সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন ও মানসিক দাসত্ব
সাম্রাজ্যবাদ তার অর্থনৈতিক স্বার্থেই সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের নীতি গ্রহণ করে। বিশ্বায়ন যে গ্লোবাল ভিলেজের ধারণাটি এনেছে সংস্কৃতির মোড়কে মিডিয়া ও প্রযুক্তির কল্যাণে তাকে ছড়িয়ে দেয়া এখন আরও সহজ হয়ে পড়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া এখন যোগাযোগের নেটওয়ার্কের গতি বৃদ্ধি করেছে এবং শোষণমূলক সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে বিকশিত করেছে। বিশ্বায়িত মিডিয়ার কল্যাণে সাম্রাজ্যবাদ সহজেই আজকের দিনে তার পছন্দমতো শত্রু তৈরি করে বিশ্বব্যাপী মানবমনে সে শত্রু সম্পর্কে ভীতি বা ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। আশির দশকে ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সাম্যবাদ সম্পর্কে নানা কাল্পনিক ভীতিকর তত্ত্ব ও তথ্য হাজির করে জনমনে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব সৃষ্টিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে পশ্চিমা তথা মার্কিন মিডিয়া। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পরে সাম্প্রতিক বিশ্বে তাদের কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদ সে শূন্যস্থান দখল করেছে। পশ্চিমা অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যে পুষ্ট আল-কায়েদাসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন ও তাদের নেতাদের সম্পর্কে আকর্ষণীয় ও ম্যানিপুলেটেড তথ্য সরবরাহ করে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’কে অনন্তকাল টিকিয়ে রাখতে চায়। বলাই বাহুল্য যে, এ যুদ্ধ আদৌ সন্ত্রাসবাদবিরোধী নয়, বরং সন্ত্রাসবাদী সাম্রাজ্য দখলের যুদ্ধ।
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রচারিত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় মার্কিন সিরিজ ম্যাকগাইভারে ভিলেন চরিত্রে অধিকাংশ সময়েই সোভিয়েতদের দেখানো হতো। এ সিরিজের নায়ক চরিত্র ছিল মার্কিন এক গোয়েন্দা যিনি সারা বিশ্বের নিপীড়িত ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারে সদাতৎপর। এর বিভিন্ন পর্বে দেখানো হয়েছে, ম্যাকগাইভার সোভিয়েত নির্যাতনের শিকার আফগানদের রক্ষা করছে কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের জেলখানা থেকে উদ্ধার করে আসছে। সম্পূর্ণ এক মেরু একটি বিশ্ব গড়ার সবরকম সাংস্কৃতিক উপাদান ম্যাকগাইভারে সন্নিবেশিত ছিল। এ সিরিজে মার্কিনীদের উপস্থাপন করা হয়েছে মানবদরদী ও বিশ্বময় নির্যাতিত অসহায় মানুষের বন্ধু হিসেবে। অপরদিকে, রাশিয়ান, জার্মান বা চীনাদের দেখানো হয়েছে অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হিসেবে। এভাবে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন মানবমনে মার্কিন দাসত্বের বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। একইভাবে, দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধের সময়ে স্টার স্পোর্টসে প্রচারিত জনপ্রিয় রেসলিং শো ডব্লিউডব্লিউএফ (ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশন)-এ নাটিকার আকারে বিনোদনমূলক রেসলিং দেখানো হতো, তাতেও যুদ্ধংদেহী সাম্রাজ্যবাদকে দেয়া হতো নগ্ন সমর্থন। ফরাসীরা ইরাক যুদ্ধে অংশ না নেয়ায় সে সময়ে ফরাসীদের উপস্থাপন করা হতো ভীরু ও কাপুরুষ হিসেবে। মার্কিন মিত্রদের ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। শত্রু রাষ্ট্রগুলোর রেসলারদের অমানবিক ও পরাজিত হিসেবে প্রদর্শন করা হতো। অপরদিকে, মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি সবসময় সেখানে প্রাধান্য পেত। পাশাপাশি মারমুখী প্রবণতাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জানানো হতো। ইরাক যুদ্ধের সময়ে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইনকে