সেই অগ্নিমূর্তিধারী মা বাবার বন্ধুর সামনে গিয়ে কেমন একটু কাঁচুমাচু হয়ে গেল।
দিনটার কথা আজো আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাবার সাথে একচোট ঝগড়া শেষে মা যাচ্ছিল ছাদে। কাপড় শুকাতে দিয়েছিল। সেগুলো তুলে আনতে। আমি আর নয়ন মুখ কালো করে বিল্ডিং ব্লক্স মেলাচ্ছিলাম। আমি তখন পড়ি ক্লাস টেনে। নয়ন থ্রিতে। নয়নের বিল্ডিং ব্লক্স মেলানোটা মেনে নেয়া গেলেও আমারটা মেনে নেয়া যায় না।
ক্লাস টেনে পড়ুয়া একটি মেয়ে পড়ার বইয়ের নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়বে। কিংবা আরেকটু বেশি পাকনা হলে সেবা রোমান্টিক বা হুমায়ুন আহমেদের প্রেমের উপন্যাস পড়বে। মন খারাপ হলে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবে। বান্ধবীদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিফোনে খেজুরে আলাপ করবে। মা-বাবা কৈফিয়ত চাইলে সিরিয়াস মুখে বলবে, ‘পড়ার আলাপ করি তো! তবুও সন্দেহ করো!’ তারপর মা-বাবা সরে গেলেই ফিসফিস করে বান্ধবীকে বলবে, ‘এই এখন কথা বলতে পারবো না…কাল বলবো। সব কথা শুনলে একেবারে হাঁ হয়ে যাবি! কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছিল আমার দিকে! মনে করেছে আমি কিচ্ছু দেখিনি! খবরদার কাউকে এসব কথা বলবি না যেন! মনে থাকবে তো?…প্রমিস?’
আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-১)
অথচ আমার জীবনে এসব রোমান্টিসিজমের জায়গাই ছিল না। রোমান্টিসিজম শুরু হওয়ার আগেই আমি জেনে গিয়েছিলাম, জীবনের কঠোর ক্লাইমেক্সের খবর। স্বামী স্ত্রীর কুৎসিত ঝগড়া শুনতে শুনতে একেকসময় মনে হতো, এখান থেকে পালিয়েযাই। পালিয়ে গিয়ে সব নিজের মতো করে শুরু করি। সেখানে মা-বাবা থাকবে না। তাদের এসব ঝগড়াঝাঁটি শুনতে হবে না। শুধু থাকবো আমি আর আমার পরম আকাঙ্ক্ষিত কোনো ভালোবাসার মানুষ। যার সাথে দিনরাত আমি সুখের গল্প করবো। নুন মরিচ ফুরিয়ে গেলে ঝ্যাত করে বলে উঠবো না, ‘সংসারের কোনোদিকে খবর রাখো না…সব কেন আমাকেই দেখতে হবে?’
তবে মনে মনে ঠিকই আশা করবো, আমি কিছু বলার আগেই আমার পরমপ্রিয় সেই জন বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বলবে, ‘কী কী লাগবে মেসেজ করে দাও তো প্লিজ! যদি কিছু ভুলে যাই!’
কী যে বলতে শুরু করলাম আবোল তাবোল! বাবার সেই বন্ধুর আমাদের বাসায় আসার দিনটির কথা বলছিলাম। মাঝখানে এসব কীসের হাবিজাবি আলাপ জুড়ে দিলাম!
তো, আমি আর নয়ন বিল্ডিং ব্লক্স মিলাচ্ছিলাম। মা-বাবা ঝগড়াঝাঁটি করে একটু বিরতিতে গেছে। ততদিনে মা-বাবার মধ্যে তুমুল যুদ্ধংদেহী সম্পর্ক। সকালে মেঘ গজরায় আর রাতে ঝরে তুমুল বর্ষণ…এমন অবস্থা। আমি আর নয়ন খড়কুটোর মতো ভাসতে থাকি। ভেসে ভেসে ভিজতে থাকি। নয়ন কীই বা এমন বোঝে! তবু মাঝে মাঝে সেও কাঁদো কাঁদো মুখে বলতো, ‘আপু চল আমরা নানাবাড়িতে চলে যাই!’
মনে মনে আমিও পালানোর কথা ভাবতাম। তবু নয়নের মুখে পালানোর কথা শুনলে আমার বুকটা ধক করে উঠতো। তাহলে কি আমাদের কোনো নিজের বাড়ি থাকবে না? সবারই তো নিজের বাড়ি থাকে, পরিবার থাকে, ভাইবোন থাকে! একটা স্থায়ী ঠিকানা থাকে! আমাদেরও যাহোক কিছু একটা আছে। নয়ন কেন সেটাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছে? আমরা কি দোষ করেছি যে, অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে আমাদের? আহারে! আমার ছোট্ট ভাইটা না জানি কত কষ্টে এমন কথা বলছে!
আরো পড়ুন: আরো পড়ুন: ফাহমিদা বারীর উপন্যাস চোরকাটা (পর্ব-২)
সবকিছু ভুলে গিয়ে আমি তখন ওকে বোঝাতাম, ‘ছি! এমন কথা ভুলেও চিন্তা করবি না! মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যাবি? মন খারাপ লাগবে না? মা-বাবা কি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে?’
নয়ন আর কিছু বলতো না। হয়ত ওর কচিমন এই চিন্তায় লেগে যেত, মা-বাবা কি সত্যিই আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে? যদি থাকতে না পারে…তাহলে তারা আমাদের কথা চিন্তা করে হলেও কেন ঝগড়াঝাঁটিকে ছেড়ে থাকতে পারে না?
মা ছাদে চলে যেতেই বাবা আমাদের ঘরে ঢুকলো। গম্ভীর মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাদের মুখভঙ্গি লক্ষ করতে লাগলো। আমরা জিজ্ঞাসু মুখে তাকাতেই বাবা কৈফিয়তের সুরে বললো, ‘ইয়ে, তোরা কী করছিস দেখতে এলাম! এমনিই একটু ঘুরছি!’
আমরা কিছু বললাম না। বাবার এই কৈফিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই। তবু প্রতিবার ঝগড়া শেষে বাবা এই কাজটি করে। মা কিন্তু কিচ্ছু করে না। চুপচাপ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন একটা ভাব করে যেন কিছুই হয়নি। মেজাজ খারাপ হয়েছে, ঝগড়া করেছে। ছেলেমেয়ের কাছে এসে কৈফিয়ত দেওয়ার কী হলো?
বাবা আমাদের কাছ থেকে উত্তর না পেয়েও ফিরে গেল না। ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চাইলো, ‘ইয়ে…নিরা…তুই একটু এদিকে আসবি? এই ঘরে একটু আয় তো!’
আমি একটু নিরাসক্ত মুখেই বললাম, ‘এখানেই বলো না বাবা! আমি উঠে গেলে নয়ন ভয় পাবে।’
বাবা সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভয় পাবে কেন? আমি তোর সাথে একটু কথা বলবো। এতে ভয় পাওয়ার কী হলো?’
নয়ন তখন জুল জুল করে আমার আর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন বুঝতে চেষ্টা করছে আলোচনা কোনদিকে গড়াচ্ছে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাবার সাথে পাশের ঘরে গেলাম। যাওয়ার আগে নয়নের দিকে তাকিয়ে অল্প একটু হাসি দিলাম। সেই হাসির অর্থ আমি আর নয়নই শুধু বুঝতে পারি।
হঠাৎ কখনো মাঝরাতে পাশের ঘর থেকে গোঙানির মতো গরগরে হিংস্র কণ্ঠস্বর ভেসে এলে নয়ন আমাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে। ওর ঘুমভাঙ্গা কচি শরীরটা কাঁপতে থাকে তিরতির করে। আমি আমার ‘ততটা শক্ত না হয়ে ওঠা’ হাতদুটো দিয়ে প্রাণপনে নয়নকে জড়িয়ে ধরে থাকি। ডিমলাইটের বিভ্রম জাগানো আলোয় নয়ন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পরম নির্ভরতার আশ্বাসে। আমি আমার এই অল্প অল্প হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলি, ‘ভয়ের কিছু নাই…কিচ্ছু নাই…কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে… সব ঠিক হয়ে যাবে…ভয় পাসনে সোনা ভাই আমার…আমি আছি তো!’
গল্পকার,
রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশল নিয়ে পড়ে এখন নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে।