সেই সব মানুষ (পর্ব-৪)
যজ্ঞাগুণ্ডা হলেন চারণ কবি
যজ্ঞাগুণ্ডা । ভালো নাম যজ্ঞেশ্বর দে । জন্ম ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে । গুরুদয়াল দে আর শ্যামাসুন্দরীর সন্তান । জন্ম বিক্রমপুরে হলেও যজ্ঞেশ্বর বেড়ে উঠেছেন বরিশালে । মধ্যবিত্ত পরিবার । গুরুদয়াল ডেপুটির আর্দালির চাকরি করেন । আঠাশ বছরে শ্যামাসুন্দরীর প্রথম সন্তান যজ্ঞেশ্বরের জন্ম । তাঁর জন্মসাল নিয়ে গোলমাল আছে । কারো মতে ১৮৭৬, কারো মতে ১৯৭৮, আবার কেউ বলেন ১৮৮২ । গভীর ধর্মবিশ্বাস ছিল শ্যামাসুন্দরীর । তিনি মনে করতেন তাঁর সন্তান মহাদেবের দান । তাই নাম দিলেন যজ্ঞেশ্বর ।
ছোটবেলায় যজ্ঞেশ্বর পাঠশালায় পড়েছেন । তারপরে এলেন ব্রজমোহন স্কুলে । অশ্বিনীকুমার দত্তের স্কুল । বড় বিচিত্র মানুষ অশ্বিনীকুমার । এম এ, বি এল । প্রথমে শ্রীরামপুরের কাছে চাতরা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন । তারপরে ওকালতি শুরু করেন বরিশালে । কিন্তু ভালো লাগল না ওকালতি । এই জীবিকায় নৈতিকতা বজায় থাকে না বলে মনে হল । ছেড়ে দিলেন তাই । তখন বরিশালের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত । রমেশ দত্ত অশ্বিনীকুমারেকে বললেন, ‘তুমি একটা স্কুল খোলো । আমি পাশে থাকব ।’ অশ্বিনীকুমার সে কথায় উৎসাহিত হলেন । বাবার নামে এক স্কুল খুললেন তিনি । ব্রজমোহন স্কুল । সে স্কুল ছিল সত্য, প্রেম, পবিত্রতার পরীক্ষাগার । তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বরিশালে । আদর্শের উপযোগী ছিল বিদ্যালয়ের সংগীতটি :
এসেছি সংসারে খাটিব শিখিব
মরি কিংবা বাঁচি পিছু না হটিব
ছোট বড় কাজ কিছু না বাছিব
কর্ম-মন্ত্রে দীক্ষা, কিসের মান ?
যজ্ঞেশ্বরও গাইতেন এই গান । কিন্তু বিদ্যালয়ের এই আদর্শ তাঁকে বেঁধে রাখতে পারল না । প্রথাগত পড়াশোনায় ছিল না একবিন্দু মনোযোগ । কোনক্রমে আট ক্লাশ অবধি পৌঁছেছিলেন । তারপর পড়াশোনায় ইতি । আসলে পাগল করেছে বাহির মোরে । সেই বাইরে আছে বন্ধু-বান্ধব। তাদের নিয়ে হইহই করে বেড়াতেন তিনি । লোকে বলত যজ্ঞাগুণ্ডার দল । তাদের দৌরাত্ম্যে অস্থির মানুষ। সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে তারা । পুলিশের চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ । তখন আসরে নামলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিটসানবেল । গুণ্ডার দলে মিশে গেলেন তিনি । চাকরি-বাকরির লোভ দেখাতে লাগলেন তাদের । সেই লোভে মজল অনেকে । দল ভেঙে গেল যজ্ঞেশ্বরের । পারিবারিক মুদির দোকান ছিল তাঁদের । সেখানে এসে যোগ দিলেন যজ্ঞেশ্বর।
এই মুদির দোকান চালাতে চালাতে বৈষ্ণব গায়ক বীরেশ্বর গুপ্তের সঙ্গে আলাপ হল । ভিড়ে গেলেন তাঁর কীর্তনের দলে । সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল যজ্ঞেশ্বরের । আর ছিল গানের গলা । অল্পদিনের মধ্যে নিজেই গড়ে তুললেন এক কীর্তনের দল । আস্তে আস্তে নাম হল সে দলের । কিন্তু ভালো কীর্তনীয়া হতে হলে রাধা-কৃষ্ণকথা জানা দরকার । জানা দরকার বৈষ্ণব পদ আর পদকর্তাদের, চৈতন্যজীবনচরিত পড়া দরকার, আর দরকার ভালো গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ার । অবধূত রামানন্দ হরিবোলানন্দের কাছে গেলেন যজ্ঞেশ্বর । দীক্ষার পরে তাঁর নতুন নাম হল মুকুন্দদাস । বদলে গেল তাঁর বেশভূষা । অন্তর্হিত হল ঔদ্ধত্য । একদিন যে ছিল গুণ্ডার সর্দার সে এখন ভক্তিবিগলিত মানুষ । মস্তকে আস্কন্ধবিলম্বিত কুঞ্চিত কেশদাম, পরিধানে শুভ্র শ্বেতবস্ত্র, বক্ষে শ্বেত উত্তরীয়, গলায় তুলসীর মালা, নয়নে আনন্দাশ্রু…. ।
যজ্ঞেশ্বর থেকে মুকুন্দদাস । এক পরিবর্তন । এখানেই শেষ নয় । আবার আর এক পরিবর্তন । মুকুন্দদাস হবে গেলেন চারণ কবি । শেখ গুমহানির মতো । তখন তাঁর দেবতা হলেন তাঁর স্বদেশ । কিন্তু এই পরিবর্তন কেমন করে হল ?
আমাদের যেতে হবে কীর্তনীয়া যোগেশ পালের বৈঠকখানায় । সেখানে আসত নানা পত্র-পত্রিকা । আলোচনা হত দেশ-বিদেশের রাজনীতি নিয়ে । সেসব পত্রিকা পড়ে, আলোচনা শুনে মুকুন্দদাসের মনে লাগল দেশাত্মবোধের রং । তারপরে এসে পড়ল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ । ভাসিয়ে নিয়ে গেল মুকুন্দকে । ছোটলাট হবে এসেছেন ব্যামফিল্ড ফুলার । লাট হিসেবে ছোট হতে পারেন, কিন্তু নির্যাতনে তিনি বিরাট বড়। ফুলার আদেশ দিলেন ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেওয়া চলবে না । তাঁর নির্দেশে পুলিশ পণ্ড করে দিল বরিশালের প্রাদেশিক সম্মেলন ।
কিন্তু বরিশালে ফুলার যেমন আছেন, তেমনি আছেন অশ্বিনী দত্ত । তাঁর আদেশে বিলাতিবস্ত্র বর্জন চলতে লাগল । সেই অশ্বিনীকুমার যজ্ঞাকে ডেকে পাঠালেন । গলবস্ত্র হয়ে মুকুন্দদাস বললেন, ‘আদেশ করুন ।’ অস্বিনীকুমার বললেন, ‘যজ্ঞা, তুই গান গেয়ে জাগিয়ে তোল ঘুমন্ত দেশকে । তোর কাজ হবে চারণের কাজ, চারণ কবি তুই ।’
সেই আদেশ শিরোধার্য করে মুকুন্দ দাস বেরিয়ে পড়লেন পথে । তৈরি করলেন যাত্রাপালা । প্রথম স্বদেশি যাত্রা ‘মাতৃপূজা’ । মুকুন্দের উদাত্তকণ্ঠের জাগরণের গান মাতিয়ে দিল মানুষকে :
অগ্নিময়ী মায়ের ছেলে আগুন নিয়েই খেলবে তারা,
মরেনি বীর সেনাদল আবার আগুন জ্বালবে তারা ।
অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা তাদের জ্বলবে না রে হোমানল,
তাদের ত্যাগ বৈরাগ্যের পূর্ণাহূতি বজ্রানলের কালানল ।
এদেশের ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাতিভেদ । তাকে ছিন্ন করার ডাক দিলেন চারণ কবি মুকুন্দদাস :
হিন্দু পার্শি জৈন সাঁই
মুচি ডোম মেথর কসাই
আমরা সকলেই এক মায়ের ছেলে
এই মহামন্ত্র ভুলবো না ।
নজর পড়ল ইংরেজ পুলিশের । দেশের মানুষকে তাতাচ্ছে মুকুন্দদাস । সে যে রাজদ্রোহী । ধরতে হবে তাকে। পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগলেন মুকুন্দ । কোন জায়গায় যাত্রাপালার উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ক্ষিপ্র গতিতে তিনি চলে যান অন্য গ্রামে । ফুলারের চোখ লাল হয়ে ওঠে আরও, দমননীতি আরও কঠোর হয় । বিভিন্ন বিপ্লব সমিতিকে বে-আইনি ঘোষণা করা হয় । গ্রেপ্তার করা হয় অশ্বিনীকুমারের মতো নেতাদের ।
মুকুন্দ তখন তার দল নিয়ে খুলনার বাগেরহাট থেকে ফিরছিলেন । যাবেন উত্তর সাহাবাজপুর । রাতের অন্ধকার নেমেছে তখন । ঘাপটি মেরে মেঘনার বুকে লুকিয়ে ছিল পুলিশের লঞ্চ । অতর্কিতে তারা ঘিরে ধরল মুকুন্দদের নৌকো । ১০৮ ধারায় গ্রেপ্তার করা হল মুকুন্দদাসকে । শাস্তি হল ৩০০টাকা জরিমানাসহ তিন বছরের কারাবাস ।
বন্দি হলেন বটে চারণ কবি, কিন্তু তাঁর গান ঘুরতে লাগল মানুষের মুখে মুখে । হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে :
ফুলার, আর কি দেখাও ভয় ?
দেহ তোমার অধীন বটে,
মন তো তোমার নয় ।
হাত বাঁধিবে পা বাঁধিবে
ধরে না হয় জেলেই দিবে-
মন কি ফেরাতে পারবে,
সে তো পূর্ণ স্বাধীন রয় ।
বন্দে মাতরম মন্ত্র কানে,
বর্ম এঁটে দেহে মনে,
রোধিতে কি পারবে রণে
তুমি কত শক্তিময় !
জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বেহাল সংসারের হাল ধরেছিলেন মুকুন্দদাস । আবার খুললেন মুদির দোকান । কিন্তু নিজের ব্রত থেকে বেরিয়ে এলেন না । ‘সমাজ’, ‘আদর্শ’, ‘পল্লিসেবা’, ‘কর্মক্ষেত্র’, ‘পথ’—এসব পালায় চলতে থাকল জনজাগরণের কাজ । কখনও হতাশায় বলে উঠলেন, ‘ ভাই রে মানুষ নাই এ দেশে’ । ভগবানের কাছে পরমুহূর্তে প্রার্থনা করলেন :
ভারতের ভগ্ন প্রাণগুলি লগ্ন করে দে মা,
মগ্ন হুউক তব চিন্ময়ী ধ্যানে ।
গণ্ডী ভেঙ্গে ফেলে মুক্ত গগনতলে,
দাঁড়াক মিলনপ্রার্থী চূর্ণ করি অভিমানে ।
দেশের জন্য দেশবাসীকে জীবন উৎসর্গ করার আহ্বান জানালেন :
সাজ রে সন্তান হিন্দু-মুসলমান,
থাকে থাকিবে প্রাণ না-হয় যাইবে প্রাণ ।
লইয়ে কৃপাণ হও আগুয়ান,
নিতে হয় মুকুন্দেরে নিও রে সঙ্গে ।

গবেষক