নিয়ে বিদ্রƒপাত্মক নাটিকা দেখানো হয়েছে। এখনও এ ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে ইরাকে মার্কিন মহানুভবতার বানোয়াট গল্পের ওপর নির্মিত মার্কিন চলচ্চিত্র দ্য হার্ট লকার ও ইরানবিদ্বেষী চলচ্চিত্র দ্য আর্গোকে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘অস্কারে’ ভূষিত করা হয়। সেইসঙ্গে ভিন্নমতকে রুখে দিতে মাইকেল ম্যূরের ফারেনহাইট ৯/১১ কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় যা ফ্রান্সে সর্বোচ্চ খেতাব জয় করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সমরবাদী প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবসময় মিডিয়াকে ব্যবহার করেছে, এখনও ব্যবহার করে যাচ্ছে। অন্যায় যুদ্ধগুলোকে ন্যায্যতা দিতে বৈশ্বিক মিডিয়াগুলো সদাতৎপর। মিথ্যা ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করে গণতন্ত্র, মানব-মুক্তি ও স্বাধীনতার বুলি আওড়িয়ে বিশ্বের তেল-গ্যাস সম্পদ দখল ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মিডিয়া আলগর্কি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে প্রধান প্রধান টিভি নেটওয়ার্ক এ যুদ্ধকে সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সগুলোর জন্য বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজে লাগায়। এক্ষেত্রে স্ফীত সামরিক বাজেটের পক্ষে মিডিয়া এক প্রকার ত্রাতা হিসেবে কাজ করে আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সাধারণভাবে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বীতশ্রদ্ধ মানুষকে পুনরায় যুদ্ধাগ্রহী করে তোলার পেছনেও মিডিয়ার অবদান কম নয়। বৈশ্বিক মিডিয়া যে ‘যুদ্ধ জয় বা বিজয়ের দর্শন’ ছড়িয়ে দেয় তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ অন্যায় যুদ্ধকে দেশপ্রেমের ‘প্রতিভূ’ ভাবতে শুরু করে। মিডিয়ার এহেন প্রচারণার কল্যাণেই প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় অতি উৎসাহী কিছু মার্কিন জনগণকে হলুদ ফিতেও বাঁধতে দেখা যায়।
মার্কিন মিডিয়া ও চলচ্চিত্রে এখন পর্যন্ত মুসলিমবিদ্বেষ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সংবাদ-মাধ্যমে মুসলিমদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেয়া হচ্ছে, চলচ্চিত্রে তাদের ভিলেন হিসেবে দেখানো হচ্ছে। যদিও এফবিআই ডাটাবেস থেকে বের হওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮০-২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত ৬% সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলিমরা জড়িত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নাজীরা যেমন সব সংকটের প্রাণকেন্দ্রে ‘ইহুদী ষড়যন্ত্র’কে দায়ী করেছিল, একইভাবে আজকের সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব ‘মুসলিম সংকটে’র গল্প হাজির করে যা প্রাচ্যবিদ্বেষী পশ্চিমের মনে ছাপ ফেলে। এটি এক ধরনের প্রতীকের মতো যাকে যিযেক ‘মাস্টার সিগনিফায়ার’ বলে অভিহিত করেছেন। মিডিয়া আবি®কৃত মুসলিম সন্ত্রাস এখন একটি ‘মাস্টার সিগনিফায়ার’। বিশ্ব মিডিয়া এই মুসলিম জুজু আবিষ্কারের পর মন্দা, বেকারত্ব, পুলিশি নিপীড়ন থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে।২ এ কাজে তারা পুরোপুরি সফল। কারণ ইউগভপোলের জরিপ থেকে জানা যায়, ৫৫ শতাংশ আমেরিকান মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। বয়সভেদে এ হারের আবার তারতম্য রয়েছে। বয়স ও আদর্শিক দিক থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণকারী ব্যক্তিদের একটি তুলনামূলক তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ১৮-২৯ বয়সীদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ৪০%, ৩০-৪৪ বয়সীদের মধ্যে ৪৫%, ৪৫-৬৪ বয়সীদের মধ্যে ৬৩%, ৬৫-র ঊর্ধ্বে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ৭০%। আদর্শিক দিক থেকে ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ৪৩%, রিপাবলিকানদের মধ্যে ৫৩% এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ৭৬%। জাতীয়তার দিক থেকে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এ হার ৬২%, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ৩২% এবং হিস্পানিকদের মধ্যে এ হার ৩৬%।৩ এই বিদ্বেষ সৃষ্টি করেই একের পর এক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে হামলা চালানো জায়েজ করা যাচ্ছে।
এই বিদ্বেষের সংস্কৃতি ছড়ানোর পাশাপাশি মিডিয়া সাম্রাজ্য মার্কিন ও পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণেও কম পিছিয়ে নেই। স্বনির্ভর রাষ্ট্রগুলোকে ঔপনিবেশিকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউনেস্কোকে ব্যবহার করছে। এতে তারা বৈশ্বিক মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি একটি দেশের স্থানীয় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণারোপে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে নব্য-উদারবাদী দর্শনকে যেমন তারা বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রচার করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি নিজেদের অভিরুচি, ফ্যাশন, ভোগের চরিত্রকে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে অনুকরণীয় হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছে। বহুজাতিক কর্পোরেশনের পণ্যগুলোকে তারা ‘আভিজাত্যের প্রতীক’ হিসেবে প্রদর্শন করে থাকে যাতে মানবমন সহজেই পণ্যের সেবাদাসে পরিণত হয়। বিভিন্ন ‘ব্র্যান্ড নেম’ ব্যবহার করে পণ্যগুলোকে আকর্ষণীয় বস্তুতে পরিণত করা হয়। ফলে মিকি মাউস, কোকাকোলা, ম্যাকডোনাল্ড কালক্রমে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বস্তুতে উন্নীত হয়েছে। মানুষের মানসজগতে দাস মনোবৃত্তি ও শ্রেণী বৈষম্যের দর্শনকে টিকিয়ে রাখতে কর্পোরেট মিডিয়া চালু করেছে ‘তারকা সংস্কৃতি’। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র, টিভি ও সংগীত ব্যক্তিত্বদের তাদের পণ্যের ‘ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাজে তাদের উচ্চবর্গীয়ের স্থান দেওয়া হয় ও অন্যান্যদের তাদের অনুসারী অধীনস্থের পর্যায়ে নামিয়ে আনার এক অঘোষিত শ্রেণীদর্শন কার্যকর করা হয়। এতে মানবচিত্তে গুটিকয়েক মানুষের ক্ষমতা ও আধিপত্যকে মেনে নেয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
মিডিয়ার প্রচারণা ছাড়াও গবেষণা কর্মকে প্রভাবিত করার ফর্মুলাও জানা আছে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রবক্তাদের। এক্ষেত্রে মার্কিন সরকারের অর্থ সাহায্যে ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (NED)) এবং এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ (USAID) বিভিন্ন সংস্থা ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও সমগোত্রীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিলে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব সংস্থা বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম, সমাজবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, গবেষণা ও ছাত্র বৃত্তির জন্য অর্থ যোগায়, মুক্তবাজারের সহায়ক পাঠ্যপুস্তক রচনায় অর্থ প্রদান করে। এরা তৃতীয় বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাতে নানাভাবে সহায়তা দেয়।৪ কেননা অর্থনেতিক বিশ্বায়নের অন্যতম বস্তুগত ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সুশীল সমাজের অতিজাতিকীকরণ। দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রবর্তনের গবেষণার মাধ্যমে পশ্চিমা অর্থপুষ্ট সুশীল সমাজ মানুষের আচরণগত পরিবর্তন সাধনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। এর ফলে যেকোনো দেশে গণতন্ত্রের জন্য গণআন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মার্কিন হস্তক্ষেপ থাকে।
মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারী ও আধা সরকারী এজেন্সি ও ব্যুরোগুলোর নীতি নির্ধারণে ও অধ্যয়নে এবং নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মেলনে মার্কিন পরিকল্পনা ও নকশানুযায়ী ‘গণতন্ত্র প্রবর্তনের’ ধারণা সংযোজিত হয়। যে যুক্তরাষ্ট্র একসময়ে চিলি, নিকারাগুয়া, হাইতি, ফিলিপাইনস্, পানামা, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন জুগিয়েছে, সে-ই আজ গণতন্ত্র প্রবর্তনে ব্যস্ত। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই তাত্ত্বিক কাঠামোর অংশীদার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনাগুলোতে ‘গণতন্ত্রায়ন’ এর ওপর রচিত প্রচারণামূলক সাহিত্যকর্মে ভরে যায় এবং ক্যাম্পাসগুলোতে ‘গণতন্ত্রায়ন’ এর ওপর কোর্সের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।৫ এ ধরনের গবেষণা দেশে দেশে অসম শ্রেণী সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক পরিসরে উত্তর-দক্ষিণের মধ্যকার নির্ভরশীলতার বৈষম্যমূলক শ্রেণী সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে একমাত্র বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত করার ক্ষেত্রে এসব গবেষণা অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে অতিজাতিক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তাদের সৃষ্ট সুশীল সমাজের অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি শ্রেণী বা গ্রুপের আদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা জরুরী। এই আদর্শগত ভিত্তিই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রস্থ দেশগুলোর কাঠামোগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। অতিজাতিক নিয়ন্ত্রণারোপের জন্য যে আধিপত্যের প্রয়োজন, তা আবার টিকে থাকছে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক ও প্রান্তের অধীনস্থ উভয় গোষ্ঠীর আদর্শিকভাবে কর্পোরেটকরণের মধ্য দিয়ে। আদর্শগত এ হাতিয়ার ব্যবহার করেই আজকের দিনের আধিপত্যবাদী বৈশ্বিক সামাজিক কাঠামো গঠন করা গেছে। সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের যুগেই মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।৬
বিশ্বয়ন পর্বে এসে পুঁজিবাদ তার সংকট উত্তরণের জন্য একচেটিয়াতন্ত্রের প্রবর্তন করে এবং বিশ্বময় বাজার দখলের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের অভ্যুদয় ঘটায়। বাজার মৌলবাদের দর্শন তখন থেকে বহুজাতিক কর্পোরেশনের স্বার্থ রক্ষার নতুন নগ্ন পন্থা অনুসরণ করে। যুগে যুগে পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন তার কৌশল পরিবর্তন করে নতুন ধরনের শোষণ কাঠামো তৈরি করছে আর যুগের পরিবর্তনে আবিষ্কার করছে নতুন নতুন শব্দ, যেমন ‘মুক্ত বিশ্ব’, ‘মুক্ত বাণিজ্য’, ‘গণতন্ত্র’, ‘আমদানি উদারিকরণ’ প্রভৃতি। বাজার দখলের জন্য এসব শব্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ।
তথ্যসূত্র
১) মাইকেল প্যারেন্টি, অনু. ওমর তারেক চৌধুরী, সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, তৃতীয় মুদ্রণ, ঢাকা: শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০০৫, পৃ. ১১১।
২) ফারুক ওয়াসিফ, “মাইনরিটি রিপোর্ট নাফিস কাহিনী”, available from। facebook.com/faruk.wasif?fref=ts.
[Accessed 2012]
৩) Mona Chalabi, ”How anti-Muslim are Americans? Data paints to extent of Islamophobia”. The Guardian, 8 December, 2015.
৪) মাইকেল প্যারেন্টি, সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, পৃ. ৬৭।
৫)William I. Robinson, Promoting Polyarcly: Globalization, US Intervention and Hegemony, 16.
৬) Ibid, p. 30-1.
সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা