| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

প্রসঙ্গ যেহেতু সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

বেশ অনেক লম্বা সময় ধরে নিসর্গ সম্পাদকের উৎপীড়ন চলে আসছে এমন একটি মুক্ত গদ্য তাঁকে জমা দেয়ার জন্যে, যার ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা বা অসাম্প্রদায়িকতা বাংলাসাহিত্যে কিংবা বাংলা কবিতায় কেমন ঘণ্টা বাজিয়েছে তার যৎকিঞ্চিৎ আলোক যেন বিচ্ছুরিত হয়। সম্পাদক মশায়, নিতান্ত সদাশয় বলেই এই অধমের প্রতি এহেন কৃপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। তিনি আমার চেয়ে অধিকজ্ঞাত যে, ভাটিবাংলার একান্ত দক্ষিণ পূর্বকোণে নিতান্ত অবহেলিত কিছু কবিতা পদবাচ্য বাক্য রচনা ভিন্ন আমার পক্ষে আর কোন রকম যোগ্যতা অর্জন করে ওঠা সম্ভব হয়নি। তারপরও, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় যা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপকের আজীবন গবেষণার সন্দর্ভ হতে পারে, তা আমি কী করে লিখি! আমি এখন আদার ব্যাপারীর মতন এমন বিষয় নিয়ে কীইবা লিখতে পারি সে ব্যাপারে আপনারা নিশ্চয় যথেষ্ট ভাবিত হয়ে পড়েছেন। তবে, আপনাদের এতটুকু নিশ্চিন্ত করতে পারি যে, আর যা’ই লিখিত হোক এই মস্তিষ্ক থেকে, আপনাদেরকে নতুন কিছু জানানোর কিংবা জ্ঞান প্রদান করার ক্ষমতা, যোগ্যতা অথবা সাধ্য আমার নেই। তবু বাজারে তেমন তেমন খ্যাত না হলেও সম্পাদক মহোদয় যখন আমাকে লেখক বলে গণ্য করেছেন, সেহেতু দু’চার কলম যা পারি লেখার চেষ্টা চালাচ্ছি। কষ্ট করে পাঠ না করলেও তেমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না বলে আগে থেকেই ঘোষণা করছি।

প্রসঙ্গ যেহেতু সাম্প্রদায়িকতা, তাই সম্প্রদায় বলতে কী বুঝি তা কিছুটা বলে কাগজের খালি পৃষ্ঠা ভরে তোলা যেতেই পারে। আমি যতটুকু জ্ঞান বিদ্যা শিখে ছিলাম তা থেকে জানতে পাই যে, মানুষ সমাজবদ্ধ বা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করার মতো এক ধরনের প্রাণী। প্রতিটি দলের সদস্য মনুষ্যগণ নিজ নিজ দলের স্বার্থ এবং অপর সদস্যদের রক্ষা করার জন্যে দৃঢ় সংকল্প ছিল। এই কর্ম করতে গিয়ে অন্য প্রাণী থেকে যেমন, তেমনি তারা অন্য দলের মানুষ থেকেও নিজেদেরকে রক্ষা করার প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণ করতে কুন্ঠিত হতো না। এসব দলগুলিকে তাদের গোত্র কিংবা সম্প্রদায় বলে সম্বোধন করা যেতে পারে। সেই অর্থে মনুষ্য প্রজাতি সেই আদ্যিকাল থেকে সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখে আসছে। অর্থাৎ মনুষ্যগণ আদ্যোপান্ত সাম্প্রদায়িক প্রাণী বিশেষ। তাহলে সাম্প্রদায়িক শব্দটি এতখানি নেতিবাচক অর্থে গৃহীত হচ্ছে কোন্ প্রকারে? তবে কি শাব্দিক অভিধান ছেড়ে শব্দটি ব্যবহারিক অভিধানের দিকে পা বাড়িয়েছে? এখন মনে পড়ছে, দু’টি সম্প্রদায় যখন দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত হয়ে থাকে, তখন তাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে সকলেই অভিহিত করে থাকে। একদা প্রাচীন সমাজে এই রূপে দাঙ্গা বা যুদ্ধ করে বীরত্ব প্রদর্শন করলে তারা নিজ নিজ সম্প্রদায়ে বীর বলে প্রশংসিত হতো, বিরুদ্ধ শিবিরেও তাদের সমীহ করা হতো। তাহলে, আজকে এসে সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করার সংগ্রাম অকস্মাৎ নেতিবাচক হয়ে পড়লো কোন্ কারণে? আবার আমরা তো দেখে থাকি যে বাঙালি সম্প্রদায় পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং যথাবিহিত প্রশংসিত হয়েছে। এসকল যোদ্ধাগণকে আমরা নানান সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করেছি। তবে কি ‘সম্প্রদায়’ বা ‘গোত্র’ এমনকি ‘জাতি‘ শব্দগুলিকে ব্যবহারিক জীবনে আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যুৎপত্তিগত অর্থবোধকতা থেকে ভিন্ন প্রকারে ব্যবহার করে ছোট্ট গণ্ডীতে আবদ্ধ করে ফেলেছি? যেমন বৈজ্ঞানিক নামানুসারে ‘গণ’ বা ‘জাতি’ হিসাবে আমরা ‘মেরুদণ্ডী’, আর সেই মেরুদণ্ডী জাতির একটি প্রজাতি হলো ‘হোমোস্যাপিয়েন্স’ বা তথাকথিত মানুষ। যেখানে মানুষ জাতি নয়, প্রজাতি মাত্র, সেই মানুষ যখন একেকটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীকে আবার জাতি বলে সম্বোধন করে জাতিকে প্রজাতি থেকে ছোট করে ফেলছে। আবার কখনও কখনও সম্পূর্ণ মনুষ্য প্রজাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে গোষ্ঠীর স্বার্থ বড় করে দেখি, যাকে আমরা জাতিপ্রেম কিংবা দেশপ্রেম বলে অভিহিত করে থাকি। এই জাতি মনুষ্য প্রজাতির ভগ্নাংশমাত্র। আবার সেই তথাকথিত আর্য জাতি কিংবা আরব জাতি কিংবা বাঙালি জাতি নামক জাত্যাভিমান আমাদের জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণও হয়ে ওঠে। এসব জাত্যাভিমান একটিমাত্র পৃথিবীকে মানচিত্রের নানান রঙের দেশ ও জাতিতে বিভক্ত করেছে। এককালে তথাকথিত আর্য্যগণ আফ্রিকা এবং ভারতবর্ষের মানুষকে মনুষ্যজ্ঞান করতো না বলে গরু বাছুরের তুল্য মনে করে বাজারে ক্রয়বিক্রয় করে নিজ সম্পত্তি-জ্ঞানে বহুবিধ কর্মকাণ্ডে খাটিয়ে নিতো। এদের এক দল মালিক সম্প্রদায় এবং অপর দল দাস সম্প্রদায়ে পরিগণিত হয়েছিলো। বস্তুত পৃথিবীতে প্রকৃত সম্প্রদায় দু’টি; একটি শোষক, অপরটি শোষিত। এটা সকলেরই জ্ঞাত। তবু বিভিন্ন অনুশাসন মানুষের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে নানা রকমের সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে থাকে। এই যেমন বিভিন্ন গোত্রকে আমরা সম্প্রদায় বলে ধরতে পারি, তেমনি আবার বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী বা ভাষিক সম্প্রদায়ও সমাজে রয়েছে, যাদের কারও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। তবে কী সেই নেতিবাচক সম্প্রদায়?  

মনুষ্যসমাজে কিছু কিছু শাসন বা অনুশাসন বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করেছে এবং করে যাচ্ছে। এরা মানুষের ভূতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক কিংবা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীবদ্ধতার আঙিনার আওতা ছাপিয়ে গিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একটি ভাবধারার আওতায় নিয়ে আসে। এর নাম যদিও ইংরেজিতে রিলিজিওন বলা হয়, বাংলায় এটি ধর্ম নামে খ্যাত। যদিও ধর্ম বলতে আমরা এক সময় ‘চরিত্র’ বুঝতাম, যেমন পানির ধর্ম, বাতাসের ধর্ম ইত্যাদি, কিন্তু ইদানীং রিলিজিওন যদিও চরিত্র শুদ্ধির কথা বলে থাকে, তবুও দেখা যাচ্ছে চরিত্র বা আচরণ নিয়ে ধর্ম-পালনকারীদের তেমন একটা মস্তিষ্ক প্রদাহ নেই, যতটা আছে অপর ধর্মীয় গোষ্ঠী অপেক্ষা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার নিয়ত পায়তারা। আর মনে সন্দেহ জাগছে এই ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় তৈরির কারণে পৃথিবীময় একধরনের প্রভাব ও ক্ষমতা বিস্তারের প্রতিযোগিতা ঘটমান রয়েছে, যাকে নেতিবাচক সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে গণ্য করে ব্যবহারিক অভিধান সাম্প্রদায়িক শব্দটিকে একান্ত নেতিবাচক বলে গ্রহণ করেছে। আমি এখন যতই মাথাকুটে বুঝাতে চেষ্টা করি না কেন, জগতের কোনো শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন ব্যক্তি এই শব্দটিকে ইতিবাচক হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হবেন না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। 

এখন বাংলা সাহিত্যের দিকে তবে সামান্য নজর বুলানো যেতে পারে। হর প্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কার হেতু চর্যাপদকে বাংলা কবিতার তথা বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন বলে সকলে মনে করে থাকেন। তবে, শাস্ত্রী মশায় নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন যে এগুলো বৌদ্ধদোহা বা শ্লোক জাতীয় কিছু হয়ে থাকবে। সেই বিচারে এরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাহিত্য। যতদূর জানা যায় নবম খ্রীষ্টাব্দ, মতান্তরে সপ্তম খ্রীষ্টাব্দে বৌদ্ধ ভান্তেগণ পাহাড়ে বসে ধ্যান ও জীবনযাপনের কালে যেসমস্ত শ্লোক লিখে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্বাণ লাভের আকুতির পাশাপাশি হৃদয়ের অন্তর্নিহিত প্রেম এবং কখনও সামাজিক আর্থিক দুরবস্থাও চিত্রিত হয়েছিল। তবুও অস্বীকারের যো নেই যে এই দোহাগুলো একান্ত বৌদ্ধধর্মীয় সম্প্রদায়ের কথা বা গান। তবে কিনা, এখানে ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি বিষোদগার পরিলক্ষিত হয়নি। চর্যাপদের পরে যে নিদর্শনটি বাংলা সাহিত্যের সর্বস্বীকৃত ঐতিহ্য, তা বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটাকে আপনারা যতই প্রেমের কাহিনীকাব্য ভাবুন না কেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধার প্রেম যে ধর্মীয় বন্দনারও অংশীভূত তাতো অস্বীকার করার উপায় দেখিনি। এভাবে মধ্যযুগে যখন নানা রকম মঙ্গলকাব্য এবং কাহিনীকাব্য রচিত হচ্ছিল, সকলই মূলত লেখকের ধর্মবিশ্বাস এবং সম্প্রদায়ের অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত ছিল। যদিও লেখকগণ এসব দেবকাহিনি রচনার ছলে নিজ এবং মানবিক মনে বেদনার কথা ঘটনার ছত্রছায়ায় রূপায়িত করেছিলেন, তবুও এদের কিছুতেই সম্প্রদায়চেতনা বহির্ভূত বলা যাবে না। বাংলা সাহিত্যের সীমা ছাড়িয়ে বাঙালি যখন অনুবাদ সাহিত্যের দিকে নজর দিল তখনও মহাভারত, রামায়ন, ইত্যাদিও কেবলি ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপার। তথাকথিত আধুনিক বাংলা কবিতার দিকে তাকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রামায়নের আশ্রয় নিলেও তিনিই প্রথম দেবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। চর্যাপদ থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সকলেই ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ, অনুষঙ্গ বা কাহিনিকে নির্ভর করে কবিতা বা পদ রচনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের কাউকেই সাম্প্রদায়িক বলে কেঊই আখ্যা দিয়াছেন বলে শোনা যায়নি। অর্থাৎ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সামাজিক বিষয়-আশয় নিয়ে লিখলেও কেঊ সাম্প্রদায়িক হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তাহলে কী সেই লক্ষণসমূহ, যা থাকলে কোনো সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িক বলে অপবাদ দেয়া যাবে? এটা বুঝতে হলে সম্প্রদায়গুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহ কর্তৃক ধর্মের জুজু প্রদর্শনপূর্বক নিজ গোষ্ঠীর লোকেদের দাবিয়ে রাখা এবং অপরাপর জনগোষ্ঠীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নিপীড়ন নির্যাতনের ইতিবৃত্তের দিকে তাকিয়ে দেখতে হয় বৈকি। এমনকি নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখার প্রয়াসেও এই ধরনের সাহিত্য রচিত হতে পারে। এরূপ সাহিত্য আদতেই সাহিত্য কি-না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। কারণ যা জনগোষ্ঠীর ‘সহিত’ না থেকে জনগোষ্ঠীকে ‘রহিত’ করতে প্রয়াসী, তা কী করে সাহিত্য পদবাচ্য হবে, আমার বোধের মধ্যে আসে না।

ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কথা তো বললাম, কিন্তু লিঙ্গ সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ না করলে কি চলে? আমার তো মনে হচ্ছে, পৃথিবীর তাবৎ চিরায়ত সাহিত্য হিসেবে যা কিছু খ্যাত হয়েছে, এদের প্রায় সকলই পুরুষ সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করে আসছে এবং নারীর স্বার্থকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে নারীর মনুষ্য মর্যাদা পর্যন্ত ক্ষুণ্ন করেছে। তবে নিসর্গ সম্পাদকের আকর্ষণ বোধ করি কেবল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যাপারে নিশানা তাক করেই রয়েছে। অতএব, আমার আলোচনাকে বিস্তারের দিকে না ঠেলে দিয়ে বরং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে গুটিয়ে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে আলোচনা করতে হবে বলেই বোধ করছি।   

ধরা যাক, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মশায় শ্রীকান্ত নামক বিখ্যাত উপন্যাসে যখন লিখেছেন, “বাঙালী ও মুসলমানের মধ্যে ফুটবল খেলা অনুষ্টিত হইবে”, তখন নিশ্চয়ই অনুধাবন করা যায়, মুসলমানেরা বাঙালি নয়। অথচ শরৎবাবুর জীবদ্দশায় শুমারী বলছে বাঙালিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা অধিক। তাহলে কেন তিনি এমন বাক্য রচনা করলেন? তিনি কি তৎকালীন বাঙালি সমাজ সম্পর্কে যথাবিহিত জ্ঞাত ছিলেন না? যতদূর জানি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সমকালে সকলের চেয়ে বেশি সমাজসচেতন লেখক ছিলেন। তবে কি উল্লিখিত বাক্যটির ভিতরে সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধি বিরাজমান ছিল?! অন্য অর্থে বলা চলে, সেকালের হিন্দু বাবুসমাজ বাংলাভাষী মুসলমানদের বাঙালি বলে মানতেন না। এই হিন্দু মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতরে বৈপরীত্য এবং নানা রকম দ্বন্দ্ব সুদীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান থাকলেও সামাজিক মেলামেশায় একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কও বিরাজমান ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরাজ যখন ভারতবাসীদের মধ্যে স্বাধীনতাকামী মনোভাবের বিকাশ লক্ষ করেছিল তখন মুসলিম লীগের জন্মদানে পৃষ্ঠপোষকতা এবং ফলশ্রুতিতে দ্বিজাতিতত্ত্ব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরোধকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করে দিল। অতএব ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি এতকাল ধরে এই ভূখণ্ডে বসতি করলেও ঊনবিংশ শতকের তথাকথিত বঙ্গীয় রেনেসাঁর আগে কথিত কিংবা তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের নিদর্শন অন্তত বাংলা ভাষায় মেলে না। বরং আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সপক্ষে গান গাইতে শুনি “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে”।

সাহিত্যকে যদি ধর্মীয় সম্প্রদায় সংক্রান্ত চিন্তা অনুসারে চিহ্নিত করতে হয়, তবে তাকে তিন প্রকার বলে ধরা যাবে। প্রথমত, নিজ সম্প্রদায়ের সপক্ষে গুনকীর্তনমূলক সাহিত্য, দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিপক্ষে প্রগতিপন্থী সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির সপক্ষে রচিত সাহিত্য; এবং তৃতীয়টি হচ্ছে অপর সম্প্রদায়কে হেয় জ্ঞান করে উস্কানি প্রদানমূলক সাহিত্য। আমার যতটুকু জ্ঞানবুদ্ধি, তাতে একথাই বোধ হচ্ছে যে, সম্পাদক মহোদয় এই তৃতীয় প্রকারের সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িক সাহিত্য বলে অভিহিত করতে চান। আমিও তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করে বাধ্য। এটাই যদি ধরে নিই, তবে বাংলায় সব ধরনের সম্প্রদায়-সংশ্লিষ্ট সাহিত্য কি তৈরি হয়নি? নিশ্চয় হয়েছে। উস্কানি প্রদানমূলক সাহিত্য যদি ধরি, তবে তার অন্যতম বিকাশ চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতায় পরিলক্ষিত হয়েছে। আবার আশির দশকে এসেও ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কেউ কেউ তেমন তেমন উস্কানি উদ্রেককারী কবিতা লিখেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। কথাসাহিত্যের নানান অন্ধিসন্ধি সম্পর্কে আমার খোঁজ খবরের ঊনতা হেতু বাংলা সাহিত্যের এই ধারাটি নিয়ে আমি কোনো উচ্চবাচ্য করার সাহস পাই না। তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের লেখায় কিছু কিছু জায়গায় কেন জানি না, সাম্প্রদায়িক তথা মৌলবাদিতার গন্ধ আমার নাকে এসে লেগেছিল। অত্র কাগজের সম্পাদক মহাশয় নিশ্চয় দুয়েকজন বিজ্ঞ কথাসাহিত্যিক কিংবা কথাসাহিত্যে পারদর্শী ব্যক্তিকে উক্ত বিষয়ে নিবন্ধ রচনায় উস্কানি দিয়েছেন। তাই, আদার ব্যাপারী আর জাহাজের খবর নাইবা ঘোষণা করলাম। 

অতএব দৃষ্টি ফেরানো যাক বাংলা কবিতার দু’চারটি উদাহরণের দিকে। বাংলা কবিতায় চল্লিশের দশকে একজন শক্তিমান কবির আবির্ভাব ঘটে যিনি নিজেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের জাগরণের লক্ষ্যে উৎসর্গিত করেছিলেন। তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতাটি বারবার পাঠ করলে চমৎকৃত হতে হয়। আর এখন মনে হচ্ছে, এই কবিতায় পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতিমান কবি টি এস এলিয়টের বিখ্যাত কবিতা ‘পোড়োজমি’র সাথে সাযুজ্য রয়েছে। আপনারা যারা তথকথিত মডার্নিজমের নামে এখনও অন্ধ রয়ে যাননি, তারা একটু ভাল করে লক্ষ করলে দেখতে পাবেন যে, পোড়োজমি বা ওয়েইস্টল্যান্ড কবিতাটিতে যতখানি বিশ্বযুদ্ধের পরে সমাজের মানুষগুলোর একাকিত্বের এবং যুদ্ধের ভয়াবহতাকে চিত্রিত করা হয়েছে, ঠিক ততখানিই এটা খ্রিস্টিয় ধর্মের এবং ধর্মীয় নীতিবোধের দিকে ধাবিত করার জন্যে আহাজারি করে বিরচিত হয়েছিল। এলিয়ট আফসোস করে বলেছেন, শহরের গীর্জাসমূহে রবিবারে মানুষ তেমন ভীড় করছে না, বরং তারা গীর্জা অপেক্ষা শহরে আরও বেশি করে খাবারের দোকান তৈরি করতে চায়। অর্থাৎ টি এস এলিয়টের কবিতার পর্যবেক্ষণ বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংসস্তূপের চিত্রের সুন্দর বর্ণনা হেতু তাঁকে আমরা যত মডার্ন বলে থাকি না কেন, তাঁর চেতনা বা মনোজগত কিন্তু ধর্মীয় পুনরুত্থানের জন্যে আকুল।

ঠিক তেমন করেই ফররুখ আহমদ তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতায় দেশ এবং সাধারণ মানুষের জীবনের রোগ নির্ণয় এবং ব্যাখ্যা করে তার সমাধানে ধর্মীয় প্রেরণার দিকে নিজের মতামতকে ধাবিত করেছেন। আর তা’এমন একটি সময়ে, যখন ভারতবাসী ইংরেজ রাজত্ব থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তখন মুসলিম লীগের নেতৃত্ব আকস্মিক গজিয়ে তোলা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে উস্কানি দিয়ে আগুনে ঘৃতবৎ ভূমিকা রেখেছিল। এই সময়ে এই কবিতা আমাদের এই ইশারা প্রদান করেছিল যে, ইংরেজ থেকে মুক্তি অপেক্ষা মুসলিম জনগোষ্ঠীর পৃথক হওয়ার সাধনাই আসল সাধনা। আরও আগ বাড়িয়ে চিন্তা করলে আমরা একথাও বলতে পারি, ফররুখ এবং তাঁর সমসময়ে বেশ কিছু কবি-লেখকগণ বাংলার মুসলমানদের জন্যে পৃথক সাহিত্য সৃজন করার পাঁয়তারা করেছিলেন, যাতে বাঙালি মুসলমানগণ ভিন্নধর্মের লোকেদের লেখা সাহিত্য পাঠ না করে এই মুসলমানী বাংলা সাহিত্য পাঠ করেন। শুধু তা-ই নয়, এই কাজটিকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে অনেক অনেক বেশি আরবী ফার্সি শব্দ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কবিতার ভেতরে ঢুকিয়ে এক কিম্ভুত বাংলা ভাষার সৃজনেও তাঁরা ব্যাপৃত হয়েছিলেন।

“আহা, সে নিকষ আকীক বিছানো কতদিন পরে ফিরে

ডেকেছে আমাকে নীল আকাশের তীরে,

ডেকেছে আমাকে জিন্দিগী আর মওতের মাঝখানে

এবার সফর টানবে আমাকে কোন স্রোতে কেবা জানে!”

কিংবা

“আনি আলমাস, গওহর লুটে আনি জামরুদ লাল,

নিথর পাতাল বালাখানা থেকে ওঠাই রাঙা প্রবাল,

এরা জিঞ্জিরে আটক চিড়িয়াহীন কামনায় বুড়া

শিরাজী মত্ত! পাথর হানিয়া করি সব মাথা গুঁড়া।

রাত জেগে শুনি খোদার আলমে বিচিত্র কল্লোল

তারা ছিটে পড়ে মধ্য সাগরে জাহাজে জাগায় দোল,

আমরা নাবিক জংগী জোয়ান ইশারা পেয়েছি কত

মউজের মুখে তাই ভেসে যাই টুকরো খড়ের মত।”

‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতায় ফররুখ আহমদ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে অন্ধকার সমূদ্র পাড়ি দেওয়ার ডাক দিয়েছেন। তাঁর এই জোয়ান নাবিক দুঃখ রাত্রির পারে এখনও ‘হেরার রাজতোরণ’ লক্ষ করেন। তাঁকে তাই তামুদ্দনিক কবি বলেও অভিহিত করা হতো। তিনি জালিমের হাত থেকে নির্যাতিতের মুক্তি কামনা করতেন বটে, তবে সে কেবল নির্যাতিত মুসলমানের। সেই সময়টাই হয়তো এমন ছিল। সেকালের মোহাম্মদী পত্রিকায় এমনকি আহমদ শরীফ একপ্রবন্ধে মুসলমান লেখকদের রচনায় হিন্দুয়ানীর প্রভাব প্রবল এবং মারাত্মক বলে উল্লেখ করেছিলেন। এমনকি, পরামর্শও মিলেছে যে, বাংলা ভাষায় স্বকীয় সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, আর তার আদর্শ কোরআনের শিক্ষা এবং মুসলমানি ঐতিহ্যানুগ হতে হবে; এবং সেক্ষেত্রে ফররুখের কবিতা পথের দিশারী বলেও উচ্চারিত হয়েছে বৈকি। মোহাম্মদী পত্রিকার পৌষ ১৩৫৮ সংখ্যায় সৈয়দ আলী আহসানও ফররুখ আহমদকে ইকবালের বলিষ্ট আবেগ-তাড়িত বলে অভিহিত করেন। এমনকি সেই সময়ে আবুল কালাম শামসুদ্দীনের উৎসাহে পূর্ব বাংলা রেনেসাঁ সোসাইটি এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ইত্যাদি সংঘটিতভাবে মুসলিম সাহিত্য সাধনার পথ নির্দেশ দিতে চাইল। 

অর্থাৎ সেকালে বাঙালি কবিগণ আকস্মিকভাবে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি থেকে নিজেকে অপসৃত করে আরব্য পারস্যলোকের মানসে কেবলমাত্র বাংলা ভাষার খোলসের ভেতরে নিজেদের ধরে রাখতে ব্যাপৃত হয়েছিলেন। আর সেই ফররুখের উত্থান উন্মেষ বাংলার তরুণ যুবাদের মধ্যে যে আবেগ উচ্ছ্বাস তৈরি করেছিল, তার ফলশ্রুতিতে ফররুখের অনেক অনুকারকের জন্মলাভ হয়ে গেল। সে-সকল অক্ষম অনুকারকের দল বাংলা কবিতাকে বিপর্যস্ত করছিলো, তাদের প্রগল্ভ রচনা আর যা-ই হোক কবিতা তো নয়ই, এমনকি বাংলাও নয় বলে স্বয়ং কবি শামসুর রাহমান ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতন সাহিত্যমেলায় পঠিত প্রবন্ধে উচ্চারণ করেছিলেন। ফররুখ আহমদ একটি মহাকাব্যও রচনা করেছিলেন ‘হাতেম তা’য়ী’ শিরোনামে। এই মহাকাব্যে তিনি আঠারো অক্ষরের পদে মুসলমানী বাংলা তৈরির বেশ কিছু নয়া নিরীক্ষা প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর ‘সিন্দাবাদ’, ‘বা’র দরিয়ায়’, ‘দরিয়ায় শেষ রাত্র’, ‘শাহরিয়ার’, এজিদের ছুরি’, ‘শহীদে কারবালা’ এবং ‘পাঞ্জেরী’ সহ অনেক কবিতার জন্যে ফররুখ আহমদকে আমরা মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকি। আর বাঙালির ইতিহাসে, তা আমাদের অজানা নয় যে, এই মুসলিম সাহিত্য একসময় আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাঙালির জাতীয় চেতনার সবচেয়ে কঠোর অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে চেয়েছিল। 

ফররুখের বেশ পূর্বেই জন্মগ্রহণ করেন এবং আবির্ভূত হয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘তুমি যে নূরের রবি” এখনও বাঙালি মুসলমানদের মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে নিয়মিত সুর করে পঠিত হয়। নবীর গুনকীর্তন করে এই পদ রচিত হয়েছিল। তিনি ইসলাম-ভক্ত হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রতিও অনুরক্ত ছিলেন এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর প্রেমের কবিতা, কিশোর উপযোগী কবিতা যেমন ছিল, তেমনই ছিল ‘এছলাম’, ‘আজান’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দহম’, ‘হে খুদা দয়াময়’, ‘রাখাল খলিফা’, ‘উট চালকের গান’— এই সকল কবিতা রচনা কালে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ফারসী কবি জামী’র দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েন। 

আমাদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি জতির সৌভাগ্য যে, আমাদের ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষার জন্যে লড়াই সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় এবং ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁরাই বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির বুনিয়াদ গড়ে দিলেন। আর পঞ্চাশের দশকে এই ভাষা আন্দোলনের সাথে সাথে আমাদের সাহিত্য সাম্প্রদায়িকতার দূষণ থেকে মুক্তি পেয়ে ফল্গুধারার মতো অসাম্প্রদায়িকতার পথে বিকশিত হতে থাকলো। আর এই লড়াই সংগ্রাম পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়াছিল সেই মহান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমরা তো জানি, ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের হত্যার মাধ্যমে ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’। আশির দশকে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি। তারা কেবল ক্ষমতার দিকেই হাত বাড়ায়নি, সংস্কৃতির দিকেও হায়েনার কালো হাত অগ্রগামী হয়। এদের পৌরহিত্য করেন একদা সমাজতন্ত্রীরূপে পরিচিত কবি আল মাহমুদ। আমরা প্রথমদিকে এই ভেবে তৃপ্ত ছিলাম যে, বাংলা কবিতার আধুনিক রাজপ্রাসাদে আল মাহমুদ লোকসংস্কৃতির উপাদান ব্যবহার করে তাকে আরও সৌকর্যমণ্ডিত করে তুলছেন। এই ধরনের ভাবনা চিন্তার সপক্ষে লোক লোকান্তর এবং কালের কলস সবিশেষ ভূমিকা রেখে এসেছে। আবার ‘সোনালী কাবিন’-এ এসে আমরা দেখতে পাই ‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে’ উজ্জীবিত চৌদ্দটি সনেটের অসাধারণ সংযোজন, যাতে প্রেম এবং সমাজতন্ত্রের চেতনা এক অসামান্য সংশ্লেষ ও সমন্বয় ঘটেছিল। কিন্তু আশির দশকে যখন মৌলবাদী জামাত শিবির চক্রের উত্থান ঘটতে লাগলো, তখন আল মাহমুদেরও নতুন করে মুসলমানী হলো। তিনি সোনালী কাবিন শীর্ষক কবিতার নবম সনেটের নবম ও একাদশ ছত্রে যথাক্রমে ‘বৈদিক’ এবং ‘কৌটিল্যের’ শব্দ দুইটি সংযোজন করে সোনালী কাবিন সনেটগুচ্ছেরও মুসলমানী করে ছাড়লেন। 

“অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন

করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর

তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ?”

এইভাবে কবি আল মাহমুদ নিজের বাক্যবাণে নিজেই নিপতিত হলেন, ‘মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ’-এর দলে নাম লিখালেন। আর তারপরে তো তিনি ক্রমাগত লিখে গেলেন ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্যরজনীর রাজহাঁস’, ‘মিথ্যেবাদী রাখাল’। এসব গ্রন্থে সংযোজিত কবিতাগুলো আমাদের কাছে প্রতীয়মান করে যে, আল মাহমুদ ক্রমাগত ডানে সরে গিয়েছেন। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতায় ধর্মগ্রন্থ বুকে নিয়ে শুয়ে থাকা কবি অকস্মাৎ সম্মুখীন হন কেয়ামতের; এবং সকল কিছুই, এমনকি কবির পরিবারও ধ্বংস হয়ে যায়। সব কিছুই ঢাকা পড়ে গিয়েছে, কিছুই উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই। অথচ তখনও ধর্মগ্রন্থখানি টিকে রয়েছে :

“সবকিছু ঢাকা পড়ে আছে। কোনো কিছুই উদ্ধারের আশা নেই।

আমি শুধু বিছানার ওপর পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থটি দেখলাম

কোরান, খোলা, বাতাসে পবিত্র পৃষ্ঠাগুলো নড়ছে।‘

একই কাব্যগ্রন্থের ‘ইহুদিরা’ কবিতায় আল মাহমুদ দেখালেন, ইহুদিরা অনিষ্টকর অন্ধকারের প্রাণী; ডাইনী আর গুপ্ত সাপের ফিসফাসের সাথে তারা সম্পর্কিত। আর পরবর্তী সময়ে তিনি ঘোষণা দেন, আল্লার অশ্বের সোয়ারী সমস্ত রহস্যের দরোজা পার হয়ে যাচ্ছেন। আর ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতায় তিনি তো জ্বিহাদের ঘোষণা দেন—

“মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্যে হাহাকার করে ওঠে

মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;

আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি’

এখানে তিনি অনুপ্রবেশকারী খিলজিপুত্রের আগ্রাসন বা ক্ষমতা দখলকে আইন সিদ্ধতা প্রদান করেন এই বলে যে, “আল্লার সেপাই তিনি দুঃখীদের রাজা। যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা, আর মানুষ করে মানুষের পূজা, সেখানেই আসেন তিনি। খিলজিদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।” আর এমন উদাহরণের সংখ্যা অনেক বাড়ানো যাবে বটে, তাতে বক্তব্যের যেহেতু তেমন হেরফের ঘটবে না, তাই উদাহরণ প্রদান থেকে বিরত হয়ে এটুকু বলি, এই কবি যেখানে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু সম্প্রতি শাস্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর সাথে একই সঙ্গে সভা করে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নিয়েছিলেন। অথচ তাঁর ‘দোয়েল ও দয়িতা’ গ্রন্থের ‘আমি এক নতুন তরিকা’ কবিতায় তাঁকে ডানপন্থী বলায় সমালোচনা করে লেখেন :

“হোন তিনি সুলতান মাহমুদ কিংবা আল মাহমুদ

আয়না বা আরশির ওপর তাদের কোনো ভরসা রাখেনি

আয়না মূলত এক অবাস্তব আরব্য আবিষ্কার যা ডানকে বাঁদিকে ঘুরিয়ে দেখায়। অথচ

আয়না এখন আমাকে ডানদিকে ঘুরে যাওয়া কবি হিসেবে

প্রতিপন্ন করুক এ আমি কী করে চাইতে পারি? আমি কোনোদিকেই

ঘুরতে না চাওয়া এক নতুন তরিকা।”

বস্তুতপক্ষেই মৌলবাদ কোনোদিকেই ঘুরতে না চাওয়া একটি তরিকা। এটি প্রগতির বিপক্ষে এবং স্থবিরতার সপক্ষে অবস্থান করে। আল মাহমুদ পরিবৃত হয়ে পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কজন গৌণ কবিও বাংলা কবিতায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদের চাষাবাস করেছেন এবং করছেন। তবে, আবহমান বাংলার যে সচল প্রতিবাদী চেতনার ধারা, তা এসব জগদ্দল প্রস্তরীভূত চেতনাকে কিছুতেই সামনে এসে দাঁড়াবার সুযোগ দেয় না। কিন্তু সমাজের ধর্মপ্রাণ অবহেলিত অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের মনে মাঝেমধ্যে যে জায়গা করে নেয়, সেটাই কখনও-সখনও সামাজিক বিপত্তি ঘটিয়ে থাকে।  

আমাদের সমাজের ধনবাদী চরিত্রের কারণে বৈষম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে এবং তার বিপরীতে বাম রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার কারণে মৌলবাদ এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দেশে দেশান্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর এটা দখলদারী এবং কর্তৃত্ববাদিতার সবচাইতে সহজ হাতিয়ার বলেই সুযোগসন্ধানীগণ ধর্মকে আশ্রয় করে থাকে।

আমাদের বাংলা কবিতা সূচনাকাল থেকে অভাবের বিরুদ্ধে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা রেখে এসেছে বিধায় এইসকল ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী কবিতার চরণ এই সমাজ, সমকাল বা মহাকালকে কিছুমাত্র আকীর্ণ করতে পারে না। এতটুকু বলে এখন ক্ষান্ত দেয়ার মনস্থ করলাম, কেননা, এর পরে, আর কাব্যালোচনা থাকবে না বলেই বোধ হচ্ছে। কারণ শেষ পর্যন্ত সকল কিছু রাজনীতির অধিকারেই যাবে।

 

[লেখাটি নিসর্গ থেকে পুনঃপ্রকাশ করা হলো]

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত