয়ের দিন কনে তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়েছে, তাই লেহেঙ্গাটি আর পড়া হয়নি। লেহেঙ্গাটি ‘মনেরেখ’ নামক দোকান থেকে ঊনিশ হাজারে কেনা, বিক্রয় মূল্য সতের হাজার টাকা। বিজ্ঞাপনটা পড়ে কিছুক্ষন থম মেরে বসেছিলাম, মনে মনে শুধু বলেছি এরা কি মানুষ!! মেয়েটি পালিয়ে গেছে একথাটি না বললে কি লেহেঙ্গাটির দাম কোনও অংশে কম ধরা হত? একটা মেয়ের কত শখের থাকে তার বিয়ের পোশাক, নাই বা পড়লো সে বা নাইবা পড়া হল তার সেটা কিন্তু তাই বলে এর সাথে জুড়ে থাকা ইমোশনটা তো মিথ্যে হয়ে যায় না। কেমন মানুষ এরা? নিশ্চয়ই মেয়ের অমতে বিয়ে দিচ্ছিলো। হয়তো মেয়েটা ফিরে আসুক সে আশাও তারা করেনা। কিন্তু মেয়েটার চোখে যদি বিজ্ঞাপনটি পড়ে কি রকম দুঃখ পাবে সে! আচ্ছা, মেয়েটি কি ঠিক করেছে নাকি ভুল করেছে? কে জানে তার কাছে পালিয়ে যাওয়াটাই হয়ত ঐসময়ে সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে। যাই হোক, ভালো করে না জেনে এ ব্যাপারে কোনোও মন্তব্য করা ঠিক হবেনা। বিজ্ঞাপনের নীচে দেয়া ফোন নম্বরে চোখ যায় , ভাবি একবার ফোন দেই, মনে মনে গুন গুন করি, ” আমি মানুষ আমার কেন পাখির মত মন….” বসন্তবৌরি পাখিটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, একবার মনে হয় শখের বাইনোকুলারটা চোখে দিয়ে তাকে খুঁজি, পরক্ষনেই মত পাল্টাই, কারো চোখে পড়লে কে কি ভাববে তা চিন্তা করে বিচলিত হই।

বন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই, ফেসবুক স্ক্রল করে ছবি দেখি। এবার একটা বর কনের ছবিতে চোখ আটকে যায়। ছবিটি পোস্ট করেছে আমারই পরিচিত একজন। ছবিটার দিকে তাকিয়েই মনে হয়েছে আরে বৌএর শাড়িটাতো একেবারে আমার ওয়ালিমার শাড়িটার মত!খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি সেই ফিরোজা সবুজ রং, জড়ির সুতার কাজ, তার মধ্যে মিনা করা ছোট ছোট ফুল। কিন্তু একি আঁচলের কোনে কালো দাগটাও একই রকম, কি করে সম্ভব! একরাশ আবেগ ভর করে মনে। আমি স্মৃতির তোড়ে ভেসে যাই যদিও আমার বিয়ের শাড়িটি পছন্দ করে কেনার সৌভাগ্য আমার হয়নি । মনে মনে খোলা লাল মেরুন জমিনে ছোট্ট ছোট্ট বুটি আর পার আর আঁচলে ভারী কাজকরা একটা শাড়ি চাইতাম, কিন্তু সে পছন্দের কথা মুখ ফুটে কাউকে বলা হয়নি, অবশ্য কেউ তা জিজ্ঞেসও করেনি। যাই হোক, যে রকমই হোক আমার জীবনের একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের সাক্ষী এই শাড়ি। যদিও অত কাজ করা শাড়ি আজকাল কেউ পরেনা, এই বউটিই ব্যাতিক্রম। অবশ্য অনেকে তো আবার মা বা নানীর বিয়ের শাড়ি পড়েও বিয়ের পিঁড়িতে বসে, ব্যাপারটা মন্দ না। মনে মনে খুব নষ্টালজিক হয়ে উঠলাম ছবিটা দেখে, শাড়িটি দেখে। বারান্দা ছেড়ে শোওয়ার ঘরে আসি আলমারি খুলি, শাড়ির ভাজে চোখ বুলাই, শাড়িটা খুঁজি। অনেকদিন ধরে আলমারিতে পড়ে আছে শাড়িটা, বের করা হয় না, কোথায় রেখেছি মনে করতে ও পারছিনা, তবে আলমারিতে ছিল সেটা নিশ্চিত। একে একে শাড়ির প্যাকেট গুলো নামাই, আলমারির তাক খালি করি আবার গুছাই, না শাড়িটি কোথাও নেই। মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়। আবার ছবিটা দেখি, মনটা বিষন্নতর হয়। ভাবি শাড়িটি যাবে কোথায়? কি মনে করে আমার পরিচিতাকে ফোন দেই, শাড়িটি সম্পর্কে জানতে চাই, কেথা থেকে কিনেছে জিজ্ঞেস করি।তিনি জানান তার আত্মীয়ার কাছ থেকে জেনে তিনি আমাকে জানাবেন। অপেক্ষা করি, কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যে বড্ড দীর্ঘ, সময় কাটেনা। আমার বিয়ের, ওয়ালিমার ছবিগুলো দেখি, কোথাও খুব গোলমেলে মনে হয়। মনে পড়ে আমার স্বামী জয়নাল বাড়ৈকে একদিন ফোনে কাউকে জিজ্ঞেস করতে শুনেছিলাম বিয়ের শাড়ি লাগবে কিনা? কিন্তু তারপরে ? নাহ্ মনে পড়ছে না কিছুই। যদিও আমার ছোট বোনের বিয়েতে বরের শেরওয়ানি কেনা নিয়েও বেজায় হট্টগোল পাকিয়েছিল সে। তাই বলে না বলে আমার শাড়ি অন্যকে দিয়ে দিবে! হয়তো ভেবছে বিয়ের শাড়ি অযথাই পড়ে আছে অথবা তার টাকায় কেনা শাড়ি যেমনটি ইচ্ছা সেটি করা যেতেই পারে। অবশ্য তার কাছে কোনোও রকম খেয়ে -পরে টাকা জমানোই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। ভদ্রলোক তার জীবনের অবসর সময়ের সিংহভাগ সময় কেবল টাকা গুনেই কাটিয়েছেন। প্রায় সময়ই দেখা যেত একাকী ঘরে বসে টাকা গুনছেন। সংসারে অন্য কোনও শখ বা সাধ ছিলনা তার! সেই সব টাকারা তাকে কতখানি স্বস্তি দিতে পেরেছে কে জানে! আজ নিজেকে শুধু বলির পাঁঠা মনে হয় আমার, অবশ্য আগেও হত। তার সাথে আমার কখনো বন্ধুত্ব হয়নি, সম্পর্কটা ছিল দায়িত্ববোধের, পড়ে একদিন, অনেকদিন পরে জানলাম শুধুই কাগজের। ফোনের রিং বাজতেই ব্যাস্ত হয়ে ধরি, আমার পরিচিতা জানায় শাড়িটি মোয়াজ্জেম নামক এক ব্যাক্তির কাছ থেকে কিনেছে বৌটি, তবে শাড়িটি সেকেন্ড হ্যান্ড। জিজ্ঞেস করি,
– চোরাই শাড়ি?
– না আপা মোয়াজ্জেম নামের লোকটির বউ তার বিয়েতে উপহার পেয়েছে
– তার মানে মোয়াজ্জেমের বউ ঐ শাড়িটি তার বিয়েতে পরেছে
– না আপা, মোয়াজ্জেমের বউ কখনোই শাড়িটি পরে নাই
– তাহলে সেকেন্ড হ্যান্ড হলো কি করে?
– মোয়াজ্জেমকে শাড়িটি যে উপহার দিয়েছে তার বৌ তার বৌভাতে পরেছে
– মোয়াজ্জেম এর নম্বরটা দেয়া যাবে
– না আপা এটা কনফিডেনসিয়াল
– ও….

ফোন ছাড়ার পড়েও বৌভাত কথাটি কানে বাজতে থাকে। সম্ভাব্য মোয়াজ্জেম নামক লোকদের চেহারা মনে করি, একজনের কথা খুব তীব্রভাবে মনে হয়, সে জয়নাল বাড়ৈ সাহেবের বিশেষ স্নেহ ভাজন।সন্দেহের মেঘ জমা হতে শুরু করে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। কষ্ট হয় মনের গহীনে কোথাও, হিসেব মেলেনা। একবার ভাবি মোয়াজ্জেমকে ফোন করি, আবার ভাবি শাড়িটা যদি তাকে দিয়ে দেয়া হয় তা হলে সেটা নিয়ে সে যা খুশী করতে পারে। তবুও নিশ্চিত হবার জন্য আমার পরিচিতাকে ফোন দেই। মনে মনে খুব আশা করি আমার চেনা মোয়াজ্জেম যেন শাড়ি বিক্রেতা মোয়াজ্জেম না হয়। কিন্তু আমার চেনা মোয়াজ্জেম এর পরিচয় বলতেই আমার পরিচিতা হেসে ওঠেন, নিশ্চিত করেন ইনিই তিনি যাকে আমি সন্দেহ করছি। বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে ওঠে, একেই মনে হয় বলে পায়ের নীচের মাটি সরে যাওয়া, কেমন হালকা লাগে নিজেকে। দু- এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে চোখের কোল বেয়ে, সেগুলো কি রাগ, অভিমান নাকি অবহেলার, নিজের কাছেই প্রশ্ন করি। মনে মনে বলি মৃত সম্পর্কের প্রতি রাগ করতে নেই…. রাগ করতে নেই….. এরা মৃত মানুষের মতই…। বসন্তবৌরি পাখিটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, বারান্দায় যাই, শোবার ঘরের জানালায় দাঁড়াই, বসন্তবৌরি পাখিটাকে খুঁজি…. পাখিটার মত হারিয়ে যেতে মন চায়… সত্যিই তো আমি মানুষ আমার কেন পাখির মত মন…..

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত