“সূর্য দীঘল বাড়ি” : সমাজবাস্তবতার নিরীখে (পর্ব-১)
পূবেতে পুকুর ঘাট পশ্চিমেতে হাট
উত্তরেতে লাউ-সীম দখিনে জমিন
সেই ঘরেতে বাস করে খোদার মোমিন
আর পূব-পশ্চিম সুর্য-দীঘল হয় যে ঘর
জ্বরা -ব্যাধি -মৃত্যু তার নিত্য সহচর।।
ভাল উপন্যাস থেকে ভাল চলচ্চিত্র হতে পারে। আবার নাও পারে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উভয়েরই ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। সাফল্যটা নির্ভর করে উপন্যাসটির দৃশ্যশ্রাব্য রূপায়নের সময় চলচ্চিত্রের ভিন্ন মাধ্যমটিতে, চলচ্চিত্রকার কোনো নতুন মাত্রা যোগ করতে পারলেন কী-না। বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী” একটা উপন্যাস হিসাবেই যুগে যুগে বাঙ্গালী পাঠকদের মুগ্ধ করে এসেছে। চলচ্চিত্র বানিয়ে সত্যজিৎ “পথের পাঁচালী” -কে একটা নতুন মাত্রা এনে দিলেন। একই কথা বলা যায় অদ্বৈত মল্লবর্মনের “তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসটির ঋত্বিক ঘটককৃত চলচ্চিত্রয়ানের ক্ষেত্রেও। আবু ইসাকের “সূর্য দীঘল বাড়ি” এমন একটি উপন্যাস, পূর্ববাংলার সমাজবাস্তবতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে যে রকম আন্তরিক প্রয়াস “লালসালু” বা “সংশপ্তক” এ রকম দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের সাহিত্যে খুব একটা বেশি নেই। এই উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়নে মসিহ্উদ্দীন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী কতখানি নতুন চলচ্চিত্রিক মাত্রা যোগ করতে পেরেছেন ? বিষয়টি আলোচনায় একটু বিশদে যাওয়া যাক।
তেমন ভালো লাগেনি জয়গুনের ঘরে আগুন লাগার দৃশ্যটি। কেমন কৃত্রিম ঠেকেছে। একই ভাবে ভালো লাগেনি স্রেফ দাঁড়িযে থেকে করিম বক্সের গলা টিপুনী খেয়ে মরার শটটি। অস্বস্তি লেগেছে হাসুর চুলের কন্টিনিউটি রক্ষার ব্যর্থতা দেখে। তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে পূর্ববঙ্গের এক গ্রামের সামাজিক বাস্তবতা ও তার প্রেক্ষাপটে জয়গুন নাম্নী এক হতভাগ্য নারীর আত্মমর্যাদার লড়াইয়ের চিত্রণে পরিচালকদ্বয়ের সুগভীর আন্তরিক প্রয়াস।
বিদেশী সমালোচকেরা ছবিটিতে মানবতাবোধের আর্তির প্রকাশ দেখতে পেয়েছিলেন। ক্যাথলিক ও ইভানজেলিস্ট সংগঠনসমূহের পুরষ্কার এই ধারণাই দৃঢ় করে। আর আমরা কি দেখতে পেলাম? ‘নদী ও নারী’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘পালঙ্ক’- য়ের পরে এই প্রথম আমরা পেলাম এমন একটি চলচ্চিত্র যা আমাদের চিরকালের জানা-অজানা পূর্ববঙ্গের একটা গ্রামকে সেলুলয়েডে মূর্ত করল। পেলাম এমন একটি চলচ্চিত্র যেখানে গ্রাম আছে, কিন্তু গ্রাম্যতা নেই। মফস্বল আছে, কিন্তু উপস্থাপনায় মফস্বলীয়তা নেই। এক অখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্রকারের করা “পথের পাঁচালী”-র নির্মাণশৌকর্ষে চলচ্চিত্রিক নন্দনতত্ত্বের কিছু মৌলিক ও গভীর সৃষ্টি দেখে পাশ্চাত্ত্যের কিছু সমালোচকেরা প্রথমে মনে করেছিলেন এটা একটা ‘আকস্মিক’(accidental) সৃষ্টি মাত্র। যেমন কোনো গ্রামীণ স্বভাবকবি হঠাৎ করেই সৃষ্টি করে ফেলেন কোনো গভীর ব্যঞ্জনাময় চরণ, এটাও সে জাতীয় কিছু। এ ভুল তাদের ভাঙ্গল “অপরাজিত” দেখার পর। তখনই ওরা বুঝলেন চলচ্চিত্র নন্দনতত্ত্ব সর্ম্পকে ভালভাবেই অবহিত ও কত বিদগ্ধ একজন মননশীল শিল্পী ছিলেন “পথের পাঁচালী”-র ক্যামেরার পেছনে। “সূর্য দীঘল বাড়ি”-র প্রথম শট্টি থেকেই বুঝে নেওয়া যায় যে, চলচ্চিত্রকারদ্বয় আধুনিক চলচ্চিত্র ভাষায় রীতি-নীতি জানেন। শুধুমাত্র আঙ্গিক নয়, বাস্তববাদী একজন শিল্পীর কাছে যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ের ক্ষেত্রেও তাঁরা রেখেছেন একটা আধুনিক পরিশীলিত মননের ছাপ। গ্রাম বাংলার প্রতি শহুরে মধ্যবিত্তের যে এক ধরণের জোলো সেন্টিমেন্ট, যা আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে হামেশাই উপস্থিত, তার পরিবর্তে বাংলার গ্রাম সম্পর্কে দেখা গেল একটা বিশ্লেষণাত্নক দৃষ্টিভঙ্গি।
আবু ইসহাক ওঁর অনবদ্য উপন্যাসটিতে যে গ্রাম এঁকেছেন এবং শাকের-নিয়ামত সেলুলয়েডে যে গ্রামটাকে মূর্ত করতে চেয়েছেন , তার একটা ভৌগোলিক বিবরণ থাকলেও , এ গ্রাম পূর্ববঙ্গের যে কোনো গ্রাম, একটা আর্কিটাইপ। জল-কাদায় ঘেরা আম-জাম-কাঁঠালের শ্যামলছায়ায় মেশানো এ গাঁয়ের প্রধান কেন্দ্র গাঁয়ের মসজিদটি। ‘গণদেবতা’- তে রাঢ় বাংলায় চন্ডীমন্ডপকেন্দ্রিক হিন্দু গ্রামের অসামান্য চিত্র এঁকেছিলেন তারাশঙ্কর। তা’ নিয়ে একটা ছবি করেছেন তরুণ মজুমদার। কিন্তুু মসজিদকেন্দ্রিক পূর্ব বাংলার গ্রাম নিয়ে বড় কোনো সাহিত্যকর্ম এদেশে তেমন হয়নি। ‘আনোয়ারা’ ও ‘আবদুল্লাহ’-র ঐতিহ্য যে রক্ষা করা যায়নি তা বাংলা সাহিত্যের এক বিরাট ক্ষতি। যাই হোক, গাঁয়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ জোতদার, যার অর্থানুকূল্যে মসজিদের নূরানী চেহারার ইমাম সাহেব লালিত, সেই গদু প্রধানের ঘরেও মাত্র টিনের চাল, তবে মসজিদটি কিন্তু পাকা। বিচার-আচার মসজিদেই হয়, যা গ্রামীণ সমাজের পুরোপুরি কেন্দ্রবিন্দু এবং নিয়ন্ত্রক। এ গাঁয়ের অধিবাসীদের মসজিদ ও তার অন্তর্নিহিত সূক্ষ¥ শ্রেণী দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে এক অসহায়া নারীর নিজের ও নিজের সন্তানদের জন্যে এক পরিশ্রমী কিন্তু সম্মানজনক জীবনের সংগ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে ছবির কাহিনী।
গাঁয়ের কেউ মধুর চাক ভাঙ্গলে সে মধুর উপরে গদু প্রধানের অধিকার যেমন স্বীকৃত, তেমনী গাঁয়ের নারীদের যৌবনের মধুর প্রতি তার অধিকারও মসজিদের নিয়ন্ত্রকদের কাছে খুব অসঙ্গত কিছু নয়। গাঁয়ে রয়েছে এক দিকে গদু প্রধানের মত মুষ্টিমেয় কিছু জোতদার, যাদের গোয়ালে একাধিক হৃষ্টপুষ্ট গাভী, গোলায় ধান আর মগজে রয়েছে পরনারীচর্চার অনন্ত অবসর, অন্য দিকে রয়েছে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিত্য সংগ্রামরত, নিঃস্বকরণের দিকে দ্রুত ও অনিবার্য পথযাত্রী, জয়গুনের পরিবারের মত অসংখ্য ভূমিহীন পরিবার, শ্রমই যাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। আর এই দুই শ্রেণীর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন কোণে অবস্থান করছে খলিল মাতবর, খুরশীদ মোল্লা , জোবেদালী ফকির, ইমাম সাহেব, প্রমুখ গ্রামীণ মধ্যস্বত্ব-ভোগী পরগাছাজীবীরা ও করীম বক্সের মত সেইসব প্রান্তিক চাষি আকাল পড়লেই যাদের বউ-বাচ্চাদের তাড়িয়ে দিতে হয়। জোতদার গদু প্রধানের উঠোনে আলাপরত গদু, খলিল মাতবর ও মৌলভী সাহেবের সঙ্গে একই ফ্রেমে দেখা যায় চারটে হৃষ্টপুষ্ট গাভী । ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট। দুধে-ভাতে আছে তারা। এর পাশাপাশি জয়গুন , করীম বক্স, ভাউজ বা লালুর মায়ের পরিবারের শুধুমাত্র দেহ ধারণ করে বেঁচে থাকার নির্মম প্রতিবেশ, গ্রামীণ ‘আছে’ ও ‘নেই’ এই দুই শ্রেণীর অবস্থানকে মূর্ত করেছে, যে শ্রেণীগত অবস্থান এবং দ্বন্দ্ব চলে আসছে আবহমান কাল ধরে এবং তেভাগা, টঙ্ক ও নানকার প্রভৃতি বড় বড় কৃষক আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যে দ্বন্দ্ব, কখনোই তেমন বিস্ফোরিত হয়নি।
শোষণের মাত্রা যতই তীব্র হোক না কেন, এই একত্র যুথবদ্ধ অচলায়তন জীবন যাকে র্মাকস বলেছিলেন “উদ্ভিদসুলভ জীবন” , সেখানে শোষিত শ্রেণী খুব কমই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। বরং সমস্ত শোষণ ও যন্ত্রণাকে ভাগ্যের পরিণতি হিসাবে মেনে নেয়ার এক ধরণের অদৃষ্টবাদী চেতনা পূর্ববঙ্গের গ্রামজীবনের ভাবজগতে বিরাজ করে এসেছে সেই আবহমান কাল ধরে। তাছাড়া বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে ছড়ান ছিটানো হাজারো পীর-ফকির-বাউল-মরমীর মধ্যে যে জীবনদর্শন আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি তা শ্রেণী চেতনায় তেমন উদ্বুদ্ধ করে না, বরং নেতি জন্মায় ইহজাগতিকতা সম্পর্কে, করে তোলে পলায়নবাদী অদৃষ্টবাদী। ছবি শুরুর প্রথমে ক্যামেরা রেললাইনের বস্তির পাশে প্যান করে। দেখি মানুষের হাতের পাঞ্জা আঁকা চিত্র- ‘এখানে জ্যোতিষী দ্বারা হাত দেখানো হয়’। মানুষের ভাগ্য তার কর্মে নয়, তার ভাগ্যরেখায় নিয়ন্ত্রিত। তারপরেই মিডশট্ থেকে ক্লোজ আপে ভেসে ওঠে জয়গুনের মুখ— যে নারী নিজের ভাগ্যকে নিজে গড়তে চেয়েছিল। সাউন্ডট্রাকে ভেসে আসে ঢেঁকির পাড়ের শব্দ। পিছনে ফেলে আসা গাঁয়ের নস্টালজিক স্মৃতি। ওরা ফিরে যাবে গ্রামে— ফিরে এল, কারণ ইতিমধ্যেই “মেঘে ভিইজ্যা রোদে পুইড়া” ছিন্নমূল পরিবারটি “শহরের মজা টের পাইয়া গেছে।”
গ্রাম বাংলার এই নিস্তরঙ্গ ‘উদ্ভিদসুলভ জীবন’ যে মানুষকে কত হীন করে তোলে, কলুষিত করে তার আত্মাকে, “পথের পাঁচলী”- র সেজ বৌয়ের জবানীতেও আমরা তার ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। সেজবৌ, যে দুর্গার দুটি পেয়ারা বা একটি পুঁতির মালা চুরির কারণে পাড়া মাথায় করত, হরিহরের পরিবারের নিশ্চিন্তপুর ত্যাগের সময় সেই সেজবৌকেই এক ধামা ফল এনে সর্বজয়ার হাতে তুলে দেয়ার সময় দেখি এই আত্মোপলদ্ধি ; “এই এক জায়গায় পড়ে থাকা ……… এ কোনো কাজের কথা নয় নতুন বৌ। এ মানুষকে বড় ছোট করে দেয় …….. আমাকে নিজেকে দিয়েই তো দেখছি।”
এর পাশাপাশি যদি আমরা ভারতীয় গ্রাম সর্ম্পকে মার্কসের উদ্ধৃতি তুলে ধরি তাহলে সত্যজিতের সমাজ-সচেতনতার ব্যাপারে যারা কটাক্ষ করেন তাদের চেতনার দৈন্যই প্রকাশ পায়। ভারতীয় গ্রাম সম্পর্কে মার্কস বলেছেন; “এ-কথা যেন না ভুলি যে এই সব শান্ত সরল (Idyllic) গ্রাম গোষ্ঠিগুলি যতই নিরীহ মনে হোক, প্রাচ্য স্বৈরাচারের তারাই ভিত্তি হয়ে এসেছে চিরকাল; মানুস্যমানসকে তারাই যথাসম্ভব ক্ষুদ্রতম পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তাকে বানিয়েছে কুসংস্কারের অবাধ ক্রীড়নক, তাকে করেছে চিরাচরিত নিয়মের ক্রীতদাস, হরণ করেছে তার সমস্ত কিছু মহিমা ও কর্মক্ষমতা। …………. সে আত্মপরতার কথা যেন না ভুলি, যে এই দীন, অনড় ও উদ্ভিদসুলভ জীবন, এই নিষ্ক্রিয় ধরণের অস্তিত্ব থেকে অন্য দিকে তার পাল্টা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে বন্য লক্ষ্যহীন এক অপরিসীম ধ্বংসশক্তি এবং হত্যা ব্যাপারটিকেই গোটা ভারতবর্ষে পরিণত করেছে এক ধর্মীয় প্রথায়।”
তাই এই আপাত শান্ত নিরীহ “idyllic” জীবনে হত্যা-মৃত্যু-ভায়োলেন্স যে কতখানি সুপ্ত, গ্রামসমাজ যে কতখানি দাঁড়িয়ে আছে ভায়োলেন্সের উপর, করিম বক্সের প্রতিবাদহীন অসহায় মৃত্যু তারই প্রমান। দনস্কয়ের করা গোর্কির “আমার ছেলেবেলা”- তেও দেখি নিজনি নভোগরদের আপাত শান্ত জীবনের প্রতিটি মজ্জায় কী ভাবে মিশে রয়েছে অমানবিক নিষ্ঠুরতা। নিজনি নভোগরদের অবস্থা বাংলার চেয়ে হয় তো আরো বেশি শোচনীয়, কারণ ওখানে সামন্তবাদী নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এসে মিশেছিল- পুঁজিবাদী লোভ।
পরের অংশ আগামী কাল

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে।