Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩)

Reading Time: 4 minutes

বাবা পাশের ঘরে এসে আমাকে বললো, ‘ইয়ে…নীরা…তোকে একটা কথা বলতাম।’

বাবার চোখজোড়া কেমন যেন অদ্ভুত রকম জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে তাকিয়ে আমার মনে কোনোরকম উদ্দীপনার জন্ম হলো না। বাবা কী বলবে আমি জানি। ‘তোরা কি আমাদের সব কথা শুনেছিস? বল তো দোষটা কার? দেখলি তো তোর মা কেমন গায়ে ধাক্কা মেরে ঝগড়া করে? তুই বল…না না…চুপ করে থাকিস না…তুই বল এমন একটা ইরেসপন্সিবল ওম্যানের সাথে আমি কেমন করে সংসার করবো? আমি যে দিনের পর দিন তাকে সহ্য করছি, আরে! আমার তো পুরষ্কার পাওয়া উচিত!’

এতদিন ধরে কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার এখন কেমন যেন ক্লান্তি জন্মে গেছে। নয়নকে যাকিছুই বলি না কেন, আমারও কি ইচ্ছে করে না এই বাসা থেকে পালিয়ে যেতে? মনের মধ্যে খুব সঙ্গোপনে এই স্বপ্নটাকে লালন করে চলেছি আমি। এখান থেকে পালিয়ে যাবো…দূরে কোথাও ঘর বাঁধবো…মা-বাবা কেউ আমার সঙ্গে থাকবে না…শুধু থাকবো আমি আর আমার পরমপ্রিয় কেউ। এই পর্যন্ত ভাবতে না ভাবতেই হুট করে দৃশ্যপটে নয়ন চলে আসে। আমি খুব বেশিকিছু আর ভাবতে পারি না। কিংবা ভালো লাগে না ভাবতে। ভাইটাকে অদৃশ্য করে দিয়ে নিজের সুখের রাজত্ব খুব বেশিক্ষণ সাজাতে পারি না আমি। তার পরিবর্তে দিনের পর দিন মা-বাবার একে অন্যকে এই দোষারোপ করা শুনে যেতে থাকি।

আমি চুপ করে আছি দেখে বাবাই আবার বললো, ‘কীরে, তুই এমন মুখ করে রেখেছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’

আমার অসহ্য লাগছে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘আমি ঠিক আছি। তুমি কী বলবে…বলো।’

বাবা সাথে সাথে সোৎসাহে বলে উঠলো, ‘ইয়ে নীরা…আজকে আমাদের বাসায় একজন গেস্ট আসবে। আমার কলিগ। একটু ভালো নাস্তা দিতে হবে। তোর মাকে তো এখন কিছুই বলা যাবে না! তুই একটু বানিয়ে দিতে পারবি না মা?’

আমি বেশ অবাক হলাম। মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা বাদ দিয়ে বাবার মুখে এ কী সুর! বাসায় গেস্ট আসছে? বাবার কলিগ?

এটা এক নতুন কথাই বটে! মায়ের অভিযোগ একেবারে মিথ্যে নয়। বাবার সত্যিই কোনো বন্ধুবান্ধব নেই।

হয়ত গল্পগুজব করতে ভালো লাগতো না বাবার। কিংবা বন্ধু তৈরি করাতেও তার কোনো অপারগতা থেকে থাকতে পারে। আর আত্মীয়পরিজনও তেমন একটা আসতো না আমাদের বাসায়। দাদাবাড়ির সাথে তো প্রথম থেকেই কোনো সংযোগ ছিল না!দাদী তো সেই কবেই মারা গিয়েছিল! দাদা কিংবা চাচারা কখনো ভুলেও আমাদের খোঁজখবর নিতে আসেনি। অজানা এক দূরত্বসূচক রেখা টেনে দেওয়া ছিল দাদাবাড়ির সাথে। আর বাবার সাধ্য ছিল না সেই রেখাকে অতিক্রম করার।

আগে নানাবাড়ি থেকে দু’একজন আসতো। মামারা আসতো। মামাতো ভাইবোনেরাও এসেছে দু’একবার। কিন্তু সেই আসাও বন্ধ হয়ে গেছে ম্যালাদিন যাবত। আমার মায়ের বাড়ি থেকে কেউ এলে বাবা সাধারণত বাসায় থাকতো না। অনেক রাত করে বাসায় ফিরতো। কারো সাথে খেতে বসতো না। যতটা পারা যায় কথা বলাও এড়িয়ে চলতো। এক পর্যায়ে মামারাও বুঝে গেছে যে, তাদের এই বাসায় আসাটা অনাকাঙ্ক্ষিত।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২)

এই খারাপ ব্যবহারের জন্য মা কিন্তু বাবাকে কথা শোনাতে ছাড়তো না কখনো। ‘অফিস থেকে ফিরেই তো ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকো! আমার ভাইরা এই বাসায় আসাতেই এখন এত বাইরে কাজ পড়ে গেল? একটু পাশে বসে কথা বললে কি মুখ খসে পড়তো?’

বাবাও ছাড়তো না একচুল। উল্টো তেজের সাথে উত্তর দিত, ‘হাভাতের দল সব, কাজ নাই কর্ম নাই! যখন তখন ঘুরঘুর করতে করতে চলে আসে! কীসের আশায় আসে বুঝি না কিছু? বোন ধনীর দুলালকে হাত করেছে…যদি কিছু মালপাত্তি পাওয়া যায়! এটাই তো গোপন ইচ্ছা!’

‘আহা! কী ধনীর দুলালরে আমার! বাবা লাত্থি মেরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। একটা কানাকড়িও কপালে জোটেনি…নিজেকে সে আবার ধনীর দুলাল বলে পরিচয় দেয়!’

এই পর্যায়ে বাবা একেবারে হুংকার ছেড়ে বলতো, ‘বের করে দিয়েছে কার জন্য জানো সেটা? তোমার জন্য! তোমার মতো হাড় হাভাতের মেয়েকে পছন্দ করেছি বলে বের করে দিয়েছে আমার বাবা! বেশ করেছে! আমি তো চোখে ঠুলি পরেছিলাম। আমার বাবা তো আর চোখের মাথা খায়নি! তাই ঠিকই জানতো, একদিন এমনটাই হবে! দলে দলে হাভাতের গুষ্টি এসে আমার বাসায় লাইন দিবে…যদি কিছু জোটে সেই আশায়!’


আরো পড়ুন: আরো পড়ুন: ফাহমিদা বারীর উপন্যাস চোরকাটা (পর্ব-৩)

এসব তিক্ত ঝগড়ার গল্প আমরা কখনো বাইরে প্রচার করেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু এক কান দু’কান হতে হতে কীভাবে কীভাবে যেন সবাই জেনে গেল, এসব নোংরা বাদানুবাদের কথা। আশেপাশের পাড়াপ্রতিবেশিরা দরজা জানালার ফাঁকফোকড় দিয়ে উঁকিঝুকি মেরে যা বোঝার সব বুঝে গেল। কেউওই পারতপক্ষে আমাদের ছায়া মাড়াতো না। আমার বান্ধবীরা তো বহু আগে থেকেই আমাদের বাসায় আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আমিই চেষ্টা তদবির করে মাঝে মাঝে দু’একজনকে ধরে টরে আনতাম। কিন্তু প্রত্যেকেই আমাদের বাসায় এসে কেমন যেন হাঁসফাঁস করতো। অক্সিজেনের অভাবে যেন ঠিকমত শ্বাস নিতে পারতো না কেউ। ধীরে ধীরে আমিও জোর করা ছেড়ে দিলাম। জোর করে কি আর কারো বন্ধু হওয়া যায়?

মামাবাড়ির লোকজনও একসময় একেবারেই আসা বন্ধ করে দিলো। আমরা আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধবহীন হয়ে গেলাম। কাজেই আমাদের বাসায় অতিথি আসার খবরটা নতুনই বটে!

আমাকে হাঁ হয়ে যেতে দেখে বাবা ঠেলা দিয়ে বললো, ‘কীরে! আমার কলিগ আসার খবর শুনে এত আকাশ থেকে পড়লি কেন? আমার কাছে কেউ আসতে পারে না নাকি?’

আমি উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। টুকটাক রান্নাবান্না পারি আমি। কাজ চলে যাওয়ার মতো আর কী! বাসার এই নিত্য অশান্তিতে প্রায়ই মা রাগ করে রান্না বন্ধ করে দেয়। সারাদিন রান্নাঘরে ঢোকে না। সেটাই স্বাভাবিক। ঝগড়া করার পরে সবার জন্য রান্না করতে যাবে কোন দুঃখে?

কিন্তু পেট তো সেটা বোঝে না। অগত্যা সেই দিনগুলোতে আমাকেই রান্নাঘরে ঢুকতে হয়। এটা সেটা করতে করতে এখন রান্নাটা ভালোই শিখে গেছি।

ডিব্বা ডাব্বা হাতড়ে কিছু পাস্তা পেলাম। ফ্রিজে পেলাম পোতায়ে যাওয়া ব্রকোলী, টমেটো আর অল্প কিছু চিজ। সেসব দিয়েই পাস্তা রান্না করে ফেললাম। আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে নয়ন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। ওর হয়ত ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু মুখে কিছু বলছে না দেখে আমিই বললাম, ‘একটা বাটি নিয়ে আয়। তোকে একটু পাস্তা দিই!’

নয়ন জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের বাসায় কে আসবে রে আপা?’

বললাম, ‘বাবার কলিগ।’

এসব কথার মাঝখানেই ছাদ থেকে মা চলে এলো। আমাকে আর নয়নকে রান্নাঘরে দেখে ঘুরেফিরে সবকিছু দেখলো। কিন্তু ভালোমন্দ কিছুই জিজ্ঞেস করলো না।

এমন সময় দরজার কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলতে যাওয়ার আগেই বাবা নিজেই গিয়ে দরজা খুললো। ঝকঝকে চেহারার একজন মানুষ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। হাসি হাসি মুখে বাবাকে বললো, ‘কীরে মাহফুজ! চিনতে পেরেছিস? বলতো আমি কে?’

মা উৎসুক মুখে দরজার দিকে তাকালো। ঝকঝকে চেহারার মানুষটাকে মা যেন একটু বেশিই সময় নিয়ে দেখলো।

আমি তাকালাম বাবার মুখের দিকে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, বাবা কেমন একটু মিইয়ে গেছে। আগন্তুককে দেখে বাবা যেন ঠিক খুশি হতে পারলো না!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>