সেলিনা হোসেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব

Reading Time: 4 minutes

সেলিনা আপার সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র ৪ বছর। বাংলাদেশের চিত্রা প্রকাশন থেকে আমার অনুদিত মাই স্টোরি বইটির প্রকাশের সময়। আপার একাধিক বইয়ের প্রকাশক চিত্রা। প্রথম দেখাতে যেভাবে উনি হেসে বুকে টেনে নিয়ে ছিলেন, আমার ধারণার অতীত ছিল সেই ভালবাসা। এই সময় আমার লেখা লেখি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কিছু কথা হয়।অনুবাদ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে শুধু অনুবাদ সাহিত্য নিয়েই লাগাতার কাজ করছি শুনে খুব অবাক হলেন। এবং বললেন, এই ধরনের পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম । তাঁর গ্রন্থ যে একাধিক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে একথা জানাতে ভুললেন না।


তাঁর সেদিনের আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম।সত্যি বলতে কী তখনো ওনার খুব বড় পাঠক ছিলাম তা বলতে পারি না। চিত্রার সিইও শাম্মী তার অনেকগুলো বই, উপন্যাস দেন পড়ার জন্য।সেগুলোর মধ্যে দিয়েই শুরু হল আপার লেখার সঙ্গে পরিচয়। এবং বিস্মিত হলাম। আপা যাদের নিয়ে লিখেছেন তারা কেউ উচু ক্লাসের মানুষ নয়।মধ্যবিত্ত ও নিচু ক্লাসের মানুষ, যারা যেকেনো সামাজিক অস্থিরতার শিকার।
তার গল্পে উঠে আসছে আদিবাসী সমাজ, দেশভাগের যন্ত্রণা, সাধারণ মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদ।
আপার সঙ্গে দ্বিতীয় বার সাক্ষাৎ হল কলকাতা বইমেলা ২০১৮ তে। আত্মজা থেকে তাঁর হেঁটে যাই জনভোর বই প্রকাশিত । আর আর আমার সনাতনী রিকশার উৎসসন্ধানে। উনি স্টলে এলেন।হাত দু’টো এমন ভাবে ধরলেন যে কত আপন আমার। আবারো এক প্রস্ত গল্প। বেশ কিছু ছবি তোলা।
আর অনাবিল হাসি, যা বুঝতে দেন না, এতবড় কথা সাহিত্যিক তিনি। ঠিক যেন আমার মা কাকিমা এমনি তাঁর আন্তরিকতা।


তৃতীয় বার মুখোমুখি হলাম দিল্লী বইমেলায় ।আমি ভেবেছিলাম ভুলে গেছেন। প্রতিব়ছর কত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন উনি। দেশ বিদেশ জুড়ে তাঁর এত এত অনুরাগী। আমার মতো এত সাধারণ মানুষকে মনে রাখতে পারাটা বেশ কঠিন। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রতিপন্ন করে দিল্লিতে গেটের মুখে দেখা হওয়া মাত্রই কাছে টেনে নিলেন। হাত দুটো ধরলেন পরম নির্ভরতায়। বললেন, কতদিন পর দেখা হল। নতুন কী লিখলে? পত্রিকা, প্রকাশনা, কেমন চলছে ? এখানে কোথায় উঠেছ?
আমি বিস্মিত হয়ে যাই।এমন একজন পৃথিবীর সেরা কথা সাহিত্যিক আমার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছেন, খোঁজ করছেন কাজের। বিশ্বাস করুন, অভিভূত ও অবাক হয়েছি ।
দিল্লি থাকা ৩ দিনই তিনি এসেই কথা বলেছেন, হাত ধরে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে এসেছি অডিটোরিয়ামে।আর বারবার বলেছেন তোমার নামটা খুব সুন্দর।বিতস্তা ।মানে পদ্মার মত পবিত্র নদী।
সত্যি আমি মুগ্ধ এমন মানুষের সান্নিধ্য।

সেলিনা হোসেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে বহুমাত্রিক প্রতিভাধর কথাসাহিত্যিক। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের সাথে মিলেমিশে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে শক্তিশালী বলয় সৃষ্টি করেছে। বাঙালির ভাষা আন্দোলন, সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে অসামান্য দক্ষতায় তিনি সৃষ্টি করেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প এবং বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ। তাঁর গল্প উপন্যাস ইংরেজি, ফরাসী, রুশ, মেলে, কানাড়ী, হিন্দী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
জন্মস্থান রাজশাহী শহর, পৈতৃক নিবাস লক্ষীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রাম। এ. কে মোশাররফ হোসেন ও মরিয়ম-উন-নিসার নয় সন্তানের মধ্যে চর্তুথ সন্তান তিনি। শৈশবের আঙিনা করতোয়া নদীর পাশে, তারপর পদ্মা নদীর অববাহিকায়। রাজশাহীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে ছোটগল্পবিষয়ে প্রবন্ধ রচনার জন্য ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক লাভ করেন।
সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমিতে এবং ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন।
বাংলা একাডেমিতে জীবনের সিংহভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন, আর সেই সময় গভীর সংযোগ ঘটে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গ্রন্থের ।
বাংলা একাডেমির অভিধান প্রকল্প, বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প, বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী, লেখক অভিধান, চরিতাভিধান, এবং একশত এক সিরিজ, গ্রন্থসমূহ প্রকাশনার দায়িত্বপালন করেন। ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন।


তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ৪৩টি, ছোটগল্পগ্রন্থ ১৫, শিশুকিশোর সাহিত্য ৩৭টি, ইংরেজিতে অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৩টি।
তাঁর রচিত ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, প্রকাশিত হবার পর তাঁর ব্যাপ্তি, খ্যাতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।এরপর লেখেন, কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’, ‘লারা’, ‘ভূমি ও কুসুম’, আগস্টের একরাত’, ‘সাতই মার্চের বিকেল’ বিপন্ন শহরের দহন’, ইত্যাদি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ‘স্বদেশে পরবাসী, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন , একাত্তরের ঢাকা, নিজেরে করো জয় ইত্যাদি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং ‘নারীর ক্ষমতায়ন: রাজনীতি ও আন্দোলন’, ‘জেন্ডার বিশ্বকোষ’, ‘বাংলাদেশ নারী ও সমাজ’ ‘দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী গল্প’ ইত্যাদি সম্পাদিত গ্রন্থ বিশেষ মর্যাদা বহন করে।
সেলিনা হোসেন দরিদ্র, ছিন্নমূল, দুঃস্থ অসহায় নারী ও শিশুদের জন্য বেসরকারী সেবা সংস্থা ‘ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন’ গড়ে তুলেছেন। অসামান্য সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি দক্ষতার সাথে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১০ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচকডক্টর অব লিটারেচরে ভূষিত করে। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), সাহিত্যে একুশে পদক (২০০৯) সহ বহু পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করে।
এই কথা সাহিত্যিকের জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

 

 

 

 

.

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>